ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ১৪ নভেম্বর ২০২৪, ৩০ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

সংগ্রামী নেতা শহীদ তিতুমীর

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বঙ্গদেশে ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর অন্যতম। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের একজন অগ্রণী সৈনিক। এ দেশে ইসলামের পতাকাবাহী আরেক মর্দে মোমিন হাজী শরীয়তুল্লাহর সমসাময়িক ছিলেন তিতুমীর। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলায় ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরের বাবা সৈয়দ হাসান আলী ও মা রোকেয়া আবেদা খাতুন। তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) এর বংশধর। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তারা ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন এবং ভারতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

তিতুমীর তার শিক্ষক হাজী নিয়ামত উল্লাহর কাছে কোরআন-হাদিস, আরবি, ফারসি ভাষা সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ছিলেন কোরআনে হাফেজ। বিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি তার ওস্তাদের কাছ থেকে কুস্তি লড়াই, লাঠি খেলা, তলোয়ার ও ঢাল-সড়কি চালানোর কায়দা শিখে নেন। তিনি অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। এ সময়ই তিনি কলকাতার প্রখ্যাত পালোয়ান আবিদ আলীকে পরাজিত করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। অতঃপর তিতুমীর হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে স্বদেশ ত্যাগ করে মক্কায় গমন করেন এবং মক্কায় অবস্থানকালে মুক্তি-সংগ্রামের পথপ্রদর্শক ও উপমহাদেশের মহান সাধক সংস্কারক সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। সৈয়দ আহমদ বেরলভির শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার থেকে দীক্ষা নেন মীর নিসার আলী তিতুমীর। ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে তিতুমীর নারিকেলবাড়িয়ার সন্নিকটে আস্তানা স্থাপন করে সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দিন দিন তার শাগরেদ বাড়তে থাকে।

সৈয়দ মীর নিসার আলীর আহ্বানে চব্বিশপরগনা ও নদীয়া জেলাসহ আশপাশের এলাকায় নতুন করে জাগরণ সৃষ্টি হয়। তার ডাকে বিভিন্ন জায়গায় অবহেলা ও অনাদরে পড়ে থাকা মসজিদগুলো সংস্কার করা হয়। আবার মসজিদে যথারীতি নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। নামাজের সময় মুসল্লিতে মসজিদগুলো ভরে যায়। ব্যাপকভাবে ইসলামি আলোচনা ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হতে থাকে। তিতুমীর তার অনুসারীদের ইসলামের বিধান মতো দাড়ি রাখতে আদেশ করেন। তার অনুসারীরা হিন্দুদের অনুকরণে ধুতি পরিধান করতেন না। পোশাকের বিশেষত্ব ও দাড়ির মাধ্যমে সহজেই তার অনুসারীদের চিহ্নিত করা যেত। হিন্দুদের দেখাদেখি অজ্ঞতাবশত যেসব রসম-রেওয়াজ মুসলমানদের মাঝে অনুপ্রবেশ করেছিল, তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি অনুসারীদের আহ্বান জানান।

তিতুমীরের এসব কল্যাণময় কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াল তার সমকালীন জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। কৃষ্ণদেবের অত্যাচারে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটে। জমিদার ঘোষণা দেয়, ‘যারা তিতুমীরের অনুসারী এবং দাড়ি রেখেছে, তাদের আড়াই টাকা হারে বার্ষিক দাড়ি কর দিতে হবে। কাঁচা মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫০০ টাকা এবং পাকা মসজিদের জন্য ১ হাজার টাকা দিতে হবে। প্যাঁচা, পাচু, হরি, কড়ি ইত্যাদি নাম বদল করে মুসলমান নাম রাখলে ৫০ টাকা কর দিতে হবে।’ জমিদার কৃষ্ণদেব ঘোষণা দিয়ে দমে থাকেনি। জোরজবরদস্তি করে এসব কর আদায় করতে থাকেন। তিতুমীরের ভক্ত ও অনুসারী আমিনুল হক দাড়ির কর দিতে অস্বীকার করায় তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে শহীদ করা হয়।

তিতুমীরের এ আন্দোলন ছিল মূলত প্রথম দিকে ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটি কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। নদীয়া ও চব্বিশপরগনার কৃষক দলে দলে তিতুমীরের সংস্কার কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে যোগ দেন। তার নেতৃত্বে এক বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠে। মুসলমান প্রজাদের একতাবদ্ধ এবং তিতুমীরের জনপ্রিয়তায় হিন্দু জমিদাররা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। জমিদাররা তার শক্তি বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে জমিদার মহাজনের অধিকাংশই ছিল হিন্দু এবং কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ছিল মুসলমান। কাজেই কৃষক জনসাধারণের মুক্তি কামনায় এ সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত কৃষকের অর্থনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হয়। একদিকে স্বৈরাচারী ইংরেজ শাসকদের শোষণ-পীড়ন, অন্যদিকে জমিদার মহাজন ও নীলকরদের অকথ্য অত্যাচার। কাজেই তিতুমীরের এ মুক্তি-সংগ্রাম একই সঙ্গে ইংরেজ শাসক এবং জমিদার মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল। মুসলমানদের সঙ্গে জমিদার মহাজন কর্তৃক অত্যাচারিত নিম্নশ্রেণি হিন্দুরাও যোগ দিয়েছিল।

প্রথম থেকে জমিদাররা তাদের দুষ্টু বুদ্ধি প্রয়োগে এ মহান আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে এ আন্দোলনের প্রারম্ভে ধর্মীয় সংস্কারমূলক প্রশ্ন জড়িত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা গণবিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল।

জমিদার কৃষ্ণদেব খাজনা দেওয়ার জন্য প্রজাদের ১০ দিন সময় দিয়েছিল। কিন্তু ১০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও খাজনা না দেওয়ায় জমিদার চারজন বরকন্দাজ পাঠালে তিতুমীরের লোকদের তাড়া খেয়ে তিনজন পালিয়ে যায় এবং একজন ধরা পড়ে। এ অবস্থায় জমিদার ক্ষিপ্ত হয়ে তার লোকজন নিয়ে প্রজাদের বাড়ি লুট করে। একটি মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে তিতুমীর ও প্রজারা থানায় অভিযোগ করলে এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি, বরং মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করা হয়। এই পক্ষপাতিত্ব ঘটনায় তিতুমীর ও প্রজারা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

এদিকে জমিদাররা তিতুমীর ও তার অনুচরদের দমন করার জন্য একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করতে লাগল। তিতুমীর ভাবলেন শান্তিপূর্ণভাবে যেহেতু প্রজাদের স্বার্থ সংরক্ষণ হচ্ছে না, তখন অস্ত্রের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ প্রেক্ষিতে তিনি ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তার শিস্য মুঈজ উদ্দিনের নারকেলবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে কর্মক্ষেত্র স্থাপন করেন। তিতুমীর ও তার সহযোগীরা নারকেলবাড়িয়ায় আত্মরক্ষার জন্য বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন এবং অস্ত্রশস্ত্র জমা করেন।

আন্দোলন চলাকালে বিশিষ্ট দরবেশ ফকির মিসকিনশাহ তিতুমীরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তার নির্ভরযোগ্য সঙ্গীতে পরিণত হন। তিতুমীরের একনিষ্ঠ অনুসারীদের মধ্যে নারকেলবাড়িয়ার মুঈজ উদ্দিন, যশোর থেকে আগত প্রখ্যাত দরবেশ মুসিরতশাহ, শেখ উমির, করিম সর্দার, রমজান, ওয়াকিল আহমদ, আবদুল্লাহ, লাল মুহাম্মদ আলাউদ্দিন, মুহাম্মদ মাসুফ, কারিমশাহ ও তার পুত্রদ্বয় মসিউল্লাহ ও আবদুর রহিম এবং তিতুমীরের ভাগ্নে গোলাম মাসুম অকুতোভয় সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

তিতুমীর ঘোষণা করেন, কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়েছে। তিনি নিজেকে দেশের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন এবং জমিদারদের কাছ থেকে কর দাবি করেন। এরূপ ঘোষণায় শুধু জমিদাররা নয়, নীলকুঠির সাহেবরাও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ নীলকুঠির সাহেবরাও কুঠির নামে প্রায় সবার ছোট-বড় জামিনদারির মালিক হয়ে বসেছিল। তিতুমীরের সহচর গোলাম মাসুম প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। এই সময় তিতুমীরের সঙ্গে হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজদের যে সংঘর্ষ বাধে তাতে তিতুমীরের বাহিনী জয়ী হয়। ইংরেজরা পরাজয়বরণ করায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিক চিন্তায় পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত নদীয়ার কালেক্টরকে বিলম্ব না করে তিতুমীর ও তার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার নির্দেশ দেন। এবারও ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হলে লর্ড বেন্টিক কর্নেল স্টুয়ার্ডের নেতৃত্বে ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর তিতুমীরের কেল্লা আক্রমণ করে।

বিদ্রোহীদের ইট, বেল ও তির বর্ষণে বহু সৈন্য হতাহত হয়। এবার কর্নেল কামান দাগানোর হুকুম দেয়। অনবরত গোলার আঘাতে বাঁশেরকেল্লা ধসে পড়ে। একটা গোলার আঘাতে বাঁশেরকেল্লার অধিনায়ক এবং কৃষক বিদ্রোহের দুঃসাহসিক বীর তিতুমীর শহীদ হন।

তিতুমীরের প্রজা আন্দোলন ছিল একটি গণবিপ্লব। কৃষক ও তাঁতিরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ব্যর্থ হলেও তা পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছিল। আর আজাদি সংগ্রামের প্রথম শহীদের গৌরব তিতুমীরের, অন্য কারও নয়। এ কথা সত্য, তিতুমীরের শাহাদতবরণের রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়েই পরবর্তীকালে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ সুপ্রশস্ত হয়েছিল।

লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা ঢাকা

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

সংগ্রামী নেতা শহীদ তিতুমীর

আপডেট টাইম : ০৫:১৫ পূর্বাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ১০ মে ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বঙ্গদেশে ইসলামি শিক্ষা সম্প্রসারণে যারা উল্লেখযোগ্য অবদান রেখেছেন, তাদের মধ্যে সৈয়দ নিসার আলী তিতুমীর অন্যতম। তিনি ছিলেন উপমহাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রথম পর্যায়ের একজন অগ্রণী সৈনিক। এ দেশে ইসলামের পতাকাবাহী আরেক মর্দে মোমিন হাজী শরীয়তুল্লাহর সমসাময়িক ছিলেন তিতুমীর। পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশপরগনা জেলায় ১৭৮২ খ্রিষ্টাব্দে জন্মগ্রহণ করেন তিনি। সৈয়দ মীর নিসার আলী তিতুমীরের বাবা সৈয়দ হাসান আলী ও মা রোকেয়া আবেদা খাতুন। তাদের পূর্বপুরুষ ছিলেন ইসলামের চতুর্থ খলিফা আলী (রা.) এর বংশধর। ইসলাম প্রচারের উদ্দেশ্যে তারা ভারত উপমহাদেশে আগমন করেন এবং ভারতেই স্থায়ীভাবে বসবাস করেন।

তিতুমীর তার শিক্ষক হাজী নিয়ামত উল্লাহর কাছে কোরআন-হাদিস, আরবি, ফারসি ভাষা সাহিত্য বিষয়ে শিক্ষা লাভ করেন। তিনি ছিলেন কোরআনে হাফেজ। বিদ্যা অর্জনের পাশাপাশি তার ওস্তাদের কাছ থেকে কুস্তি লড়াই, লাঠি খেলা, তলোয়ার ও ঢাল-সড়কি চালানোর কায়দা শিখে নেন। তিনি অসাধারণ দৈহিক শক্তির অধিকারী ছিলেন। এ সময়ই তিনি কলকাতার প্রখ্যাত পালোয়ান আবিদ আলীকে পরাজিত করে সুখ্যাতি অর্জন করেন। অতঃপর তিতুমীর হজব্রত পালনের উদ্দেশ্যে স্বদেশ ত্যাগ করে মক্কায় গমন করেন এবং মক্কায় অবস্থানকালে মুক্তি-সংগ্রামের পথপ্রদর্শক ও উপমহাদেশের মহান সাধক সংস্কারক সৈয়দ আহমদ শহীদ বেরলভির সঙ্গে তার সাক্ষাৎ ঘটে। সৈয়দ আহমদ বেরলভির শিষ্যত্ব গ্রহণ করে তার থেকে দীক্ষা নেন মীর নিসার আলী তিতুমীর। ১৮২৭ খ্রিষ্টাব্দে দেশে ফিরে তিতুমীর নারিকেলবাড়িয়ার সন্নিকটে আস্তানা স্থাপন করে সমাজ সংস্কারের কাজে আত্মনিয়োগ করেন। দিন দিন তার শাগরেদ বাড়তে থাকে।

সৈয়দ মীর নিসার আলীর আহ্বানে চব্বিশপরগনা ও নদীয়া জেলাসহ আশপাশের এলাকায় নতুন করে জাগরণ সৃষ্টি হয়। তার ডাকে বিভিন্ন জায়গায় অবহেলা ও অনাদরে পড়ে থাকা মসজিদগুলো সংস্কার করা হয়। আবার মসজিদে যথারীতি নামাজের ব্যবস্থা করা হয়। নামাজের সময় মুসল্লিতে মসজিদগুলো ভরে যায়। ব্যাপকভাবে ইসলামি আলোচনা ও ওয়াজ মাহফিল অনুষ্ঠিত হতে থাকে। তিতুমীর তার অনুসারীদের ইসলামের বিধান মতো দাড়ি রাখতে আদেশ করেন। তার অনুসারীরা হিন্দুদের অনুকরণে ধুতি পরিধান করতেন না। পোশাকের বিশেষত্ব ও দাড়ির মাধ্যমে সহজেই তার অনুসারীদের চিহ্নিত করা যেত। হিন্দুদের দেখাদেখি অজ্ঞতাবশত যেসব রসম-রেওয়াজ মুসলমানদের মাঝে অনুপ্রবেশ করেছিল, তা থেকে মুক্ত হওয়ার জন্য তিনি অনুসারীদের আহ্বান জানান।

তিতুমীরের এসব কল্যাণময় কাজে বাধা হয়ে দাঁড়াল তার সমকালীন জমিদার কৃষ্ণদেব রায়। কৃষ্ণদেবের অত্যাচারে পরিস্থিতির ভয়াবহ অবনতি ঘটে। জমিদার ঘোষণা দেয়, ‘যারা তিতুমীরের অনুসারী এবং দাড়ি রেখেছে, তাদের আড়াই টাকা হারে বার্ষিক দাড়ি কর দিতে হবে। কাঁচা মসজিদ নির্মাণের জন্য ৫০০ টাকা এবং পাকা মসজিদের জন্য ১ হাজার টাকা দিতে হবে। প্যাঁচা, পাচু, হরি, কড়ি ইত্যাদি নাম বদল করে মুসলমান নাম রাখলে ৫০ টাকা কর দিতে হবে।’ জমিদার কৃষ্ণদেব ঘোষণা দিয়ে দমে থাকেনি। জোরজবরদস্তি করে এসব কর আদায় করতে থাকেন। তিতুমীরের ভক্ত ও অনুসারী আমিনুল হক দাড়ির কর দিতে অস্বীকার করায় তাকে অমানুষিক নির্যাতন করে শহীদ করা হয়।

তিতুমীরের এ আন্দোলন ছিল মূলত প্রথম দিকে ধর্মীয় ও সামাজিক বিষয়ের মধ্যেই সীমাবদ্ধ। এটি কোনো রাজনৈতিক আন্দোলন ছিল না। নদীয়া ও চব্বিশপরগনার কৃষক দলে দলে তিতুমীরের সংস্কার কর্মসূচির প্রতি সমর্থন জানিয়ে যোগ দেন। তার নেতৃত্বে এক বড় ধরনের আন্দোলন গড়ে ওঠে। মুসলমান প্রজাদের একতাবদ্ধ এবং তিতুমীরের জনপ্রিয়তায় হিন্দু জমিদাররা আতঙ্কিত হয়ে ওঠে। জমিদাররা তার শক্তি বৃদ্ধির পথ রুদ্ধ করার জন্য মরিয়া হয়ে ওঠে।

বাংলাদেশে জমিদার মহাজনের অধিকাংশই ছিল হিন্দু এবং কৃষক সম্প্রদায়ের অধিকাংশ ছিল মুসলমান। কাজেই কৃষক জনসাধারণের মুক্তি কামনায় এ সংগ্রাম শেষ পর্যন্ত কৃষকের অর্থনৈতিক সংগ্রামে পরিণত হয়। একদিকে স্বৈরাচারী ইংরেজ শাসকদের শোষণ-পীড়ন, অন্যদিকে জমিদার মহাজন ও নীলকরদের অকথ্য অত্যাচার। কাজেই তিতুমীরের এ মুক্তি-সংগ্রাম একই সঙ্গে ইংরেজ শাসক এবং জমিদার মহাজন ও নীলকরদের বিরুদ্ধে আপসহীন সংগ্রামে পরিণত হয়েছিল। মুসলমানদের সঙ্গে জমিদার মহাজন কর্তৃক অত্যাচারিত নিম্নশ্রেণি হিন্দুরাও যোগ দিয়েছিল।

প্রথম থেকে জমিদাররা তাদের দুষ্টু বুদ্ধি প্রয়োগে এ মহান আন্দোলনকে সাম্প্রদায়িক আখ্যা দিয়ে দুর্বল করার চেষ্টা করেছিল। প্রকৃতপক্ষে এ আন্দোলনের প্রারম্ভে ধর্মীয় সংস্কারমূলক প্রশ্ন জড়িত থাকলেও শেষ পর্যন্ত তা গণবিদ্রোহে পরিণত হয়েছিল।

জমিদার কৃষ্ণদেব খাজনা দেওয়ার জন্য প্রজাদের ১০ দিন সময় দিয়েছিল। কিন্তু ১০ দিন অতিবাহিত হওয়ার পরও খাজনা না দেওয়ায় জমিদার চারজন বরকন্দাজ পাঠালে তিতুমীরের লোকদের তাড়া খেয়ে তিনজন পালিয়ে যায় এবং একজন ধরা পড়ে। এ অবস্থায় জমিদার ক্ষিপ্ত হয়ে তার লোকজন নিয়ে প্রজাদের বাড়ি লুট করে। একটি মসজিদে আগুন লাগিয়ে দেয়। এর প্রতিবাদে ক্ষুব্ধ হয়ে তিতুমীর ও প্রজারা থানায় অভিযোগ করলে এর কোনো প্রতিকার পাওয়া যায়নি, বরং মুসলমান প্রজাদের কাছ থেকে মুচলেকা আদায় করা হয়। এই পক্ষপাতিত্ব ঘটনায় তিতুমীর ও প্রজারা আরও বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠেন।

এদিকে জমিদাররা তিতুমীর ও তার অনুচরদের দমন করার জন্য একের পর এক মিথ্যা মামলা দায়ের করতে লাগল। তিতুমীর ভাবলেন শান্তিপূর্ণভাবে যেহেতু প্রজাদের স্বার্থ সংরক্ষণ হচ্ছে না, তখন অস্ত্রের সাহায্য নেওয়া ছাড়া উপায় নেই। এ প্রেক্ষিতে তিনি ১৮৩১ খ্রিষ্টাব্দের অক্টোবর মাসে তার শিস্য মুঈজ উদ্দিনের নারকেলবাড়িয়ার গ্রামের বাড়িতে কর্মক্ষেত্র স্থাপন করেন। তিতুমীর ও তার সহযোগীরা নারকেলবাড়িয়ায় আত্মরক্ষার জন্য বাঁশেরকেল্লা নির্মাণ করেন এবং অস্ত্রশস্ত্র জমা করেন।

আন্দোলন চলাকালে বিশিষ্ট দরবেশ ফকির মিসকিনশাহ তিতুমীরের সঙ্গে একাত্ম হয়ে তার নির্ভরযোগ্য সঙ্গীতে পরিণত হন। তিতুমীরের একনিষ্ঠ অনুসারীদের মধ্যে নারকেলবাড়িয়ার মুঈজ উদ্দিন, যশোর থেকে আগত প্রখ্যাত দরবেশ মুসিরতশাহ, শেখ উমির, করিম সর্দার, রমজান, ওয়াকিল আহমদ, আবদুল্লাহ, লাল মুহাম্মদ আলাউদ্দিন, মুহাম্মদ মাসুফ, কারিমশাহ ও তার পুত্রদ্বয় মসিউল্লাহ ও আবদুর রহিম এবং তিতুমীরের ভাগ্নে গোলাম মাসুম অকুতোভয় সংগ্রামী ভূমিকায় অবতীর্ণ হন।

তিতুমীর ঘোষণা করেন, কোম্পানির রাজত্বের অবসান হয়েছে। তিনি নিজেকে দেশের শাসক হিসেবে ঘোষণা করেন এবং জমিদারদের কাছ থেকে কর দাবি করেন। এরূপ ঘোষণায় শুধু জমিদাররা নয়, নীলকুঠির সাহেবরাও সন্ত্রস্ত হয়ে পড়ে। কারণ নীলকুঠির সাহেবরাও কুঠির নামে প্রায় সবার ছোট-বড় জামিনদারির মালিক হয়ে বসেছিল। তিতুমীরের সহচর গোলাম মাসুম প্রধান সেনাপতি নিযুক্ত হন। এই সময় তিতুমীরের সঙ্গে হিন্দু জমিদার এবং ইংরেজদের যে সংঘর্ষ বাধে তাতে তিতুমীরের বাহিনী জয়ী হয়। ইংরেজরা পরাজয়বরণ করায় তৎকালীন গভর্নর জেনারেল লর্ড বেন্টিক চিন্তায় পড়েন এবং শেষ পর্যন্ত নদীয়ার কালেক্টরকে বিলম্ব না করে তিতুমীর ও তার বাহিনীকে পর্যুদস্ত করার নির্দেশ দেন। এবারও ইংরেজ বাহিনী পরাজিত হলে লর্ড বেন্টিক কর্নেল স্টুয়ার্ডের নেতৃত্বে ১৮৩১ সালের ১৯ নভেম্বর তিতুমীরের কেল্লা আক্রমণ করে।

বিদ্রোহীদের ইট, বেল ও তির বর্ষণে বহু সৈন্য হতাহত হয়। এবার কর্নেল কামান দাগানোর হুকুম দেয়। অনবরত গোলার আঘাতে বাঁশেরকেল্লা ধসে পড়ে। একটা গোলার আঘাতে বাঁশেরকেল্লার অধিনায়ক এবং কৃষক বিদ্রোহের দুঃসাহসিক বীর তিতুমীর শহীদ হন।

তিতুমীরের প্রজা আন্দোলন ছিল একটি গণবিপ্লব। কৃষক ও তাঁতিরা এই আন্দোলনে যোগ দিয়ে জমিদার ও নীলকরদের বিরুদ্ধে সংগ্রাম করেছিলেন। শক্তিশালী প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে তার সংগ্রাম ব্যর্থ হলেও তা পরবর্তীকালে স্বাধীনতা সংগ্রামের প্রেরণা জুগিয়েছিল। আর আজাদি সংগ্রামের প্রথম শহীদের গৌরব তিতুমীরের, অন্য কারও নয়। এ কথা সত্য, তিতুমীরের শাহাদতবরণের রক্ত পিচ্ছিল পথ বেয়েই পরবর্তীকালে এ দেশের স্বাধীনতা সংগ্রামের পথ সুপ্রশস্ত হয়েছিল।

লেখক : শিক্ষক, বাইতুন নূর মাদ্রাসা ঢাকা