বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য বেগম মতিয়া চৌধুরী চারবার নির্বাচিত হন শেরপুর-২ (নালিতাবাড়ী-নকলা) আসনে। এ থেকে মনে হতে পারে তার নির্বাচনযাত্রা বুঝি নিষ্কণ্টক ছিল বরাবর। কিন্তু বাস্তবতা হলো গত ২০ বছর ধরে এই আসনে তাকে নিজ ঘরের বিরোধিতা মোকাবিলা করতে হয়েছে। দলের স্থানীয় নেতাকর্মীদের মধ্যকার বিভেদ এমন যে তারা বলছে, এখানে আওয়ামী লীগের শত্রু আওয়ামী লীগ। বৃহত্তর ময়মনসিংহ অঞ্চলের মধ্যে এই আসনটিকে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ বলে মনে করে রাজনৈতিক মহল।
১৯৭৯ সালে জিয়াউর রহমানের আমলে মরহুম আবদুস সালাম এ আসন থেকে এমপি নির্বাচিত হয়ে স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী হন। এরপর এ আসনে যিনি নির্বাচিত হয়েছেন প্রায় সবাই মন্ত্রী, উপমন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী কিংবা হুইপের মতো গুরুত্বপূর্ণ পদে দায়িত্ব পালন করেন।
বর্তমান এমপি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য মতিয়া চৌধুরী সরকারের কৃষিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পালন করছেন টানা দুই মেয়াদে।
১৯৯৬ সাল থেকে এখন পর্যন্ত চারটি সংসদ নির্বাচনের তিনটিতে জয়ী হন আওয়ামী লীগের মতিয়া চৌধুরী। তবে প্রতিবারই বিরোধী দলের পাশাপাশি নিজ দলের বিভক্তিকে মোকাবিলা করতে হয়েছে তাকে। আগামী একাদশ সংসদ নির্বাচনে এই বিভক্তি আরও বেশি প্রকট হয়ে দেখা দেবে বলে মনে করছেন দলের নেতাকর্মীরা।
নকলা-নালিতাবাড়ী দুই উপজেলা নিয়ে গঠিত এ আসনে আওয়ামী লীগে ঐক্য নেই প্রায় ২০ বছর ধরে। নেই পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও আস্থা। বিশেষ করে নালিতাবাড়ী উপজেলা আওয়ামী লীগে চলছে পরস্পরকে কোণঠাসা করার রাজনীতি। ফলে নেতাকর্মীদের মধ্যে বেড়েছে দূরত্ব ও হতাশা।
এলাকার এমপি কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরী, সাবেক উপজেলা পরিষদের চেয়ারম্যান ও বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বদিউজ্জামান বাদশা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি মুক্তিযোদ্ধা আব্দুল হালিম উকিল ও উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকসেদুর রহমান লেবুর মধ্যকার টানাপোড়েনে এখানকার আওয়ামী লীগ বহুধাবিভক্ত। এই বিভক্তির সুবিধা কাজে লাগিয়ে বর্তমান উপজেলা চেয়ারম্যান ও ভাইস চেয়ারম্যানের পদটি দখল করেছে বিএনপি। একই কারণে বিগত পৌর মেয়রের পদটিও ছিল বিএনপির দখলে।
দুই দশক ধরে চলা এই বিভেদ ও বিভক্তির রাজনীতির লাগাম এখনই টেনে না ধরলে আগামী একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে স্থানীয় মানুষের ধারণা।
আওয়ামী লীগের এই বিভেদ কাজে লাগাতে চায় বিএনপি। সরকারবিরোধী দলটির মধ্যে অভ্যন্তরীণ কিছু বিভেদ থাকলেও জাতীয় নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করেন স্থানীয় নেতারা। এ কারণে বিএনপির নেতাকর্মীরা আছেন বেশ ফুরফুরে মেজাজে।
এ আসনে আওয়ামী লীগ থেকে মনোনয়ন-প্রত্যাশীদের মধ্যে বেগম মতিয়া চৌধুরী তো আছেনই। এ ছাড়া সাবেক উপজেলা চেয়ারম্যান ও বর্তমানে জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য বদিউজ্জামান বাদশা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকসেদুর রহমান লেবু মনোনয়ন-প্রত্যাশী।
বিএনপি থেকে মনোনয়ন-প্রত্যাশীরা হলেন জাতীয় সংসদের সাবেক হুইপ মরহুম জাহেদ আলী চৌধুরীর ছেলে বিএনপির জাতীয় নির্বাহী কমিটির সদস্য ইঞ্জিনিয়ার ফাহিম চৌধুরী, বেগম খালেদা জিয়ার রাজনৈতিক উপদেষ্টা ব্যারিস্টার হায়দার আলী, নালিতাবাড়ী উপজেলা পরিষদ চেয়ারম্যান মোখলেছুর রহমান রিপন ও জহিদুর রহমান শ্যামল।
জাতীয় পার্টি (এরশাদ) থেকে সাবেক মন্ত্রী মরহুম আব্দুস সালামের ছেলে জেলা জাতীয় পার্টির সহ-সভাপতি শওকত সাঈদ ও জাতীয় পার্টি নির্বাহী কমিটির সদস্য তালুকদার রোজী সিদ্দিকীর নাম শোনা যাচ্ছে।
সূত্রমতে, ১৯৯৬ সালে আওয়ামী লীগ ক্ষমতাসীন হওয়ার পর স্থানীয় আওয়ামী লীগে বিভক্তি ছড়িয়ে পড়ে। সে সময়ের এমপি ও কৃষিমন্ত্রী বেগম মতিয়া চৌধুরীর আনুকূল্যে থাকা তৎকালীন কেন্দ্রীয় কৃষক লীগ নেতা বদিউজ্জামান বাদশা এবং উপজেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি আব্দুল হালিম উকিলের দ্বন্দ্বের বলি হন উপজেলা ছাত্রলীগের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ চকন ও সাধারণ সম্পাদক ইউসুফ আলী।
এর প্রভাব পড়ে ২০০১ সালের জাতীয় সংসদ নির্বাচনে। মতিয়া চৌধুরী পরাজিত হন চারদলীয় জোট প্রার্থী বিএনপির জাহেদ আলী চৌধুরীর কাছে।
পরে ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত সংসদ নির্বাচনে মতিয়া চৌধুরী আবার বিজয়ী হন। ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচনে দলের প্রভাবশালী নেতাদের প্রায় সবাই যখন বিনা প্রতিদ্বন্দ্বিতায় নির্বাচিত হন, তখন মতিয়া চৌধুরীকে ভোটের মোকাবিলা করতে হয় নিজ দলের প্রার্থীর বিপক্ষে। তিনি দলের মনোনয়ন পেলেও তাকে চ্যালেঞ্জ জানিয়ে স্বতন্ত্র প্রার্থী হন বদিউজ্জামান বাদশা। তবে নির্বাচনের দিন ভোট ডাকাতির অভিযোগ এনে বেলা ১১টায় বাদশা নির্বাচন বর্জন করেন। মতিয়া চৌধুরী চতুর্থবারের মতো এমপি নির্বাচিত হন।
কিন্তু ১৯৯৬ সালে স্থানীয় আওয়ামী লীগে যে বিভেদ ও বিভক্তির রাজনীতির শুরু, তার ধারাবাহিকতা এখনো চলছে। বর্তমানে দলে গ্রুপ-উপগ্রুপে বিভক্তি আরও প্রকট হয়ে উঠেছে।
বর্তমানে একদিকে বদিউজ্জামান বাদশা দলের মনোনয়ন পাওয়ার প্রত্যাশায় মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন। একই সঙ্গে দলের অনিয়মের প্রতিবাদ ও শৃঙ্খলা প্রতিষ্ঠার জন্য মাঠে রয়েছেন সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকসেদুর রহমান লেবু। তিনি তৃণমূলের নেতাকর্মীদের সক্রিয় রাখার জন্য দেশরত জনঐক্য পরিষদ গঠন করে গণসংযোগ করে যাচ্ছেন শহর থেকে গ্রাম পর্যন্ত। তার সঙ্গে রয়েছেন স্থানীয় নেতাকর্মী ও শ্রমিক সংগঠন।
অন্যদিকে বেগম মতিয়া চৌধুরী চলছেন নিজের মতো করে। তিনি এখানে উপজেলা আওয়ামী লীগের কমিটি গঠন করে দিয়েছেন। তার নির্দেশমতো দলীয় সাংগঠনিক কার্যক্রম ও এলাকার উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
আওয়ামী লীগের নিজেদের মধ্যকার শত্রুতা যে আগামী নির্বাচনের জন্য ক্ষতির কারণ হতে পারে তা স্থানীয় সমর্থক-শুভাকাক্সক্ষীরাও আশঙ্কা করছেন।
একটি কলেজের প্রভাষক সাইফুল ইসলাম বলেন, আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের মধ্যে যোগাযোগ ও সমন্বয়ের অভাব ও দূরত্ব বাড়ছে। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে এখনই অনেক নেতাকর্মী ও সাধারণ ভোটার শঙ্কিত।
নাম প্রকাশ না করার শর্তে একজন শিক্ষক বলেন, মতিয়া চৌধুরীর বড় ভাবমূর্তি থাকলেও আওয়ামী লীগের কেউ কেউ নালিতাবাড়ীর সন্তান পরিচয় দিয়ে বদিউজ্জামান বাদশাকে আগামী দিনে এমপি হিসেবে দেখতে চান। আবার উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক মোকসেদুর রহমান লেবু তার নেতাকর্মী ও স্থানীয় শ্রমিক সংগঠনের নেতাকর্মীদের নিয়ে মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন।
এ প্রসঙ্গে উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক ও জেলা আওয়ামী লীগের সদস্য সরকার গোলাম ফারুক বলেন, ‘স্থানীয় আওয়ামী লীগকে রক্ষার জন্য এখন স্থানীয় নেতৃত্ব প্রয়োজন। হায়ার করা নেতা দিয়ে আর চলে না।’
উপজেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সভাপতি আবদুল হালিম উকিল ঐক্যবিনাশী বিভেদ দূর করার দাবি জানিয়ে বলেন, দলের স্বার্থেই নেতাকর্মীদের মূল্যায়ন করা উচিত।
তবে বর্তমান সাধারণ সম্পাদক ফজলুল হক আওয়ামী লীগের ভেতরকার সব দ্বন্দ্ব ও অনৈক্যের কথা মানতে নারাজ। তিনি বলেন, ‘যারা স্থানীয় নেতৃত্ব প্রতিষ্ঠার দিবাস্বপ্ন দেখছেন, তারা আসলে স্থানীয় আওয়ামী লীগের ক্ষতি করছেন।’
বিএনপির অবস্থান সম্পর্কে স্থানীয় একজন রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, উপজেলা বিএনপির আহ্বায়ক ও যুগ্ম আহ্বায়কের মধ্যে কিছু কোন্দল থাকলেও স্থানীয় পদ-পদবি নিয়েই তা সীমাবদ্ধ। জাতীয় নির্বাচনে এর কোনো প্রভাব পড়বে না বলে মনে করছেন দলের নেতারা। জাতীয় নির্বাচনে যে-ই মনোনয়ন পাবেন তার পক্ষে সবাই কাজ করবেন বলে জানা গেছে।
এই আসনে জামায়াতে ইসলামীসহ অন্যান্য দলের চোখে পড়ার মতো তেমন কোনো কর্মকা- নেই বললেই চলে।
সূত্রঃ ঢাকাটাইমস