তারিখ শব্দটি আরবি। এর প্রচলিত অর্থ ইতিহাস, বছরের নির্দিষ্ট দিনের হিসাব। আল্লামা ইবনে মানজুর (রহ.) তাঁর বিখ্যাত আরবি অভিধান ‘লিসানুল আরবে’ লিখেছেন, তারিখ হলো—সময়কে নির্দিষ্ট করা, সময়ের চিত্র তুলে ধরা, সময়ের ঘটনাপ্রবাহকে শব্দবদ্ধ করা। আল্লামা আইনি (রহ.) লিখেছেন, সায়দাভি (রহ.) বলেছেন, ‘তারিখ’ শব্দটি ‘আরখুন’ থেকে উদ্ভূত; যার অর্থ নবজাতক, সদ্য প্রসূত শিশু। ইতিহাসের সঙ্গে এর সামঞ্জস্য হলো নবজাতকের জন্মের মতো ইতিহাসও সৃজিত হয়, রচিত হয়। একের পর এক সন্তান জন্ম দেওয়ার মতো ইতিহাসের ধারা চলমান, প্রবহমান।
কেউ কেউ বলেছেন, ‘তারিখ’ শব্দটি অনারবি। ‘মা’ ও ‘রোজ’ থেকে পরিবর্তন করে একে আরবিতে রূপান্তর করা হয়েছে। এর অর্থ : দিন, মাস, বছরের হিসাব।
উল্লিখিত আলোচনা থেকে বোঝা যায়, সংখ্যা গণনা, হিসাব সংরক্ষণের সঙ্গে ইতিহাসের সখ্য অনেক গভীর। সন-তারিখ ইতিহাসের অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনচরিত রচনা, সময়ের আলোচনা-পর্যালোচনা সন-তারিখ ছাড়া সম্ভব নয়। যদিও এটি ইতিহাস রচনার মূল উদ্দেশ্য নয়, তবু সন-তারিখ প্রথা ইতিহাসের অনুষঙ্গ হয়ে আছে সেই আদিকাল থেকে। ফলে ইতিহাস বোঝাতে ‘তারিখ’ শব্দটিকেই ব্যবহার করা হয়।
তারিখ গণনার সূচনা যেভাবে হলো
তারিখ গণনার সূচনা কিভাবে হলো, কবে থেকে হলো, বিভিন্ন গ্রন্থে বিভিন্নভাবে বিষয়টি বর্ণনা করা হয়েছে। ‘আল মাওসুআতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা’ গ্রন্থে বিষয়টি এভাবে এসেছে—
ইসলাম আসার আগে আরবের সমষ্টিগত কোনো তারিখ ছিল না। সে সময় তারা প্রসিদ্ধ ঘটনা অবলম্বনে বছর, মাস গণনা করত। হজরত ইবরাহিম (আ.)-এর সন্তানরা কাবা শরিফ নির্মিত হওয়ার আগে তাঁর আগুনে নিক্ষিপ্ত হওয়ার ঘটনা অবলম্বনে তারিখ নির্ধারণ করত। কাবা শরিফ নির্মাণের পর তাঁরা বিক্ষিপ্ত হওয়া পর্যন্ত এর আলোকেই সাল গণনা করতেন। তারপর বনু ইসমাঈলের যারা হেজাজের তেহামা অঞ্চল থেকে বেরিয়ে অন্যত্র চলে যেত, তখন সেই গোত্র বেরিয়ে যাওয়ার দিন থেকে তারিখ গণনা করত। যারা তেহামাতে রয়ে যেত তারা বনি জায়েদ গোত্রের জুহাইনা, নাহদ ও সাদের চলে যাওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করত। কাব বিন লুআইয়ের মৃত্যু পর্যন্ত এ ধারা চলমান ছিল। পরে তাঁর মৃত্যুর দিন থেকে নতুনভাবে সাল গণনা শুরু হয়। এটি চলতে থাকে হস্তী বাহিনীর ঘটনা পর্যন্ত। হজরত ওমর (রা.) হিজরি নববর্ষের গোড়াপত্তন করার আগ পর্যন্ত আরবে ‘হস্তীবর্ষ’ই প্রচলিত ছিল। (আল-কামেল লিইবনিল আসির : ১/৯)
বনু ইসমাঈল ছাড়া আরবের অন্য লোকেরা নিজেদের মধ্যে ঘটে যাওয়া বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাকে উপলক্ষ করে বর্ষ গণনা করত। যেমন—বাসুস, দাহেস, গাবরা, ইয়াওমু জি-কার, হরবুল ফুজ্জার ইত্যাদি ঐতিহাসিক যুদ্ধের দিন থেকে নতুন নতুন বর্ষ গণনার সূত্রপাত করত। এ তো গেল আরবদের সাল গণনার বর্ণনা। গোটা বিশ্বের ইতিহাস পাঠ করলে দেখা যায়, পৃথিবীতে মানব ইতিহাসের সূচনালগ্ন থেকে বর্ষপঞ্জি গণনা শুরু করা হয়। আদি পিতা আদম (আ.) পৃথিবীতে আগমনের দিন থেকে সাল গণনা শুরু। এ ধারা চলতে থাকে হজরত নুহ (আ.)-এর মহাপ্রলয় পর্যন্ত। এরপর মহাপ্রলয় থেকে নতুন বর্ষপঞ্জি তৈরি করা হয়। এটা চলতে থাকে ইবরাহিম (আ.) অগ্নিকুণ্ডে নিক্ষিপ্ত হওয়ার আগ পর্যন্ত। এ বর্ষপঞ্জি চলতে থাকে ইউসুফ (আ.) মিসরে শাসনকর্তা নিযুক্ত হওয়া পর্যন্ত। সে ঘটনা থেকে শুরু হয় নতুন বর্ষ গণনা। এটি চলতে থাকে মুসা (আ.) মিসর ত্যাগের ঘটনা পর্যন্ত। সেটি চলতে থাকে দাউদ (আ.)-এর শাসনামল পর্যন্ত। সেটি চলতে থাকে সুলাইমান (আ.)-এর রাজত্বকাল পর্যন্ত। সেটি চলতে থাকে হজরত ঈসা (আ.)-এর যুগ পর্যন্ত। ঈসা (আ.)-এর জন্ম থেকে নতুন বর্ষ গণনা শুরু হয়। আরবের হিময়ার গোত্র তাবাবিয়াহ (ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার দিন) থেকে, প্রাচীন আরবের গাসসান গোত্র বাঁধ নির্মাণের দিন থেকে সাল গণনা করে। সানআ অধিবাসীরা হাবশিদের ইয়েমেন আক্রমণের দিন থেকে বর্ষ গণনা শুরু করে। তারপর তারা পারস্যদের জয়লাভের ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করে। (আল-ইলান, লিস সাখাভি : ১৪৬-১৪৭)
পারসিকরা তাদের রাষ্ট্রনায়কদের চার স্তরে বিন্যস্ত করে সাল গণনা করত। রোমানরা পারসিকদের কাছে পরাজিত হওয়া পর্যন্ত দারা ইবনে দারা নিহত হওয়ার দিন থেকে সাল গণনা করত। কিবতিরা মিসরের রানি কিলইয়ুবাতরাকে রুখতে বুখতে নছর কর্তৃক সাহায্য করার ঘটনাকে কেন্দ্র করে সাল গণনা করত। ইহুদিরা বায়তুল মাকদিসে হামলা এবং এটি তাদের হাতছাড়া হওয়ার ঘটনাকে উপলক্ষ করে বর্ষ গণনা করে। খ্রিস্টানরা হজরত ঈসা (আ.)-কে আসমানে উত্তোলনের ঘটনাকে স্মারক বানিয়ে খ্রিস্টবর্ষ পালন করে। (আল মাওসুয়াতুল ফিকহিয়্যা আল কুয়েতিয়্যা : ১০/২৮ ‘তারিখ’)