বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ জীবনের অর্থ খুঁজে বের করা যেমন কঠিন, তারচেয়ে বেশি কঠিন জীবনের অস্তিত্ব খুঁজে পাওয়া। জীবনের বাঁকে বাঁকে কঠিন সব সমীকরণের সমাধান করতে পারলেও জীবনের অস্তিত্ব, মূল ও পরিণতি কী, তা নিয়ে চিন্তা করার ফুরসতইবা কই আমাদের।
মানবজীবনের মূল উৎপত্তি নিয়ে নৃতাত্ত্বিক কিংবা বিশ্বধর্মের দর্শনে ভিন্ন ভিন্ন তথ্য ও পরিভাষা সাধারণ মানুষদের বিভ্রান্তিতে ফেলে। বিশ্বধর্মের সর্বশেষ ধর্ম ইসলামে এ ব্যাপারে পরিষ্কার ধারণা তুলে ধরা হয়েছে পবিত্র কোরআন ও হাদিসের মাধ্যমে। এখানে জীবনের অধ্যায়গুলোকে মূলত তিন পর্বে বিভক্ত করে বর্ণনা করা হয়েছে। যথা ১. ‘আলমে আরওহয়াহ (সুরা আরাফ : ১৭২, সূরা হাদিদ : ২০), ২. দুনিয়ার জীবন (সূরা আনআম : ৭০) এবং ৩. আখেরাতে জীবন (সূরা বাকারা : ২৮; আলে ইমরান : ১৮৫)।
‘আলমে আরওয়া (রুহের জগৎ) সম্পর্কে কোরআনে বেশ কয়েকটি আয়াত সত্যয়ন ও বর্ণনা করেছে। (তার মধ্যে সূরা আরাফের ১৭২ নম্বর আয়াতে বলা হয়েছে ‘আর যখন তোমার পালনকর্তা বনণ আদমের পৃষ্ঠদেশ থেকে বের করলেন তাদের সন্তানদের এবং নিজের ওপর তাদের প্রতিজ্ঞা করালেন, আমি কি তোমাদের পালনকর্তা নই? তারা বলল, অবশ্যই, আমরা অঙ্গীকার করছি। আবার না কেয়ামতের দিন বলতে শুরু করে যে, এ বিষয়টি আমাদের জানা ছিল না।’ আল্লাহ রাব্বুল আলামিন আদম (আ.) কে সৃষ্টি করার সঙ্গে সঙ্গে মানবজাতির রুহগুলোকে সৃষ্টি করে এ জগতে স্থান দেন। সেখানে রুহ ছিল, কিন্তু কোনো শরীর ছিল না।
দ্বিতীয় পর্বের দুইটি স্তর। প্রথম স্তরে মানবশিশু ১২০ দিন পর মায়ের গর্ভেই রুহ প্রাপ্তির মাধ্যমে ব্যক্তির দুনিয়াবি জীবন শুরু হয়ে যায়। (বোখারি)। মাতৃগর্ভ থেকে বের হয়েই তার ইহজাগতিক জীবনের মূল পর্ব শুরু হয়ে গেলেও তার কোনো কার্যক্রমের জবাবদিহিতা শুরু হয় আরও পরে। যখন সে শরয়িভাবে ‘বালেগ’ হয়। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তার এ জীবনের জবাবদিহিতা করার লক্ষ্যে পরিচালনা করতে হয় প্রত্যেকটা কার্যক্রম। (বোখারি)। কারণ এ সময়টাই হলো তার পরবর্তী এবং আসল জীবনের প্রস্তুতির সময়। এখানকার প্রস্তুতির ওপর নির্ভর করবে তার আসল জীবনের পরিণতি।
মৃত্যুর মধ্য দিয়ে প্রত্যেক ব্যক্তির আখেরাতের জীবন শুরু হয় বটে, কিন্তু এ জীবনের তৃতীয় পর্বের প্রথম পর্বে প্রবেশ করে কিছু সময়ের জন্য। এটাকে ‘আলম আল বারযাখ (সূরা মোমিনুন : ১০০) বলা হয়। এখানে প্রবেশের শুরুতেই তাকে তিনটি প্রশ্ন করা হয় ১. তোমার রব কে? ২. তোমার দ্বীন কী? এবং ৩. তোমার নবী কে? (আবু দাউদ : ৪৭৫৩)। এসব উত্তরের যথোপযুক্ত উত্তরের ওপর নির্ভর করে তার অবস্থান হবে ইল্যিয়ুনে (সুরা মুতাফফিফিন : ১৮-২০) না সিজ্জিনে (সূরা মুতাফফিফিন : ৭-৮)। কেয়ামতের আগ পর্যন্ত প্রথম মানবের মৃত্যু থেকে শুরু করে সবাই এই নির্দিষ্ট সময় অবস্থান করবে এখানে। জীবনের এ অধ্যায়ের দ্বিতীয় পর্বের শুরু হবে পুনরুত্থানের মধ্য দিয়ে। (সূরা ত্বহা : ৫৫)। এদিনে সব মানবজাতি ফের উত্থিত হয়ে হাশরের বা বিচারের মাঠে উপস্থিত হবে। (সূরা হাশর : ২)। সব কাজের বিচার হবে এই দিনে। (সূরা ইসরা : ১৩-১৪)।
ভালো আমলের পাল্লা ভারী হলে ব্যক্তির জায়গা হবে জান্নাতে আর তার ব্যতিক্রম হলে স্থান হবে জাহান্নামে। (সূরা বায়্যিনাত : ৬-৮)। জান্নাত হলো একমাত্র শান্তির এবং জাহান্নাম হলো একমাত্র প্রকৃত দুঃখের জায়গা। জান্নাতের মধ্যে সব ধরনের সুখের প্রাপ্তির মধ্যে সর্বোত্তম প্রাপ্তি হবে মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিনের সাক্ষাৎ। (সূরা কাহাফ : ১১০)। সবচেয়ে কম আমল নিয়ে যে ব্যক্তি জান্নাতে যাবে, সে যে জান্নাতটি পাবে তা হবে এ পৃথিবীর চেয়ে দশগুণ বেশি। কী থাকবে না সেখানে? যা চাওয়া হবে সঙ্গে সঙ্গেই দেওয়া হবে। প্রত্যাশার কোনো অপ্রাপ্তিই সেখানে থাকবে না।
পক্ষান্তরে জাহান্নাম হবে সব ধরনের কষ্ট ও দুঃখের উপকরণ দিয়ে সজ্জিত। সেখানে প্রজ্বলিত আগুনের সর্বনিম্নস্তরে, যেখান থেকে উৎপন্ন হবে মূল আগুন, সেখানে থাকবে মুনাফিকরা। (সূরা নিসা : ১৪৫)। অপমানজনকভাবে জাহান্নামে থাকবে বিনাকারণে মানব হত্যাকারীরা। তাদের কপালে লিখে দেওয়া হবে ‘আল্লাহর রহমত থেকে বঞ্চিত’ নামের এক মোহর। এমনকি সব জাহান্নামিও তাদের ঘৃণা করবে। (সূরা দুখান : ৫১-৫৯)। তাদের খাদ্য হবে যাক্কুম বৃক্ষের কাঁটাযুক্ত ফল এবং পানীয় হিসেবে দেওয়া হবে এমন পুঁজ, যার সামান্য পরিমাণও যদি এ দুনিয়ায় দেওয়া হতো, তাহলে সারাবিশ্ব এতটাই দুর্গন্ধ হয়ে যেত যে, সব প্রাণী মৃত্যুবরণ করত। (সূরা দুখান : ৪৩-৪৬)।
এ আলোচনা দুইটি মৌলিক ধারণা দেবে সবাইকে। এক. ডারউইনের মতবাদ, যা মানব বিবর্তনবাদ নামেও প্রসিদ্ধ (মানবজাতি প্রাইমেট অ্যানিমেল (বানর প্রজাতি) থেকে এসেছে)। দুই. মানবজীবনের আসল পরিণতি সম্পর্কে অবহিত করবে। ফলে নিজের মূল ও অস্তিত্বের শুরু নিয়ে যেমন গর্ব করতে পারবে, তেমনি শেষ পরিণতির জন্য নিজেকে সম্পূর্ণভাবে প্রস্তুত করতে পারবে। সেখানে নিজের ঈমান ও আমলের দৃঢ়তার ওপর নির্ভর না করে অন্যের সুপারিশের ভরসায় থেকে অন্যায়ের মধ্যে নিমজ্জিত রাখবে না। প্রকৃত সত্য উপলব্ধির মাধ্যমে মিথ্যাকে ছুড়ে ফেলতে যেমন সাহসী হবে, তেমনি চূড়ান্ত জীবনে শান্তিকে নিশ্চিত করতে দুনিয়াবি জীবনের প্রত্যেক সেকেন্ডকে কাজে লাগানোর প্রত্যয়ে দ্ব্যর্থহীনভাবে প্রয়াস চালাবে। শয়তানের কুমন্ত্রণা তাকে ছুঁতেও পারবে না। এটা আমাদেরও প্রত্যাশা।