ঢাকা , শুক্রবার, ১১ এপ্রিল ২০২৫, ২৮ চৈত্র ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
সংবাদ শিরোনাম :

চাকরিচ্যুত বিডিআির সদস্যদের পুনর্বহালের দাবিতে কর্মসূচি পিলখানা হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ত জওয়ানরা এখনও বেপরোয়া

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। এ ঘটনায় তখন বিডিআর সদর দফতরে কর্মরত প্রায় প্রতিটি জওয়ান বিদ্রোহের সাথে সম্পৃক্ত থেকে হত্যাকাণ্ড, নাশকতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অভিযুক্তদের অনেকেই আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের নামে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত বিডিআর সদর দফতরে কর্মরত (বিদ্রোহের সময়) জওয়ানদের জিজ্ঞাসাবাদের কোনো উদ্যোগ নেই। হত্যাকাণ্ড, নাশকতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের সাথে জড়িত অনেক জওয়ান এখন বেপরোয়া। এসব অভিযুক্তরা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

অন্যদিকে পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের ক্ষতিপূরণসহ চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে জিগাতলায় বিজির ৪ নম্বর গেটের সামনে কর্মসূচি পালন করেন চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। আন্দোলনকারীরা বর্তমান বিজিবি মহাপরিচালকের সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি না পেয়ে তারা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রোববারের কর্মসূচি শেষ করেন। রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের পক্ষ থেকে পাঁচ প্রতিনিধি পিলখানার ৪ নম্বর গেটে যান স্মারকলিপি নিয়ে। তারা বিজিবি মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চান। কিন্তু সেটি তাদের দেওয়া হয়নি। স্মারকলিপি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে প্রতিনিধি দলকে ফেরত পাঠানো হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শতাধিক চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিজিবি সদর দপ্তরের ৪ নম্বর গেটের সামনে অবস্থান নেয়। তাদের পূর্বঘোষিত অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, বিজিবি ও সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সেই বীভৎস দৃশ্যাবলি এ দেশের মানুষের মন থেকে আজও মুছে যায়নি। শুধু কতিপয় বিডিআর সদস্য যে এমন হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করতে পারে, সে কথাও মানুষ বিশ্বাস করে না। তাদের অনেকেই মনে করেন, পর্দার আড়াল থেকে কেউ না কেউ এ ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছে। সেই ইন্ধনদাতা কারা? তারা কি এ দেশেরই লোক, নাকি বিদেশি এজেন্ট? পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অনেক আগে ঘটে যাওয়া কিছু কিছু ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, কেবল কিছুসংখ্যক মধ্যম ও নিম্ন সারির বিডিআর সদস্য দ্বারা এত বড় ঘটনার পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। এ ঘটনায় স্বার্থান্বেষী মহলের কোনো না কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে। আদালতও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তারই প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে ছিল স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। দেশ-বিদেশে আলোচিত এই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত বলেছেন, ওই ঘটনা ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা। বিডিআর জওয়ানরা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে যে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে, সেই কলঙ্কের চিহ্ন তাদের বহুকাল বহন করতে হবে। তাই পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত, নেপথ্যে জড়িত ও ইন্ধনদাতাদের নাম তদন্ত কমিশন প্রকাশ করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিজিবি মহাপরিচালক বরাবর লেখা স্মারকলিপিতে তারা উল্লেখ করেন – আমরা ২০০৯ সালে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য। আপনার জ্ঞাতার্থে, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বিডিআরের ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ১০ জন বিভিন্ন পদবির বিডিআর সৈনিক এবং ৭ জন বেসামরিক নাগরিকসহ মোট ৭৪ জন শহীদ হন। এটি আমাদের জাতির ইতিহাসে অন্যতম মর্মান্তিক অধ্যায় এবং আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর এক ভয়াবহ আঘাত। আমরাও এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তৎকালীন সরকার পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং পিলখানার বাইরে অবস্থানরত অন্যান্য ব্যাটালিয়ন/সেক্টর/ট্রেনিং স্কুলে কর্মরত বিডিআর সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার লক্ষ্যে গণহারে নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদের বিনা বিচারে জেলখানায় বন্দী রাখা হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যাদের ফৌজদারি মামলায় কোনোভাবে জেল দিতে পারেনি, তাদের বিশেষ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে জেল-জরিমানাসহ সাজা প্রদান করা হয়।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানায় যখন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তখন পিলখানার বাইরে দেশের অন্যান্য ইউনিটের বিডিআর ক্যাম্পগুলো ছিল পুরোপুরি শান্ত এবং ওই দিন বিভিন্ন ইউনিটের নিরাপত্তায় নিয়োজিত জওয়ানদের অস্ত্র অস্ত্রাগারে জমা নিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু পরের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার বাইরে দেশের বিভিন্ন ইউনিটে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা হলো: ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে সারাদেশে বিডিআরের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে সেনা সদস্যরা অবস্থান নেয়। রাজশাহী সেক্টরে জোরপূর্বক অস্ত্রাগারের চাবি নেওয়ার জন্য কিছু সেনা সদস্যের সাথে সেক্টরের গেটে ধস্তাধস্তি হয়। আনুমানিক সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে পিলখানার বাইরের শুধুমাত্র দুয়েকটি ইউনিট বাদে বাকি সব ইউনিট থেকে সেনা কর্মকর্তাদের ইউনিট ত্যাগের পরিকল্পিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়; যা ইউনিটগুলোর ‘চেইন অব কমান্ড’ বিলুপ্ত করে সেখানে অভিভাবকশূন্য করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে, যেমন- খাগড়াছড়ি, ফেনীর বিডিআর ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। উপরোক্ত ঘটনাগুলো টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় যা দেখে বিডিআর সৈনিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে যায়।

এই ঘটনাগুলো দ্বারা দেশের সকল বিডিআরের ইউনিটে অবস্থানরত সৈনিকদের মনে ভীতি সঞ্চার হয় যা দুই বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। যার কারণে নিরাপত্তাহীনতার তাগিদ থেকে কিছু সংখ্যক বিডিআর সদস্য আমাদের পরিবার, সরকারি সম্পদ ও নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা অন্যায়ভাবে ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে চিহ্নিত করে হাজারো নিরীহ বিডিআর সদস্যকে গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা এবং চাকরিচ্যুতির মতো কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করা হয়। যা ছিল বিচারের নামে চরম প্রহসন ও স্বেচ্ছাচারিতার এক নগ্ন নিদর্শন। এ ধরনের প্রহসনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে হাজার হাজার নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদের চাকরিচ্যুত করে তৎকালীন সরকার পরিস্থিতিকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে এবং প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।

স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে, আমরা বিডিআর সদস্যরা শুধুমাত্র পেশাগত জীবনেই ক্ষতিগ্রস্ত হইনি বরং সামাজিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক জীবনেও ভয়াবহ বিপর্যয়ের শিকার হয়েছি। আমাদের পরিবারগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আমাদের পরিবারগুলোর মানসিক শান্তি ও স্থিতি পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। এ ঘটনার ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা এখনও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে যাচ্ছি, যা আমাদের নাগরিক অধিকার, সম্মান ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

ফিলিস্তিনকে স্বাধীন রাষ্ট্রের স্বীকৃতি দিতে যাচ্ছে ফ্রান্স

চাকরিচ্যুত বিডিআির সদস্যদের পুনর্বহালের দাবিতে কর্মসূচি পিলখানা হত্যাকান্ডে সম্পৃক্ত জওয়ানরা এখনও বেপরোয়া

আপডেট টাইম : ০৪:৪৭ অপরাহ্ন, রবিবার, ৬ এপ্রিল ২০২৫

পিলখানায় বিডিআর বিদ্রোহের নামে নির্মম ও নৃশংসভাবে হত্যা করা হয় ৫৭ জন দেশপ্রেমিক সেনা কর্মকর্তাসহ ৭৪ জনকে। এ ঘটনায় তখন বিডিআর সদর দফতরে কর্মরত প্রায় প্রতিটি জওয়ান বিদ্রোহের সাথে সম্পৃক্ত থেকে হত্যাকাণ্ড, নাশকতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ রয়েছে। বর্তমান অন্তর্বর্তীকালীন সরকার ক্ষমতায় আসার পর অভিযুক্তদের অনেকেই আদালতের নির্দেশে কারাগার থেকে মুক্তি পেয়েছেন। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার মেজর জেনারেল (অব.) আ ল ম ফজলুর রহমানের সভাপতিত্বে পিলখানা হত্যাকাণ্ড তদন্তে স্বাধীন তদন্ত কমিশন গঠন করেছেন। কিন্তু বিডিআর বিদ্রোহের নামে হত্যাকাণ্ডে সম্পৃক্ত বিডিআর সদর দফতরে কর্মরত (বিদ্রোহের সময়) জওয়ানদের জিজ্ঞাসাবাদের কোনো উদ্যোগ নেই। হত্যাকাণ্ড, নাশকতা ও রাষ্ট্রীয় সম্পদ লুটপাটের সাথে জড়িত অনেক জওয়ান এখন বেপরোয়া। এসব অভিযুক্তরা এখনও ধরা ছোঁয়ার বাইরে।

অন্যদিকে পিলখানায় হত্যাকাণ্ডের ঘটনায় চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের ক্ষতিপূরণসহ চাকরিতে পুনর্বহালের দাবিতে জিগাতলায় বিজির ৪ নম্বর গেটের সামনে কর্মসূচি পালন করেন চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা। আন্দোলনকারীরা বর্তমান বিজিবি মহাপরিচালকের সাক্ষাৎ চেয়েছিলেন। কিন্তু সেটি না পেয়ে তারা কর্মসূচি চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়ে রোববারের কর্মসূচি শেষ করেন। রোববার দুপুর সোয়া ১২টার দিকে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্যদের পক্ষ থেকে পাঁচ প্রতিনিধি পিলখানার ৪ নম্বর গেটে যান স্মারকলিপি নিয়ে। তারা বিজিবি মহাপরিচালকের সঙ্গে সাক্ষাতের অনুমতি চান। কিন্তু সেটি তাদের দেওয়া হয়নি। স্মারকলিপি নিয়ে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের কাছে পাঠানোর আশ্বাস দিয়ে প্রতিনিধি দলকে ফেরত পাঠানো হয়।

সরেজমিনে দেখা গেছে, শতাধিক চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য ও তাদের পরিবারের সদস্যরা বিজিবি সদর দপ্তরের ৪ নম্বর গেটের সামনে অবস্থান নেয়। তাদের পূর্বঘোষিত অবস্থান কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে বিপুল সংখ্যক পুলিশ, বিজিবি ও সেনাসদস্য মোতায়েন করা হয়।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পিলখানা হত্যাকাণ্ডের সেই বীভৎস দৃশ্যাবলি এ দেশের মানুষের মন থেকে আজও মুছে যায়নি। শুধু কতিপয় বিডিআর সদস্য যে এমন হত্যাকাণ্ডের পরিকল্পনা করতে পারে, সে কথাও মানুষ বিশ্বাস করে না। তাদের অনেকেই মনে করেন, পর্দার আড়াল থেকে কেউ না কেউ এ ঘটনায় ইন্ধন জুগিয়েছে। সেই ইন্ধনদাতা কারা? তারা কি এ দেশেরই লোক, নাকি বিদেশি এজেন্ট? পিলখানা হত্যাকাণ্ডের অনেক আগে ঘটে যাওয়া কিছু কিছু ঘটনা বিচার-বিশ্লেষণ করে অনেকেই বলার চেষ্টা করছেন, কেবল কিছুসংখ্যক মধ্যম ও নিম্ন সারির বিডিআর সদস্য দ্বারা এত বড় ঘটনার পরিকল্পনা করা সম্ভব নয়। এ ঘটনায় স্বার্থান্বেষী মহলের কোনো না কোনো সংশ্লিষ্টতা আছে। আদালতও পূর্ণাঙ্গ রায়ে তারই প্রতিধ্বনি করে বলেছেন, বিডিআর বিদ্রোহের পেছনে ছিল স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। দেশ-বিদেশে আলোচিত এই পিলখানা হত্যাকাণ্ডের মামলার রায়ের পর্যবেক্ষণে উচ্চ আদালত বলেছেন, ওই ঘটনা ছিল রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা ও অর্থনৈতিক-সামাজিক নিরাপত্তায় বিঘ্ন সৃষ্টির লক্ষ্যে একটি স্বার্থান্বেষী মহলের ষড়যন্ত্র। শুধু তাই নয়, ষড়যন্ত্রের মাধ্যমে একটি দক্ষ, প্রশিক্ষিত বাহিনীকে ধ্বংসেরও চেষ্টা। বিডিআর জওয়ানরা দেশের অর্থনৈতিক মেরুদণ্ড ভেঙে দেওয়াসহ স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের ওপর প্রত্যক্ষ হুমকির বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়ে যে কলঙ্কজনক অধ্যায়ের সৃষ্টি করেছে, সেই কলঙ্কের চিহ্ন তাদের বহুকাল বহন করতে হবে। তাই পিলখানা হত্যাকাণ্ডে সরাসরি জড়িত, নেপথ্যে জড়িত ও ইন্ধনদাতাদের নাম তদন্ত কমিশন প্রকাশ করবে বলে বিশেষজ্ঞরা মনে করেন।

বিজিবি মহাপরিচালক বরাবর লেখা স্মারকলিপিতে তারা উল্লেখ করেন – আমরা ২০০৯ সালে অন্যায়ভাবে চাকরিচ্যুত বিডিআর সদস্য। আপনার জ্ঞাতার্থে, ২০০৯ সালের ২৫ ও ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানায় সংঘটিত নৃশংস হত্যাকাণ্ডে বিডিআরের ৫৭ জন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, ১০ জন বিভিন্ন পদবির বিডিআর সৈনিক এবং ৭ জন বেসামরিক নাগরিকসহ মোট ৭৪ জন শহীদ হন। এটি আমাদের জাতির ইতিহাসে অন্যতম মর্মান্তিক অধ্যায় এবং আমাদের সার্বভৌমত্বের ওপর এক ভয়াবহ আঘাত। আমরাও এই নির্মম হত্যাকাণ্ডে জড়িত প্রকৃত অপরাধীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি চাই। তৎকালীন সরকার পিলখানায় সংঘটিত হত্যাকাণ্ড এবং পিলখানার বাইরে অবস্থানরত অন্যান্য ব্যাটালিয়ন/সেক্টর/ট্রেনিং স্কুলে কর্মরত বিডিআর সদস্যদের বিরুদ্ধে একটি সুপরিকল্পিত ষড়যন্ত্র বাস্তবায়ন করে। হত্যাকাণ্ড ঘটানোর পর প্রকৃত অপরাধীকে আড়াল করার লক্ষ্যে গণহারে নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদের বিনা বিচারে জেলখানায় বন্দী রাখা হয়। আবার কিছু কিছু ক্ষেত্রে দেখা যায় যাদের ফৌজদারি মামলায় কোনোভাবে জেল দিতে পারেনি, তাদের বিশেষ আদালতের মাধ্যমে বিভিন্নভাবে জেল-জরিমানাসহ সাজা প্রদান করা হয়।

২৫ ফেব্রুয়ারি ২০০৯ পিলখানায় যখন হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হয় তখন পিলখানার বাইরে দেশের অন্যান্য ইউনিটের বিডিআর ক্যাম্পগুলো ছিল পুরোপুরি শান্ত এবং ওই দিন বিভিন্ন ইউনিটের নিরাপত্তায় নিয়োজিত জওয়ানদের অস্ত্র অস্ত্রাগারে জমা নিয়ে নেওয়া হয়। কিন্তু পরের দিন ২৬ ফেব্রুয়ারি পিলখানার বাইরে দেশের বিভিন্ন ইউনিটে অনাকাঙ্ক্ষিত অনেক ঘটনা ঘটে যার মধ্যে উল্লেখযোগ্য কিছু ঘটনা হলো: ২৬ ফেব্রুয়ারি সকাল থেকে সারাদেশে বিডিআরের বিভিন্ন ব্যাটালিয়নে সেনা সদস্যরা অবস্থান নেয়। রাজশাহী সেক্টরে জোরপূর্বক অস্ত্রাগারের চাবি নেওয়ার জন্য কিছু সেনা সদস্যের সাথে সেক্টরের গেটে ধস্তাধস্তি হয়। আনুমানিক সকাল ৯টা থেকে ১০টার মধ্যে পিলখানার বাইরের শুধুমাত্র দুয়েকটি ইউনিট বাদে বাকি সব ইউনিট থেকে সেনা কর্মকর্তাদের ইউনিট ত্যাগের পরিকল্পিত নির্দেশনা প্রদান করা হয়; যা ইউনিটগুলোর ‘চেইন অব কমান্ড’ বিলুপ্ত করে সেখানে অভিভাবকশূন্য করা হয়। পরবর্তীতে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী বিভিন্ন স্থানে, যেমন- খাগড়াছড়ি, ফেনীর বিডিআর ক্যাম্পে অবস্থান নেয়। উপরোক্ত ঘটনাগুলো টেলিভিশনে সম্প্রচার করা হয় যা দেখে বিডিআর সৈনিকরা উদ্বিগ্ন হয়ে যায়।

এই ঘটনাগুলো দ্বারা দেশের সকল বিডিআরের ইউনিটে অবস্থানরত সৈনিকদের মনে ভীতি সঞ্চার হয় যা দুই বাহিনীর মধ্যে উত্তেজনা সৃষ্টি করে। যার কারণে নিরাপত্তাহীনতার তাগিদ থেকে কিছু সংখ্যক বিডিআর সদস্য আমাদের পরিবার, সরকারি সম্পদ ও নিজেদের সুরক্ষার জন্য প্রতিরক্ষামূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করে, যা অন্যায়ভাবে ‘বিদ্রোহ’ হিসেবে চিহ্নিত করে হাজারো নিরীহ বিডিআর সদস্যকে গ্রেপ্তার, জেল-জরিমানা এবং চাকরিচ্যুতির মতো কঠোর শাস্তির সম্মুখীন করা হয়। যা ছিল বিচারের নামে চরম প্রহসন ও স্বেচ্ছাচারিতার এক নগ্ন নিদর্শন। এ ধরনের প্রহসনমূলক কার্যকলাপের মাধ্যমে হাজার হাজার নিরপরাধ বিডিআর সদস্যদের চাকরিচ্যুত করে তৎকালীন সরকার পরিস্থিতিকে তাদের রাজনৈতিক স্বার্থে ব্যবহার করেছে এবং প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করার অপচেষ্টা চালিয়েছে।

স্মারকলিপিতে আরও বলা হয়েছে, আমরা বিডিআর সদস্যরা শুধুমাত্র পেশাগত জীবনেই ক্ষতিগ্রস্ত হইনি বরং সামাজিক, পারিবারিক এবং অর্থনৈতিক জীবনেও ভয়াবহ বিপর্যয়ের শিকার হয়েছি। আমাদের পরিবারগুলো মারাত্মক অর্থনৈতিক সংকটে পড়ে এবং সামাজিকভাবে হেয় প্রতিপন্ন হয়। আমাদের সন্তানদের ভবিষ্যৎ জীবন অনিশ্চিত হয়ে পড়ে। আমাদের পরিবারগুলোর মানসিক শান্তি ও স্থিতি পুরোপুরি নষ্ট করে দিয়েছে। এ ঘটনার ফলে আমরা ক্ষতিগ্রস্ত পরিবারগুলোর সদস্যরা এখনও সামাজিক বৈষম্যের শিকার হয়ে যাচ্ছি, যা আমাদের নাগরিক অধিকার, সম্মান ও মর্যাদাকে ক্ষুণ্ণ করছে।