বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ চারদিক সুনসান। একটানা ডেকে চলা ঝিঝির ডাক আর থেকে থেকে নাম না জানা পাখির কুজন, এছাড়া আর কোনো শব্দের অস্তিত্ব নেই। জনমানুষ তো দূরের কথা, কোনো পশুপাখির ছায়া পর্যন্ত দেখা যাচ্ছে না।
আকাশছোঁয়া গাছগুলো তাদের পত্র-পল্লবে আকাশকে এমনভাবে ঢেকে রেখেছে যেন আমাদের নজর লেগে আকাশের সর্দি লেগে যাবে। সুর্যদেবও পাতার বেষ্টনী পাড়ি দিয়ে আসতে বোধহয় সাহস করছেন না। আধো আলো আর আধো অন্ধকারের এই সুনসান পরিবেশে আমরা এগিয়ে চলেছি ১২ জন পাবলাখালি বনের মধ্য দিয়ে। মনে অজানা ভয় কখন কি হয়। মাঝে মাঝে তো নিজের নিশ্বাসটাকেই বড় ভয় হচ্ছে। চারদিকে কেমন একটা গা ছমছমে অনূভুতি। কখন জানি হাতির পালের সামনে পড়তে হয়।
পাবলাখালি আসার মূল উদ্দেশ্য হাতি দেখা। হাতি মানে পালা হাতি নয়, রীতিমতো তাণ্ডব চালানো একপাল বুনোহাতি। সামনে পড়লে আর রক্ষা নেই। কী পরিমাণ তাণ্ডব চালাতে পারে তার কিছুটা নমুনা কিছুক্ষণ আগে পরিলক্ষিত করে এসেছি নদীর ঘাটের কাছের এক বাংলোর বিধ্বস্ত অবস্থা দেখে।
আমরা আপাতত এসেছি মাইনি মুখ থেকে। দুই দিন আগে ঢাকা থেকে রওনা দিয়ে রাঙামাটি হয়ে ট্রলারে ছুটেছিলাম কর্ণফুলীর উৎসমুখের সন্ধানে। কাপ্তাই লেক পাড়ি দিয়ে হরিণা আর কাট্টলি বিল হয়ে লংগদু দিয়ে সড়ক পথে গতকাল সন্ধ্যায়ই পৌঁছেছি মাইনিতে, যেখানে অপরূপ রূপসী মাইনি নদী মিলিত হয়েছে কাপ্তাই লেকে। মাইনি ঘাট, কাপ্তাই লেকের মাছ ব্যবসায়ীদের হাব বলা চলে। এখান থেকে সারা দেশে কাপ্তাই লেকের মাছ পৌঁছে দেয়া হয়। বিচ্ছিন্নতাবাদীদের ভয় আর বন্যপ্রাণীর হামলার ভয় মাথায় নিয়েও রাতের ঘুমটা বেশ ভালোই দিয়েছি।
ভোরে ঘুম থেকে উঠে বাকীবিল্লাহ ভাই আর ওসমান ভাইকে নিয়ে বেরিয়ে পড়লাম মাইনি ঘুরে দেখতে। মেঠোপথ ধরে কখনও হালকা চড়াই আবার কখনো ছোট ছোট উতরাই, তিন দিকে কাপ্তাই লেক আর মাইনি নদী, সব মিলিয়ে যেন কোনো স্বর্গোদ্যানে এসে পৌঁছেছি। মাঝে মাঝেই চোখ কচলে দেখে নিচ্ছি স্বপ্ন দেখছি না তো। না স্বপ্ন না, আমার সোনার দেশের এই অপরূপ রূপে আবার মুগ্ধ না হয়ে পারলাম না। ভোরের হালকা শীতে হাঁটতে বেশ ভালোই লাগছিল আর সাথে থেমে থেমে ক্যামেরার ক্লিক তো চলছিলই। পাশের বিজিবি ক্যাম্পের জাওয়ানরা এই ভোরবেলাতেই মর্নিং ড্রিলে বেড়িয়েছে। সাদা স্যান্ডো গেঞ্জি আর সাদা হাফ প্যান্টে সারি বেধে তাদের ড্রিল মুগ্ধতা ছড়ালো আরেকবার। মাইনি বিজিবি ক্যাম্পটা একেবারে লেকের গা ঘেঁষে তৈরি।
ছোট্ট একটা টিলার উপর অপরূপ নৈসর্গিক পরিবেশ চারদিকে। হাঁটতে হাঁটতে চলে এলাম রাবেতা এ ইসলামীর হাসপাতালে। আমাদের দলের কয়েকজনের রাতের থাকার ব্যবস্থা হয়েছিল এখানে। মাইনিতে আসলে থাকার সেইরকম ভালো কোনো হোটেল নেই। দুই-তিনটা ছোট বোডিংয়ের মতো রয়েছে আর বন বিভাগের বাংলো বন বিশ্রাম। রাবেতা হাসপাতালের পিছন দিকেই রেস্ট হাউস। লাল টালির দুইতলা রেস্ট হাউসটাও অসম্ভব সুন্দর লোকেশনে অবস্থিত। তিন দিকেই কাপ্তাই লেক আর মাইনি নদী আর বিভিন্ন ধরনের গাছপালা চারদিকটাকে আরো মোহনীয় করে তুলেছে। রেস্ট হাউসের ব্যাক ইয়ার্ডে একটা শিউলি তলা ফুলে ফুলে বিছিয়ে আছে। কাঠগোলাপ তলায় বিছিয়ে থাকা সাদা কাঠ গোলাপ মনে পড়িয়ে দিল সেই বিখ্যাত গান “কাঠ গোলাপের সাদার মায়ায়”।
আমাদের হাঁকডাকে রোমেল আর আরাফসহ বাকিরা দ্রুতই শয্যা ছাড়ল। সবাই মিলে রেস্ট হাউসের ছাদে কিছুক্ষণ আড্ডা দিয়ে এখানকার ম্যানাজারের সাথে এখানকার ব্যাবস্থাপনা নিয়ে হালকা আলাপ সেরে পাশের ছোট টং দোকানে চা নিয়ে বসলাম। নিজেদের বাল্যকাল ফিরিয়ে আনতেই কিনা আরাফ ব্যাস্ত হয়ে পড়লো বনরুটি কেটে তার মধ্যে কনডেন্সড মিল্ক ঢেলে বাটারবন বানাতে। খেতে অবশ্য খুব খারাপ লাগলো না। খাওয়া দাওয়ার পাট চুকিয়ে ইঞ্জিন নৌকায় মাইনী নদী পাড়ি দিয়ে আবার ফিরে আসলাম আমাদের আপাত বাসস্থান মাইনি মুখ রিজার্ভ ফরেস্টের বন বাংলোয়। এতক্ষণে সকালের ব্রেকফাস্ট তৈরি হয়ে গিয়েছে। খিচুড়ি ডিম ভাজা আর আলুর ভর্তা দিয়ে ভরপেট খেয়ে আর এক কাপ চা নিয়ে লেকের পাড়ের বারান্দায় বসে সকালের রোদ উপভোগ, এর চেয়ে অপার্থিব আর কি হতে পারে।
জীবনে সুখী হতে খুব বেশি কিছু কি লাগে। তন্ময় হয়ে উপভোগ করলাম কাপ্তাই লেকের সৌন্দর্য, কোথায় পড়ে রইলো ট্র্যাফিক জ্যামে ক্লিষ্ট নগর জীবন। এভাবে কতক্ষণ কেটেছে জানিই না। রেস্ট হাউসের ম্যানেজারের ডাকে আবার বাস্তবে ফিরে এলাম, পাবলাখালি যাওয়ার ট্রলার রেডি। দেরি না করে পথে খাওয়ার জন্য কিছু রসদ নিয়ে রওনা হয়ে গেলাম। নিরপত্তার অজুহাতে তিনজন মাইনীতেই থেকে গেল। অবশ্য তাদের দোষও দিতেও পারি না। কাল রাতে রেস্ট হাউসের গানম্যান বিচ্ছিনতাবাদীদের নৃশিংষতার কথা জানালেন আর সাথে এও জানাতে ভুললেন না পাবলাখালি রিজার্ভ ফরেস্টে তাদের দলবদ্ধ অবস্থানের কথা। প্রাণের মায়া সবারই থাকে। সবাই তো আর আমার মতো উম্মত্ত ষাড়ের চোখে লাল কাপড় বাঁধতে ঘর ছাড়ে নাই। তার উপর রাতে এনএসআই থেকে ফোন আসায় অনেকেই আরো ঘাবড়ে গিয়ে থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিল। আসলে এনএসআই থেকে আমার এক পূর্ব পরিচিত লোক ফোন করে খোঁজ নিয়েছিলেন আর কিছু সাবধানতা অবলম্বন করতে বলেছিলেন, তাতেই অনেকের সাহস উবে গিয়েছিল।
যাই হোক, আমাদের যাত্রা শুরু হলো কাপ্তাই লেকের বুক চিড়ে। বর্ষা শেষের কারণে এখনো পানি নেমে যায়নি। তার ওপর গত তিন দিনের টানা বর্ষণে লেকের পানি কিছুটা বেড়েছে। চারদিকে যেদিকে তাকাই শুধু পানি আর পানি, কোথাও পানির উপর কিছু গাছ মাথা তুলে আছে, কোথাওবা ঘড়ের টিনের চাল দেখা যাচ্ছে। আশেপাশে লোকালয়ের কোনো চিহ্ন নেই। বেশ কিছুদূর যাওয়ার পর লোকালয়ের দেখা মিললো। কয়েক ঘর পরিবার নিয়ে ছোট্ট গ্রাম। শহরের কোলাহল থেকে বিচ্ছিন্ন এই দ্বীপের মত গ্রামের এক মাত্র যোগাযোগ ব্যাবস্থা নৌকা। লেকের পানিতে মাছ ধরে আর বনের কাঠ কেটেই তাদের জীবন চলে যায়। এই গ্রামের অধিকাংশ লোকই কখনও শহরের আলো দেখেনি। এখানেই জন্ম এখানেই শেষ নিশ্বাস ত্যাগ। আরো কিছুদূর এগিয়ে দেখা মিললো ঝাকে ঝাকে বকের। অনেকদিনপর এত বড় বকের ঝাক দেখলাম, কিছুদূর গিয়ে দেখা মিলল বালি হাস, পানকৌড়ি, চখা, মাছরাঙা, ঘুঘু, শালিক সহ আরো নাম না জানা পাখির।
পাখি দেখতে দেখতেই পৌঁছে গেলাম পাবলাখালি বাজারে। মনে পড়ে গেল বন বাংলোর ম্যানেজারের সতর্কবানী, বনের বেশি গভীরে যাওয়া যাবে না। পাবলাখালির কথা পরেছিলাম আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগে পত্রিকায় এক আর্টিকেলে। পাবলাখালি রিজার্ভ ফরেস্টের রহস্যময়তার কথা, পদে পদে বিপদের হাতছানি, শ্বাপদের হিংস্র দাতের করাল গ্রাস আর মানুষরূপী কিছু শ্বাপদের মুখ ব্যাদান আর সেই সাথে পাগলা হাতির কথা, মনের গভীর কোনে একটা আচড় কেটে রেখেছিল। এতগুলো বছর গেল কিন্তু সেই আচড়ের দাগ আজো মিটেনি। আজ বুঝি দাগ মেটানোর দিন। এর আগে অনেকবারই পাবলাখালি, মাইনি, লংদু, কাসালং আসার প্ল্যান করেছি কিন্তু কিছুতেই ব্যাটে বলে মিলছিল না।
ঘাটে নামতেই নৌকার মাঝির আরেকদফা সর্তকতা, কিছুতেই বনের গভীরে যাওয়া যাবে না। আমাদের সময় বেধে দিলেন তিন ঘন্টা, এর মধ্যেই ফিরে আসতে হবে। সময়ের বাধনে কি মনকে বেধে রাখা যায়। পরের চিন্তা পরে করা যাবে। দলবেধে হাটা শুরু করলাম মেঠো পথ দিয়ে। লেকের পার ধরেই আস্তে আস্তে চড়াই ভেঙ্গে চলে আসলাম পাবলাখালি রিজার্ভ ফরেস্টের বন বাংলোয়। ছোট্ট একটা টিলার উপর লেকের পাড়ে অসম্ভব সুন্দর এই বন বাংলো। একটা ছোট পেভমেন্টের উপর এই বাংলো। কিন্তু চার দিক সুনসান আশপাশে কোনো লোকজনের ছায়াও দেখা যাচ্ছে না। কী আর করা বাংলোর সামনের ঘাসের লনে বসেই কিছুক্ষণ জিরিয়ে নিলাম। সেই সাথে গ্রুপ ফটো তোলার পালাও চুকালাম। বেশ কিছুক্ষণ পর দেখি সাত-আট বছরের এক বালক আরেক কিশোরের হাত ধরে মাটির রাস্তা দিয়ে এগিয়ে আসছে। কাছে ডাকলাম। জিজ্ঞেস করে জানা গেল, এ রাস্তা ধরে কিছুদুর এগিয়ে গেলেই একটা ছোট বাঙ্গালী পাড়া আছে, তারা সেই গ্রামের বাসিন্দা। আর গ্রামের পাশ দিয়েই বনে ঢোকার রাস্তা চলে গেছে। আমরা আর দেরি না করে দুই বালককে গাইড সাবস্ত্য করে অজানার পথে পা বাড়ালাম।
মাটির রাস্তা ধরে কিছুটা চড়াই পার হতেই দেখা মিলল বনের পথের। লোকালয় ছেড়ে পা বাড়ালাম বনের রাস্তা ধরে। চারদিকে নাম না জানা গাছের সারি। দলের এক বিজ্ঞ লোক মোবাইলের অ্যাপ বের করে ব্যস্ত হয়ে পড়লেন গাছের নাম আর চৌদ্দগোষ্ঠী উদ্ধারে। হায়রে প্রযুক্তি, ইট কাঠ পাথরের ক্লেদাক্ত পৃথিবী ছেড়ে লোকালয়ের মায়া মাড়িয়ে প্রযুক্তিকে ঝেড়ে ফেলে দুদণ্ড শান্তিতে থাকতে এসেছিলাম এখানে, কিন্তু প্রযুক্তি এখানেও পিছু ছাড়ছে না। যাই হোক প্রযুক্তিবিদের প্রযুক্তি গাছের ডালে বাড়ি খেয়ে মুখ থুবড়ে পড়লো, কারন নেটওয়ার্ক ছাড়া এইখানে প্রযুক্তি অচল।
এবার শান্তিতে বনের পথ পাড়ি দিতে থাকলাম। চারদিক কেমন একটা গা ছমছমে অনুভূতি। কেমন একটা ঠাণ্ডা ঠাণ্ডা অনুভূতি আর চারদিকে মাতাল করা কেমন একটা বুনো গন্ধ। সামনে এগিয়েই পাশে পেলাম কাপ্তাই লেকের একটা ক্ষুদ্র নালার মতো অংশ; যেটা অনেকক্ষণ আমাদের সঙ্গ দিল। আকাশছোঁয়া গাছগুলোর অধিকাংশেরই নাম জানি না, তবে একেকটা একেকরকম। সৌন্দর্যে কে কাকে ছাপিয়ে যাবে সেই প্রতিযোগিতা যেন চলছে। আর আমার অবস্থা যেন সৌন্দর্যগ্রস্ত বানপ্রস্থ সেই পথিকের ন্যায় যে সব হারিয়ে পথকেই বানিয়েছে তার ঠিকানা। চিরস্থায়ী বন্দোবস্তের মতো সম্ভব না হলেও আপাতত পথকেই ঠিকানা বানিয়ে বনের পথ ধরে এগিয়ে চললাম। মনের মধ্যে অজানা ভয় কখন কী হয়। দলের কয়েকজন তো মতামত দিয়েই ফেললো আর বোধহয় সামনে আগোনো ঠিক হবে না। আশপাশে কোন জনমানুষের দেখা নাই। বিপদে পড়লে চিৎকার করলেও কেউ শুনবে না। দুর্বৃত্তের ভয় তো আছে, সেই সাথে কখন হাতির পালের সামনে পড়ি তার ঠিকানা নেই। পাবলাখালি নেমেই হাতির উন্মত্ততার যে নমুনা দেখে এসেছি তার রেশ মনে রয়ে গেছে এখনো। তাই আমার মনেও কু-ডাক ডেকে উঠলো। যতই প্রকৃতি প্রেমিক হই,নিজের জানের ভয় সবারই আছে। এর মধ্যে আমাদের দুই পথপ্রদর্শক ঘোষণা দিয়ে বসল এর আগে তারা আর কিছুতেই যাবে না। সামনে নাকি বিপদ হতে পারে। কী আর করা বাস্তবতার কাছে প্রেমকে জলাঞ্জলি দিয়ে ফিরতি পথ ধরলাম।
মো. আশরাফ উদ্দিন আহমেদ (শাকিল)
চিকিৎসক, বারডেম জেনারেল হাসপাতাল