সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, মোস্তাফিজের বাড়ি চাঁপাইনবাবগঞ্জের ভোলাহাটে। বাবার নাম আব্দুর রাকিব।
গ্রিন প্লাজা রিয়েল এস্টেটের চেয়ারম্যান হিসেবে কাগজে-কলমে ওয়ালিউর রহমান বাবুর নাম রয়েছে। তিনি প্রয়াত ব্যাংক কর্মকর্তা মাইনুল হাসানের স্ত্রী নাসরিন সুলতানার সহোদর ভাই। বাবু অভিযোগ করেন, ‘আমার বোনের কাছ থেকে অনেক টাকা নিয়ে এই ব্যবসা শুরু করে মোস্তাফিজ। সেই টাকার কোনো হিসাব নাই। আমাদের একটা জমিও ডেভেলপার হিসেবে নিয়েছে তিন বছর আগে। ওই জমিতে থাকা বাড়িটি ভেঙে ফেললেও এখনো কাজ শুরু করেনি। আমরা এখন ভাড়া বাড়িতে থাকি।’
বাবু বলেন, ‘আমাকে চেয়ারম্যান করে রাখা হলেও আমি ওর কোনো কাজের বিষয়ে খোঁজ রাখি না। তবে তার কাছে টাকার জন্য অনেক মানুষ আসে। ওর কারণে আমার বোনটি এখন মানসিকভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। সে কেবল কান্নাকাটি করে। ঠিকমতো কথাও বলতে পারে না। আমরা এখন কী করব, বুঝে উঠতে পারছি না।’
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, মোস্তাফিজ এভাবে রাজশাহী নগর ও আশপাশের জেলার অন্তত অর্ধশত মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করে কমপক্ষে ২০ কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন। পাওনাদারদের এড়াতে তিনি অনেকটা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন। ঠিকমতো অফিসেও বসছেন না।
এর পরও মোস্তাফিজের প্রতারণা থেমে নেই। আবাসন প্রকল্পের জন্য আরো পাঁচটি জায়গা নিয়েছেন তিনি। এর মধ্যে দুটি জায়গায় ফ্ল্যাটের কাজ শুরু করেছেন। একেকটি ফ্ল্যাট বিক্রি করেছেন একাধিক ব্যক্তির কাছে। জমির মালিকদের বাড়িভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও তিনি কাউকেই ঠিকমতো দেননি। আবার কোনো মালিককে একেবারেই ভাড়ার টাকা দেননি। এ নিয়েও ভুক্তভোগীরা অভিযোগ করেছেন। আবার কারো বিরুদ্ধে উল্টো মামলা করে জেলও খাটিয়েছেন মোস্তাফিজ।
রাজশাহী নগরীর দড়িখরবোনা এলাকার বাসিন্দা আবু হানিফের একটি জমি বছরখানেক আগে ভবন নির্মাণের জন্য ডেভেলপার হিসেবে ৩০০ টাকার স্ট্যাম্পের মাধ্যমে নেন মোস্তাাফিজ। কিন্তু বাড়ির কাজ শুরু করতে পারেননি। এমনকি আবু হানিফকে বাড়িভাড়া দেওয়ার কথা থাকলেও মোস্তাফিজ তা দেননি। বাধ্য হয়ে আবু হানিফ তাঁর জমিটি অন্য একটি ডেভেলপারকে রেজিস্ট্রি করে দেন। এতে ক্ষিপ্ত হয়ে মোস্তাফিজ আবু হানিফের নামে উল্টো মামলা করে তাঁকে আড়াই মাস জেলও খাটান। পরে জামিনে মুক্তি পান তিনি।
আবু হানিফ বলেন, ‘আমার পরিবারকে নিঃস্ব করে দিয়েছে মোস্তাফিজ। আমি এর বিচার চাই। আমি জমির মালিক হয়ে আমাকেই জেল খাটতে হলো।’
রাজশাহী শিক্ষা বোর্ডের সাবেক চেয়ারম্যান কামরুল ইসলাম বলেন, ‘আমার কাছ থেকে একটি ফ্ল্যাট বিক্রির কথা বলে ২৫ লাখ টাকা নেন মোস্তাফিজ। কিন্তু পরে জানতে পারি, ওই ফ্ল্যাট আরেকজনের কাছে তিনি বিক্রি করেছেন। শেষে আমি মেয়র সাহেব ও নগর পুলিশের কাছে অভিযোগ করি। পরে আরেকটি ফ্ল্যাট লিখে দেওয়ার বিষয়ে কথা হয়। আজ (মঙ্গলবার) সেটা রেজিস্ট্রি করে দেওয়ার কথা থাকলেও তা তিনি দেননি।’
রাজশাহী গোদাগাড়ীর বাসিন্দা এজাজুল হকের দাবি, ফ্ল্যাট বিক্রি বাবদ তাঁর কাছ থেকে মোস্তাফিজ ১২ লাখ টাকা নিয়েছিলেন। কিন্তু এটিও অন্যজনের কাছে বিক্রি করেন মোস্তাফিজ। তিনি টাকা ফেরত চাইলে তাঁকে রাজশাহীতে ডেকে নেওয়া হয়। কিন্তু টাকা ফেরত না দিয়ে সহযোগীদের দিয়ে এজাজের কাছ থেকে ফ্ল্যাট বিক্রির চুক্তিপত্রের মূল কাগজ কেড়ে নেওয়া হয়। এরপর ভয়ভীতি দেখিয়ে এজাজকে তাড়িয়ে দেওয়া হয়।
এজাজ কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার সঙ্গে যে প্রতারণা করেছে মোস্তাফিজ, এমন দুষ্কর্ম যেন আর কারো সঙ্গে করতে না পারে সে। আমি ওর বিচার চাই। সে একজন প্রতারক। আমার মতো অনেক মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করেছে মেস্তাফিজ। সে প্রতারণা করেই কোটিপতি হয়েছে।’
রাজশাহী নগরীর বালিয়া পুকুর এলাকার ওমর ফারুক বলেন, ‘আমাকেও ফ্ল্যাট দেবে বলে ৩৫ লাখ টাকা নিয়েছিল। শেষে একাধিকবার সালিস করে কয়েক দফায় সেই টাকা আমি নিয়েছি। এখনো লাখ তিনেক টাকা পাই। মোস্তাফিজের কাজই হলো মানুষের সঙ্গে প্রতারণা করা।’
সাদিকা খাতুন নামের এক নারী বলেন, ‘আমার কাছ থেকে ৪০ লাখ টাকা নিয়েছে মোস্তাফিজ। কিন্তু ফ্ল্যাট দিতে পারেনি। আমি টাকার জন্য এখন ঘুরছি। এ নিয়ে রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সে অভিযোগ করেছি। এতে লাভ হয়নি।’
এ ব্যাপারে মোস্তাফিজুর রহমান বলেন, ‘কয়েকটি ফ্ল্যাট নিয়ে সমস্যা ছিল। সেগুলোর অনেকটাই সমাধান করেছি। কিছু ঝামেলা আছে, সেগুলোও সমাধান করা হবে। তবে আমি কারো সঙ্গে প্রতারণা করিনি। আবু হানিফ নিজেই আমার সঙ্গে প্রতারণা করেছেন।’
মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে রাজশাহীর সিটি মেয়র ও চেম্বার অব কমার্সের সভাপতির কাছে সাত-আটটি অভিযোগ জমা পড়েছে। মেয়র এ এইচ এম খায়রুজ্জামান লিটনের হস্তক্ষেপে কয়েকজন ভুক্তভোগী ফ্ল্যাটও বুঝে পেয়েছেন। কিন্তু এখনো ফ্ল্যাটের নিবন্ধন পাননি তাঁরা। আবার যাঁরা ফ্ল্যাট পাননি তাঁরা এখনো ঘুরছেন টাকার জন্য। মেয়র খায়রুজ্জামান বলেন, মোস্তাফিজের বিরুদ্ধে বেশ কয়েকটি অভিযোগ পেয়েছি। এ ব্যাপারে খোঁজ নিয়ে সমাধানের চেষ্টা করব।
রাজশাহী চেম্বার অব কমার্সের সভাপতি মাসুদুর রহমান রিংকু বলেন, ‘মোস্তাফিজ একসময় চেম্বারের পরিচালক পদও বাগিয়েছিলেন। কিন্তু তাঁর নানা কাণ্ডে এই সদস্য পদ নেই। আমাদের কাছে তাঁর বিরুদ্ধে প্রতারণার তিনটি অভিযোগ ছিল। এর মধ্যে একটির মীমাংসা করে দিয়েছি। অন্য দুটির হয়নি। কারণ তিনি এখন আর চেম্বারের কেউ নন।’
রাজশাহী মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার হেমায়তুল ইসলাম বলেন, ‘মোস্তাফিজের নামে অনেক অভিযোগ। আমরা সেগুলো খতিয়ে দেখছি। পুলিশ এসব নিয়ে কাজ করছে