হাওরের বিস্তীর্ণ বুকে পানি আর পানি। বুকভরা জলরাশিতে ডুবো ডুবো দুই শিশু সহোদর জিহাদ ও জিয়া।
অন্তত খেয়ে পড়ে বেঁচে থাকার সংগ্রামে টিকে থাকতে দরিদ্র কৃষক বাবার সঙ্গে ঢলের পানিতে নামতে হয়েছে ওদেরও।
পানিতে ডুবন্ত আধা পাকা ধান যে করেই হোক টেনে তুলতেই হবে। অথচ স্বপ্নভঙ্গের অধ্যায়ে শেষ সম্বলটুকু ঘরে তুলতে অপরিহার্য নৌকা ভাড়া করার সক্ষমতাও নেই।
হা হুতাশের এ সময়ে থই থই পানিতে কলাগাছের ভেলাই তাই দুই ভাইয়ের শেষ ভরসা।
নিজেদের তৈরি এ বাহনেই ভেজা ধানের আঁটি তুলে শহররক্ষা বাঁধের সড়কের টানের দিকে শরীর ভাসিয়ে দিয়েছে ওরা।
পানিতে স্বামীর বোনা স্বপ্ন তলিয়ে যাওয়ার পর নিজ সন্তানদের সংগ্রামে নামার দৃশ্য অসহায় দৃষ্টিতে টানে দাঁড়িয়ে দেখছিলেন মা মেহের বেগমও। সন্তানদের মতোই এ ধান যে তারও জীবন-মরণ।
মিঠামইন উপজেলা সদরের শহররক্ষা বাঁধের পাদসীমায় পাকা সড়ক। সড়কের কোণাঘেঁষে সারি সারি পাকা-আধা পাকা ধানের গাদা। সপ্তাহ দুয়েক আগেও যার সামনে ছিলো সোনা রাঙা ধানের মাঠ।
চৈত্রের অকাল বন্যার পানির নিচে তলিয়ে গেছে কৃষকের মুঠো মুঠো স্বপ্ন। ফসল হারানোর হাহাকার ও দীর্ঘশ্বাসে মোড়া তাই এ বেড়িবাঁধ লাগোয়া গ্রামগুলো। বছরের একমাত্র ফসল বিলীন হওয়ায় অসহায় মানুষজনের মাথায় ভেঙে পড়েছে নীলাকাশ।
বুক সমান পানিতে তলিয়ে যাওয়ার আশঙ্কায় থাকা ধানের থোড়া কেটে আনতে পদে পদে অবর্ণনীয় দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে তাদের।
ফসল কাটতে ভোরবেলাতেই ভিজে টইটুম্বর ভাগ্যবিড়ম্বিত কৃষকদের জীবন সংগ্রামের চিত্রকল্পেরই যেন সাক্ষ্য দিচ্ছে বেড়িবাঁধও।
তাদের মতোই হাওরের ভয়ঙ্কর থাবায় জিহাদ ও জিয়ার ভাগ্যাকাশে অনিশ্চয়তার কালো মেঘ। প্রায় দুই একর ফসল হারিয়েছেন ওদের বাবা রুহুল আমিন।
কথা বলা তো দূরের কথা, দম ফেলারও জো নেই রুহুল আমিনেরও। সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত জমির ফসল কাটতেই সময় যাচ্ছে তার।
ফসল ফলাতে গিয়ে সব টাকাই গেছে জলে। টিকে থাকা সামান্য ফসলটুকু ঘরে তুলতে তাই দুই সন্তানকে নিয়ে নিজেও কোমর বেঁধে নেমে পড়েছেন।
দুর্যোগকালীন পরিস্থিতির কারণে স্থানীয় শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে চলছে বিশেষ ছুটি। পরিবারের দুর্দিনে তাই বসে থাকা হয়নি জিহাদ ও জিয়ারও। গৃহস্থ বাবাকে সহায়তা করতে বুক পানি মাড়িয়ে পাকা ধান তুলে আনতে প্রাণান্তকর প্রচেষ্টাই চালিয়ে যেতে হচ্ছে মাদ্রাসাপড়ুয়া এ দু’কচি মুখকে।
কলাগাছের ভেলায় ওদের ধান পরিবহনের দৃশ্য ‘ঠাঁই নাই, ঠাঁই নাই, ছোটো সে তরী, আমারি সোনার ধানে গিয়েছে ভরি’ কবিতাকেই প্রকারান্তরে মনে করিয়ে দিচ্ছে।
ওদের কলাগাছের ভেলাই যেন কবিগুরুর সেই ‘সোনার তরী’।
এমন তরী টানে ভিড়িয়ে ধানের গাদা তৈরির ফাঁকে জিহাদ বলে, ‘আগাম বন্যায় আমাদের দুই কানি (একর) ফসল তলিয়ে গেছে। টিকেছে মাত্র ১৫ শতাংশ।
এ ফসল ঘরে আনতে নৌকা ভাড়া করতে গেলে প্রতিদিন ৭শ’ থেকে ৮শ’ টাকা লাগবে। নৌকায় এতো টাকা খরচ করলে সংসার চলবে না’।
কলাগাছের ভেলাই তাই দারিদ্র্যপীড়িত মানুষজনের সম্বল।
জিহাদ ও জিয়ার মা মেহের বেগমও ভার মুখে জানালেন, ‘সামনে অন্ধকার ভবিষ্যত। দু’মুঠো খেয়ে-পরে বেঁচে থাকার তাগিদেই ওদের পানিতে থাকতে হচ্ছে’।
বিভিন্ন হাওর নিধনকারী বাঁধগুলোর দুর্নীতি পরায়ন ঠিকাদার, পিআইসি ও পাউবোর অবহেলা এবং অর্থলোভের কারণে বৈশাখে বর্ষা হল শাল্লায়।
পানিতে ২২ হাজার হেক্টর বোরো ফসল তলিয়েছে যেখানে উৎপাদন হত ৭৮ হাজার মে. টন ধান, যার বাজার মুল্য ২৮৮ কোটি ৯২ লাখ টাকা বলে উপজেলা মাসিক সভায় জানিয়েছে উপজলা কৃষি অফিস।
আজ হাওর পাড়ের কৃষক পরিবার যাদের জন্য অনাথ, অসহায়,ও কৃষকের ভাগ্যে যোগ করেছে দুর্দশা তাদের বিচার চায় হাওর পাড়ের মানুষ। আর এ দুর্দশার জন্য পিআইসি, ঠিকাদার,পাউবোই দায়ী । যে সব বাঁধ ভেঙ্গে হাওর তলিয়ে এ দুর্দশা তৈরি হয়েছে তাদের মধ্যে প্রথমেই রয়েছে বরাম হাওর । পিআইসি সভাপতি লাল মিয়ার ১২ লাখ টাকার প্রকল্পের কাদিরপুরের বাঁধ ভেঙ্গে বিনষ্ট হল বরাম হাওর। তার পর দিন জোয়ারিয়া প্রকল্পের ৩ ঠিকাদারের প্রকল্প (বরাদ্দের পরিমাণ জানা যায়নি) দিয়ে পানি প্রবেশ করে তলিয়েছে জোয়ারিয়াসহ শাল্লার হাওর। তার একদিন পর সুখলাইন মৌজার গৌরারি নামে একটি ছোট হাওরের পিআইসি বাহাড়া ইউপির চেয়ারম্যান বিধান চৌধুরীর প্রায় ১০ লাখ টাকার প্রকল্পের বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়েছে হাওরটি।
তার পর দিন বাউশি নোয়াগাঁওয়ের পাশে (মেস্তুরবাড়ির খাল) পিআইসি সভাপতি আজিজুল হকের আড়াই লাখ টাকার প্রকল্প যেখানে ১ হাজার
মাটিও ফেলেনি সেই বাঁধ দিয়ে পানি প্রবেশ করে মাছুয়ারকাড়া পিআইসি দুলাল মিয়ার ১৪ লাখ টাকার প্রকল্পের বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়েছে ঘিলুটিয়া হাওর। তার পরের দিন বান্ডা প্রকল্পের হবিবপুর ও হরিনগরের উত্তর পাশের ঠিকাদারের প্রকল্পে কাজ না করায় সেদিকে এবং পাশে পিআইসি সভাপতি আভা রানী তালুকদারের প্রকল্পের বাঁধ ভেঙ্গে ঘাগানী হাওরটি তলিয়েছে । তার ২ দিন পর জয়পুর, লৌলারচর গ্রামের মধ্যবর্ত্তী স্থানে মরা নদীর মুখে (কাজাউরা খালের) বাঁধের পিআইসি প্রদীপ ভৌমিকের ১৪ লাখ টাকার বাঁধ ভাঙ্গার কিছুক্ষণের মধ্যেই নিয়ামতপুর গ্রামের পাশে বাঘড়াধড়ার পিআইসি সীতিল চন্দ্র দাসের সাড়ে ১৫ লাখ টাকার বাঁধ ভেঙ্গে বিশাল ছায়ার হাওর তলিয়েছে। তার ২ দিন পর কালিয়াগুডা হাওরের পিআইসি আবুল মিয়ার ১৩ লাখ টাকার বাঁধ ও পিআইসি বসির মিয়ার ১৩ লাখ টাকার প্রকল্পের বাঁধ ভেঙ্গে কালিয়াগুডা হাওরে পানি প্রবেশ করেছে । এই দিন রাতে কাঠগাং বাঁধের পিআইসি আম্বিয়া বেগমের ১০ লাখ টাকার বাঁধ ভেঙ্গে তলিয়েছে কালিয়াগুডা পশ্চিম হাওর ।
এ নিয়ে গিলোটিয়া হাওর পাড়ের কাশিপুর গ্রামের তৈয়ব আলী,ফখরুল মিয়া জানান, এবছর শাল্লার সবকটি বাঁধের কাজ নামমাত্র হয়েছে। কিন্তু পাউবো যোগসাজসে বিল উঠিয়েছে ৩ কিস্তি। কিন্তু গ্রামের পাশে প্রায় ১৩ লাখ টাকার কাশিপুরের বাঁধে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে।
তারা বলেন এলাকার অনেকেই জানেইনি পিআইসি’র টিপু সুলতান দিঘা প্রকল্প নামে এবছর আরও একটি ৭ লাখ টাকার নতুন প্রকল্প তৈরি করে সেখানে ১ হাজার মাটিও কাটেনি । তারা এসব দুর্নীতির বিচার দাবি করেন ।
সাবেক ইউপি চেয়ারম্যান আবুল লেইছ চৌধুরী বলেন, জনগণের মঙ্গল চিন্তা না করে এবার ঠিকাদাররা কাজেই করেনি। আর পিআইসিরা সামান্য কাজ করেছে। এলাকার মানুষ বাঁধে কাজ না করলে হাওর বহু আগেই তলিয়ে যেত। তিনি বলেন এইসব দুর্নীতিবাজরা কাজের চেয়ে অর্থ লোপাটের চেষ্টায় ছিল বলেই আজ আমাদের এ অবস্থা । প্রত্যেক প্রকল্পে বাঁধের অনুপাতে ৩ গুণ বেশী অর্থ বরাদ্দ হওয়ার পরও কেন হাওর ডুববে, প্রশ্ন তার। এ জন্য তিনি ঠিকাদার, পিআইসি, পাউবোর দুর্নীতিবাজদের আইনের আওতায় নিয়ে বিচার করার দাবি জানান ।
উপজেলা আওয়ামীলীগ সাধারণ সম্পাদক আল আমিন চৌধুরী বলেন, মুখে অনেকেই জনগণের সেবক বলে দাবি করেন, এবার হাওর রক্ষা বাঁধের সাথে সংশ্লিষ্ট অনেকের কার্যক্রম দেখে মনে হয়েছে তারা কেমন সেবক। যারা জনতার সাতে বেইমানি করেছে তাদের শাস্তি হওয়া প্রয়োজন।