ঢাকা , বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

নারী নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তি হোক

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  নারীকে নিরাপদ রাখার জন্য দেশের আইন-কানুনই সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন পালন এটাকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে পারে। পরিবারকেও আরও সচেতন হতে হবে। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো সবসময় বিপজ্জনক। যে দেশে নারীর অবমাননার শাস্তি যত কঠিন এবং দ্রুত প্রয়োগযোগ্য, সে দেশে নারী তত নিরাপদ, নারী নির্যাতন তত কম
‘আদমেরে কইয়া দিছো গন্ধম তুমি খাইও না, গন্ধমেরে কইয়া দিছো আদমেরে ছুঁইয়ো না’- বহুল জনপ্রিয় একটি গানের কলি। আদম সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মহান সৃষ্টিকর্তা ভাবলেন তার একজন সঙ্গী দরকার। তাই সৃষ্টি করলেন বিবি হাওয়াকে, যাকে দিলেন একজন নারীর রূপ। দুইজনের দৈহিক-মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্য আলাদা। সৃষ্টির পরে তাদের বেহেশতে থাকতে দিলেন। মহান প্রভু শুধু একটি সাবধান বাণী উচ্চারণ করলেন- ‘গন্ধমবৃক্ষের কাছে যাবে না।’ কিন্তু আদম-হাওয়াকে তো আদতে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই প্রভু-আজ্ঞা অমান্য করে তারা গন্ধমবৃক্ষের কাছে গেলেন। নির্দেশ অমান্যের শাস্তি হিসেবে বিতাড়িত হলেন স্বর্গ থেকে।
আজ থেকে ৮০ বছর আগে নোয়াখালীর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম আবদুল জলিল হেডমাস্টার বিয়ের দর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন-
On the occasion of the happy Wedlock of my nephew Mvi. Md. Aminullah with Mossammat Afia Khatun Philosophy of Marriage.
Marriage is not a conventional convenience of society, but it is a moral something, tempered under the heat of the furnace of religion and hammered at the anvil of the heart under the beat of cultured rationality, as such a true marriage is an asset for the attainment of perfection. [বিয়ে সমাজের সনাতন কোনো সুবিধা নয়। তবে এটি একটি নৈতিক বিষয়, যা ধর্মীয় চুল্লির উত্তাপের (অনুশাসনের) মিশ্রণে উষ্ণায়িত এবং হৃদয়ের যৌক্তিক সাংস্কৃতিক লয়ে পরিশীলিত। এ ধরনের একটি সত্যিকার বিয়ে পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ।]
আমরা দেখতে পাই, বিয়েকে তিনি Marriage না বলে Wedlock বলেছেন। আমরা জানি lock অর্থ তালা, যা আমরা ঘরে, অফিসে, দোকানে প্রভৃতি স্থানে ব্যবহার করি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তদ্রুপ বিয়ে হচ্ছে এমন একটি প্রথা, যা নারী-পুরুষ দুইজনকে একত্রিত করে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে। যেখানে সে নারী শুধু ওই পুরুষের ভোগ্যা, অন্য কারও নয়। ১৯৩৭ সালের ১০ অক্টোবর আবদুল জলিল তার বন্ধুপ্রতিম ভাগ্নের বিয়েতে উপঢৌকন হিসেবে এ অমোঘ বাণী লিখেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার শক্তিশালী পথনির্দেশনা। নীতিনৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের মিশেলে নারী-পুরুষের বৈধ মিলনের এক চমৎকার দলিল।
বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-গোত্রের বিয়ের সংস্কৃতি আলাদা। সাধারণত ধর্মীয় রীতি অনুসরণপূর্বক যে বিয়ে হয়, তা সর্বোচ্চ বৈধ বিয়ে। আবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হলফনামা দিয়ে এক ধরনের বিয়ে হয়, যা কোর্টম্যারেজ নামে পরিচিত। এর বাইরে এক ধরনের বিয়ে আছে, যা সাধারণত সিনেমা-নাটকে দেখা যায়। প্রেমিক-প্রেমিকা নদীতীরে বটবৃক্ষের শীতল ছায়ায় বসে বলে থাকে- ‘সাক্ষী থাইকো বটবৃক্ষ/সাক্ষী গাঙের পানি/দেহ-প্রাণ দিছি তারে স্বামী বলে মানি।’ তবে একটি বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছে যে, সম্মতি ছাড়া কোনো পুরুষ কোনো নারীকে জোরপূর্বক ভোগ করতে পারবে না। এরকমটি হলে তা ধর্ষণ বা রেপের আওতায় পড়বে, যা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যেও ধর্ষণ একটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আরবে ধর্ষণের শাস্তি পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ইদানীং আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। একাধিক সন্তানের জননী থেকে তিন বছরের শিশুও রেহাই পাচ্ছে না। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে গেল ২৭ মাসে ৮ হাজার ৪৬৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৯৩০টি, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৭২৮টি এবং এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৮০৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ পরিসংখ্যান রাজধানী, জেলা-উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত। বর্তমানে সারা দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের লক্ষাধিক মামলা ঝুলে আছে। বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩.৬৬ শতাংশ মামলা। এসব মামলায় সাজার পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। পরিসংখ্যানের বাইরে লোকলজ্জা, সামাজিক প্রভাব ও প্রভাবশালীদের হুমকিতে আরও কত ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায়, তার হিসাব কেউ রাখে না। তবে নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় মিলিত হলে তা অনাচার-পাপ-অনৈতিক বলে বিবেচিত হবে। এটি প্রচার বা প্রকাশ হয়ে পড়লে তা নিন্দনীয়, ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজধানীতে ইদানীং লিভটুগেদার নামে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কথা শোনা যায়। শোনা যায়, সমকামিতার মতো জঘন্য পাপাচারের কথা এবং তার সপক্ষেও সরব সহানুভূতি! এছাড়া পরকীয়া পাপাচার আজ শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্রই। অনৈতিক এ সম্পর্কের বলি হচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশু। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হত্যা অবধি গড়াচ্ছে।
আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম কখনোই এসব অনুমোদন দেয় না। ইসলামী সমাজে বিয়ে ছাড়া কোনো নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় মিলিত হলে তা ব্যভিচার বা জেনা নামক মহাপাপ হিসেবে গণ্য এবং এতে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। পবিত্র ধর্ম ইসলামে নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে এবং নারীর অধিকার সর্বতোভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও নারীরা আজ সর্বক্ষেত্রে মর্যাদার আসনে আসীন। নারীর ক্ষমাতয়নে বিশ্বে বাংলাদেশ একটি মডেল। সে বাংলাদেশে খোদ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনা ঘটেছে; আর জাতি হিসেবে আমাদের তা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখ ও লজ্জাজনক আর কিছু নেই। কিন্তু কেন এমন ঘটনা ঘটছে? সমাজ গবেষক বা নিরাপত্তা গবেষক কারও কোনো মন্তব্য নেই। আসলে মন্তব্য করার মতো তেমন কোনো ভাষা কারও কাছেই নেই। মধ্যরাতে একাকী গভীর অরণ্যে বিষধর সাপ, জীবজন্তুর হামলার আশঙ্কা থাকে, এটা কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। স্বাভাবিক নিরাপত্তাবোধ থেকেই তা অনুভূত হয়। সেদিন বনানীর হোটেল রেইনট্রি কোনো হোটেল ছিল না, সেটি ছিল এক গভীর অরণ্য। সেখানে সাফাত, সাকিফ, নাঈম, বেলাল ও রহমত নামের যুবকরা মানুষ ছিল না, ছিল হিংস্র হায়েনা। তাই যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। মেয়েগুলোর কাকুতি-মিনতি, আর্তচিৎকার কেউ কানে নেয়নি। পশুরা মানুষের কথা বোঝে না। কী করেনি তারা? দলবদ্ধভাবে উপর্যুপরি ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, ভিডিওচিত্র ধারণ এবং সবশেষে ফিনিশিং টাচ হিসেবে জোরপূর্বক জন্মনিরোধক ট্যাবলেট সেবন করানো। কোনো ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে ওই মেয়েগুলোকে ক্রীতদাসী বানানোর শান্তিপূর্ণ সমাধান!
প্রশ্ন হলো- কেন সাফাত-সাকিফ-নাঈম এত শক্তিশালী? এত ক্ষমতাবান? এত নির্ভীক? তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়? বাংলাদেশ আজ নব্য ধনীদের অপসংস্কৃতির অবাধ লীলাভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সর্বত্রই তাদের বল্গাহীন দাপট। একটি স্বাধীন দেশে এটি কোনোক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত-আব্রুর বিনিময়ে আমরা এ দেশ চাইনি। সময় এসেছে এদের কঠোর হাতে দমন করার। অন্যদিকে আমাদের মেয়েগুলোরও কী হয়েছে? মধ্যরাতে বন্ধুর জন্মদিনে হোটেলে যেতে হবে কেন? যাওয়ার সময় কি বাবা-মা বা অভিভাবককে বলে গেছে? ইত্যাকার নানা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। পাশ্চাত্যের উগ্র সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ, প্রযুক্তির সহজপ্রাপ্যতা ও অপব্যবহার হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমাদের তরুণ ও যুব সমাজকে কে রক্ষা করবে, তার কোনো উত্তর কেউ দিতে পারছে না। আবার এসব নিয়ে লেখালেখিতে ঝুঁকিও আছে।
উৎপাদন, উন্নয়ন, কর্মমুখর একটি গতিশীল সমাজ-রাষ্ট্রে অপরাধবৃত্তিও সমান তালে চলে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তা নিবৃত্ত করা। সরকার এক্ষেত্রে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গি তৎপরতা থেকে শুরু করে সব অপরাধেরই বিচার হচ্ছে, শাস্তি হচ্ছে। তবু কিছু কিছু অসৎ কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কোনো কোনো অপরাধের বিচার বিলম্বিত হচ্ছে; অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না। ফলে এ সমাজ-রাষ্ট্রে বিচারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে ধর্ষিতা মেয়েসহ অসহায় বাবা ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দেন। এ নীরব প্রতিবাদ ও আত্মত্যাগের ভাষা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। জনগণ চায় হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ মারাত্মক অপরাধের বিচার সর্বোচ্চ কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি, বিচারিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করা হোক। পৃথিবীর সব দেশেই অপরাধ ঘটে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু প্রয়োজন অপরাধ দমনে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের দক্ষতা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি। প্রভাবমুক্ত হয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ। এছাড়া দ্রুততম সময়ে বিচারকাজ সম্পন্ন করা। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা সবসময় অপরাধীর পক্ষে যায়। এটা নিরসন আজ সময়ের দাবি।
নারীকে নিরাপদ রাখার জন্য দেশের আইন-কানুনই সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন পালন এটাকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে পারে। পরিবারকেও আরও সচেতন হতে হবে। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো সবসময় বিপজ্জনক। যে দেশে নারীর অবমাননার শাস্তি যত কঠিন এবং দ্রুত প্রয়োগযোগ্য, সে দেশে নারী তত নিরাপদ, নারী নির্যাতন তত কম। আরব দেশগুলো তার প্রমাণ। আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে কৌটিল্যের জমানায়ও কোনো পুরুষ যদি কোনো গণিকাকেও ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলাৎকার করত, সে ক্ষেত্রে পুরুষের কঠিন শাস্তি ও বিপুল জরিমানার বিধান ছিল। আজ আমাদের প্রয়োজন নারী-শিশুসহ জনগণের জান-মান-ইজ্জত-আব্রু-সম্পদ-সুনাম রক্ষার্থে কঠোর আইন এবং তার দ্রুত প্রয়োগ।
আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে দ্রুতবেগে ধাবিত হচ্ছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম-বেশি দৃশ্যমান, যখন আমাদের মেয়েরা হিমালয় জয় করে, আমাদের মাশরাফি-মুস্তাফিজ-সাবিকরা বিশ্ব ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ায়, দারিদ্র্যবিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিশুমৃত্যুসহ যখন আমাদের অর্জন বিস্ময়কর, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যখন আমার প্রধানমন্ত্রী বিশ্বস্বীকৃতি পান, ঠিক তখন সাফাত-সাকিফ-নাঈমদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য, দম্ভ আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়। আমরা আর একটিও রেইনট্রি হোটেল বাংলাদেশে দেখতে চাই না। বাংলার মুক্ত ভূমিতে কখনও এদের অবাধ বিচরণ দেখতে চাই না। এরা পশু। এদের স্থান হবে জঙ্গলে-কারাগারে। যত ক্ষমতাবানই হোক, আইনের আওতা থেকে কেউ যেন পার না পেতে পারে।
রেইনট্রি হোটেলের ঘটনার এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি চাই, যাতে আগামীতে বাংলার বুকে আর কোনো সাফাত-সাকিফ-নাঈম জন্ম না নেয়। নারীর প্রতি সহিংস হওয়ার সাহস যেন কেউ না দেখায়। আমাদের নারী-শিশুরা যেন ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, মাঠে-ময়দানে, দিনে-রাতে সর্বত্র নিরাপদ থাকে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

নারী নির্যাতনকারীদের কঠোর শাস্তি হোক

আপডেট টাইম : ০৫:৫০ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ৪ অগাস্ট ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  নারীকে নিরাপদ রাখার জন্য দেশের আইন-কানুনই সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন পালন এটাকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে পারে। পরিবারকেও আরও সচেতন হতে হবে। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো সবসময় বিপজ্জনক। যে দেশে নারীর অবমাননার শাস্তি যত কঠিন এবং দ্রুত প্রয়োগযোগ্য, সে দেশে নারী তত নিরাপদ, নারী নির্যাতন তত কম
‘আদমেরে কইয়া দিছো গন্ধম তুমি খাইও না, গন্ধমেরে কইয়া দিছো আদমেরে ছুঁইয়ো না’- বহুল জনপ্রিয় একটি গানের কলি। আদম সৃষ্টির সঙ্গে সঙ্গে মহান সৃষ্টিকর্তা ভাবলেন তার একজন সঙ্গী দরকার। তাই সৃষ্টি করলেন বিবি হাওয়াকে, যাকে দিলেন একজন নারীর রূপ। দুইজনের দৈহিক-মনোজাগতিক বৈশিষ্ট্য আলাদা। সৃষ্টির পরে তাদের বেহেশতে থাকতে দিলেন। মহান প্রভু শুধু একটি সাবধান বাণী উচ্চারণ করলেন- ‘গন্ধমবৃক্ষের কাছে যাবে না।’ কিন্তু আদম-হাওয়াকে তো আদতে মানুষ হিসেবে সৃষ্টি করা হয়েছে। তাই প্রভু-আজ্ঞা অমান্য করে তারা গন্ধমবৃক্ষের কাছে গেলেন। নির্দেশ অমান্যের শাস্তি হিসেবে বিতাড়িত হলেন স্বর্গ থেকে।
আজ থেকে ৮০ বছর আগে নোয়াখালীর বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ মরহুম আবদুল জলিল হেডমাস্টার বিয়ের দর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে বলেছিলেন-
On the occasion of the happy Wedlock of my nephew Mvi. Md. Aminullah with Mossammat Afia Khatun Philosophy of Marriage.
Marriage is not a conventional convenience of society, but it is a moral something, tempered under the heat of the furnace of religion and hammered at the anvil of the heart under the beat of cultured rationality, as such a true marriage is an asset for the attainment of perfection. [বিয়ে সমাজের সনাতন কোনো সুবিধা নয়। তবে এটি একটি নৈতিক বিষয়, যা ধর্মীয় চুল্লির উত্তাপের (অনুশাসনের) মিশ্রণে উষ্ণায়িত এবং হৃদয়ের যৌক্তিক সাংস্কৃতিক লয়ে পরিশীলিত। এ ধরনের একটি সত্যিকার বিয়ে পরিপূর্ণতা অর্জনের ক্ষেত্রে অমূল্য সম্পদ।]
আমরা দেখতে পাই, বিয়েকে তিনি Marriage না বলে Wedlock বলেছেন। আমরা জানি lock অর্থ তালা, যা আমরা ঘরে, অফিসে, দোকানে প্রভৃতি স্থানে ব্যবহার করি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার লক্ষ্যে। তদ্রুপ বিয়ে হচ্ছে এমন একটি প্রথা, যা নারী-পুরুষ দুইজনকে একত্রিত করে একটি নিরাপত্তা বলয় তৈরি করে। যেখানে সে নারী শুধু ওই পুরুষের ভোগ্যা, অন্য কারও নয়। ১৯৩৭ সালের ১০ অক্টোবর আবদুল জলিল তার বন্ধুপ্রতিম ভাগ্নের বিয়েতে উপঢৌকন হিসেবে এ অমোঘ বাণী লিখেছিলেন, যার মধ্যে রয়েছে সামাজিক নিরাপত্তার শক্তিশালী পথনির্দেশনা। নীতিনৈতিকতা, সামাজিক মূল্যবোধ ও ধর্মীয় অনুশাসনের মিশেলে নারী-পুরুষের বৈধ মিলনের এক চমৎকার দলিল।
বিভিন্ন জাতি-ধর্ম-গোত্রের বিয়ের সংস্কৃতি আলাদা। সাধারণত ধর্মীয় রীতি অনুসরণপূর্বক যে বিয়ে হয়, তা সর্বোচ্চ বৈধ বিয়ে। আবার ম্যাজিস্ট্রেটের সামনে হলফনামা দিয়ে এক ধরনের বিয়ে হয়, যা কোর্টম্যারেজ নামে পরিচিত। এর বাইরে এক ধরনের বিয়ে আছে, যা সাধারণত সিনেমা-নাটকে দেখা যায়। প্রেমিক-প্রেমিকা নদীতীরে বটবৃক্ষের শীতল ছায়ায় বসে বলে থাকে- ‘সাক্ষী থাইকো বটবৃক্ষ/সাক্ষী গাঙের পানি/দেহ-প্রাণ দিছি তারে স্বামী বলে মানি।’ তবে একটি বিষয়ে সবাই ঐকমত্যে পৌঁছে যে, সম্মতি ছাড়া কোনো পুরুষ কোনো নারীকে জোরপূর্বক ভোগ করতে পারবে না। এরকমটি হলে তা ধর্ষণ বা রেপের আওতায় পড়বে, যা কঠিন শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হবে। এমনকি আফ্রিকার গহিন জঙ্গলে বসবাসকারী উপজাতিদের মধ্যেও ধর্ষণ একটি মারাত্মক অপরাধ হিসেবে বিবেচিত। আরবে ধর্ষণের শাস্তি পাথর নিক্ষেপে হত্যা করা। বাংলাদেশে ধর্ষণের ঘটনা ইদানীং আশঙ্কাজনক হারে বেড়ে চলেছে। একাধিক সন্তানের জননী থেকে তিন বছরের শিশুও রেহাই পাচ্ছে না। পুলিশ সদর দপ্তরের পরিসংখ্যান মতে, বাংলাদেশে গেল ২৭ মাসে ৮ হাজার ৪৬৩টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। ২০১৫ সালে ৩ হাজার ৯৩০টি, ২০১৬ সালে ৩ হাজার ৭২৮টি এবং এ বছর জানুয়ারি থেকে মার্চ পর্যন্ত ৮০৫টি ধর্ষণের ঘটনা ঘটে। এ পরিসংখ্যান রাজধানী, জেলা-উপজেলা ও গ্রাম পর্যায়ে বিস্তৃত। বর্তমানে সারা দেশে ধর্ষণ ও নারী নির্যাতনের লক্ষাধিক মামলা ঝুলে আছে। বছরে নিষ্পত্তি হচ্ছে মাত্র ৩.৬৬ শতাংশ মামলা। এসব মামলায় সাজার পরিমাণ ১ শতাংশেরও কম। পরিসংখ্যানের বাইরে লোকলজ্জা, সামাজিক প্রভাব ও প্রভাবশালীদের হুমকিতে আরও কত ধর্ষণের ঘটনা চাপা পড়ে যায়, তার হিসাব কেউ রাখে না। তবে নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় মিলিত হলে তা অনাচার-পাপ-অনৈতিক বলে বিবেচিত হবে। এটি প্রচার বা প্রকাশ হয়ে পড়লে তা নিন্দনীয়, ক্ষেত্রবিশেষে শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচিত হয়। রাজধানীতে ইদানীং লিভটুগেদার নামে পাশ্চাত্য সংস্কৃতির কথা শোনা যায়। শোনা যায়, সমকামিতার মতো জঘন্য পাপাচারের কথা এবং তার সপক্ষেও সরব সহানুভূতি! এছাড়া পরকীয়া পাপাচার আজ শহর-বন্দর-গ্রাম সর্বত্রই। অনৈতিক এ সম্পর্কের বলি হচ্ছে নারী-পুরুষ-শিশু। কোনো কোনো ক্ষেত্রে তা হত্যা অবধি গড়াচ্ছে।
আমাদের সমাজ-সংস্কৃতি-ধর্ম কখনোই এসব অনুমোদন দেয় না। ইসলামী সমাজে বিয়ে ছাড়া কোনো নারী-পুরুষ স্বেচ্ছায় মিলিত হলে তা ব্যভিচার বা জেনা নামক মহাপাপ হিসেবে গণ্য এবং এতে কঠোর শাস্তির বিধান রয়েছে। পবিত্র ধর্ম ইসলামে নারীকে সর্বোচ্চ মর্যাদা দেয়া হয়েছে এবং নারীর অধিকার সর্বতোভাবে সংরক্ষণ করা হয়েছে। বাংলাদেশেও নারীরা আজ সর্বক্ষেত্রে মর্যাদার আসনে আসীন। নারীর ক্ষমাতয়নে বিশ্বে বাংলাদেশ একটি মডেল। সে বাংলাদেশে খোদ রাজধানীর অভিজাত এলাকায় মধ্যযুগীয় বর্বর ঘটনা ঘটেছে; আর জাতি হিসেবে আমাদের তা প্রত্যক্ষ করতে হচ্ছে। এর চেয়ে দুঃখ ও লজ্জাজনক আর কিছু নেই। কিন্তু কেন এমন ঘটনা ঘটছে? সমাজ গবেষক বা নিরাপত্তা গবেষক কারও কোনো মন্তব্য নেই। আসলে মন্তব্য করার মতো তেমন কোনো ভাষা কারও কাছেই নেই। মধ্যরাতে একাকী গভীর অরণ্যে বিষধর সাপ, জীবজন্তুর হামলার আশঙ্কা থাকে, এটা কাউকে বুঝিয়ে বলতে হয় না। স্বাভাবিক নিরাপত্তাবোধ থেকেই তা অনুভূত হয়। সেদিন বনানীর হোটেল রেইনট্রি কোনো হোটেল ছিল না, সেটি ছিল এক গভীর অরণ্য। সেখানে সাফাত, সাকিফ, নাঈম, বেলাল ও রহমত নামের যুবকরা মানুষ ছিল না, ছিল হিংস্র হায়েনা। তাই যা ঘটার তা-ই ঘটেছে। মেয়েগুলোর কাকুতি-মিনতি, আর্তচিৎকার কেউ কানে নেয়নি। পশুরা মানুষের কথা বোঝে না। কী করেনি তারা? দলবদ্ধভাবে উপর্যুপরি ধর্ষণ, শারীরিক নির্যাতন, ভিডিওচিত্র ধারণ এবং সবশেষে ফিনিশিং টাচ হিসেবে জোরপূর্বক জন্মনিরোধক ট্যাবলেট সেবন করানো। কোনো ফাঁকফোকর রাখা যাবে না। স্বাধীন বাংলাদেশে ওই মেয়েগুলোকে ক্রীতদাসী বানানোর শান্তিপূর্ণ সমাধান!
প্রশ্ন হলো- কেন সাফাত-সাকিফ-নাঈম এত শক্তিশালী? এত ক্ষমতাবান? এত নির্ভীক? তাদের ক্ষমতার উৎস কোথায়? বাংলাদেশ আজ নব্য ধনীদের অপসংস্কৃতির অবাধ লীলাভূমিতে পরিণত হচ্ছে। সর্বত্রই তাদের বল্গাহীন দাপট। একটি স্বাধীন দেশে এটি কোনোক্রমেই মেনে নেয়া যায় না। ৩০ লাখ শহীদ ও ২ লাখ মা-বোনের ইজ্জত-আব্রুর বিনিময়ে আমরা এ দেশ চাইনি। সময় এসেছে এদের কঠোর হাতে দমন করার। অন্যদিকে আমাদের মেয়েগুলোরও কী হয়েছে? মধ্যরাতে বন্ধুর জন্মদিনে হোটেলে যেতে হবে কেন? যাওয়ার সময় কি বাবা-মা বা অভিভাবককে বলে গেছে? ইত্যাকার নানা প্রশ্ন স্বাভাবিকভাবেই এসে যায়। পাশ্চাত্যের উগ্র সংস্কৃতির অন্ধ অনুকরণ, প্রযুক্তির সহজপ্রাপ্যতা ও অপব্যবহার হিতে বিপরীত হয়ে যাচ্ছে। এ ভয়াবহ অবস্থা থেকে আমাদের তরুণ ও যুব সমাজকে কে রক্ষা করবে, তার কোনো উত্তর কেউ দিতে পারছে না। আবার এসব নিয়ে লেখালেখিতে ঝুঁকিও আছে।
উৎপাদন, উন্নয়ন, কর্মমুখর একটি গতিশীল সমাজ-রাষ্ট্রে অপরাধবৃত্তিও সমান তালে চলে। রাষ্ট্রের দায়িত্ব তা নিবৃত্ত করা। সরকার এক্ষেত্রে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে। জঙ্গি তৎপরতা থেকে শুরু করে সব অপরাধেরই বিচার হচ্ছে, শাস্তি হচ্ছে। তবু কিছু কিছু অসৎ কর্মকর্তা বা রাজনৈতিক প্রভাবের কারণে কোনো কোনো অপরাধের বিচার বিলম্বিত হচ্ছে; অপরাধী শাস্তি পাচ্ছে না। ফলে এ সমাজ-রাষ্ট্রে বিচারের প্রতি আস্থাহীন হয়ে ধর্ষিতা মেয়েসহ অসহায় বাবা ট্রেনের নিচে আত্মাহুতি দেন। এ নীরব প্রতিবাদ ও আত্মত্যাগের ভাষা রাষ্ট্রকে বুঝতে হবে। জনগণ চায় হত্যা, ধর্ষণ, অপহরণসহ মারাত্মক অপরাধের বিচার সর্বোচ্চ কম সময়ের মধ্যে সম্পন্ন করার লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় আইনি, বিচারিক ও প্রশাসনিক ব্যবস্থা দ্রুত নিশ্চিত করা হোক। পৃথিবীর সব দেশেই অপরাধ ঘটে। আমাদের দেশও ব্যতিক্রম নয়। কিন্তু প্রয়োজন অপরাধ দমনে সংশ্লিষ্ট সব কর্তৃপক্ষের দক্ষতা ও আন্তরিকতা বৃদ্ধি। প্রভাবমুক্ত হয়ে ত্বরিত পদক্ষেপ গ্রহণ। এছাড়া দ্রুততম সময়ে বিচারকাজ সম্পন্ন করা। বিচারের দীর্ঘসূত্রতা সবসময় অপরাধীর পক্ষে যায়। এটা নিরসন আজ সময়ের দাবি।
নারীকে নিরাপদ রাখার জন্য দেশের আইন-কানুনই সবচেয়ে বড় রক্ষাকবচ। একই সঙ্গে ধর্মীয় অনুশাসন পালন এটাকে অনেক বেশি শক্তিশালী করতে পারে। পরিবারকেও আরও সচেতন হতে হবে। গড্ডলিকা প্রবাহে গা ভাসানো সবসময় বিপজ্জনক। যে দেশে নারীর অবমাননার শাস্তি যত কঠিন এবং দ্রুত প্রয়োগযোগ্য, সে দেশে নারী তত নিরাপদ, নারী নির্যাতন তত কম। আরব দেশগুলো তার প্রমাণ। আজ থেকে প্রায় ২৫০০ বছর আগে কৌটিল্যের জমানায়ও কোনো পুরুষ যদি কোনো গণিকাকেও ইচ্ছের বিরুদ্ধে বলাৎকার করত, সে ক্ষেত্রে পুরুষের কঠিন শাস্তি ও বিপুল জরিমানার বিধান ছিল। আজ আমাদের প্রয়োজন নারী-শিশুসহ জনগণের জান-মান-ইজ্জত-আব্রু-সম্পদ-সুনাম রক্ষার্থে কঠোর আইন এবং তার দ্রুত প্রয়োগ।
আমরা যখন মধ্যম আয়ের দেশ থেকে উচ্চ আয়ের দেশে দ্রুতবেগে ধাবিত হচ্ছি, বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ছোঁয়া যখন দেশের প্রত্যন্ত অঞ্চলে কম-বেশি দৃশ্যমান, যখন আমাদের মেয়েরা হিমালয় জয় করে, আমাদের মাশরাফি-মুস্তাফিজ-সাবিকরা বিশ্ব ক্রিকেটে দাপিয়ে বেড়ায়, দারিদ্র্যবিমোচন, দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা, শিশুমৃত্যুসহ যখন আমাদের অর্জন বিস্ময়কর, নারীর ক্ষমতায়নের জন্য যখন আমার প্রধানমন্ত্রী বিশ্বস্বীকৃতি পান, ঠিক তখন সাফাত-সাকিফ-নাঈমদের সীমাহীন ঔদ্ধত্য, দম্ভ আমাদের সব অর্জনকে ম্লান করে দেয়। আমরা আর একটিও রেইনট্রি হোটেল বাংলাদেশে দেখতে চাই না। বাংলার মুক্ত ভূমিতে কখনও এদের অবাধ বিচরণ দেখতে চাই না। এরা পশু। এদের স্থান হবে জঙ্গলে-কারাগারে। যত ক্ষমতাবানই হোক, আইনের আওতা থেকে কেউ যেন পার না পেতে পারে।
রেইনট্রি হোটেলের ঘটনার এমন দৃষ্টান্তমূলক বিচার ও অপরাধীদের শাস্তি চাই, যাতে আগামীতে বাংলার বুকে আর কোনো সাফাত-সাকিফ-নাঈম জন্ম না নেয়। নারীর প্রতি সহিংস হওয়ার সাহস যেন কেউ না দেখায়। আমাদের নারী-শিশুরা যেন ঘরে-বাইরে, কর্মক্ষেত্রে, মাঠে-ময়দানে, দিনে-রাতে সর্বত্র নিরাপদ থাকে।