বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বিয়ের মাধ্যমে অন্তরের প্রশান্তি বাড়ে। কর্মমুখর দিন শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে স্বস্তি আসে স্ত্রীর মাধ্যমে। জাগতিক জীবনের শত কোলাহল, কষ্ট মানুষ সহ্য করে প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে। এ বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একজন ব্যক্তি থেকে। তা থেকেই তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।’ (সূরা আরাফ : ১৮৯)
ইজাব ও কবুল তথা প্রস্তাব ও প্রস্তাব গ্রহণের মাধ্যমে একজোড়া পুরুষ ও নারীর পবিত্র বন্ধনে আবদ্ধ হওয়াকে বিয়ে বলে। বিয়ের প্রস্তাব ও এ প্রস্তাব গ্রহণ কিংবা গ্রহণ না করার ক্ষেত্রে তারা উভয়ে সম্পূর্ণ স্বাধীন। জোর করে অথবা কোনোরূপ ভয়ভীতি কিংবা টাকাপয়সার লোভ দেখিয়ে বিয়ে বন্ধন সম্পূর্ণ নিষিদ্ধ। ইসলামে বিয়েবন্ধন কোনো গোপন চুক্তি নয়। তা হতে হবে প্রকাশ্যে একাধিক সাক্ষীর উপস্থিতিতে ঘোষণার মাধ্যমে। গোপন বিয়ে পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি পায় না। যে বিয়ের পারিবারিক ও সামাজিক স্বীকৃতি নেই, সে বিয়ে গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। মহান রাব্বুল আলামিন সমগ্র জাতিকে দুইভাগে বিভক্ত করে সৃষ্টি করেছেন। যার অর্ধেক পুরুষ, আর অর্ধেক নরী। অতঃপর বেঁধে দিয়েছেন পারস্পরিক দয়ামায়া, অনুরাগ ও ভালোবাসার বন্ধনে।
ইসলামে বিয়ের ভেতর পাঁচটি উপকার রয়েছে ১. সন্তান লাভ, ২. কামরিপু দমন, ৩. বসবাসের স্থান, ৪. আত্মীয়স্বজন বৃদ্ধি এবং ৫. গৃহকর্মে পতীর সহযোগিতা ও সহানুভূতি লাভ।
স্বামী-স্ত্রীর মিলনের ফলে সন্তানের জন্মলাভ ঘটে। এতে বংশরক্ষা এবং জনসংখ্যা বিস্তার লাভ করে। এটি বিয়ের মূল উদ্দেশ্য। এ উদ্দেশ্যের ফলস্বরূপ ঘটে মানব অস্তিত্বের ধারাবাহিকতা, রাসুল (সা.) এর উম্মত বৃদ্ধি এবং এর মাধ্যমে তাঁর ভালোবাসা অন্বেষণ, মৃত্যুর পর নেককার সন্তানের দোয়া পাওয়ার পথ সুগম হয়।
শয়তানের আক্রমণ থেকে রক্ষা পাওয়ার জন্য বিয়ে উত্তম অস্ত্র। প্রবৃত্তিকে বশে রাখা, কামরিপুর অসহনীয় দৌরাত্ম্য নিয়ন্ত্রণে রাখা, চোখের দৃষ্টি ধর্মীয় আঙ্গিকে সামলে রাখা এবং লজ্জাস্থান রক্ষা করার জন্য বিয়ে অনেক উপকারী। রাসুল (সা.) যুবকদের সম্বোধন করে বলেছেন, ‘হে যুবসমাজ! তোমাদের মধ্যে যারা বিয়ের সামর্থ্য রাখে, তাদের বিয়ে করা কর্তব্য। কেননা বিয়ে দৃষ্টি নিয়ন্ত্রণকারী, যৌনাঙ্গের পবিত্রতা রক্ষাকারী। আর যার সামর্থ্য নেই, সে যেন সিয়াম পালন করে। কেননা সিয়াম হচ্ছে যৌবনকে দমন করার মাধ্যম।’ (বোখারি : ৫০৬৫)।
পাত্রী নির্বাচনের ক্ষেত্রেও ইসলামের দৃষ্টিতে বিশেষ একটি গুণ যাচাই করে দেখা আবশ্যক। সে গুণটি হচ্ছে, ‘কনের দ্বীনদার ও ধার্মিক হওয়া।’ এ সম্পর্কে রাসুল (সা.) এরশাদ করেন, ‘চারটি গুণের কারণে একটি মেয়েকে বিয়ে করার কথা বিবেচনা করা হয়। তার ধনসম্পদ, তার বংশ গৌরব তথা সামাজিক মানমর্যাদা, তার রূপ-সৌন্দর্য এবং দ্বীনদারি। কিন্তু তোমরা দ্বীনদার মেয়েকে বিয়ে করে সফলতা অর্জন করো।’ (বোখারি : ৪৭০০)। হাদিসে বর্ণিত চারটি গুণের মাঝে সর্বশেষ গুণটাই মুখ্য। প্রথম তিনটি গুণ বিদ্যমান থাকার পরও যদি শেষের গুণ অর্থাৎ দ্বীনদারি না থাকে, তাহলে প্রথমোক্ত তিনটি গুণ মূল্যহীন হয়ে যাবে। তবে এক্ষেত্রে মেয়েকেও পছন্দের ব্যাপারে সুযোগ দিতে হবে। সম্প্রতি এ বিষয়টি আমরা অনেকটা এড়িয়ে যাই। অথচ তা খুবই জরুরি। যে ব্যক্তি নেককার নারীকে বিয়ে করল, সে ইসলামের পথে ক্রমাগ্রসর হলো। মহানবী (সা.) এরশাদ করেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা যাকে একজন নেককার স্ত্রী দান করেছেন, তিনি তাকে ইসলামের পথে অর্ধেক অগ্রসর করে দিয়েছেন। এবার অবশিষ্ট অর্ধেকের জন্য তার উচিত আল্লাহকে ভয় করা।’ (মুসতাদরাক হাকেম : ২/১৬১)।
যৌনবোধ সহজাত প্রবণতা হওয়ার কারণে অন্যের বিনা ইঙ্গিতে বা অজানা-অচেনা হওয়া সত্ত্বেও পুরুষ-নারী পরস্পরের প্রতি আপনা থেকেই যৌন আকর্ষণ অনুভব করে এবং বাধাপ্রাপ্ত না হলে দৈহিক মিলনেও ব্রতী হয়। সহজাত প্রক্রিয়াকে সহজেই অবদমন করা খুবই কঠিন। অন্যান্য ধর্মে এ কাজটিকে পবিত্রতার জন্য জরুরি করতে গিয়ে অধিকাংশ ক্ষেত্রেই বিফলতা জুটেছে। ইসলাম সহজাত প্রবণতা রোধ করার চেষ্টা করেনি, আর তাই ইসলামে বৈরাগ্য নেই। সহজাত প্রবণতা প্রাণীর প্রাকৃতিক ধর্ম। তাই ইসলামও প্রাকৃতিক ধর্মকে অস্বীকার করেনি। যৌন প্রয়োজনের মতো বিষয়কে অবদমন করতে চাইলে তা কখনোই সম্ভব নয়।
আর তাতে শুধু যৌন বিড়ম্বনা ও উৎপীড়ন বাড়ে। সমাজে সৃষ্টি হয় ব্যভিচারের সুযোগ। এ জঘন্য আচরণকে রহিত করার লক্ষ্যে বিয়ে ইসলামের এক মৌলিক কর্ম। মহান রাব্বুল আলামিন বলেন, ‘আজ তোমাদের জন্য সব ভালো জিনিস বৈধ করা হলো, যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদের (জবাইকৃত) খাদ্যদ্রব্য তোমাদের জন্য বৈধ ও তোমাদের (জবাইকৃত) খাদ্যদ্রব্য তাদের জন্য বৈধ এবং বিশ্বাসী সচ্চরিত্রা নারীরা ও তোমাদের আগে যাদের কিতাব দেওয়া হয়েছে, তাদের সচ্চরিত্রা নারীরা তোমাদের জন্য বৈধ করা হলো যদি তোমরা তাদের মোহর প্রদান করে বিয়ে করো, প্রকাশ্য ব্যভিচার অথবা উপপতীরূপে গ্রহণ করার জন্য নয়। আর যে-কেউ ঈমানকে অস্বীকার করবে তার কর্ম নিষ্ফল এবং সে পরকালে ক্ষতিগ্রস্তদের অন্তর্ভুক্ত হবে।’ (সূরা মায়েদা : ৫)।
উল্লেখিত আয়াতে আহলে কিতাবদের (ইহুদি ও খ্রিষ্টান) মহিলাকে বিয়ে করার অনুমতি দেওয়ার সঙ্গে সঙ্গে প্রথমত এই শর্ত লাগানো হয়েছে যে, তাকে পবিত্রা (সতী) হতে হবে; যে শর্ত আজকাল অধিকাংশ আহলে কিতাবের মহিলাদের মধ্যে পাওয়া যায় না। দ্বিতীয়ত, আয়াতের শেষে বলা হয়েছে, যারা ঈমানের সঙ্গে কুফরি (অস্বীকার) করে, তাদের আমল নষ্ট হয়ে যায়। এখানে সতর্ক করা উদ্দেশ্য যে, এমন মহিলাকে বিয়ে করার ফলে যদি ঈমান নষ্ট হওয়ার আশঙ্কা থাকে, তাহলে খুবই ক্ষতি (সম্পদ) ক্রয় করা হবে। বর্তমানে আহলে কিতাবদের মহিলাকে বিয়ে করার ফলে ঈমান যে চরম ক্ষতির শিকার হবে, তা বর্ণনা করার অপেক্ষা রাখে না। অথচ ঈমান বাঁচানো ফরজ কর্তব্য। একটি অনুমতিপ্রাপ্ত কর্মের জন্য ফরজ কর্মকে বিপদ ও ক্ষতির সম্মুখীন করা যেতে পারে না। কেননা এ অনুমতিপ্রাপ্ত কর্মটি ততক্ষণ পর্যন্ত কর্মে বাস্তবায়ন করা যাবে না, যতক্ষণ পর্যন্ত ওপরে উল্লিখিত দুটি জিনিস (অসতীত্ব ও ঈমানের সঙ্গে কুফরি) বিলুপ্ত না হয়েছে। এছাড়া অধুনা কালের আহলে কিতাবরা তাদের ধর্মীয় ব্যাপারে অসচেতন; বরং সম্পর্কহীন ও বিদ্রোহী। এর পরিপ্রেক্ষিতে তারা কি আসলেই আহলে কিতাবের মধ্যে গণ্য হবে?
মোটকথা, ইসলাম চাচ্ছে, বিয়ে করে যৌনচাহিদা পূরণের সুযোগ স্বামী-স্ত্রী আল্লাহর সীমার মধ্য থেকে লাভ করুক। কোনো অবস্থায়ই সীমালঙ্ঘন করার অনুমতি নেই। নিঃসন্দেহে যৌন পবিত্রতা এক মহার্ঘ্য বিষয়। অন্য কোনো বিষয়ের বিনিময়ে যৌন পবিত্রতা বিসর্জন দেওয়া কখনোই জায়েজ হতে পারে না। বিয়ে হৃদয়ে শান্তি আনে। স্ত্রীর সাহচর্যে এবং তার সঙ্গে রসালাপে প্রেম-ভালোবাসা জন্মে। স্ত্রী গৃহকর্মের দায়ভার গ্রহণ করে স্বামীর অধিক পরিশ্রম করা থেকে নিষ্কৃতি দেয়। ফলে সতী ও সৎ স্ত্রী স্বামীর ধর্মের সাহায্যকারিণী হয়। পরিবারের তত্ত্বাবধানের জন্য স্ত্রীর প্রয়োজন অস্বীকার্য। পরিবারের সবার দেখাশোনা, সন্তান লালনপালন, অর্থনৈতিক সামগ্রী রক্ষণাবেক্ষণে স্ত্রী অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আর বিয়ের মাধ্যমেই পরিবারে স্ত্রীর আগমন ঘটে। বিয়ের ফলেই সন্তান জন্ম হয়। উত্তম সন্তান মা-বাবার জন্য সওয়াব অর্জনের অসিলা হয়। অন্যদিকে রাসুল (সা.) এর উম্মত বৃদ্ধির কারণে তিনিও হাসরের মাঠে গৌরববোধ করবেন। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘সন্তান প্রসবিনী কুৎসিত নারী সন্তানহীনা সুন্দরী নারী থেকে উত্তম।’ (আবু দাউদ : ২০৫০)।
বিয়ের সঙ্গে প্রেম-ভালোবাসার একটি সম্পর্ক রয়েছে। বিয়ের মাধ্যমে অন্তরের প্রশান্তি বাড়ে। কর্মমুখর দিন শেষে ক্লান্ত-শ্রান্ত দেহে স্বস্তি আসে স্ত্রীর মাধ্যমে। জাগতিক জীবনের শত কোলাহল, কষ্ট মানুষ সহ্য করে প্রিয়তমা স্ত্রীর মুখপানে চেয়ে। এ বিষয়ে কোরআনে বলা হয়েছে, ‘তিনিই তোমাদের সৃষ্টি করেছেন একজন ব্যক্তি থেকে। তা থেকেই তার স্ত্রী সৃষ্টি করেন, যাতে সে তার কাছে শান্তি পায়।’ (সূরা আরাফ : ১৮৯)। আর এক নিদর্শন এই যে, ‘তিনি তোমাদের জন্য তোমাদের মধ্য থেকে তোমাদের সঙ্গিনীদের সৃষ্টি করেছেন, যাতে তোমরা তাদের কাছে শান্তিতে থাক এবং তিনি তোমাদের মধ্যে পারস্পরিক সম্প্রীতি ও দয়া সৃষ্টি করেছেন।’ (সূরা রুম : ২১)। আর এগুলো প্রেম-ভালোবাসার নিদর্শন বৈ কিছু নয়।
লেখক : শিক্ষক, রসুলপুর জামিয়া ইসলামিয়া, ঢাকা