ঢাকা , শুক্রবার, ১০ জানুয়ারী ২০২৫, ২৭ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভিন্নমত বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলের

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। এ সরকারের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনকে ফোকাস করা। এমন অভিপ্রায় জানিয়ে দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন কারও দাবিও ছিল না। তাছাড়া এই ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার কোনো নজিরও নেই। ১৫ বছর ধরে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলন করেছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কিছু চিন্তা করা সমীচীন হবে না। বরং কোনো সন্দেহের উদ্রেক হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকাটাই মঙ্গল। নেতারা এ-ও মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে গিয়ে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তখন তাদের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। সুতরাং তাদের ধারণা, সরকার এই পথে হাঁটবে না। বৃহস্পতিবার বিএনপিসহ চারটি জোট ও অন্তত ২০টি দলের শীর্ষ নেতারা যুগান্তরের কাছে প্রায় অভিন্ন এমন প্রতিক্রিয়া করেন।

তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই ইস্যুতে তাদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট করেনি। অপরদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে মন্দ হবে না।

বুধবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে গত ৬ জানুয়ারি রাজধানীতে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। সেখানে কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও এমন মতামত আছে। ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ চিত্র পাচ্ছে বলে গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন। এর আগে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একাধিক মতবিনিময়েও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিষয়ে পরামর্শ উঠে আসে।

সোমবার রাতে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠক হয়। এতে নেতারা অভিমত দেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান না। দলটির অভিমত, এই ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো নজির নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে এখন সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা।

জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচনকালীন সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া। যদি তা না করে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবে তাহলে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে এই সরকার জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে যাচ্ছে। অবশ্য আমরা মনে করি, এই সরকার তা করবে না।

বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব জাতীয় নির্বাচনকে প্রাধান্য দেওয়া। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে পারে। কিন্তু এর আগে কোনো অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করেনি। নেতারা জানান, জনগণ দীর্ঘ ১৫ বছর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। ফ্যাসিবাদী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা বিলুপ্তের পর্যায়ে নিয়েছিল। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। স্থিতিশীলতা তৈরিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরতে হবে। তাই দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দরকার।

তবে স্থানীয় নির্বাচন আগে চায় কিনা তা এখনো স্পষ্ট করছে না জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, জামায়াত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে। আলোচনা চলছে। সিদ্ধান্ত হলে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই করতে হবে এবং এ বিষয়ে মনোযোগ দিতেই হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশন, উপেজলা ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করেছে। যে কারণে স্থানীয় সরকারের কাছে জনগণের অনেক সেবা পেতে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। অতীতের অভিজ্ঞতায় যেটা দেখেছি, যখন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়, তখন সেখানে পুরোপুরি সে দলের লোকদের কাছে জনগণ জিম্মি হয়ে যায়। অনেকে নমিনেশন পেপারও সাবমিট করতে পারে না। এছাড়া দলীয় এমপিদের আলাদা একটা বলয় তৈরি হয়। এতে করে মানুষের মনে একটা ভিন্ন বার্তা যায় যে, এরা না হলে কাজ করতে পারবে না। এখন যেহেতু পরিবর্তন হয়েছে, যদি স্থানীয় নির্বাচন একটা নিরপেক্ষ পরিবেশে হয়, তা মন্দ হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের একটা সময়সীমা দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে অথবা ২৬ সালের শুরুতে। এই সময়সীমা ঠিক করে আগেই যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে ফেলতে পারে তাহলে মনে হয় তা সম্ভব।

এদিকে এই ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে একমত মিত্র রাজনৈতিক দলও। এই সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন চায় না বাম গণতান্ত্রিক জোটও। ৬ দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। আর ১৬ বছর মানুষ যেই নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ম্যান্ডেট বা কর্তব্য হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা দায়িত্ব নয়। সাধারণত একটা রাজনৈতিক সরকার আসলে তারাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করে। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত কোনো তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল বা জনগণের পক্ষ থেকেও এমন দাবি করা হয়নি।

তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে খুব আকস্মিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বক্তব্য পেলাম। আমি মনে করি এই দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের নয়। সরকারের এটা করার পেছনে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আবার বিশেষ কোনো রাজনৈতিক অংশ বা মহলকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়ার জন্য তারা এই ধরনের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের কথা ভাবছেন কিনা এই প্রশ্নটাও কিন্তু দেখা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তখন তাদের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিও থাকবে।’

ছয়দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন আমাদের এখন এজেন্ডা নয়। আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। হঠাৎ করে স্থানীয় নির্বাচনের কথা কেন বললেন তা আমাদের কাছে একটা বড় প্রশ্ন। আর আমরা জাতীয় নির্বাচনের কথা বললেই উনারা সংস্কারের কথা বলেন। যদিও আমরা বলেছি ভালো নির্বাচনের জন্য যা যা সংস্কার করা দরকার তা করতে হবে। ইতোমধ্যে জনমনে এই প্রশ্নে আশঙ্কা আসছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার উদ্দেশ্য হবে প্রকৃতপক্ষে জাতীয় নির্বাচনকে কালবিলম্ব করা। আমরা মনে করি কালবিলস্ব না করে অবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত। তা না হলে যদি সংকটে পড়ে তাহলে গণ-অভ্যুত্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সুতরাং স্থানীয় সরকার নির্বাচন এই মুহূর্তে কোনো এজেন্ডা মনে করছি না। এই মুহূর্তে প্রধান এজেন্ডা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করে ওই পথেই এগেনো উচিত। ’

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার কোনো প্রয়োজন নেই। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করাই হচ্ছে সরকারের কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ এই সরকার সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সব সময়ই নির্বাচিত সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন না করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে যাওয়াটাও জাতীয় নির্বাচনকে প্রলম্বিত করা, কিংস পার্টিকে সহায়তা করা। এবং জনমনে বিভিন্ন সন্দেহ তৈরি করা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কারও দাবিও ছিল না। সুতরাং আমার মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কিছু চিন্তা না করে, কোনো সন্দেহের উদ্রেক না করে কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকাটাই মঙ্গল এবং যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল।’

১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘এই সরকারের কাজ হচ্ছে আরেকটা জাতীয় নির্বাচন দিয়ে নতুন নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেওয়া। মানুষ ১৬ বছর ধরে ভোট দিতে পারেনি। তারা তো জাতীয় নির্বাচনের ভোট চায়। স্থানীয় সরকারের ভোট করবে নির্বাচিত সরকার। এটা তো অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে। যে যাই বলুক, আমার ধারণা সরকার এই পথে হাঁটবে না।’ এছাড়া বিএনপির মিত্র আরও অন্তত দশটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে একই মতামত পাওয়া গেছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন ভিন্নমত বিএনপিসহ বেশির ভাগ দলের

আপডেট টাইম : ২ ঘন্টা আগে

অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন চায় না ফ্যাসিবাদবিরোধী আন্দোলনে যুক্ত বিএনপিসহ বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল। এ সরকারের প্রধান দায়িত্ব ও কর্তব্য হওয়া উচিত সুষ্ঠু ও নিরপেক্ষ জাতীয় নির্বাচনকে ফোকাস করা। এমন অভিপ্রায় জানিয়ে দলগুলোর শীর্ষ নেতারা বলছেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন কারও দাবিও ছিল না। তাছাড়া এই ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন হওয়ার কোনো নজিরও নেই। ১৫ বছর ধরে নিরপেক্ষ সরকারের অধীনে জাতীয় নির্বাচনের দাবিতে তারা আন্দোলন করেছে। সুতরাং অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কিছু চিন্তা করা সমীচীন হবে না। বরং কোনো সন্দেহের উদ্রেক হয় এমন কোনো সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকাটাই মঙ্গল। নেতারা এ-ও মনে করেন, স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে গিয়ে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তখন তাদের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচনও প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকি থাকবে। সুতরাং তাদের ধারণা, সরকার এই পথে হাঁটবে না। বৃহস্পতিবার বিএনপিসহ চারটি জোট ও অন্তত ২০টি দলের শীর্ষ নেতারা যুগান্তরের কাছে প্রায় অভিন্ন এমন প্রতিক্রিয়া করেন।

তবে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী এই ইস্যুতে তাদের অবস্থান এখনো স্পষ্ট করেনি। অপরদিকে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ জানিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হলে মন্দ হবে না।

বুধবার অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস জানিয়েছেন, জাতীয় নির্বাচনের পাশাপাশি স্থানীয় নির্বাচনের প্রস্তুতি নিচ্ছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর আগে গত ৬ জানুয়ারি রাজধানীতে গণমাধ্যমকর্মীদের সঙ্গে মতবিনিময় করে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন। সেখানে কমিশনের প্রধান ড. তোফায়েল আহমেদ বলেন, জাতীয় পর্যায়ে সংসদ নির্বাচন নিয়ে আলোচনা হলেও ঢাকার বাইরে মানুষের মতামতে স্থানীয় সরকার নির্বাচন প্রাধান্য পাচ্ছে। রাজনৈতিক দলগুলোর স্থানীয় পর্যায়ের নেতাদের মধ্যেও এমন মতামত আছে। ঢাকার বাইরে মতবিনিময় করতে গিয়ে স্থানীয় সরকার সংস্কার কমিশন এ চিত্র পাচ্ছে বলে গণমাধ্যমের কাছে দাবি করেন। এর আগে নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার কমিশনের একাধিক মতবিনিময়েও জাতীয় সংসদ নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার বিষয়ে পরামর্শ উঠে আসে।

সোমবার রাতে দেশের অন্যতম প্রধান রাজনৈতিক দল বিএনপির সর্বোচ্চ নীতিনির্ধারণী ফোরামের বৈঠক হয়। এতে নেতারা অভিমত দেন, অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে তারা স্থানীয় সরকার নির্বাচন চান না। দলটির অভিমত, এই ধরনের সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো নজির নেই। বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতির আলোকে জনআকাঙ্ক্ষাকে প্রাধান্য দিয়ে এখন সরকারের উচিত জাতীয় নির্বাচনের দিকে ফোকাস করা।

জানতে চাইলে বিএনপির জাতীয় স্থায়ী কমিটির সদস্য গয়েশ্বর চন্দ্র রায় যুগান্তরকে বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের মূল কাজ হচ্ছে নির্বাচনকালীন সংস্কার ও জাতীয় নির্বাচনকে গুরুত্ব দেওয়া। যদি তা না করে জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন নিয়ে ভাবে তাহলে সরকারের কার্যক্রম নিয়ে প্রশ্ন দেখা দেবে। কেউ কেউ প্রশ্ন তুলতে পারে এই সরকার জাতীয় নির্বাচনকে বিলম্বিত করে ক্ষমতায় আঁকড়ে থাকতে যাচ্ছে। অবশ্য আমরা মনে করি, এই সরকার তা করবে না।

বিএনপির কয়েকজন সিনিয়র নেতা জানান, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব জাতীয় নির্বাচনকে প্রাধান্য দেওয়া। নির্বাচন অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য করতে প্রয়োজনীয় সংস্কার ও ভোটার তালিকা হালনাগাদ করতে পারে। কিন্তু এর আগে কোনো অন্তর্বর্তী বা তত্ত্বাবধায়ক সরকার স্থানীয় নির্বাচন নিয়ে চিন্তা করেনি। নেতারা জানান, জনগণ দীর্ঘ ১৫ বছর ভোটাধিকার থেকে বঞ্চিত। ফ্যাসিবাদী সরকার নির্বাচন ব্যবস্থা বিলুপ্তের পর্যায়ে নিয়েছিল। অনেক সংগ্রাম, ত্যাগ, রক্তের বিনিময়ে স্বৈরাচারের পতন হয়েছে। স্থিতিশীলতা তৈরিতে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় ফিরতে হবে। তাই দ্রুত জাতীয় নির্বাচন দরকার।

তবে স্থানীয় নির্বাচন আগে চায় কিনা তা এখনো স্পষ্ট করছে না জামায়াতে ইসলামী। দলটির সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল হালিম বলেন, জামায়াত বিষয়টি গুরুত্বের সঙ্গে পর্যালোচনা করছে। আলোচনা চলছে। সিদ্ধান্ত হলে তা আনুষ্ঠানিকভাবে জানানো হবে।

তবে অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হওয়ার পক্ষে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। দলটির মুখপাত্র ও সিনিয়র যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান বলেন, জাতীয় নির্বাচন অবশ্যই করতে হবে এবং এ বিষয়ে মনোযোগ দিতেই হবে। কিন্তু বর্তমান সরকার ইতোমধ্যে সিটি করপোরেশন, উপেজলা ও পৌরসভার জনপ্রতিনিধিদের অপসারণ করেছে। যে কারণে স্থানীয় সরকারের কাছে জনগণের অনেক সেবা পেতে নানা ধরনের সমস্যা হচ্ছে। অতীতের অভিজ্ঞতায় যেটা দেখেছি, যখন কোনো দলীয় সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচন হয়, তখন সেখানে পুরোপুরি সে দলের লোকদের কাছে জনগণ জিম্মি হয়ে যায়। অনেকে নমিনেশন পেপারও সাবমিট করতে পারে না। এছাড়া দলীয় এমপিদের আলাদা একটা বলয় তৈরি হয়। এতে করে মানুষের মনে একটা ভিন্ন বার্তা যায় যে, এরা না হলে কাজ করতে পারবে না। এখন যেহেতু পরিবর্তন হয়েছে, যদি স্থানীয় নির্বাচন একটা নিরপেক্ষ পরিবেশে হয়, তা মন্দ হয় না। সরকারের পক্ষ থেকে জাতীয় নির্বাচনের একটা সময়সীমা দেওয়া হয়েছে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যে অথবা ২৬ সালের শুরুতে। এই সময়সীমা ঠিক করে আগেই যদি স্থানীয় সরকার নির্বাচন করে ফেলতে পারে তাহলে মনে হয় তা সম্ভব।

এদিকে এই ইস্যুতে বিএনপির সঙ্গে একমত মিত্র রাজনৈতিক দলও। এই সরকারের অধীনে স্থানীয় নির্বাচন চায় না বাম গণতান্ত্রিক জোটও। ৬ দলীয় জোট গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক যুগান্তরকে বলেন, ‘সরকারের প্রধান দায়িত্ব হচ্ছে জাতীয় নির্বাচন অনুষ্ঠিত করা। আর ১৬ বছর মানুষ যেই নির্বাচনের জন্য অপেক্ষা করছে, অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান ম্যান্ডেট বা কর্তব্য হচ্ছে জাতীয় নির্বাচনের মধ্য দিয়ে নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। তাদের স্থানীয় সরকার নির্বাচন করা দায়িত্ব নয়। সাধারণত একটা রাজনৈতিক সরকার আসলে তারাই স্থানীয় সরকারের নির্বাচন করে। আমাদের দেশে এ পর্যন্ত কোনো তত্ত্বাবধায়ক বা অন্তর্বর্তী সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের কোনো উদ্যোগ গ্রহণ করেনি। এছাড়া কোনো রাজনৈতিক দল বা জনগণের পক্ষ থেকেও এমন দাবি করা হয়নি।

তিনি বলেন, ‘সরকারের কাছ থেকে খুব আকস্মিকভাবে স্থানীয় সরকার নির্বাচনের বক্তব্য পেলাম। আমি মনে করি এই দায়িত্ব অন্তর্বর্তী সরকারের নয়। সরকারের এটা করার পেছনে ক্ষমতাকে দীর্ঘায়িত করা নিয়ে প্রশ্ন উঠবে। আবার বিশেষ কোনো রাজনৈতিক অংশ বা মহলকে বাড়তি কোনো সুবিধা দেওয়ার জন্য তারা এই ধরনের স্থানীয় সরকারের নির্বাচনের কথা ভাবছেন কিনা এই প্রশ্নটাও কিন্তু দেখা দিয়েছে। সেক্ষেত্রে সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হবে। আর সরকারের নিরপেক্ষতা প্রশ্নবিদ্ধ হলে তখন তাদের অধীনে আগামী জাতীয় নির্বাচন প্রশ্নবিদ্ধ হওয়ার ঝুঁকিও থাকবে।’

ছয়দলীয় বাম গণতান্ত্রিক জোটের শীর্ষ নেতা বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, ‘স্থানীয় সরকার নির্বাচন আমাদের এখন এজেন্ডা নয়। আমরা পরিষ্কারভাবে বলেছি, ১৫ জানুয়ারির মধ্যে জাতীয় নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করতে হবে। হঠাৎ করে স্থানীয় নির্বাচনের কথা কেন বললেন তা আমাদের কাছে একটা বড় প্রশ্ন। আর আমরা জাতীয় নির্বাচনের কথা বললেই উনারা সংস্কারের কথা বলেন। যদিও আমরা বলেছি ভালো নির্বাচনের জন্য যা যা সংস্কার করা দরকার তা করতে হবে। ইতোমধ্যে জনমনে এই প্রশ্নে আশঙ্কা আসছে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার উদ্দেশ্য হবে প্রকৃতপক্ষে জাতীয় নির্বাচনকে কালবিলম্ব করা। আমরা মনে করি কালবিলস্ব না করে অবিলম্বে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করা উচিত। তা না হলে যদি সংকটে পড়ে তাহলে গণ-অভ্যুত্থানও প্রশ্নবিদ্ধ হবে। সুতরাং স্থানীয় সরকার নির্বাচন এই মুহূর্তে কোনো এজেন্ডা মনে করছি না। এই মুহূর্তে প্রধান এজেন্ডা হচ্ছে জাতীয় সংসদ নির্বাচনের সুনির্দিষ্ট তারিখ ঘোষণা করে ওই পথেই এগেনো উচিত। ’

১২ দলীয় জোটের মুখপাত্র ও বাংলাদেশ এলডিপির চেয়ারম্যান শাহাদাত হোসেন সেলিম বলেন, ‘জাতীয় নির্বাচনের আগে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করার কোনো প্রয়োজন নেই। জাতীয় নির্বাচন সুষ্ঠুভাবে করাই হচ্ছে সরকারের কঠিন চ্যালেঞ্জ। কারণ এই সরকার সর্বত্র নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠা করতে পারেনি। সব সময়ই নির্বাচিত সরকারের অধীনে স্থানীয় সরকারের নির্বাচন হয়ে আসছে। এই মুহূর্তে জাতীয় নির্বাচন না করে স্থানীয় সরকার নির্বাচন করতে যাওয়াটাও জাতীয় নির্বাচনকে প্রলম্বিত করা, কিংস পার্টিকে সহায়তা করা। এবং জনমনে বিভিন্ন সন্দেহ তৈরি করা। স্থানীয় সরকার নির্বাচন কারও দাবিও ছিল না। সুতরাং আমার মনে হয় অন্তর্বর্তী সরকারের অন্য কিছু চিন্তা না করে, কোনো সন্দেহের উদ্রেক না করে কোনো বিতর্কিত সিদ্ধান্ত থেকে দূরে থাকাটাই মঙ্গল এবং যত দ্রুত জাতীয় নির্বাচনের তারিখ ঘোষণা করবে ততই জাতির জন্য মঙ্গল।’

১১ দলীয় জাতীয়তাবাদী সমমনা জোটের সমন্বয়ক ও এনপিপির চেয়ারম্যান ড. ফরিদুজ্জামান ফরহাদ বলেন, ‘এই সরকারের কাজ হচ্ছে আরেকটা জাতীয় নির্বাচন দিয়ে নতুন নির্বাচিত সরকারের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর করে দেওয়া। মানুষ ১৬ বছর ধরে ভোট দিতে পারেনি। তারা তো জাতীয় নির্বাচনের ভোট চায়। স্থানীয় সরকারের ভোট করবে নির্বাচিত সরকার। এটা তো অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব নয়। স্থানীয় সরকার নির্বাচন করলে জাতীয় নির্বাচন বিলম্বিত হবে। যে যাই বলুক, আমার ধারণা সরকার এই পথে হাঁটবে না।’ এছাড়া বিএনপির মিত্র আরও অন্তত দশটি রাজনৈতিক দলের কাছ থেকে একই মতামত পাওয়া গেছে।