মাত্র ৫৬ হাজার বর্গমাইল আয়তনের এই বাংলাদেশের ভূ-প্রকৃতি যথেষ্ট বৈচিত্রপূর্ণ।বাংলাদেশে ছোট-বড় মিলে প্রায় ৪০০ হাওর রয়েছে। এর বেশীর ভাগই সিলেট, সুনামগঞ্জ, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, নেত্রকোনা, কিশোরগঞ্জ ও ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলায় অবস্থিত। প্রধান হাওরগুলোর মধ্যে রয়েছে- টাঙ্গুয়ার হাওর, শনির হাওর, তল্লার হাওর, নলুয়ার হাওর, হাইল হাওর, হাকালুকি হাওর। হাওর হচ্ছে এই বৈচিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। এটি হচ্ছে এক বিশেষায়িত জলাভূমি। প্রতি বছর বর্ষায মৌসুমে, কখনোবা আগাম বন্যায় হাওরগুলো প্লাবিত হয়। বছরের কয়েকটি মাস এ অঞ্চল গভীর পানিতে নিমজ্জিত থাকে। চারপাশে যে দিকে চোখ যায়, শুধু পানি আর পানি। যেন কূল-কিনারহীন কোনো এক সমুদ্র। এর মধ্যেই অনেক দূরে দূরে ছোট্ট দ্বীপের মতো ভেসে থাকে একেকটি গ্রাম। কোথাও কোথাও এক দুটি হিজল গাছ নাক জাগিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে কোনোমতে। এ এক অপার বিষ্ময়। বিশ্বে এমন অনন্য ভৌগোলিক বৈশিষ্ট্যময় এলাকা খুবই বিরল।
হাওরগুলো মূলত সুদূর অতীতে ভূ-আলোড়ন বা ভূমিকম্প থেকে সৃষ্ট। কয়েকটি হাওর আবার বন্য প্রতিরোধী বাঁধের ভেতরে পড়েও তৈরি হয়েছে। আকৃতির দিক দিয়ে হাওরগুলো সাধারণত গোলাকৃতির, অনেকটা গামলার মতো।
বর্ষা শেষে ধীরে ধীরে হাওরের পানি নেমে যেতে থাকে। ভেসে উঠতে থাকে জমি। কিছু জায়গা অবশ্য কখনোই শুকায় না। বারো মাস পানি থাকে। এগুলোকে বিল বলে। হেমন্তের শেষে জেগে উঠা জমিতে বোরো ধানের চাষ হয়। এটিই হাওর অঞ্চলের একমাত্র ফসল।
অন্যদিকে বর্ষায় দিগন্ত বিস্তৃত হাওরে যে মাছেরা ভেসে বেড়ায়, বর্ষা শেষে সেগুলো হাওরের বিলে এসে আশ্রয় নেয়।
হাওর অঞ্চল দেশের ধান ও মাছের অন্যতম বড় উৎস। প্রতি বছর বন্যায় বা পাহাড়ি ঢলে বয়ে আসে বিপুল পলিকনা। আর সে কারণে হাওরের মাটি বরাবরই উর্বর। সুফলা। অন্যদিকে বর্ষায় চারদিক প্লাবিত হয়ে যায় বলে বিলের মাছগুলো বিভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ে। সহজেই এদের প্রজনন হয়। অথৈ পানির কারণে তখন মৎস্য শিকার তুলনামূলক কম হয় বলে মাছের পোনা বড় হওয়ার সুযোগ পায়। ফলে হাওর এলাকায় বিপুল মাছের উৎপাদন হয়।
শুধু ধান ও মাছ নয়, পাখিরও এক বড় অভয়ারন্য হচ্ছে হাওর অঞ্চল। বিশেষ করে প্রতি বছর শীত মৌসুমে পরিযায়ী পাখিরা এখানে ভিড় করে। প্রচণ্ড শীত সহ্য করতে না পেরে সুদূর সাইবেরিয়া থেকে এরা ঝাঁকে ঝাঁকে ছুটে আসে বাংলাদেশের হাওর অঞ্চলে।
হাওর অঞ্চলের ভূপ্রকৃতির অনন্য বৈশিষ্টের কারণে এই জনপদের মানুষের জীবনধারাও দেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে বেশ ভিন্ন। বছরের বড় অংশ জুড়ে পুরো এলাকা পানিতে তলিয়ে থাকে বলে এখানে ভালো কোনো সড়ক অবকাঠামো নেই। মেঠো পথে গরুর গাড়িতে করে পণ্য পরিবহণ করতে হয়। আর সাধারণ চলাফেরার ক্ষেত্রে পদযুগলই ভরসা। অন্যদিকে বর্ষায় নৌকা হয়ে উঠে যোগাযোগের একমাত্র বাহন। উপজেলা সদর, এক গ্রাম থেকে অন্য গ্রামে যাওয়া, এমনকি গ্রামীণ হাটে যাওয়ার জন্য নৌকা ছাড়া উপায় থাকে না।
গ্রীষ্মের শেষে কৃষকের গোলা ভরে উঠে সোনালী ধানে। মনে থাকে আনন্দের বন্যা। সাধারণত এই সময়ে তারা বিয়েসহ নানা সামাজিক উৎসবগুলো সেরে ফেলে। অন্নের জন্যে কোনো দুঃশ্চিন্তা না থাকা এবং জলমগ্নতার জন্যে অন্য কোনো কাজ করার সুযোগ থাকে না বলে কিসসা, পুঁথি পাঠের আসর, পালা গান, যাত্রাপালাসহ নানা আয়োজনে ব্যস্ত হয়ে উঠে তারা। বাংলার সমৃদ্ধ লোকসংস্কৃতির অন্যতম আধার হচ্ছে হাওর অঞ্চল। বর্ষায় নৌকাবাইচ হাওর অঞ্চলের আরেকটি বড় উৎসব। আনন্দের উৎস।
তবে একটি মাত্র ফসলের উপর নির্ভরশীল বলে হাওরবাসীর জীবন যথেষ্ট ঝুঁকিপূর্ণ। কয়েক বছর পর পরই আগাম পাহাড়ী ঢল অথবা বাঁধ ভেঙ্গে সৃষ্ট বন্যার কারণে অসময়ে তলিয়ে যায় একের পর এক হাওয়ার। অনেক কষ্টের বোরো ফসল ঘরে তোলার আগেই বানের পানিতে ভেসে যায়। ভেসে যায় কৃষক পরিবারের স্বপ্ন ও সাধ। তাদের চোখের লোনা পানি আর বন্যার পানি একাকার হয়ে যায়। যেমনটি হয়েছে এবার, ২০১৭ সালে। ভারতের মেঘালয়ে প্রবল বৃষ্টিতে সেখান থেকে নেমে আসা পাহাড়ী ঢলে ভেঙ্গে যায় হাওর রক্ষাকারী বাধ। অবশ্য এর পেছনে সংশ্লিষ্টদের অনিয়ম, দুর্নীতি আর উদাসীনতাও কম দায়ী ছিল না। তারা সঠিক সময়ে বাধের সংস্কার কাজ শেষ না করায় পানির সামান্য তোড়েই তা খড়কুটোর মতো ভেসে যায়।