ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪, ৯ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

আমার স্কুলজীবনের স্মৃতিকথা

আবু এন এম ওয়াহিদ: ঘড়িতে সকাল দশটা বাজতেই চৌকিদার শচীন্দ্র স্কুলঘরের বারান্দায় মাথার উপরে কাঠের বিমে ঝুলানো পিতলের ঘণ্টিতে হাতুড়ি মারতেন – ঢং ঢং ঢং ঢং। মঈন স্যার এসে দশ মিনিটে রোলকল করে বেরিয়ে যেতেন। বসির স্যারের বাঁশির সুরে রোদের নিচে খোলা মাঠেদৌড়ে এসে অ্যাসেম্বিলাইনে দাঁড়াতাম। শুরু হতো লেফ্ট রাইট, লেফ্ট রাইট, কিছু শরীর চর্চা, জাতীয় সঙ্গীত, তারপর দিনের ওয়াদা। আবার হুইসল বাজলে লাইন ধরে সুশৃঙ্খলভাবে সবাই ফিরে আসতাম নিজ নিজ ক্লাসে। ঘণ্টিতে শচীর হাতুড়ির একটা বাড়ি বাজলে শুরু হতো ফার্স্ট পিরিয়ড। মঈন স্যার আবার আসতেন ইংরেজি পড়াতে। রিডিং পড়াতেন, অর্থ বোঝাতেন। তারপর বানানের পরীক্ষা। না পারলে হাত পেতে নিতে হতো বেতের বাড়ি। মাঝে মধ্যে আবার বকাঝকা ও কানমলা।

তারপর সপাং সপাং করে বেত হাতে নিয়েআসতেন সৈয়দ সা’ব। ক্লাসরুমে ঢুকে চেয়ারে বসার আগেই, ‘টুপি কোথায়?’ বলে খালি মাথায় ঠক্ ঠ্ক করে একে একে সবাইকে বেত দিয়ে মারতেন। যদি কেউ বলতো, ‘স্যার আমি হিন্দু’। ‘দেখে তো মুসলমানই মনে হয়,’ প্রতিদিন স্যারের একই উত্তর। তারপর চেয়ারে বসে সমাজ পাঠের বই থেকে গুনে গুনে পড়াতেন মাত্র দু’পাতা। সবশেষে আগের দিনের পড়া থেকে ছোট ছোট প্রশ্ন করতেন। না পারলে হাতের তালু মেলে ধরতে হতো। হাত বের করতে দেরী হলে বেতের বাড়ি গিয়ে পড়তো গিয়ে ঘাড়ে আর পিঠে।

বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন মনিন্দ্র বাবু – কোনো দিন চেয়ারে বসে, কোনো দিন দাঁড়িয়েই পড়াতেন। মারধর করতেন না খুব একটা। পড়াতেন মোটামুটি ভালই। মাঝেমধ্যে ফিজিক্স ল্যাব থেকে যন্ত্রপাতি এনে ক্লাসে এক্সপেরিমেন্ট করতেন। এটা আমাদের জন্য ছিল খুব মজার ব্যাপার, বাড়তি পাওনা, ম্যাজিকের মতো লাগতো।
বাংলা পড়তাম বসির স্যারের কাছে। তাঁর পড়া কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্লাসে বসে শুনতাম!পড়ানোর সময়, তিনি বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অনেক প্রসঙ্গ টেনে আনতেন – কতক বুঝতাম, কতক বুঝতাম না। আমাদের ওই ‘না বোঝাটা’ই বুঝিয়ে দিতো, স্যার কতকিছু জানেন!

অঙ্ক শেখাতেন প্রমথ বাবু। জ্যামিতির ক্লাসে খালি হাতে যখন ব্ল্যাকবোর্ডে নিখুঁত বৃত্ত আঁকতেন, তখন অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম! আঁকার সময় তাঁর হাত একটুও কাঁপতো না। বৃত্তের পরিধিও আঁকা বাঁকা হতো না। শিল্পীর মতো তাঁর হাতের ছোঁয়ায় জন্ম নিতো এক ছিম ছাম গোলাকার বৃত্ত।

সিভিল ডিফেন্সের ক্লাস নিতেন আব্দুল কাদির স্যার। তাঁর বেত মারামারির অভ্যেস ছিলনা একেবারেই,তবে তাঁর তীর্যক ভাষা আর ধারালো কথার খোঁচা ছিলবেতের বাড়ির চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। আবার তাঁর কথায় রসবোধেরও কোনো অভাব ছিলনা। তিনি প্রায়ই হাসাতেন। একদিন ক্লাসে বসে স্যার পড়াচ্ছেন ন্যাপাম বা আগুনে বোমার কথা। আমার পেছনের বেঞ্চে বসে আমাদের এক সহপাঠি আরেকজনের ঘাড় টিপে দিচ্ছিলো – হয়তো তার মাথা ধরেছিল। স্যার ছেলেটির কা-দেখে অত্যন্ত সিরিয়াস মুডে বললেন, ‘সর্বনাশ! তুমি করছোটা কী? আরেক জনের ঘাড় ঘর্ষণ করছো, তুমি জানো নিকটে দাহ্য পদার্থ –  মাথার চুল, যে কোনো মুহূর্তে আগুন ধরে গেলে ন্যাপাম বোমা বি®েফারণের মত সমস্ত স্কুল পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে’। আমরা তো সবাই হেসেই খুন! ‘এতে হাসির কী হলো? আমি পাচ্ছি আগুনের ভয়, আর তোমরা হাসছো,’  আবার বলে উঠলেন স্যার। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ক্লাসে ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতেন।

স্যারের কথা শুনে ভাবতাম, ‘আমি কবে এভাবে ইংরেজি বলতে


শিখবো?’সত্যি বলতে কী সে শেখা আজো আমার হয়নি। ইংরেজি বলতে গেলে এখনো ভুল হয়। কীভাবে বুঝি,শুনতে চান? ক্লাসে পড়াতে গিয়ে যখন ভুল উচ্চারণ করি তখন ছাত্রছাত্রীরা হেসে দেয়। ‘ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়,’ এই ওজরে তাদের কাছ থেকে সহানুভূতি দূরে থাক, এতটুকু করুণাও পাওয়া যায় না। ঘরেও রেহাই নেই। এখানেও আছেন আমার ইংরেজি শিক্ষক, তবে একজন দু’জন নন, আছেন তিনজন। আমার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে, যাদের জন্য আমি নিজেকে ধন্যই মরে করি। ইংরেজি বলতে ভুল হলে স্ত্রীর কাছে কোনো মাফ নেই। তিনি শাসনের সুরে শিখিয়ে দেন। মেয়েরা তর্জন গর্জন করে না, তবে হেসে হেসে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে, শুধরিয়ে দেয়, আর বলে, ‘আব্বু তুমি কী যে বলো!’

দিনের শেষের দিকে কাজী সা’ব আসতেন আরবী পড়াতে। স্যার এলে একজন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম আর একজন স্যারের মাথার পাকা চুল বেছে দিতাম। কোনো দিন পড়াতেন কোনো দিন বাতাস খেয়েই সময় পার করে দিতেন। মাঝে মধ্যে আমরা কেচ্ছা বলার জন্য তাঁকে পিড়াপিড়ি করতাম। একবার পরীক্ষা পরে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘স্যার, আমি আরবীতে কত পেয়েছি’? ‘স্যার আমাকে কাছে নিয়ে আস্তে করে বললেন, ‘অসিত সংস্কৃতে কত পায়, সেটা আমাকে জানিয়ো, আমি তোমাকে আরো কিছু বাড়িয়ে দেবো’। অসিত ছিল ক্লাসের ফার্স্টবয় এবং আমি সেকেন্ড। আরেকবার কী হয়েছিল শুনবেন? ষান্মাসিক পরীক্ষার পর স্যার আমাকে বললেন, ‘লোকমান, (আমার ডাক নাম), তুমি শুক্রবারে (তখনকার সাপ্তাহিক ছুটির দিন) আমার বাড়িতে এসে পরীক্ষার খাতাগুলো দেখে দিয়ে যেয়ো’। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমি তাই করেছিলাম!

সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন প-িত সুধীর ভট্টাচার্য্য। মাঝে মধ্যে বাংলা ক্লাসে এসে প্রক্সি দিতেন। তিনি ছিলেন খুব সহজ সরল ও খোলা মনের মানুষ। কোনো সময় খুশি হলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন। সে সময় পরীক্ষার খাতা সুঁই-সুতো দিয়ে সেলাই করা হতো। আমরা যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন  প্রথমবারের মত ¯ু‹লে এলো স্টেপ্লার। পরীক্ষার হলে প-িত মশায় স্টেপ্লার দেখে বিস্ময়ে আর উল্লাসে, ‘বিজ্ঞানকে আশীর্বাদ,’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। সে কথা আজও আমার মনে পড়ে। আজ বেঁচে থাকলে কম্পিউটার দেখে ছিল স্যার ছিল হার্টফেল করতেন।

সব সময় যে লেখাপড়ায় মন থাকতো তাও নয়। পানি খাওয়ার কৈফিয়তে দিনে অন্ততঃ তিন-চার বার করে বেরিয়ে আসতাম অফিস ঘরের পেছনে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো পুরনো ইঁদারার পারে (এখন আর সেটা নেই)। একটুখানি আড্ডা, একটুখানি সময় ক্ষেপণ, আর গায়ে মুক্ত বাতাস লাগানো ছিল ওখানকার বিশেষ আকর্ষণ। দড়িবাঁধা বালতি দিয়ে কুয়ো থেকে ঠা-া পানি তুলে হাত মুখ ধোয়া, পানি ছিটাছিটি খেলা ইত্যাদি ছিল ভীষণ এক মজার ব্যাপার। অবশেষে এ্যলুমিনিয়ামের গেলাস ভর্তি পানি এক ঢোকে গিলে ফেলা। এ যেন পানি নয়, আ’বে কাওসারজম্ জমের স্বাদ! গরমের দিনেও কুয়োর পানি থাকতো অস্বাভাবিক রকম ঠা-া!

হাফ টাইমের ব্রেকে আধা ঘন্টার ছুটি পেতাম। মাঝে মধ্যে বাজারের মসজিদে গিয়ে জোহরের নামাজ পড়তাম। আবার কোনো দিন মিঠাই পট্টির ঢাকাই দোকান থেকে এক আনার ভাজা কাবুলী চানা পকেট ভরে কিনে নিতাম।  কোনো দিন পকেটে চার আনা থাকলে হবি চাচার চায়ের দোকান থেকে এক কাপ মিক্সার (গরম পানি আর চিনি মেশানো পাতলা দুধ) আর এক পিস টোস্ট্ কিনে খেতাম। দোকানের ছোকড়া ছেলেটি, দুধে পানি মেশাতো, না পানিতে দুধ মেশাতো, সে নিয়ে  আমাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। আমার জন্য ওই বয়সে এক পেয়ালা গরম ও মিষ্টি দুধ-পানি যে কত বড় পাওনা ছিল তা বলে বোঝাবার নয়!

লেখাপড়া ছাড়া আনন্দেরও অনেক ব্যবস্থা ছিলস্কুলে। এখন হয় কী না জানি না, আমাদের সময় প্রতি বছর স্কুলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হতো। এ উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী চলতো কবিতা আবৃত্তি, গান, নাটক, ইত্যাদি। নাটক আর আবৃত্তির দায়িত্বে থাকতেন প্রমথ বাবু। আমি সব সময় আবৃত্তি করতাম। দু’ একবার নাটকেও অভিনয় করেছি। গান গাওয়ায় আমার কোনো সখ ছিলনা, তবে শুনতে খুব ভালো লাগতো। গান শেখাতেন দ্বীগেন্দ্র বাবু। এ ধরণেরই এক অনুষ্ঠানে আমি বাসু দেবের কন্ঠেপ্রথম শুনেছিলাম, ‘কে বিদেশী, মন উদাসী,বাঁশের বাঁশী,বাজাও বনে….’ গানটি। ভীষণ শ্রুতিমধুর সে গান। আজও সেই সুর আমার কানে বাজে। মনে হলে প্রথম কয়েক লাইন গুন গুন করে গাই এখনও।  বড় হয়ে জেনেছি, গানটি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা।

¯ু‹লে নিয়মিতআরো দু’টি অনুষ্ঠান হতো। হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা করতো সরস্বতীপূজো, আর আমরা নবী (সঃ) জন্মদিন উপলক্ষ্যে করতাম মিলাদ। মিলাদের অনুষ্ঠানমালাও চলতো সারাদিন ধরে। হতো ক্বীরাত, হামদ্, না’ত, আবৃত্তি, ও নবীর জীবনীর উপর রচনা প্রতিযোগিতা। আমি রচনা লিখতাম এবং নজরুলের ‘মরুভাস্কর’ থেকে আবৃত্তি করতাম একটি কবিতা। মিলাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল দুরুদ ও মুনাজাতের পরে দুই গোল্লা ঘি আর চিনির রসে ভাজা ময়দার হালুয়া (সিলেটি ভাষায় যাকে বলে তোশা শিন্নী)। এক গোল্লা নিজে খেতাম, আর এক গোল্লা অন্য সবার জন্য বাড়িতে নিয়ে যেতাম। ময়দার হালুয়া বানানোর দায়িত্বে থাকতেন আমার বাবা মোহম্মদ আতাউর রহমান। তিনিও স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। মিলাদে সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় ছিলো বড়লেখার তৎকালীন সার্কেল অফিসার আব্দুল জব্বার সা’বের দীর্ঘ  বক্তৃতা। এক বার জব্বার সা’বের বদলে মিলাদে বক্তৃতা দিয়েছিলেন আব্বার বন্ধু ডাঃ আব্দুশ শুকুর। তিনি বলেছিলেন, ‘পবিত্র কোরআনের প্রথম অহীর প্রথম শব্দ হলো ‘ঈকরা’ অর্থাৎ ‘পড়’। মুসলমানরা ‘ঈকরা’ থেকে দূরে সরে গেছে বলেই আজ পেছনে পড়ে আছে। বিশ্ব সভ্যতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে মুসলমানদের ‘ঈকরা’ কে শক্ত করে ধরতে হবে। আসুন আমরা ‘ঈকরা’র চর্চা করি’। কচি বয়সে তাঁর কথাগুলো আমার মনে খুব লেগেছিলো। আজও এই বয়সে আমাদের জীবনে ‘ঈকরা’র গুরুত্ব নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করি।

প্রতি মাসের ১৫ তারিখ ছিল স্কুলের টিউশন ফি কালেক্শনের দিন। ওই দিন ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাসটিচার পড়ানোর বদলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন তুলতেন। স্যার রসিদ লিখতেন, আর আমি  টাকা গুনে রাখতাম এবং ভাংতি দিতাম। স্যার কেন আমাকে এ কাজটি করতে দিতেন, সে নিয়ে বড় হওয়ার পর অনেক ভেবেছি। কোনো হদিস পাইনি। ‘আমার দায়িত্বশীলতা, ভালো ছাত্র হওয়া, আতাউর রহমান মাস্টার সা’বের ছেলে হওয়া’। এর যে কোনো একটিকিংবা সবই হতে পারে। কালেক্শনের পর হিসেব বুঝিয়ে দিতে রীতিমত হিমসিম খেতে হতো, কিন্তু অল্প বয়সে ১০, ৫০, ও ১০০ টাকার নোট নাড়া চাড়া করার অনুভূতি ছিল বেজায় মজার। এক সাথে দু শ’ তিন শ’ টাকা ছোঁয়া এবং গুনার এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম সুযোগ ও অভিজ্ঞতা।

হাফ টাইমের পরের ক্লাসগুলোতে স্যারেরা কী পড়াতেন, তার দিকে বিশেষ নজর থাকতো না। সময় গুনতাম কখন শচী ঘণ্টিতে মারেন ছুটির বাড়ি। স্কুলে ছাত্রদের সাথে ছাত্রীও ছিল জনাকয়েক,তাদের কথা হবে না হয় আরেক দিন।

লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

আমার স্কুলজীবনের স্মৃতিকথা

আপডেট টাইম : ০৪:৪৯ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৮ ডিসেম্বর ২০১৬

আবু এন এম ওয়াহিদ: ঘড়িতে সকাল দশটা বাজতেই চৌকিদার শচীন্দ্র স্কুলঘরের বারান্দায় মাথার উপরে কাঠের বিমে ঝুলানো পিতলের ঘণ্টিতে হাতুড়ি মারতেন – ঢং ঢং ঢং ঢং। মঈন স্যার এসে দশ মিনিটে রোলকল করে বেরিয়ে যেতেন। বসির স্যারের বাঁশির সুরে রোদের নিচে খোলা মাঠেদৌড়ে এসে অ্যাসেম্বিলাইনে দাঁড়াতাম। শুরু হতো লেফ্ট রাইট, লেফ্ট রাইট, কিছু শরীর চর্চা, জাতীয় সঙ্গীত, তারপর দিনের ওয়াদা। আবার হুইসল বাজলে লাইন ধরে সুশৃঙ্খলভাবে সবাই ফিরে আসতাম নিজ নিজ ক্লাসে। ঘণ্টিতে শচীর হাতুড়ির একটা বাড়ি বাজলে শুরু হতো ফার্স্ট পিরিয়ড। মঈন স্যার আবার আসতেন ইংরেজি পড়াতে। রিডিং পড়াতেন, অর্থ বোঝাতেন। তারপর বানানের পরীক্ষা। না পারলে হাত পেতে নিতে হতো বেতের বাড়ি। মাঝে মধ্যে আবার বকাঝকা ও কানমলা।

তারপর সপাং সপাং করে বেত হাতে নিয়েআসতেন সৈয়দ সা’ব। ক্লাসরুমে ঢুকে চেয়ারে বসার আগেই, ‘টুপি কোথায়?’ বলে খালি মাথায় ঠক্ ঠ্ক করে একে একে সবাইকে বেত দিয়ে মারতেন। যদি কেউ বলতো, ‘স্যার আমি হিন্দু’। ‘দেখে তো মুসলমানই মনে হয়,’ প্রতিদিন স্যারের একই উত্তর। তারপর চেয়ারে বসে সমাজ পাঠের বই থেকে গুনে গুনে পড়াতেন মাত্র দু’পাতা। সবশেষে আগের দিনের পড়া থেকে ছোট ছোট প্রশ্ন করতেন। না পারলে হাতের তালু মেলে ধরতে হতো। হাত বের করতে দেরী হলে বেতের বাড়ি গিয়ে পড়তো গিয়ে ঘাড়ে আর পিঠে।

বিজ্ঞানের শিক্ষক ছিলেন মনিন্দ্র বাবু – কোনো দিন চেয়ারে বসে, কোনো দিন দাঁড়িয়েই পড়াতেন। মারধর করতেন না খুব একটা। পড়াতেন মোটামুটি ভালই। মাঝেমধ্যে ফিজিক্স ল্যাব থেকে যন্ত্রপাতি এনে ক্লাসে এক্সপেরিমেন্ট করতেন। এটা আমাদের জন্য ছিল খুব মজার ব্যাপার, বাড়তি পাওনা, ম্যাজিকের মতো লাগতো।
বাংলা পড়তাম বসির স্যারের কাছে। তাঁর পড়া কবিতা, গল্প এবং প্রবন্ধ মন্ত্রমুগ্ধের মতো ক্লাসে বসে শুনতাম!পড়ানোর সময়, তিনি বিজ্ঞান, দর্শন ও ধর্মতত্ত্বের অনেক প্রসঙ্গ টেনে আনতেন – কতক বুঝতাম, কতক বুঝতাম না। আমাদের ওই ‘না বোঝাটা’ই বুঝিয়ে দিতো, স্যার কতকিছু জানেন!

অঙ্ক শেখাতেন প্রমথ বাবু। জ্যামিতির ক্লাসে খালি হাতে যখন ব্ল্যাকবোর্ডে নিখুঁত বৃত্ত আঁকতেন, তখন অবাক হয়ে চেয়ে চেয়ে দেখতাম! আঁকার সময় তাঁর হাত একটুও কাঁপতো না। বৃত্তের পরিধিও আঁকা বাঁকা হতো না। শিল্পীর মতো তাঁর হাতের ছোঁয়ায় জন্ম নিতো এক ছিম ছাম গোলাকার বৃত্ত।

সিভিল ডিফেন্সের ক্লাস নিতেন আব্দুল কাদির স্যার। তাঁর বেত মারামারির অভ্যেস ছিলনা একেবারেই,তবে তাঁর তীর্যক ভাষা আর ধারালো কথার খোঁচা ছিলবেতের বাড়ির চেয়ে অনেক বেশি যন্ত্রণাদায়ক। আবার তাঁর কথায় রসবোধেরও কোনো অভাব ছিলনা। তিনি প্রায়ই হাসাতেন। একদিন ক্লাসে বসে স্যার পড়াচ্ছেন ন্যাপাম বা আগুনে বোমার কথা। আমার পেছনের বেঞ্চে বসে আমাদের এক সহপাঠি আরেকজনের ঘাড় টিপে দিচ্ছিলো – হয়তো তার মাথা ধরেছিল। স্যার ছেলেটির কা-দেখে অত্যন্ত সিরিয়াস মুডে বললেন, ‘সর্বনাশ! তুমি করছোটা কী? আরেক জনের ঘাড় ঘর্ষণ করছো, তুমি জানো নিকটে দাহ্য পদার্থ –  মাথার চুল, যে কোনো মুহূর্তে আগুন ধরে গেলে ন্যাপাম বোমা বি®েফারণের মত সমস্ত স্কুল পুড়ে ছারখার হয়ে যাবে’। আমরা তো সবাই হেসেই খুন! ‘এতে হাসির কী হলো? আমি পাচ্ছি আগুনের ভয়, আর তোমরা হাসছো,’  আবার বলে উঠলেন স্যার। আমাদের শিক্ষকদের মধ্যে একমাত্র তিনিই ক্লাসে ফ্লুয়েন্টলি ইংরেজি বলতেন।

স্যারের কথা শুনে ভাবতাম, ‘আমি কবে এভাবে ইংরেজি বলতে


শিখবো?’সত্যি বলতে কী সে শেখা আজো আমার হয়নি। ইংরেজি বলতে গেলে এখনো ভুল হয়। কীভাবে বুঝি,শুনতে চান? ক্লাসে পড়াতে গিয়ে যখন ভুল উচ্চারণ করি তখন ছাত্রছাত্রীরা হেসে দেয়। ‘ইংরেজি আমার মাতৃভাষা নয়,’ এই ওজরে তাদের কাছ থেকে সহানুভূতি দূরে থাক, এতটুকু করুণাও পাওয়া যায় না। ঘরেও রেহাই নেই। এখানেও আছেন আমার ইংরেজি শিক্ষক, তবে একজন দু’জন নন, আছেন তিনজন। আমার স্ত্রী এবং দুই মেয়ে, যাদের জন্য আমি নিজেকে ধন্যই মরে করি। ইংরেজি বলতে ভুল হলে স্ত্রীর কাছে কোনো মাফ নেই। তিনি শাসনের সুরে শিখিয়ে দেন। মেয়েরা তর্জন গর্জন করে না, তবে হেসে হেসে কাছে এসে জড়িয়ে ধরে, শুধরিয়ে দেয়, আর বলে, ‘আব্বু তুমি কী যে বলো!’

দিনের শেষের দিকে কাজী সা’ব আসতেন আরবী পড়াতে। স্যার এলে একজন হাতপাখা দিয়ে বাতাস করতাম আর একজন স্যারের মাথার পাকা চুল বেছে দিতাম। কোনো দিন পড়াতেন কোনো দিন বাতাস খেয়েই সময় পার করে দিতেন। মাঝে মধ্যে আমরা কেচ্ছা বলার জন্য তাঁকে পিড়াপিড়ি করতাম। একবার পরীক্ষা পরে স্যারকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘স্যার, আমি আরবীতে কত পেয়েছি’? ‘স্যার আমাকে কাছে নিয়ে আস্তে করে বললেন, ‘অসিত সংস্কৃতে কত পায়, সেটা আমাকে জানিয়ো, আমি তোমাকে আরো কিছু বাড়িয়ে দেবো’। অসিত ছিল ক্লাসের ফার্স্টবয় এবং আমি সেকেন্ড। আরেকবার কী হয়েছিল শুনবেন? ষান্মাসিক পরীক্ষার পর স্যার আমাকে বললেন, ‘লোকমান, (আমার ডাক নাম), তুমি শুক্রবারে (তখনকার সাপ্তাহিক ছুটির দিন) আমার বাড়িতে এসে পরীক্ষার খাতাগুলো দেখে দিয়ে যেয়ো’। অবিশ্বাস্য হলেও সত্য, আমি তাই করেছিলাম!

সংস্কৃতের শিক্ষক ছিলেন প-িত সুধীর ভট্টাচার্য্য। মাঝে মধ্যে বাংলা ক্লাসে এসে প্রক্সি দিতেন। তিনি ছিলেন খুব সহজ সরল ও খোলা মনের মানুষ। কোনো সময় খুশি হলে অট্টহাসিতে ফেটে পড়তেন। সে সময় পরীক্ষার খাতা সুঁই-সুতো দিয়ে সেলাই করা হতো। আমরা যখন ক্লাস সেভেনে পড়ি তখন  প্রথমবারের মত ¯ু‹লে এলো স্টেপ্লার। পরীক্ষার হলে প-িত মশায় স্টেপ্লার দেখে বিস্ময়ে আর উল্লাসে, ‘বিজ্ঞানকে আশীর্বাদ,’ বলে চিৎকার করে উঠেছিলেন। সে কথা আজও আমার মনে পড়ে। আজ বেঁচে থাকলে কম্পিউটার দেখে ছিল স্যার ছিল হার্টফেল করতেন।

সব সময় যে লেখাপড়ায় মন থাকতো তাও নয়। পানি খাওয়ার কৈফিয়তে দিনে অন্ততঃ তিন-চার বার করে বেরিয়ে আসতাম অফিস ঘরের পেছনে সিমেন্ট দিয়ে বাঁধানো পুরনো ইঁদারার পারে (এখন আর সেটা নেই)। একটুখানি আড্ডা, একটুখানি সময় ক্ষেপণ, আর গায়ে মুক্ত বাতাস লাগানো ছিল ওখানকার বিশেষ আকর্ষণ। দড়িবাঁধা বালতি দিয়ে কুয়ো থেকে ঠা-া পানি তুলে হাত মুখ ধোয়া, পানি ছিটাছিটি খেলা ইত্যাদি ছিল ভীষণ এক মজার ব্যাপার। অবশেষে এ্যলুমিনিয়ামের গেলাস ভর্তি পানি এক ঢোকে গিলে ফেলা। এ যেন পানি নয়, আ’বে কাওসারজম্ জমের স্বাদ! গরমের দিনেও কুয়োর পানি থাকতো অস্বাভাবিক রকম ঠা-া!

হাফ টাইমের ব্রেকে আধা ঘন্টার ছুটি পেতাম। মাঝে মধ্যে বাজারের মসজিদে গিয়ে জোহরের নামাজ পড়তাম। আবার কোনো দিন মিঠাই পট্টির ঢাকাই দোকান থেকে এক আনার ভাজা কাবুলী চানা পকেট ভরে কিনে নিতাম।  কোনো দিন পকেটে চার আনা থাকলে হবি চাচার চায়ের দোকান থেকে এক কাপ মিক্সার (গরম পানি আর চিনি মেশানো পাতলা দুধ) আর এক পিস টোস্ট্ কিনে খেতাম। দোকানের ছোকড়া ছেলেটি, দুধে পানি মেশাতো, না পানিতে দুধ মেশাতো, সে নিয়ে  আমাদের কোনো মাথা ব্যথা ছিল না। আমার জন্য ওই বয়সে এক পেয়ালা গরম ও মিষ্টি দুধ-পানি যে কত বড় পাওনা ছিল তা বলে বোঝাবার নয়!

লেখাপড়া ছাড়া আনন্দেরও অনেক ব্যবস্থা ছিলস্কুলে। এখন হয় কী না জানি না, আমাদের সময় প্রতি বছর স্কুলে পুরস্কার বিতরণী অনুষ্ঠান হতো। এ উপলক্ষ্যে দিনব্যাপী চলতো কবিতা আবৃত্তি, গান, নাটক, ইত্যাদি। নাটক আর আবৃত্তির দায়িত্বে থাকতেন প্রমথ বাবু। আমি সব সময় আবৃত্তি করতাম। দু’ একবার নাটকেও অভিনয় করেছি। গান গাওয়ায় আমার কোনো সখ ছিলনা, তবে শুনতে খুব ভালো লাগতো। গান শেখাতেন দ্বীগেন্দ্র বাবু। এ ধরণেরই এক অনুষ্ঠানে আমি বাসু দেবের কন্ঠেপ্রথম শুনেছিলাম, ‘কে বিদেশী, মন উদাসী,বাঁশের বাঁশী,বাজাও বনে….’ গানটি। ভীষণ শ্রুতিমধুর সে গান। আজও সেই সুর আমার কানে বাজে। মনে হলে প্রথম কয়েক লাইন গুন গুন করে গাই এখনও।  বড় হয়ে জেনেছি, গানটি কাজী নজরুল ইসলামের লেখা।

¯ু‹লে নিয়মিতআরো দু’টি অনুষ্ঠান হতো। হিন্দু ছাত্র-ছাত্রীরা করতো সরস্বতীপূজো, আর আমরা নবী (সঃ) জন্মদিন উপলক্ষ্যে করতাম মিলাদ। মিলাদের অনুষ্ঠানমালাও চলতো সারাদিন ধরে। হতো ক্বীরাত, হামদ্, না’ত, আবৃত্তি, ও নবীর জীবনীর উপর রচনা প্রতিযোগিতা। আমি রচনা লিখতাম এবং নজরুলের ‘মরুভাস্কর’ থেকে আবৃত্তি করতাম একটি কবিতা। মিলাদের সবচেয়ে আকর্ষণীয় বিষয় ছিল দুরুদ ও মুনাজাতের পরে দুই গোল্লা ঘি আর চিনির রসে ভাজা ময়দার হালুয়া (সিলেটি ভাষায় যাকে বলে তোশা শিন্নী)। এক গোল্লা নিজে খেতাম, আর এক গোল্লা অন্য সবার জন্য বাড়িতে নিয়ে যেতাম। ময়দার হালুয়া বানানোর দায়িত্বে থাকতেন আমার বাবা মোহম্মদ আতাউর রহমান। তিনিও স্কুলের একজন শিক্ষক ছিলেন। মিলাদে সবচেয়ে বিরক্তিকর বিষয় ছিলো বড়লেখার তৎকালীন সার্কেল অফিসার আব্দুল জব্বার সা’বের দীর্ঘ  বক্তৃতা। এক বার জব্বার সা’বের বদলে মিলাদে বক্তৃতা দিয়েছিলেন আব্বার বন্ধু ডাঃ আব্দুশ শুকুর। তিনি বলেছিলেন, ‘পবিত্র কোরআনের প্রথম অহীর প্রথম শব্দ হলো ‘ঈকরা’ অর্থাৎ ‘পড়’। মুসলমানরা ‘ঈকরা’ থেকে দূরে সরে গেছে বলেই আজ পেছনে পড়ে আছে। বিশ্ব সভ্যতায় মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে হলে মুসলমানদের ‘ঈকরা’ কে শক্ত করে ধরতে হবে। আসুন আমরা ‘ঈকরা’র চর্চা করি’। কচি বয়সে তাঁর কথাগুলো আমার মনে খুব লেগেছিলো। আজও এই বয়সে আমাদের জীবনে ‘ঈকরা’র গুরুত্ব নিয়ে অনেক চিন্তা ভাবনা করি।

প্রতি মাসের ১৫ তারিখ ছিল স্কুলের টিউশন ফি কালেক্শনের দিন। ওই দিন ফার্স্ট পিরিয়ডে ক্লাসটিচার পড়ানোর বদলে শিক্ষার্থীদের কাছ থেকে বেতন তুলতেন। স্যার রসিদ লিখতেন, আর আমি  টাকা গুনে রাখতাম এবং ভাংতি দিতাম। স্যার কেন আমাকে এ কাজটি করতে দিতেন, সে নিয়ে বড় হওয়ার পর অনেক ভেবেছি। কোনো হদিস পাইনি। ‘আমার দায়িত্বশীলতা, ভালো ছাত্র হওয়া, আতাউর রহমান মাস্টার সা’বের ছেলে হওয়া’। এর যে কোনো একটিকিংবা সবই হতে পারে। কালেক্শনের পর হিসেব বুঝিয়ে দিতে রীতিমত হিমসিম খেতে হতো, কিন্তু অল্প বয়সে ১০, ৫০, ও ১০০ টাকার নোট নাড়া চাড়া করার অনুভূতি ছিল বেজায় মজার। এক সাথে দু শ’ তিন শ’ টাকা ছোঁয়া এবং গুনার এটাই ছিল আমার জীবনের প্রথম সুযোগ ও অভিজ্ঞতা।

হাফ টাইমের পরের ক্লাসগুলোতে স্যারেরা কী পড়াতেন, তার দিকে বিশেষ নজর থাকতো না। সময় গুনতাম কখন শচী ঘণ্টিতে মারেন ছুটির বাড়ি। স্কুলে ছাত্রদের সাথে ছাত্রীও ছিল জনাকয়েক,তাদের কথা হবে না হয় আরেক দিন।

লেখক: আবু এন. এম. ওয়াহিদ; অধ্যাপক – টেনেসি স্টেট ইউনিভার্সিটি