জাতীয় সংসদের বাইরে থাকা প্রধান বিরোধী জোটের মূল দল বিএনপির সামনে এখন দুটি চ্যালেঞ্জ। এক. সরকারকে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি মেনে নেওয়া বাধ্য করা এবং দুই. দলকে একতাবদ্ধ করে নির্বাচনে অংশ নেওয়া। তবে অবস্থাদৃষ্টে মনে হচ্ছে, সরকার এখনো বিএনপির নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবির প্রতি নমনীয় নয়। তারা সাফ জানিয়ে দিয়েছে যে, বর্তমান সাংবিধানিক কাঠামোতেই নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে।
সম্প্রতি আওয়ামী লীগ সভাপতি প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা লক্ষ্মীপুরে এক জনসভায় ভাষণ দিতে গিয়ে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে ভোট দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। অন্যদিকে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের এক বিজ্ঞপ্তির মাধ্যমে জানিয়েছেন, সারা দেশের আওয়ামী লীগের বিদ্যমান কমিটিতে আগামী নির্বাচন পর্যন্ত কোনো পরিবর্তন করা হবে না। অর্থাৎ আওয়ামী লীগ যে নির্বাচনের প্রস্তুতি নেওয়া শুরু করেছে- এসব কার্যক্রম থেকেই বুঝা যায়।
সেই তুলনায় বিএনপির অবস্থা কী। নতুন বছরে নয়াপল্টনের কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এক সাক্ষাৎকার নিতে গিয়ে তার কক্ষে দলের মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরকে একটি প্রশ্ন করা হয়েছিল, বিএনপি কি নির্বাচনে যাচ্ছে? তিনি স্পষ্ট ভাষায় উত্তর দিয়েছিলেন, ‘বিএনপি নির্বাচনমুখী দল। বিএনপি সবসময় নির্বাচনে অংশগ্রহণের প্রস্তুতি নিয়েই থাকে। তাই নির্বাচনে না যাওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। তবে বিএনপি চায়, নির্বাচনে অংশগ্রহণের সমান সুযোগ। অবাধ ও সুষ্ঠু নির্বাচনের জন্য আমরা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি করেছি। এই সহায়ক সরকার ছাড়া বর্তমান দলীয় সরকারের অধীনে কোনো নির্বাচনই নিরপেক্ষ আশা করা যায় না।’
এছাড়া বিএনপির নীতিনির্ধারণী ফোরাম স্থায়ী কমিটির বেশ কয়েকজন সদস্য যেমন ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, গয়েশ্বর চন্দ্র রায় প্রমুখ এ নিবন্ধের লেখকের সঙ্গে আলাপে জানিয়েছেন যে, বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায়। তবে কোনোভাবেই শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন কোনো সরকারের অধীনে নয়। নিরপেক্ষ নির্বাচনের জন্য নিরপেক্ষ সরকারের প্রয়োজন। এজন্যই আমরা নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের দাবি জানিয়েছি। এ সরকার কেমন হবে সেই প্রস্তাবনাও আমরা উত্থাপন করব।
উল্লেখ করা প্রয়োজন যে, নিরপেক্ষ তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল করে সংবিধানের পঞ্চদশ সংশোধনী পাস হওয়ার পর থেকেই বিএনপির নেতৃত্বাধীন ২০ দলীয় জোটের প্রধান দাবি ছিল, সংবিধানে তত্ত্বাবধায়ক ব্যবস্থার পুনঃস্থাপন করা। এছাড়া তারা কোনো নির্বাচনে অংশ নিবে না। কিন্তু আওয়ামী লীগ ও তার সহযোগীরা বিএনপির এ দাবিকে নাকচ করে দিয়ে বলেছিল, শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ নিতে হবে। অন্য কোনো দাবি মানা হবে না।
২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারির নির্বাচন শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই হয়েছে। তবে ক্ষমতাসীন ১৪ দলীয় জোটের প্রধান আওয়ামী লীগের প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী বিএনপিসহ নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত ৪৪টি রাজনৈতিক দলের মধ্যে ৩২টিই সেই নির্বাচন বর্জন করে। তারা লীগ সরকারের অধীনে নির্বাচন করতে অস্বীকৃতি জ্ঞাপন করে এই বলে যে, তাদের অধীনে নির্বাচন অবাধ ও নিরপেক্ষ হবে না। একটি সংসদ বহাল রেখে আরেকটি সংসদ নির্বাচন সংবিধানের আলোকে যথার্থ নয়। তাতে প্রতিদ্বন্দ্বীরা কেউ নির্বাচন করেন এমপি পদে বহাল থেকে, অন্যরা করেন সাধারণ নন-এমপি প্রার্থী হিসেবে। তাতে বৈষম্য সৃষ্টি হয় প্রতিদ্বন্দ্বিতায়। লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড আর অবশিষ্ট থাকে না মোটেও।
বিএনপি ও তার সহযোগীরা এসব যুক্তি দেখিয়ে সেই নির্বাচনে অংশ না নিয়ে বয়কট করে। সারাদেশে ব্যাপক আন্দোলন গড়ে তুলতে পারলেও নির্বাচনের পরে মেষ মুহূর্তে আন্দোলন হঠাৎ করেই স্থগিত করা হয়। নির্বাচনের সময় আওয়ামী লীগের নেতারা যেখানে দশম সংসদ নির্বাচনকে বলেছিল কেবল ‘নিয়ম রক্ষার’, সেই তারাই আবার আন্দোলন স্থগিত করার পর বলেছে, সংসদের মেয়াদ ৫ বছরই থাকবে। ২০১৯ সালের একদিন আগেও নির্বাচন হবে না।
বিএনপির স্থায়ী কমিটির সিনিয়র সদস্য ড. খন্দকার মোশাররফ হোসেন জেল থেকে বের হওয়ার পর দেখা করতে গেলে তার গুলশানের বাসায় এ লেখককে বলেছিলেন, ‘৫ জানুয়ারির নির্বাচন নিয়ে সৃষ্টি হওয়া অচলাবস্থা নিরসনে আসা জাতিসংঘ মহাসচিব বান কি মুন-এর রাজনৈতিক বিষয়ক বিশেষ দূত অস্কার ফার্নান্ডেজ তারানকোর সঙ্গে বৈঠকে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির মধ্যে যে সমঝোতা হয় তা ছিল এই যে, জাতীয় সংসদের দশম নির্বাচন হবে একটি নিয়ম রক্ষার নির্বাচন।
এ নির্বাচনের পরপরই সকল দলের কাছে গ্রহণযোগ্য একাদশ সংসদ নির্বাচনের সিডিউল ঘোষণা করা হবে। তখনকার উত্তপ্ত রাজনৈতিক পরিস্থিতি সামাল দিতে সক্ষম হওয়ায় আওয়ামী লীগ সেই নির্বাচনের পথে আর যায়নি। অবশ্য তখন একাদশ নির্বাচন না করার পেছনে আওয়ামী লীগের যুক্তি ছিল এই যে, যেহেতু বিএনপি ও তার সহযোগীরা ৫ জানুয়ারির নির্বাচন বয়কট করেছিল, সেহেতু মি. তারানকোর উপস্থিতিতে যে সমঝোতা হয়েছিল, তার আর কোনো মূল্যই রইল না।
বিএনপির শীর্ষ মহলের ঘনিষ্ঠদের সঙ্গে আলাপে এটা বুঝা গেছে যে, বিএনপি নির্বাচনে যেতে চায়। বিএনপি ইতিমধ্যে সারা দেশে একটি জরিপ চালিয়েছে। সেই জরিপের ভিত্তিতে তারা দলের সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতা যারা এতদিন দলের বাইরে নিষ্ক্রিয় ছিলেন, তাদের দলে টানছেন। কেননা, জরিপে দেখা গেছে, সংস্কারপন্থি হিসেবে পরিচিত নেতাদের সংসদীয় আসনে আওয়ামী লীগের নেতাদের বিপরীতের ওই সংস্কারপন্থি নেতা ছাড়া বিএনপির অন্যকোনো যোগ্য প্রার্থী পাওয়া যায়নি।
এই জরিপের ভিত্তিতেই ইতিমধ্যে দলের সাবেক নেতা সরদার সাখাওয়াত হোসেন বকুল ও জহির উদ্দিন স্বপনকে খালেদা জিয়া ডেকে কথা বলেছেন। তাদেরকে দলে আগের মতো সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দিয়েছেন। ধীরে ধীরে অন্য সংস্কারপন্থি নেতাদেরও ডেকে পাঠানো হবে এবং দলে সক্রিয় হওয়ার নির্দেশ দেওয়া হবে।
নির্বাচনের এসব প্রস্তুতির পাশাপাশি বিএনপি মনে করে, সংবিধানের বর্তমান কাঠামোর আওতায় শেখ হাসিনার অধীনে নির্বাচনে অংশ গ্রহণ করারটা ঠিক হবে না। তবে এটাও ঠিক যে, বিএনপি নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবি থেকে অনেক আগেই সরে এসেছে। পঞ্চদশ সংশোধনীর আগে সংবিধানে যেভাবে তত্ত্বাবধায়ক সরকারের রূপরেখা ছিল, সেই রূপরেখাতে আর নেই তারা। দলের নেতাদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকার চায় যা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বিকল্প। এতে কিছু প্রক্রিয়াগত পার্থক্য থাকবে। এই সহায়ক সরকার পরিচালনা হতে পারে অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে। দলের কয়েকজন সিনিয়র নেতার সঙ্গে আলাপে জানা গেছে, এই সহায়ক সরকার হবে তিন মাস মেয়াদের। রাষ্ট্রপতির অধীনে নির্বাচনকালীন এই সরকারের মন্ত্রিসভায় টেকনোক্রেট কোটায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী, সংস্থাপনসহ গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ে নির্দলীয় নিরপেক্ষ ব্যক্তিদের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব থাকছে।
রাষ্ট্রপতি রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনার মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কাঠামো চূড়ান্ত করতে পারেন। নেতারা জানান, তখন সংসদ বহাল থাকবে। প্রধানমন্ত্রীও দায়িত্বে থাকবেন। এই রূপরেখায় নির্বাচনকালীন তিন মাস প্রধানমন্ত্রীর ছুটিতে থাকার প্রস্তাব থাকছে। যাতে বলা হচ্ছে, প্রধানমন্ত্রী স্বপদে বহাল থেকে ছুটিতে থাকার মাধ্যমে নির্বাচন প্রভাবিত না হওয়ার বিষয়টি নিশ্চিত হবে।
নির্বাচনকালীন নিরপেক্ষ সহায়ক সরকারের কাঠামোতে ২০১৪ সালের নির্বাচনের আগে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ঘোষিত নির্বাচনকালীন সরকারের কথাও বিবেচনায় রাখা হতে পারে, যে সরকারে সংসদের তৎকালীন বিরোধী দল বিএনপি থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দেওয়ার প্রস্তাব করা হয়েছিল। সম্প্রতি সাবেক রাষ্ট্রপতি বদরুদ্দৌজা চৌধুরী ঢাকায় এক গ্রন্থ প্রকাশনার অনুষ্ঠানে এমন একটি কথা বলেছেন। তিনি ওই অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখাকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাকে আবার এমন একটি প্রস্তাব দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
ওই অনুষ্ঠানে বি. চৌধুরী বলেন, ‘সঠিক নির্বাচন যদি করতে হয় নির্বাচন কমিশন এ ব্যাপারে কিছুই করতে পারবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত একটি নিরপেক্ষ সরকার না থাকে। সরকারকে নিরপেক্ষ হতে হবে। যেমন প্রধানমন্ত্রী ২০১৪ সালের ৫ জানুয়ারি নির্বাচনের আগে একটা টেলিফোন করলেন বিরোধী দলের নেত্রীকে। তিনি (প্রধানমন্ত্রী) বললেন, ইয়েস আসুন আমরা সবাই মিলে সুন্দরভাবে নির্বাচনটা করি। নির্বাচনের জন্য আমি অফার দিলাম, আপনি মন্ত্রিসভায় যোগ দেন ফাইভ-ফাইভ। আপনাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এবং সংস্থাপন মন্ত্রণালয় দিয়ে দেব। সবচেয়ে বড় দুইটা মন্ত্রণালয় আপনাকে দিয়ে দেব, যেটা নির্বাচনকে স্বাধীন করার জন্য বড় ভূমিকা রাখে।
এখন প্রশ্ন হচ্ছে, বিএনপি কি শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন সরকার, না তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাবে? বর্তমান সংবিধান অনুযায়ী তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অধীনে নির্বাচনে যাওয়ার আর কোনো সুযোগ নেই। আর শেখ হাসিনাকে রেখে অন্য কোনো সরকারের অধীনেও বিএনপি নির্বাচনে যাওয়ার ব্যাপারে এখন পর্যন্ত গররাজি। তারা মনে করে, শেখ হাসিনাকে রেখে কোনো সরকারের অধীনে নির্বাচন সুষ্ঠু হতে পারে না।
বিএনপির প্রভাবশালী নেতা স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান এ নিবন্ধকারকে বলেছেন, বিএনপি আজ পর্যন্ত যেসব আন্দোলন-সংগ্রাম করেছে তাতো একটি সুষ্ঠু নির্বাচন অনুষ্ঠানের জন্যই। বিএনপি নির্বাচন চায়। তবে অন্য কোনো দলকে জিতিয়ে দেওয়ার বৈধতা দিতে বিএনপি কোনো নির্বাচনে যাবে না। এজন্য সরকারকে সদিচ্ছা দেখাতে হবে। আর জাতীয় নির্বাচন কীভাবে হবেÑ তা নিয়ে সংলাপে বসলেই একটি ফর্মুলা বের হয়ে আসতে পারে। আমরা বলেছি, নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের কথা। এর একটা প্রস্তাবও আমরা দেব। এ প্রস্তাবই যে সব কিছু তাও কিন্তু নয়। এ প্রস্তাব নিয়ে আলাপ-আলোচনা হতে পারে। এর মাধ্যমে নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের সুন্দর একটি কাঠামো বেরিয়ে আসতে পারে।
তবে বিএনপির নেতা-কর্মীরা একটি বিষয় নিয়ে বেশ সন্দিহান যে, নির্বাচনের আগে আগে হয়ত খালেদা জিয়াসহ দলের বেশকিছু কেন্দ্রীয় নেতাকে জেল দিয়ে নির্বাচনে অংশগ্রহণের অযোগ্য ঘোষণা করতে পারে, যা ইতিমধ্যে তারেক রহমানের ক্ষেত্রে ঘটেছে। তাছাড়া একটি পুতুলমার্কা বিএনপিকে সরকার নিজেদের অনুকূলে নিয়ে আসার চেষ্টাও করতে পারে বলে অনেকে আশঙ্কা করছেন। ২০ দলীয় জোটের বেশ কয়েকটি দলের ভাঙন সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যদি এমন চিন্তা করে সামনে এগুতে থাকে, তাহলে তা শুভ ফল বয়ে আনবে না বলে রাজনৈতিক পর্যবেক্ষকরা মনে করেন।