বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে যশোর-১ (শার্শা) আসনে দেশের বড় দুই দলে অভ্যন্তরীণ কোন্দল ব্যাপক আকার নিচ্ছে। এই আসনে ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগের মনোনয়ন বাগাতে তৎপর হয়ে উঠেছেন তিন নেতা। অন্যদিকে বিএনপির টিকিট পেতে মাঠে নেমেছেন চার নেতা। নির্বাচনী মাঠে সক্রিয় অন্যান্য রাজনৈতিক দলের একাধিক সম্ভাব্য প্রার্থী। সব মিলিয়ে ১০ জন প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। দলীয় সবুজ সংকেতের আশায় তাঁরা কেন্দ্রে জোর লবিং-তদবিরে ব্যস্ত। একই সঙ্গে চলছে গণসংযোগ।
যশোরের শার্শা উপজেলার ১১টি ইউনিয়ন ও একটি পৌরসভা নিয়ে যশোর-১ আসন গঠিত। দেশের বৃহত্তম স্থলবন্দর বেনাপোল এই আসনে অবস্থিত। ক্ষমতা আর অর্থের দ্বন্দ্বে শার্শায় আওয়ামী লীগ দীর্ঘদিন ধরে দ্বিধাবিভক্ত। দুই ধারায় বিভক্ত স্থানীয় নেতাকর্মীরা। এর মধ্যে নতুন করে ঢুকে পড়েছেন আরেকজন। আওয়ামী লীগের এই তিন মনোনয়নপ্রত্যাশী কর্মীদের আশ্বস্ত করে জোর গলায় বলছেন—মনোনয়ন তিনিই পাচ্ছেন।
মাঠপর্যায়ের তথ্য ও বিভিন্ন সময়ে অনুষ্ঠিত ভোটের হিসাবে দেখা যায়, এই আসনে আওয়ামী লীগের রিজার্ভ ভোট ৪০-৪৫ ও বিএনপির ৩৫-৪০ শতাংশ। বিএনপি জোটের শরিক জামায়াতের একক ভোট রয়েছে ১৫-২০ শতাংশ। এ ক্ষেত্রে জোটগত হিসাবে বিএনপি-জামায়াত জোটের ভোট প্রায় ৬০ শতাংশ। এর বাইরে ২ থেকে ৩ শতাংশ ভোট পায় জাতীয় পার্টি।
আওয়ামী লীগের ঘাঁটি হিসেবে পরিচিত যশোর-১ আসন একসময়ে নৌকার হাতছাড়া হয়ে গিয়েছিল। নৌকার সেই অবস্থান মজবুত করেন বিশিষ্ট শিল্পপতি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি শেখ আফিল উদ্দিন। নৌকার টিকিটে তিনি ২০০৮ ও ২০১৪ সালে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। এবারও তিনি শক্ত প্রার্থী। কিন্তু এমপির বিরুদ্ধে নানা অভিযোগ তুলে এখন আওয়ামী লীগের ‘ঘরের মধ্যেই ঘর’ হয়ে গেছে। আফিল উদ্দিনের নৌকার টিকিট ছিনিয়ে নিতে সচেষ্ট বেনাপোলের মেয়র ও জেলা আওয়ামী লীগের সাংগঠনিক সম্পাদক আশরাফুল আলম লিটন এবং সাবেক এডিশনাল আইজিপি মো. আব্দুল মাবুদ (পিপিএম)।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, শার্শা আওয়ামী লীগের তৃণমূলে শেখ আফিল উদ্দিনের অবস্থান বেশ সুসংহত। ২০০৮ সালের নির্বাচনের পর সংগঠনে বিভক্তি শুরু হয়। একাংশ আফিলের বিপক্ষে চলে গিয়ে আশরাফুল আলম লিটনের অনুসারী হন। তার পরও দশম সংসদ নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী ছাড়াই নৌকার টিকিট পেয়ে এমপি হন আফিল উদ্দিন। কিন্তু পৌর মেয়র লিটনের সঙ্গে তাঁর দ্বন্দ্ব দিনে দিনে প্রকট হয়েছে। বর্তমান এই দুই নেতাকে ঘিরে স্থানীয় আওয়ামী লীগের রাজনীতিতে চলছে ঠাণ্ডা লড়াই।
শার্শা উপজেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক আলহাজ নুরুজ্জামান বলেন, ‘এখানে আফিল উদ্দিনের বিকল্প নেই। উপজেলার ১১টি ইউনিয়নে তিনি নজিরবিহীন উন্নয়ন করেছেন। গত ইউপি নির্বাচনে ১১টি ইউনিয়নের মধ্যে ৯টি ইউনিয়নে তাঁর সমর্থক চেয়ারম্যান প্রার্থীরা নির্বাচিত হয়েছেন। এসব ইউনিয়নে তাঁর ব্যাপক জনসমর্থন রয়েছে।’
অন্যদিকে আশরাফুল আলম লিটন এই আসনে নিজেকে দলীয় প্রার্থী হিসেবে প্রচার করে মাঠ দখলে রাখার চেষ্টা করছেন। আফিল উদ্দিনের প্রতি ইঙ্গিত করে তিনি বলেন, ‘শার্শার বিশেষ এক ব্যক্তি দলের গঠনতন্ত্র মানেন না। জেলা কমিটি উপজেলা ছাত্রলীগ, যুবলীগ ও আওয়ামী লীগের কমিটি দিয়েছে। উনি বিপক্ষে পাল্টা কমিটি দিয়ে দলে বিভাজন সৃষ্টি করেছেন। তিনি ইউপি নির্বাচনে নৌকা প্রতীকের বিপক্ষে প্রার্থী দিয়েছেন। দলের বিপক্ষে তাঁর ধারাবাহিক কর্মকাণ্ডের কারণে শার্শার মানুষ পরিবর্তন চায়।’
বর্তমান এমপি ও পৌর মেয়রের দ্বন্দ্বের প্রেক্ষাপটে আওয়ামী ঘরানার অনেক কর্মী-সমর্থক চাইছে তৃতীয় কোনো ব্যক্তি নৌকার হাল ধরুক। সেই হিসেবে মাঠে নেমেছেন মো. আব্দুল মাবুদ। তবে যে মহলটি তাঁকে নিয়ে প্রচার চালাচ্ছে তাদের গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে প্রশ্ন রয়েছে। নিজ ইউনিয়নের বাইরে তাঁর তেমন পরিচিতিও নেই। তার ওপর গত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে কেন্দ্রে লবিং করে তিনজনকে প্রার্থিতা পাইয়ে দেন তিনি। তাঁদের মধ্যে একজন জয়ী হন। অন্য দুই জয়ী প্রার্থী শেখ আফিল উদ্দিনের সমর্থক। এ অবস্থায় নৌকার প্রার্থী হতে পারলেও তাঁর পক্ষে ছিনিয়ে আনাটা যথেষ্টই কঠিন হবে।
অন্যদিকে বিএনপির চার নেতাও ধানের শীষ প্রতীক পেতে জোর তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছেন। তাঁরা হলেন কেন্দ্রীয় বিএনপির সাবেক দপ্তর সম্পাদক মফিকুল হাসান তৃপ্তি, কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের সহসাধারণ সম্পাদক আলহাজ মহসিন কবির, শার্শা উপজেলা বিএনপির সভাপতি আলহাজ খায়রুজ্জামান মধু, সাধারণ সম্পাদক ও শার্শা সদর ইউনিয়নের সাবেক চেয়ারম্যান আবুল হাসান জহির। সংস্কারপন্থী হিসেবে পরিচিত তৃপ্তির মনোনয়ন ঠেকাতে মরিয়া একটি পক্ষ। আবার জামায়াতের অস্তিত্ব নিয়েও রয়েছে বিএনপিতে ভয়। তবে তিন প্রার্থীই আতঙ্কে আছেন তৃপ্তিকে নিয়ে। তাঁকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া ও প্রার্থী হিসেবে নাম আসার গুঞ্জনে শার্শা বিএনপির রাজনীতিতে বেশ ঝড় উঠেছে।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, বিএনপির এক অংশের নেতাকর্মীদের মধ্যে তৃপ্তির ব্যাপক জনপ্রিয়তা রয়েছে। ইতিমধ্যে বহিষ্কারাদেশ প্রত্যাহার করে তাঁকে দলে ফিরিয়ে নেওয়া হয়েছে। দলীয় নেতাকর্মীরা আশা করছেন কেন্দ্র থেকে তৃপ্তিকেই মনোনয়ন দেওয়া হবে। কারণ তিনিই এখানে বিএনপির প্রার্থী হওয়ার যোগ্য।
অন্য মনোনয়নপ্রত্যাশী খায়রুজ্জামান মধুর ঘনিষ্ঠজনরা বলছেন, মধু নিবেদিত নেতা। জন্মলগ্ন থেকেই বিএনপির রাজনীতির সঙ্গে জড়িত। দলের দুর্দিনে হামলা-মামলার শিকার হয়েছেন। গত উপজেলা নির্বাচনে তিনি প্রার্থী ছিলেন। সরকারি দলের প্রতিরোধের মুখে তিনি ভোট চলাকালে সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে নির্বাচন থেকে সরে দাঁড়ান। আগামী দিনে দল তাঁকে মূল্যায়ন করবে।
আবুল হাসান জহিরের লোকজনের ভাষ্য, অনেক হামলা-মামলা আর নির্যাতনের শিকার হয়েছেন জহির। তার পরও তিনি সংগঠনে সব সময় সক্রিয় থেকেছেন। দলীয় নেতাকর্মীদের কাছে তিনি নতুন উদ্দীপনা। তাঁর বাইরে দলের মনোনয়ন যাওয়ার কারণ নেই।
আরেক মনোনয়নপ্রত্যাশী মহসীন কবীর বলেন, ‘ওয়ান-ইলেভেনের পর দলকে সুসংগঠিত করতে আপ্রাণ চেষ্টা করেছি। বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের বর্তমান জেলা ও উপজেলা কমিটির সঙ্গেও আমার সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রয়েছে।’
এদিকে জোটগত নির্বাচন হলে বিএনপির অবস্থান কী হবে তা নিয়েও তৃণমূলে নানা প্রশ্ন ঘুরছে। কারণ এরই আগে এখানে জোটগতভাবে জামায়াত বিজয়ী হয়েছে। তবে এবার জামায়াতের নিজের ব্যানারে ভোট করার সুযোগ নেই। অস্তিত্ব রক্ষায় জামায়াত বিএনপির ঘাড়ে ভর করে ধানের শীষ প্রতীকে মনোনয়ন চাইতে পারে। সে ক্ষেত্রে জেলা জামায়াতের সাবেক আমির মাওলানা আজিজুর রহমানকে জোটের প্রার্থী ভাবছেন তৃণমূলের অনেকে।
জাতীয় পার্টির যশোর জেলা সাংগঠনিক সম্পাদক ও শার্শা উপজেলা সভাপতি ডা. আক্তারুজ্জামান এখানে মনোনয়নপ্রত্যাশী। সৎ ও মিষ্টভাষী এই নেতা শার্শায় জাতীয় পার্টিকে টিকিয়ে রেখেছেন। তবে কয়েক দিন ধরে জাতীয় পার্টির ব্যানারে আর এক প্রার্থীর নাম শোনা যাচ্ছে। তিনি হলেন চলচ্চিত্র নায়িকা শাবনূর। শার্শার নাভারণে তাঁর মামার বাড়ি। তবে এলাকার রাজনীতিতে তাঁর পরিচিতি নেই। তবে প্রার্থী হিসেবে তিনি এলাকায় কতটুকু প্রভাব ফেলতে পারেন সেটা ভাববার বিষয়।
সূত্রঃ কালের কণ্ঠ