বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ অগ্নিকাণ্ডের দুর্ঘটনায় মৃত্যুর হার বাড়ছেই। অপরিকল্পিত নগরায়ণ, প্রয়োজনীয় জনসচেতনতার ঘাটতি ও অব্যবস্থাপনাকেই আগুনে মৃত্যুর প্রধান কারণ হিসেবে দেখছেন সংশ্লিষ্টরা। দিন দিন ফায়ার সার্ভিস অ্যান্ড সিভিল ডিফেন্সের কাজের পরিধি বাড়লেও বাড়েনি উপযোগী সক্ষমতা ও সুযোগ-সুবিধা। এ কারণে দুর্ঘটনার আশঙ্কা বাড়ছেই। জনবল সংকট, সরঞ্জাম থাকলেও প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত জনবলের অভাবসহ নানা সমস্যার কারণে অনেক ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধতা স্পষ্ট হয়ে উঠেছে বিশেষায়িত এই বাহিনীটির। ফলে ফায়ার সার্ভিসের পরিপূর্ণ সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন মানুষ। তবে সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিসে সেবার মান বাড়াতে নানামুখী উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। আনা হচ্ছে ২৫টি ডাবল বেডের বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স। ১ হাজার মোটরবাইক।
জানা গেছে, অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলায় শিগগিরই ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরে ১ হাজার বিশেষ মোটরবাইক যুক্ত হচ্ছে। দ্রুত ঘটনাস্থলে ছুটে আগুন নেভাতে সক্ষম দুই চাকাবিশিষ্ট এই যানটি দেশে আসছে। এটি অধিদফতরের মোটরবাইক ইউনিটে যুক্ত হবে। সম্প্রতি দুইটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টিটিএল ফায়ার সার্ভিসের যানবাহন বহরে যুক্ত হয়েছে। সুউচ্চ মইযুক্ত এই গাড়িটি বহরে যুক্ত হওয়ায় অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা আরো এক ধাপ এগোলো। আর আগের ১৫০টি টু হুইলারের (মোটরবাইক) সঙ্গে নতুন ১ হাজার গাড়ি যুক্ত হলে অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলায় নিঃসন্দেহে গতি আসবে ফায়ার সার্ভিসে। এছাড়া ওয়াটার রেসিস্ট্যান্স ভেহিকেল, ২৫টি ডাবল বেডের বিশেষ অ্যাম্বুলেন্স, ২০ হাজার লিটার পানি ধারণে সক্ষম গাড়িও যুক্ত হয়েছে।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, মর্ডানাইজেশন প্রকল্পের আওতায় এরই মধ্যে ১ হাজার টু হুইলার ক্রয় করা হয়েছে। চীনের তৈরি এসব হুইলারের শিপমেন্টও শেষ হয়েছে। ২৫০ সিসির এসব টু হুইলার আগামী মাসের মধ্যেই ফায়ার সার্ভিসের গাড়ি বহরে যুক্ত হতে যাচ্ছে। টু হুইলারগুলোতে ২০ লিটার করে পানি ও ফোম থাকবে। এগুলো পাহাড়ি অঞ্চল, বালি ও কর্দমাক্ত রাস্তাসহ যেকোনো খারাপ রাস্তায় চলাচলের উপযুক্ত। নতুন এই মোটরবাইকগুলো কারণে ছোট ছোট অগ্নিকাণ্ড নির্বাপণ অনেক সহজ হবে। বিশেষ করে সরু সড়কে লাগা আগুন নির্বাপণে এগুলো বেশি কার্যকর। কারণ সেখানে বড় যানবাহন চলাচলে অসুবিধা হয়। প্রতিটি হুইলারকে একটি করে ইউনিট বলে গণনা করা হয়।
ফায়ার সার্ভিসের সহকারী যোগাযোগ প্রকৌশলী মো. আক্তারুজ্জামান বলেন, অগ্নি দুর্ঘটনা মোকাবিলায় ও সক্ষমতা বাড়াতে চীন থেকে ১ হাজার টু হুইলার আমদানি করা হচ্ছে। এক মাসের মধ্যে গাড়িগুলো দেশে পৌঁছাবে। বড় যানবাহন যেসব সড়কে প্রবেশ করতে পারে না সেসব সড়কে এসব টু হুইলার বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখবে। প্রত্যেকটি হুইলারে ৪০ লিটার পানি ও ফোম থাকে। যা দিয়ে একটি ছোট অগ্নিকান্ডের ঘটনা নির্বাপণ সম্ভব। এগুলো যুক্ত হলে ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা অনেক বেড়ে যাবে। তিনি আরো বলেন, সম্প্রতি ফায়ার সার্ভিসে ৬৪ মিটার পর্যন্ত কাজে সক্ষমতা সম্পন্ন দুইটি টিটিএল যুক্ত হয়েছে। এটি দিয়ে ২০৯ ফুট পর্যন্ত উঁচুস্থানে কাজ করা সম্ভব।
ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, মর্ডানাইজেশন প্রকল্পের আওতায় দুইটি উচ্চক্ষমতা সম্পন্ন টিটিএল (টার্ন টেবল লেডার বা সুউচ্চ মইযুক্ত গাড়ি) এরই মধ্যে অধিদফতরে যুক্ত হয়েছে। একই প্রকল্পের আওতায় ৪টি ২০ হাজার লিটার পানবাহী গাড়িও যুক্ত হয়েছে। এছাড়া সম্প্রতি ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় উদ্ধার সরঞ্জামসংবলিত ১১টি ইমার্জেন্সি টেন্ডার ফায়ার সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে। আরো ১১টি যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। এছাড়া ৬টি ওয়াটার রেসিস্ট্যান্স ভেহিকেল যুক্ত হয়েছে। কিন্তু আধুনিক এসব সরঞ্জাম এখনই ব্যবহৃত হচ্ছে না। এর জন্য সরঞ্জামগুলোর চালকসহ সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপর এগুলোর ব্যবহার শুরু হবে। শিগগিরই ৫ দিনব্যাপী একটি বিশেষ প্রশিক্ষণ কর্মশালা শুরু হওয়ার কথা রয়েছে। সূত্র জানায়, গণপূর্তের আওতায় জাইকার সহায়তায় আরো একটি ২০ হাজার লিটার পানিবাহী গাড়ি ও ৫৭ মিটার উচ্চ একটি এরিয়াল প্লাটফর্ম লেডার যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে।
জানা গেছে, ঢাকা উত্তর সিটি করপোরেশনের আরবান রেজিলিয়েন্স প্রকল্পের আওতায় বিশ্ব ব্যাংকের সহায়তায় ৬টি ট্রাক ফায়ার সার্ভিসে যুক্ত হয়েছে। ফায়ার সার্ভিস সূত্র জানায়, দুর্যোগ-দুর্ঘটনায় জীবন ও সম্পদ রক্ষার মাধ্যমে নিরাপদ বাংলাদেশ গড়ে তোলার মিশন নিয়ে এগিয়ে চলা ফায়ার সার্ভিসের ভিশন হচ্ছে অগ্নিকান্ডসহ সব দুর্যোগ মোকাবিলায় এশিয়ার অন্যতম শ্রেষ্ঠ প্রতিষ্ঠান হিসেবে সক্ষমতা অর্জন করা। এটি করতে হলে প্রয়োজন আধুনিক সরঞ্জামাদিসহ অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা। ভিশন বাস্তবায়নের অংশ হিসেবেই অধিদফতরে একের পর আধুনিক বিভিন্ন সরঞ্জাম যুক্ত করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরো হবে। এসব সরঞ্জাম যুক্ত হওয়ায় অগ্নিকান্ডসহ যেকোনো দুর্যোগ মোকাবিলায় ফায়ার সার্ভিসের সক্ষমতা অনেক বেড়েছে।
ফায়ার সার্ভিস ও সিভিল ডিফেন্স অধিদফতরের উপপরিচালক (পরিকল্পনা) অজিত কুমার ভৌমিক বলেন, ফায়ার সার্ভিসকে আধুনিকায়নে কাজ চলছে। এরই অংশ হিসেবে কিছু উন্নত প্রযুক্তির সরঞ্জাম এরই মধ্যে অধিদফতরে যুক্ত হয়েছে। আরো কিছু যুক্ত হওয়ার প্রক্রিয়ায় রয়েছে। যুক্ত হওয়া সরঞ্জামগুলো পরিচালনার জন্য সংশ্লিষ্টদের প্রশিক্ষণ দেওয়া হবে। এরপরই এসব সরঞ্জাম ব্যবহার করা হবে। এরই মধ্যে ২৫টি ডাবল বেডের অ্যাম্বুলেন্স ক্রয় করা হয়েছে। স্বল্পমূল্যে ভাড়া পরিশোধ করে সাধারণ মানুষও তা ব্যবহার করতে পারবে।
ফায়ার সার্ভিস সদর দফতরের তথ্যানুযায়ী, গত বছর সারা দেশে ১৮ হাজার ১০৫টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৪৫ জন। আহত হয়েছেন ২৮৭ জন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৫৭ কোটি ২৪ লাখ ৮৪ হাজার ৪৮৬ টাকা। উদ্ধারের পরিমাণ ১ হাজার ৩৪৮ কোটি ১৯ লাখ ৭৩ হাজার ৩১৯ টাকা।
অগ্নিকাণ্ডের মধ্যে বৈদ্যুতিক গোলযোগে সর্বাধিক ৩৯ শতাংশ, চুলার আগুনে ২০ শতাংশ ও সিগারেটের আগুনে ১৪ শতাংশ ঘটনা ঘটছে। এর আগে ২০১৬ সালে সারা দেশে ১৬ হাজার ৮৫৮টি অগ্নিকা-ের ঘটনা ঘটেছে। এতে নিহত হয়েছেন ৫২ জন। আহত হয়েছেন ২৪৭ জন। ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ ২৪০ কোটি ৪৩ লাখ ৪০ হাজার ৮২২ টাকা। উদ্ধারের পরিমাণ ১ হাজার ১৫৭ কোটি ৪ লাখ ১১ হাজার ৪৫৭ টাকা।
এদিকে চলতি বছরের ১ জানুয়ারি থেকে জুলাই পর্যন্ত সারা দেশে ৪ হাজার ৪৪৮টি অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটেছে। গত বছর ও এই বছরের পরিসংখ্যান থেকে দেখা যায়, দিন দিন অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে। তাই অগ্নি দুর্ঘটনা প্রতিরোধে ফায়ার সার্ভিসের পাশাপাশি জনসচেনতা বাড়ানোর তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
জানা গেছে, সারা দেশে ৩২৪টি ফায়ার সার্ভিস স্টেশন আছে। এর মধ্যে রাজধানীতেই আছে ১৫টি। মোট জনবলের সংখ্যা ৭ হাজার ৭৯৯ জন। রাজধানীর ১৫টি স্টেশনে আছে মাত্র ৫০০ কর্মী। যেখানে দরকার ১০ হাজার। এছাড়া ফায়ার সার্ভিসের সদর দফতরে ডুবুরি দল এবং অ্যাম্বুলেন্স থাকলেও মফস্বলে নেই এ সুবিধা। এমনকি দেশের অনেক উপজেলায় এখনো স্থাপিত হয়নি কোনো ফায়ার স্টেশন। যদিও আগুন নেভানো ছাড়াও সব ধরনের দুর্যোগে ফায়ার সার্ভিসের কর্মীরা সবার আগে ছুটে যান। ফায়ার সার্ভিস থেকে কাক্সিক্ষত সেবা পেতে হলে কর্তৃপক্ষের কর্মপরিধি বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে সময়োপযোগী সক্ষমতা এবং সুযোগ-সুবিধা বাড়াতে হবে। জোগান দিতে হবে প্রয়োজনীয় সরঞ্জামাদির, আধুনিক প্রযুক্তির। বাড়াতে হবে প্রশিক্ষিত লোকবল।
এদিকে রাজধানীসহ সারা দেশে অসংখ্য ঝুঁকিপূর্ণ ভবন ও কারখানা থাকলেও তার সঠিক হিসাব নেই ফায়ার সার্ভিসের। এমনকি ঝুঁকিপূর্ণ ভবন নির্ণয়ের পর চিঠি দিয়ে সাবধান করা ছাড়া আর কিছুই করার থাকে না তাদের। অগ্নি প্রতিরোধ ও নির্বাপণ আইন, ২০০৩-এর ৭ ধারা অনুযায়ী অগ্নিনির্বাপণ ছাড়পত্র ছাড়াই তৈরি হয়েছে অনেক বহুতল ভবন। এর প্রধান কারণ আইন অনুযায়ী ৭তলার ওপরে (২০ ফিট) গেলে সেটির ফায়ার সার্ভিসের অনুমোদন দরকার। কিন্তু রাজউক ১০তলা পর্যন্ত অনুমোদন দিয়ে থাকে। ফলে ফায়ার সার্ভিস অ্যাকশনে গেলে রাজউকের অনুমোদন দেখে কিছু করার থাকে না। আবার আইন কার্যকর করতে হলে অন্য কোনো সংস্থার সহায়তা নিতে হয়।