ঢাকা , মঙ্গলবার, ২৪ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

‘মৃত্যু’র ১২ বছর পর ফিরে এসেছিলেন ভাওয়াল রাজা

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মৃত্যুর ১২ বছর পর ভাওয়াল রাজা মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণের হঠাৎ ফিরে আসা গত শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত ঘটনা। জমিদারি ফিরে পেতে তিনি এক দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রায় ১৬ বছর ধরে চলা এই মামলাটির নিষ্পত্তি হয় শেষ পর্যন্ত লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে। মৃত্যুর পর ভাওয়াল রাজার ফিরে আসার গল্প নিয়ে লিখেছেন আন্দালিব আয়ান।

ঢাকায় এক সাধুর আবির্ভাব

১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে এক সাধুর আবির্ভাব হয়। জটাধারী সন্ন্যাসীর সর্বাঙ্গে ছাই মাখা। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি দিনরাত সেখানে বসে থাকতেন। তার সৌম্য চেহারা অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছিল। প্রায়ই সাধুকে ঘিরে ছোটখাটো ভিড় জমে যেত। কৌতূহলী মানুষ তাকে নানা প্রশ্ন করত। তবে সেসব প্রশ্নের উত্তর খুব কমই দিতেন সাধু। দু’একটি উত্তর দিলেও সেগুলো বাংলায় নয়। হিন্দি ভাষায় সাধু জানান, তিনি পাঞ্জাবের লোক, ছোটবেলায় ঘরবাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছেন। বাংলার জল-হাওয়া তার একেবারে পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু রটে যায়, এই সন্ন্যাসী দেখতে অবিকল মেজকুমারের মতো। এক কান-দুকান হয়ে খবরটি জয়দেবপুর ও কাশিমপুরে জমিদার বাড়িতে পৌঁছে যায়। কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরী সন্ন্যাসীকে তার জমিদারিতে নিয়ে আসেন। সেখানে ধনি-গরিব, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভিড় লেগে যায়। যারা মেজকুমারকে কাছ থেকে চেনেন তারা তো অবাক। মানুষে মানুষে এত মিল হয় নাকি!

আগন্তুকের গেরুয়া বেশ আর মুখভর্তি দাড়ি থাকলেও তারা নিশ্চিত এ-ই তাদের ‘মৃত’ মেজকুমার। লোকজন আহ্লাদ ভরে সন্ন্যাসীর হাত-পা মুখ ছুঁয়ে দেখেন।

সন্ন্যাসী কাশিমপুরে কয়েক দিন থেকে দলবল নিয়ে রাজবাড়ির অদূরে মাধব বাড়িতে ওঠেন। এখানে এসে দেখা করেন মেজকুমারের বোন জোতির্ময়ী দেবী। প্রথম দেখাতেই জ্যোতির্ময়ীর চোখ আটকে যায়। এ তো তার ভাইয়েরই প্রতিচ্ছবি। তিনি সন্ন্যাসীকে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যান। সে-ই হাত, পা, নাক, মুখ, গায়ের রঙ, গলার স্বর, পায়ের ক্ষত!

জ্যোতির্ময়ী লক্ষ্য করেন তার ভাইয়ের মতো সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনি আলগা হয়ে যায়, জিহ্বা সামনে বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ী ভাইয়ের আগের একটি ছবি সন্ন্যাসীর সামনে এনে ধরেন। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে।

উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন ও কৌতূহলী লোকজন সন্ন্যাসীর পরিচয় নিশ্চিত হতে রীতিমতো পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। জমিদার পারিবারের খুঁটিনাটি বিষয় তার বাবার নাম, মায়ের নাম, এমনকি যে ধাইমার কাছে মেজকুমার বড় হয়েছেন তার নাম পরিচয়সহ কিছুই বাদ যায় না। সন্ন্যাসী পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হন। দিন দিন সন্ন্যাসীকে ঘিরে লোকজনের কৌতূহল ও চাপ বাড়তে থাকে। ডালপালা মেলতে থাকে নানা গুজবের।

যাকে নিয়ে এত চাঞ্চল্য সেই সন্ন্যাসীর মুখ থেকে কথা বের হয় কমই। নিজ পরিচয় প্রশ্নে তিনি প্রচণ্ড রকম নির্লিপ্ততা দেখান। লোকজনের কৌতূহল প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। অনেকটা পেরেশান হয়ে অন্য সন্ন্যাসীদের নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ তীর্থে চলে যান। কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে আসেন ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে। কিন্তু লোকজনের উৎসাহে ভাটা পড়ে না।

কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরী সন্ন্যাসীকে পুনরায় তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে হাতিযোগে সন্ন্যাসীকে নিয়ে ছোটেন জয়দেবপুরের রাজবাড়ির দিকে। তাদের বহরের পিছু নেয় উৎসাহী জনতা। জয়দেবপুর পর্যন্তআসতে আসতে কাফেলা রীতিমতো জনস্রোতে রূপ নেয়।

রাজবাড়ির সামনে কামিনী গাছের নিচে বসেন সন্ন্যাসী। হাজারো লোকের কৌতূহল তাকে ঘিরে। সমবেত লোকজনের সামনে রাজবাড়ির চিকিৎসক আশুতোষ দাস গুপ্ত সন্ন্যাসীকে তাদের দার্জিলিং অবস্থানকালীন একটি ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সঠিক জবাব দিয়ে সন্ন্যাসী তার দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ দেন। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব! মেজকুমার তো আরও ১২ বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন!

১২ বছর আগের মেজকুমার

একসময় ভাওয়ালের রাজা ছিলেন কালী নারায়ণ। পরে জমিদারির দায়িত্ব পান তার একমাত্র পুত্র রাজেন্দ্র নারায়ণ। তিনিও খুব বেশিদিন জমিদারি ভোগ করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর তিন পুত্রকে জমিদারির বিভিন্ন অংশের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। এই তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজভাই রমেন্দ্র নারায়ণকেই মূলত ভাওয়াল রাজা বলা হয়। রাজা হিসেবে তিনি মন্দ ছিলেন না। প্রজাবৎসল ছিলেন। তবে মদ আর নারীর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। স্ত্রী বিভাবতী দেবী তাকে কাছে পেতেন না বললেই চলে। তার আবার শিকারের নেশা ছিল। জনশ্রুতি আছে, তার নিশানা এত ভালো ছিল যে, এক গুলিতেই কুপোকাত হতো বাঘ।

তবে বাজে নেশার কারণে রাজার শরীরে বাসা বাঁধে সিফিলিস। এই রোগের কারণে তিনি সন্তান দানে অক্ষম হয়ে পড়েন। পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তের ওপর তার চিকিৎসার দায়িত্ব পড়ে।

১৯০৯ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝিতে চিকিৎসার প্রয়োজন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য ২৪ বছরের মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পারিবারিক সিদ্ধান্তে ভারতের দার্জিলিং যান। কারণ ততদিনে সিফিলিস এত তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে, তার হাতে পায়ে ঘা সৃষ্টি হয়। দার্জিলিংয়ের শীতল আবহাওয়ায় তিনি কিছুটা শান্তি পাবেন ভেবেই এই সফরের আয়োজন করা হয়। এ সময় মেজকুমারের সঙ্গী হন তার ২০ বছরের স্ত্রী বিভাবতী দেবী, বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত এবং ব্যক্তিগত কর্মচারী মিলে ২৭ জন। দলবল নিয়ে ২৫ এপ্রিল মেজকুমার দার্জিলিং পৌঁছেন।

মে মাসের শুরুতে মেজকুমারের পেটে ব্যথাসহ নানা শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। প্রতিদিন দার্জিলিং থেকে জয়দেবপুরে তার বার্তার মাধ্যমে রাজার স্বাস্থ্যের খবর পাঠানো হতো। ধারাবাহিক এসব টেলিগ্রামের।

প্রথমটিতে জানানো হয় রাজার ৯৯ ডিগ্রি জ্বর। পরের টেলিগ্রামগুলোতে জানানো হয়, তার পেটে যন্ত্রণা, দার্জিলিং সিভিল সার্জন দেখে গেছেন ইত্যাদি।

৭ মে সন্ধ্যা থেকে কুমারের অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও বমি, রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ছোট রাজকুমার দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলে খবর আসে, ৮ মে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে কোনো একসময় মেজকুমার মারা গেছেন। দার্জিলিংয়ের শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে বলেও জানানো হয়। ১০ মে মেজরানী ও অন্যরা জয়দেবপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

তবে তখন থেকেই গুঞ্জন ছিল মেজকুমারের দেহের নাকি সৎকার হয়নি। ওই দিন শ্মশানঘাটে মেজকুমারের লাশ নেওয়ার পর শুরু হয় ঝড় ও শিলাবৃষ্টি। শিলার হাত থেকে বাঁচার জন্য লোকজন শ্মশানঘাট থেকে অন্যত্র আশ্রয় নেন। বৃষ্টির পর শ্মশানে গিয়ে তারা আর লাশটি দেখতে পাননি।

সুবিধাভোগীদের চক্রান্ত

‘মৃত’ রাজার হঠাৎ উদয় সহজে মেনে নিতে পারেনি ততদিনে রাজত্বের সুবিধাভোগী কিছু মানুষ। তারা রাজার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। রাজপরিবার শুধু নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র ও সাধারণ প্রজারাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই জটিল পরিস্থিতিতে রাজার স্ত্রী বিভাবতীর ভূমিকা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজকুমারকে মেনে নেওয়া গুটিকয়েক লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম কুমারের স্ত্রী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। কারণ তিনি ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া মেজকুমারের স্ত্রী হিসেবে বিভাবতী জমিদারির পক্ষ থেকে বার্ষিক লক্ষাধিক টাকার যে ভাতা পেতেন তার পুরোটাই গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই মেজকুমারের ফেরা সত্যেন্দ্রর জন্য হলো অশনিসংকেত। ভাইয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়াটা বিভাবতীর জন্য অসম্ভব ছিল। তার সঙ্গে পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাশগুপ্তের পরকীয়া ছিল বলেও জনশ্রুতি আছে। লোকেরা এও দাবি করত যে, দার্জিলিংয়ে মেজকুমারকে ওষুধের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।

মেজকুমারের দার্জিলিংয়ে কথিত মৃত্যুবরণ করার এক বছরের মধ্যেই মারা যান তার বড় ভাই রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। সন্ন্যাসীর আবির্ভাবের সময় জমিদারবাড়ির উত্তরসূরির মধ্যে শুধু ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায় বেঁচে ছিলেন। তিনি সন্ন্যাসীর পরিচয় নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে নীরবতা পালন করেন।

কিন্তু বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্র উঠেপড়ে লাগলেন সন্ন্যাসীকে ‘প্রতারক’ প্রমাণ করতে। তিনি ছুটলেন দার্জিলিং। মেজকুমারের মৃত্যু সনদ ও কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে ঢাকা এসে কালেক্টর জেএইচ লিন্ডসের সঙ্গে দেখা করে সন্ন্যাসীকে ‘প্রতারক’ ঘোষণার দাবি জানান।

কালেক্টর অনেকটা প্রভাবিত হয়ে সন্ন্যাসীকে প্রতারক উল্লেখ করে নোটিস জারি করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নোটিসের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

নেটিস জারির সময় কালিয়াকৈরের কাছে মির্জাপুরে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ বেধে যায়। এখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান জুনুব আলী নামে এক প্রজা। এ সময় প্রজারা রাজস্ব আদায়ের রসিদে মেজকুমারের নাম লিপিবদ্ধ করার দাবি জানান। এক পর্যায়ে প্রজারা খাজনা দিতে অস্বীকার করেন।

এদিকে, মেজকুমারের ক্ষুব্ধ সমর্থকরা জয়দেবপুরে তখন ‘ভাওয়াল তালুকদার ও প্রজা সমিতি’ গঠন করেন। হারবাইদের জমিদার দিগিন্দ্র নারায়ণ ঘোষ সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ সময় জয়দেবপুরে সন্ন্যাসীকে নিয়ে ১৫ মে বিরাট জনসভা করে জনতা। রাজবাড়ি মাঠে ওই জনসভায় অন্তত দশ হাজার নারী-পুরুষ সমবেত হন। সেদিন পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, রেল কোম্পানিকে স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল এবং বাজারে চিড়ার দর বেড়েছিল কয়েকগুণ। কাপাসিয়ার বারিষাব জমিদারির বড় তালুকদার আদিনাথ চক্রবর্তী জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। সেদিন সাধারণ মানুষ নিজেরা চাঁদা দিয়ে তহবিল গঠন করেন। পথনাটক, যাত্রাপালা, পুঁথিপাঠ, জারিগান করে, গল্প-বুলেটিন-পত্রিকা ছেপে ব্যাপক জনমত তৈরি করা হয়। অপরপক্ষও বসে নেই। তারা ‘ভাওয়ালে ভূতের কাণ্ড’ নামে বই ছেপে দেয়।

আলোচিত ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা

শেষ পর্যন্ত সত্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব পড়ে আদালতের ওপর। যদিও আদালত থেকে চূড়ান্ত ফয়সালায় পৌঁছতে লেগে যায় প্রায় সিকি শতাব্দী। ততদিনে ভাওয়ালের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারিই শুধু নয়, পুরো জমিদারি প্রথাই বিলুপ্তির মুখে। ১৯২২ সালে মেজকুমারের ঠাকুর মা রানী সত্যভামা দেবী সন্ন্যাসীবেশী মেজকুমারের সঙ্গেই ঢাকায় বাস করতে শুরু করেন। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর সত্যভামা দেবী মারা গেলে সন্ন্যাসীই তার মুখাগ্নি করেন।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে কলকাতার ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জীর একটি বাড়িতে অবস্থানকালে বড়রানী (মেজকুমারের বড় ভাই রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর স্ত্রী) সূর্যবালা দেবী সন্ন্যাসীকে দেবর বলে চিনতে পারেন। এ ছাড়া মেজরানীর কয়েকজন আত্মীয়ও মেজকুমারকে চিনতে পারেন এবং তার পক্ষে সাক্ষ্য দেন।

আইনজীবী ও স্থানীয় জমিদারদের নিয়ে সন্ন্যাসী সশরীরে ঢাকা বোর্ড অব রেভিনিউতে হাজির হয়ে তার পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য ১৯২৬ সালের ৮ ডিসেম্বর আবেদন জানান। কিন্তু তা অগ্রাহ্য হয়।

আবেদনে সন্ন্যাসী উল্লেখ করেন, দার্জিলিংয়ে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললে সহযাত্রীরা ভাবেন তিনি মরে গেছেন। দুর্যোগপূর্ণ সেই রাতে স্থানীয় শ্মশানে লাশের সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে শবযাত্রীরা লাশ ফেলে চলে আসেন। পরে স্থানীয় নাগা সন্ন্যাসীরা তাকে তুলে নিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। এ বছরগুলোতে তিনি সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হয়ে নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জমিদারির বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। কিন্তু কিছু স্বার্থপর লোক তাকে প্রতারক প্রমাণে সচেষ্ট থাকায় এখন পরিচয় প্রকাশের প্রয়োজন পড়েছে।

কর্র্তৃপক্ষ এ আবেদনেও কর্ণপাত না করায় ১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অতিরিক্ত জজ আদালতে নিজের স্বীকৃতি ও জমিদারির অংশ দাবি করে মামলা করেন সন্ন্যাসী।

মামলার শুরুতেই প্রতিপক্ষের মূল ব্যক্তি সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি দার্জিলিং সিভিল সার্জনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মেজকুমারের মৃত্যুসনদ আদালতে দাখিল করেন। এ ছাড়া দার্জিলিং আবহাওয়া অফিস থেকে মেজকুমারের মৃত্যুর দিনের আবহাওয়ার রিপোর্ট সংগ্রহ করে আদালতে জমা দেন। এর মাধ্যমে সত্যেন্দ্রনাথ প্রমাণের চেষ্টা করেন কুমারের মৃত্যুর দিন আবহাওয়া স্বাভাবিক ছিল। এ রিপোর্ট আদালতে সাময়িক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও পরে প্রমাণ হয় রিপোর্ট সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া অফিসে রক্ষিত তথ্যপত্রে কাটাছেঁড়া। এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর দুপক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণ চলে।

পরে বিচারক পান্নালাল বসু ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট ৫৩২ পৃষ্ঠার রায় দেন। উভয় পক্ষে সাক্ষ্য দেন ১৫৪৮ জন। এর মধ্যে বাদী মেজকুমারের পক্ষে ১০৬৯ জন। প্রমাণ হয় আলোচিত সন্ন্যাসীই ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়। এ রায়ের পর জয়দেবপুরের রাজবাড়ি মাঠে বিশাল একটি রাজভোগের আয়োজন করেন রাজা। হাজার হাজার লোক জমায়েত হন মাঠে। কিন্তু খাবার দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কিছু সন্ত্রাসী লাঠি হাতে ‘ধর, ধর’ বলে ধাওয়া করে। এমন অপ্রীতিকর ঘটনার পর তিনি কলকাতায় চলে যান।

এদিকে, বিবাদীপক্ষ কলকাতা হাইকোর্টে আগের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করে। ১৯৪০ সালের ২৯ আগস্ট বিচারপতি লিওনার্ড ক্যাস্টেলো আগের রায়ই বহাল রেখে আদেশ দেন। আপিলে হেরে বিবাদীপক্ষ লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে পুনরায় আপিল করেন। যদিও লাভ হয়নি। ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই প্রিভি কাউন্সিল যে রায় দেন তাতে তা রাজার অনুকূলেই যায়। প্রিভিয়ার্স কাউন্সিলের রায়ের পর মাত্র তিন দিন বেঁচেছিলেন মেজকুমার। যেন মামলার চূড়ান্ত রায়ের জন্যই তার অপেক্ষা ছিল। কারণ, এই রায়ের সঙ্গে একজন জমিদারের মান-সম্মান, ইজ্জত ও জনগণের ভালোবাসা জড়িত ছিল!

ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, ভারতবর্ষের বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে এটি দিল্লিতে গত শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ মামলা হিসেবে স্থান পেয়েছিল।

মামলাটি শুরু হয় ১৯৩০ সালে আর শেষ হয় ১৯৪৬ সালে। আদালতে প্রকাশ্যে বিচারকার্য শুরু হয় ১৯৩৩ সালের ২৭ নভেম্বর। ১৯৩৬ সালের ২১ মে পর্যন্তশুনানি চলে। সেখানে উভয় পক্ষের ১৫৪৮ জন সাক্ষ্য দেন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েক জনের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বিলেতেও কমিশন বসে।

মামলা চলার সময় ঢাকার চারটি পত্রিকা বিবরণী প্রকাশ করত এবং ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা বিকেলে বিশেষ সংস্করণ বের করত।

এককালে ভাওয়াল পরগনার শাসনকাজ পরিচালিত হতো গাজীপুরের জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে। রাজবাড়িটি এখন গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাওয়াল রাজা মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর কথিত মৃত্যু এবং ১২ বছর পর পুনঃআবির্ভাবের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী। এই কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমাও।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

‘মৃত্যু’র ১২ বছর পর ফিরে এসেছিলেন ভাওয়াল রাজা

আপডেট টাইম : ০৬:৪৭ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২২ জুলাই ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ মৃত্যুর ১২ বছর পর ভাওয়াল রাজা মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণের হঠাৎ ফিরে আসা গত শতাব্দীর অন্যতম আলোচিত ঘটনা। জমিদারি ফিরে পেতে তিনি এক দীর্ঘ আইনি লড়াইয়ে অবতীর্ণ হয়েছিলেন। প্রায় ১৬ বছর ধরে চলা এই মামলাটির নিষ্পত্তি হয় শেষ পর্যন্ত লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে। মৃত্যুর পর ভাওয়াল রাজার ফিরে আসার গল্প নিয়ে লিখেছেন আন্দালিব আয়ান।

ঢাকায় এক সাধুর আবির্ভাব

১৯২১ সালের জানুয়ারি মাসে ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে এক সাধুর আবির্ভাব হয়। জটাধারী সন্ন্যাসীর সর্বাঙ্গে ছাই মাখা। রোদ-বৃষ্টি উপেক্ষা করে তিনি দিনরাত সেখানে বসে থাকতেন। তার সৌম্য চেহারা অনেকেরই দৃষ্টি কেড়েছিল। প্রায়ই সাধুকে ঘিরে ছোটখাটো ভিড় জমে যেত। কৌতূহলী মানুষ তাকে নানা প্রশ্ন করত। তবে সেসব প্রশ্নের উত্তর খুব কমই দিতেন সাধু। দু’একটি উত্তর দিলেও সেগুলো বাংলায় নয়। হিন্দি ভাষায় সাধু জানান, তিনি পাঞ্জাবের লোক, ছোটবেলায় ঘরবাড়ি ছেড়ে সন্ন্যাসী হয়েছেন। বাংলার জল-হাওয়া তার একেবারে পছন্দ হচ্ছে না। কিন্তু রটে যায়, এই সন্ন্যাসী দেখতে অবিকল মেজকুমারের মতো। এক কান-দুকান হয়ে খবরটি জয়দেবপুর ও কাশিমপুরে জমিদার বাড়িতে পৌঁছে যায়। কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরী সন্ন্যাসীকে তার জমিদারিতে নিয়ে আসেন। সেখানে ধনি-গরিব, ছোট-বড়, নারী-পুরুষ নির্বিশেষে ভিড় লেগে যায়। যারা মেজকুমারকে কাছ থেকে চেনেন তারা তো অবাক। মানুষে মানুষে এত মিল হয় নাকি!

আগন্তুকের গেরুয়া বেশ আর মুখভর্তি দাড়ি থাকলেও তারা নিশ্চিত এ-ই তাদের ‘মৃত’ মেজকুমার। লোকজন আহ্লাদ ভরে সন্ন্যাসীর হাত-পা মুখ ছুঁয়ে দেখেন।

সন্ন্যাসী কাশিমপুরে কয়েক দিন থেকে দলবল নিয়ে রাজবাড়ির অদূরে মাধব বাড়িতে ওঠেন। এখানে এসে দেখা করেন মেজকুমারের বোন জোতির্ময়ী দেবী। প্রথম দেখাতেই জ্যোতির্ময়ীর চোখ আটকে যায়। এ তো তার ভাইয়েরই প্রতিচ্ছবি। তিনি সন্ন্যাসীকে স্বামীর বাড়িতে নিয়ে যান। সে-ই হাত, পা, নাক, মুখ, গায়ের রঙ, গলার স্বর, পায়ের ক্ষত!

জ্যোতির্ময়ী লক্ষ্য করেন তার ভাইয়ের মতো সন্ন্যাসীরও খাওয়ার সময় ডান হাতের তর্জনি আলগা হয়ে যায়, জিহ্বা সামনে বেরিয়ে আসে। জ্যোতির্ময়ী ভাইয়ের আগের একটি ছবি সন্ন্যাসীর সামনে এনে ধরেন। দুজনের চোখ দিয়ে অঝোরে পানি পড়তে থাকে।

উপস্থিত আত্মীয়-স্বজন ও কৌতূহলী লোকজন সন্ন্যাসীর পরিচয় নিশ্চিত হতে রীতিমতো পরীক্ষা নেওয়া শুরু করেন। জমিদার পারিবারের খুঁটিনাটি বিষয় তার বাবার নাম, মায়ের নাম, এমনকি যে ধাইমার কাছে মেজকুমার বড় হয়েছেন তার নাম পরিচয়সহ কিছুই বাদ যায় না। সন্ন্যাসী পরীক্ষায় সহজেই উত্তীর্ণ হন। দিন দিন সন্ন্যাসীকে ঘিরে লোকজনের কৌতূহল ও চাপ বাড়তে থাকে। ডালপালা মেলতে থাকে নানা গুজবের।

যাকে নিয়ে এত চাঞ্চল্য সেই সন্ন্যাসীর মুখ থেকে কথা বের হয় কমই। নিজ পরিচয় প্রশ্নে তিনি প্রচণ্ড রকম নির্লিপ্ততা দেখান। লোকজনের কৌতূহল প্রতিদিন লাফিয়ে লাফিয়ে বাড়তে থাকে। অনেকটা পেরেশান হয়ে অন্য সন্ন্যাসীদের নিয়ে তিনি চট্টগ্রামের চন্দ্রনাথ তীর্থে চলে যান। কিছুদিন কাটিয়ে ফিরে আসেন ঢাকার বাকল্যান্ড বাঁধে। কিন্তু লোকজনের উৎসাহে ভাটা পড়ে না।

কাশিমপুরের জমিদার অতুল প্রসাদ রায় চৌধুরী সন্ন্যাসীকে পুনরায় তার বাড়িতে নিয়ে আসেন। পরে হাতিযোগে সন্ন্যাসীকে নিয়ে ছোটেন জয়দেবপুরের রাজবাড়ির দিকে। তাদের বহরের পিছু নেয় উৎসাহী জনতা। জয়দেবপুর পর্যন্তআসতে আসতে কাফেলা রীতিমতো জনস্রোতে রূপ নেয়।

রাজবাড়ির সামনে কামিনী গাছের নিচে বসেন সন্ন্যাসী। হাজারো লোকের কৌতূহল তাকে ঘিরে। সমবেত লোকজনের সামনে রাজবাড়ির চিকিৎসক আশুতোষ দাস গুপ্ত সন্ন্যাসীকে তাদের দার্জিলিং অবস্থানকালীন একটি ঘটনার বিষয়ে প্রশ্ন করেন। সঠিক জবাব দিয়ে সন্ন্যাসী তার দাবির পক্ষে জোরালো প্রমাণ দেন। কিন্তু এটা কী করে সম্ভব! মেজকুমার তো আরও ১২ বছর আগেই মারা গিয়েছিলেন!

১২ বছর আগের মেজকুমার

একসময় ভাওয়ালের রাজা ছিলেন কালী নারায়ণ। পরে জমিদারির দায়িত্ব পান তার একমাত্র পুত্র রাজেন্দ্র নারায়ণ। তিনিও খুব বেশিদিন জমিদারি ভোগ করতে পারেননি। তার মৃত্যুর পর তিন পুত্রকে জমিদারির বিভিন্ন অংশের দায়িত্ব ভাগ করে দেওয়া হয়। এই তিন ভাইয়ের মধ্যে মেজভাই রমেন্দ্র নারায়ণকেই মূলত ভাওয়াল রাজা বলা হয়। রাজা হিসেবে তিনি মন্দ ছিলেন না। প্রজাবৎসল ছিলেন। তবে মদ আর নারীর নেশায় বুঁদ হয়ে থাকতেন। স্ত্রী বিভাবতী দেবী তাকে কাছে পেতেন না বললেই চলে। তার আবার শিকারের নেশা ছিল। জনশ্রুতি আছে, তার নিশানা এত ভালো ছিল যে, এক গুলিতেই কুপোকাত হতো বাঘ।

তবে বাজে নেশার কারণে রাজার শরীরে বাসা বাঁধে সিফিলিস। এই রোগের কারণে তিনি সন্তান দানে অক্ষম হয়ে পড়েন। পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্তের ওপর তার চিকিৎসার দায়িত্ব পড়ে।

১৯০৯ সালের এপ্রিলের মাঝামাঝিতে চিকিৎসার প্রয়োজন ও আবহাওয়া পরিবর্তনের জন্য ২৪ বছরের মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী পারিবারিক সিদ্ধান্তে ভারতের দার্জিলিং যান। কারণ ততদিনে সিফিলিস এত তীব্র আকার ধারণ করেছিল যে, তার হাতে পায়ে ঘা সৃষ্টি হয়। দার্জিলিংয়ের শীতল আবহাওয়ায় তিনি কিছুটা শান্তি পাবেন ভেবেই এই সফরের আয়োজন করা হয়। এ সময় মেজকুমারের সঙ্গী হন তার ২০ বছরের স্ত্রী বিভাবতী দেবী, বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি, পারিবারিক চিকিৎসক আশুতোষ দাসগুপ্ত এবং ব্যক্তিগত কর্মচারী মিলে ২৭ জন। দলবল নিয়ে ২৫ এপ্রিল মেজকুমার দার্জিলিং পৌঁছেন।

মে মাসের শুরুতে মেজকুমারের পেটে ব্যথাসহ নানা শারীরিক উপসর্গ দেখা দেয়। প্রতিদিন দার্জিলিং থেকে জয়দেবপুরে তার বার্তার মাধ্যমে রাজার স্বাস্থ্যের খবর পাঠানো হতো। ধারাবাহিক এসব টেলিগ্রামের।

প্রথমটিতে জানানো হয় রাজার ৯৯ ডিগ্রি জ্বর। পরের টেলিগ্রামগুলোতে জানানো হয়, তার পেটে যন্ত্রণা, দার্জিলিং সিভিল সার্জন দেখে গেছেন ইত্যাদি।

৭ মে সন্ধ্যা থেকে কুমারের অবস্থার আরও অবনতি হতে থাকে। ওষুধ খাওয়া সত্ত্বেও বমি, রক্ত মিশ্রিত পায়খানা হতে থাকে। এমন পরিস্থিতিতে ছোট রাজকুমার দার্জিলিংয়ের উদ্দেশে যাত্রা করার সিদ্ধান্ত নিলে খবর আসে, ৮ মে সন্ধ্যা ৭টা থেকে ৮টার মধ্যে কোনো একসময় মেজকুমার মারা গেছেন। দার্জিলিংয়ের শ্মশানে তার শেষকৃত্য সম্পন্ন করা হয়েছে বলেও জানানো হয়। ১০ মে মেজরানী ও অন্যরা জয়দেবপুরের উদ্দেশে যাত্রা করেন।

তবে তখন থেকেই গুঞ্জন ছিল মেজকুমারের দেহের নাকি সৎকার হয়নি। ওই দিন শ্মশানঘাটে মেজকুমারের লাশ নেওয়ার পর শুরু হয় ঝড় ও শিলাবৃষ্টি। শিলার হাত থেকে বাঁচার জন্য লোকজন শ্মশানঘাট থেকে অন্যত্র আশ্রয় নেন। বৃষ্টির পর শ্মশানে গিয়ে তারা আর লাশটি দেখতে পাননি।

সুবিধাভোগীদের চক্রান্ত

‘মৃত’ রাজার হঠাৎ উদয় সহজে মেনে নিতে পারেনি ততদিনে রাজত্বের সুবিধাভোগী কিছু মানুষ। তারা রাজার অস্তিত্বকে অস্বীকার করে। শুরু হয় প্রাসাদ ষড়যন্ত্র। রাজপরিবার শুধু নয়, রাষ্ট্রযন্ত্র ও সাধারণ প্রজারাও দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। এই জটিল পরিস্থিতিতে রাজার স্ত্রী বিভাবতীর ভূমিকা পরিস্থিতিকে আরও জটিল করে তোলে। প্রমাণ যত অকাট্যই থাক, মেজকুমারকে মেনে নেওয়া গুটিকয়েক লোকের জন্য সম্ভব ছিল না। এদের মধ্যে অন্যতম কুমারের স্ত্রী বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি। কারণ তিনি ইতোমধ্যে মেজকুমারের জীবন বীমার ৩০ হাজার টাকা উত্তোলন করে আত্মসাৎ করেছেন। এ ছাড়া মেজকুমারের স্ত্রী হিসেবে বিভাবতী জমিদারির পক্ষ থেকে বার্ষিক লক্ষাধিক টাকার যে ভাতা পেতেন তার পুরোটাই গ্রহণ করতেন সত্যেন্দ্রনাথ। তাই মেজকুমারের ফেরা সত্যেন্দ্রর জন্য হলো অশনিসংকেত। ভাইয়ের সিদ্ধান্তের বাইরে যাওয়াটা বিভাবতীর জন্য অসম্ভব ছিল। তার সঙ্গে পারিবারিক ডাক্তার আশুতোষ দাশগুপ্তের পরকীয়া ছিল বলেও জনশ্রুতি আছে। লোকেরা এও দাবি করত যে, দার্জিলিংয়ে মেজকুমারকে ওষুধের সঙ্গে বিষ প্রয়োগ করা হয়েছিল।

মেজকুমারের দার্জিলিংয়ে কথিত মৃত্যুবরণ করার এক বছরের মধ্যেই মারা যান তার বড় ভাই রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরী। সন্ন্যাসীর আবির্ভাবের সময় জমিদারবাড়ির উত্তরসূরির মধ্যে শুধু ছোট কুমার রবীন্দ্র নারায়ণ রায় বেঁচে ছিলেন। তিনি সন্ন্যাসীর পরিচয় নিয়ে সৃষ্ট বিতর্কে নীরবতা পালন করেন।

কিন্তু বিভাবতীর ভাই সত্যেন্দ্র উঠেপড়ে লাগলেন সন্ন্যাসীকে ‘প্রতারক’ প্রমাণ করতে। তিনি ছুটলেন দার্জিলিং। মেজকুমারের মৃত্যু সনদ ও কিছু সাক্ষ্যপ্রমাণ নিয়ে ঢাকা এসে কালেক্টর জেএইচ লিন্ডসের সঙ্গে দেখা করে সন্ন্যাসীকে ‘প্রতারক’ ঘোষণার দাবি জানান।

কালেক্টর অনেকটা প্রভাবিত হয়ে সন্ন্যাসীকে প্রতারক উল্লেখ করে নোটিস জারি করেন। সাধারণ মানুষের মধ্যে এ নোটিসের তীব্র প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়।

নেটিস জারির সময় কালিয়াকৈরের কাছে মির্জাপুরে পুলিশের সঙ্গে জনতার সংঘর্ষ বেধে যায়। এখানে পুলিশের গুলিতে প্রাণ হারান জুনুব আলী নামে এক প্রজা। এ সময় প্রজারা রাজস্ব আদায়ের রসিদে মেজকুমারের নাম লিপিবদ্ধ করার দাবি জানান। এক পর্যায়ে প্রজারা খাজনা দিতে অস্বীকার করেন।

এদিকে, মেজকুমারের ক্ষুব্ধ সমর্থকরা জয়দেবপুরে তখন ‘ভাওয়াল তালুকদার ও প্রজা সমিতি’ গঠন করেন। হারবাইদের জমিদার দিগিন্দ্র নারায়ণ ঘোষ সামনে থেকে আন্দোলনে নেতৃত্ব দেন। এ সময় জয়দেবপুরে সন্ন্যাসীকে নিয়ে ১৫ মে বিরাট জনসভা করে জনতা। রাজবাড়ি মাঠে ওই জনসভায় অন্তত দশ হাজার নারী-পুরুষ সমবেত হন। সেদিন পরিস্থিতি এমন দাঁড়ায় যে, রেল কোম্পানিকে স্পেশাল ট্রেনের ব্যবস্থা করতে হয়েছিল এবং বাজারে চিড়ার দর বেড়েছিল কয়েকগুণ। কাপাসিয়ার বারিষাব জমিদারির বড় তালুকদার আদিনাথ চক্রবর্তী জনসভায় সভাপতিত্ব করেন। সেদিন সাধারণ মানুষ নিজেরা চাঁদা দিয়ে তহবিল গঠন করেন। পথনাটক, যাত্রাপালা, পুঁথিপাঠ, জারিগান করে, গল্প-বুলেটিন-পত্রিকা ছেপে ব্যাপক জনমত তৈরি করা হয়। অপরপক্ষও বসে নেই। তারা ‘ভাওয়ালে ভূতের কাণ্ড’ নামে বই ছেপে দেয়।

আলোচিত ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা

শেষ পর্যন্ত সত্য উদ্ঘাটনের দায়িত্ব পড়ে আদালতের ওপর। যদিও আদালত থেকে চূড়ান্ত ফয়সালায় পৌঁছতে লেগে যায় প্রায় সিকি শতাব্দী। ততদিনে ভাওয়ালের ক্ষয়িষ্ণু জমিদারিই শুধু নয়, পুরো জমিদারি প্রথাই বিলুপ্তির মুখে। ১৯২২ সালে মেজকুমারের ঠাকুর মা রানী সত্যভামা দেবী সন্ন্যাসীবেশী মেজকুমারের সঙ্গেই ঢাকায় বাস করতে শুরু করেন। ওই বছরের ১৫ ডিসেম্বর সত্যভামা দেবী মারা গেলে সন্ন্যাসীই তার মুখাগ্নি করেন।

১৯২৪ সালের আগস্ট মাসে কলকাতার ভবানীপুরের হরিশ মুখার্জীর একটি বাড়িতে অবস্থানকালে বড়রানী (মেজকুমারের বড় ভাই রণেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর স্ত্রী) সূর্যবালা দেবী সন্ন্যাসীকে দেবর বলে চিনতে পারেন। এ ছাড়া মেজরানীর কয়েকজন আত্মীয়ও মেজকুমারকে চিনতে পারেন এবং তার পক্ষে সাক্ষ্য দেন।

আইনজীবী ও স্থানীয় জমিদারদের নিয়ে সন্ন্যাসী সশরীরে ঢাকা বোর্ড অব রেভিনিউতে হাজির হয়ে তার পরিচয় উদ্ঘাটনের জন্য ১৯২৬ সালের ৮ ডিসেম্বর আবেদন জানান। কিন্তু তা অগ্রাহ্য হয়।

আবেদনে সন্ন্যাসী উল্লেখ করেন, দার্জিলিংয়ে তিনি নিউমোনিয়ায় আক্রান্ত হয়ে সংজ্ঞা হারিয়ে ফেললে সহযাত্রীরা ভাবেন তিনি মরে গেছেন। দুর্যোগপূর্ণ সেই রাতে স্থানীয় শ্মশানে লাশের সৎকারের জন্য নিয়ে যাওয়া হয়। কিন্তু প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া ও বৃষ্টিতে শবযাত্রীরা লাশ ফেলে চলে আসেন। পরে স্থানীয় নাগা সন্ন্যাসীরা তাকে তুলে নিয়ে চিকিৎসা করে সুস্থ করে তোলেন। এ বছরগুলোতে তিনি সন্ন্যাসব্রতে দীক্ষিত হয়ে নানা স্থানে ঘুরে বেড়িয়েছেন। জমিদারির বিষয়ে তার আগ্রহ নেই। কিন্তু কিছু স্বার্থপর লোক তাকে প্রতারক প্রমাণে সচেষ্ট থাকায় এখন পরিচয় প্রকাশের প্রয়োজন পড়েছে।

কর্র্তৃপক্ষ এ আবেদনেও কর্ণপাত না করায় ১৯৩০ সালের ২৪ এপ্রিল ঢাকার অতিরিক্ত জজ আদালতে নিজের স্বীকৃতি ও জমিদারির অংশ দাবি করে মামলা করেন সন্ন্যাসী।

মামলার শুরুতেই প্রতিপক্ষের মূল ব্যক্তি সত্যেন্দ্রনাথ ব্যানার্জি দার্জিলিং সিভিল সার্জনের কাছ থেকে সংগ্রহ করা মেজকুমারের মৃত্যুসনদ আদালতে দাখিল করেন। এ ছাড়া দার্জিলিং আবহাওয়া অফিস থেকে মেজকুমারের মৃত্যুর দিনের আবহাওয়ার রিপোর্ট সংগ্রহ করে আদালতে জমা দেন। এর মাধ্যমে সত্যেন্দ্রনাথ প্রমাণের চেষ্টা করেন কুমারের মৃত্যুর দিন আবহাওয়া স্বাভাবিক ছিল। এ রিপোর্ট আদালতে সাময়িক চাঞ্চল্য সৃষ্টি করলেও পরে প্রমাণ হয় রিপোর্ট সংগ্রহের ক্ষেত্রে প্রতারণার আশ্রয় নেওয়া হয়েছে। আবহাওয়া অফিসে রক্ষিত তথ্যপত্রে কাটাছেঁড়া। এভাবে দীর্ঘ ছয় বছর দুপক্ষের সাক্ষ্য-প্রমাণ চলে।

পরে বিচারক পান্নালাল বসু ১৯৩৬ সালের ২৪ আগস্ট ৫৩২ পৃষ্ঠার রায় দেন। উভয় পক্ষে সাক্ষ্য দেন ১৫৪৮ জন। এর মধ্যে বাদী মেজকুমারের পক্ষে ১০৬৯ জন। প্রমাণ হয় আলোচিত সন্ন্যাসীই ভাওয়ালের মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায়। এ রায়ের পর জয়দেবপুরের রাজবাড়ি মাঠে বিশাল একটি রাজভোগের আয়োজন করেন রাজা। হাজার হাজার লোক জমায়েত হন মাঠে। কিন্তু খাবার দেওয়ার পূর্ব মুহূর্তে কিছু সন্ত্রাসী লাঠি হাতে ‘ধর, ধর’ বলে ধাওয়া করে। এমন অপ্রীতিকর ঘটনার পর তিনি কলকাতায় চলে যান।

এদিকে, বিবাদীপক্ষ কলকাতা হাইকোর্টে আগের রায়কে চ্যালেঞ্জ করে আপিল করে। ১৯৪০ সালের ২৯ আগস্ট বিচারপতি লিওনার্ড ক্যাস্টেলো আগের রায়ই বহাল রেখে আদেশ দেন। আপিলে হেরে বিবাদীপক্ষ লন্ডনের প্রিভি কাউন্সিলে পুনরায় আপিল করেন। যদিও লাভ হয়নি। ১৯৪৬ সালের ৩০ জুলাই প্রিভি কাউন্সিল যে রায় দেন তাতে তা রাজার অনুকূলেই যায়। প্রিভিয়ার্স কাউন্সিলের রায়ের পর মাত্র তিন দিন বেঁচেছিলেন মেজকুমার। যেন মামলার চূড়ান্ত রায়ের জন্যই তার অপেক্ষা ছিল। কারণ, এই রায়ের সঙ্গে একজন জমিদারের মান-সম্মান, ইজ্জত ও জনগণের ভালোবাসা জড়িত ছিল!

ভাওয়াল সন্ন্যাসী মামলা এতই প্রসিদ্ধি লাভ করেছিল যে, ভারতবর্ষের বিখ্যাত মামলাগুলোর মধ্যে এটি দিল্লিতে গত শতাব্দীর আলোড়ন সৃষ্টিকারী অন্যতম শ্রেষ্ঠ মামলা হিসেবে স্থান পেয়েছিল।

মামলাটি শুরু হয় ১৯৩০ সালে আর শেষ হয় ১৯৪৬ সালে। আদালতে প্রকাশ্যে বিচারকার্য শুরু হয় ১৯৩৩ সালের ২৭ নভেম্বর। ১৯৩৬ সালের ২১ মে পর্যন্তশুনানি চলে। সেখানে উভয় পক্ষের ১৫৪৮ জন সাক্ষ্য দেন। গুরুত্বপূর্ণ কয়েক জনের সাক্ষ্যগ্রহণের জন্য বিলেতেও কমিশন বসে।

মামলা চলার সময় ঢাকার চারটি পত্রিকা বিবরণী প্রকাশ করত এবং ভারতের আনন্দবাজার পত্রিকা বিকেলে বিশেষ সংস্করণ বের করত।

এককালে ভাওয়াল পরগনার শাসনকাজ পরিচালিত হতো গাজীপুরের জয়দেবপুরের ভাওয়াল রাজবাড়ি থেকে। রাজবাড়িটি এখন গাজীপুর জেলা প্রশাসকের কার্যালয়। ইতিহাস ও ঐতিহ্যবাহী ভাওয়াল রাজবাড়ির সঙ্গে জড়িয়ে আছে ভাওয়াল রাজা মেজকুমার রমেন্দ্র নারায়ণ রায় চৌধুরীর কথিত মৃত্যু এবং ১২ বছর পর পুনঃআবির্ভাবের শ্বাসরুদ্ধকর কাহিনী। এই কাহিনী নিয়ে নির্মিত হয়েছে একাধিক সিনেমাও।