ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৫ জুলাই ২০২৪, ১০ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

হলদে পাখির বাসা দেখেছেন কেউ

গ্রামেই আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। আমার এক চাচার বাড়ি বড় একটা শিমুলগাছ ছিল। এখন সেটা আছে কি না ঠিক জানি না। বসন্তকালে শিমুলগাছে ফুল ফোটে।

লাল লাল বড় পুরু ফুল। ছোট ছোট তালের মতো কুঁড়ি। বসন্তে পাখিরা শিমুল গাছে ভিড় করে। কেউ শিমুলের ফুলের মধু চুষতে আসে।
কেউ বা আসে পোকার লোভে। মধুপায়ী পোকাদের আনাগোনা কম নয় শিমুলগাছে। কিছু পাখি আসে স্রেফ ভালোবাসার টানে। তবে ভালোবাসাটা তাদের শিমুলের প্রতি নয়।
সঙ্গিনীর টানে আসে ওইসব পাখিরা। চোখগেল, বসন্তবৌরি, বেনেবউ পাখিগুলো কিছুটা লাজুক প্রকৃতির।এরা মাঠের পাশাপাশি সঙ্গিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বেছে নেয় লোকালয়। মানুষকে এড়িয়ে চলা পাখি। যে-সে গাছে বসলে মানুষের সান্নিধ্যে চলে আসার আশঙ্কা আছে।

তাই বেছে নেয় শিমুলের মতো উঁচু গাছ। চোখগেল আর বসন্তবৌরি শিমুলের মগডালে বসে তারস্বরে চিৎকার করে। তবে ওদের কণ্ঠ মধুমাখা। আর বেনেবউ, যাকে আমরা হলদে পাখি বলি–ওদের গলায় অত জোর নেই। তাই সব সময় এক জায়গায় বসে ডাকে না। এ গাছে, সে গাছে ঘুরে ঘুরে ‘খোকা হও… খোকা হও’ স্বরে ডেকে বেড়ায়। আমার ওই চাচার বাড়ি প্রায়ই একটা বেনেবউ ডেকে বেড়ায়। শুধু সে বাড়িই নয়, আশপাশের সব বাড়িরই মেহমান সে।এমনিতে ওদের ওই ডাকে কেউ পাত্তা দিত না। কিন্তু যে বাড়ি নতুন বউ আছে, সে বাড়িতে খুশির রোল পড়ে যেত। সবাই ধরেই নিত্যনতুন বউয়ের গর্ভে একটা পুত্রসন্তান আসছে। পরে নতুন বউয়ের মেয়ে সন্তান জন্মালে বেনেবউয়ের কথা কেউ মনে রাখত না। তবে ছেলে হলে বলত, “ওই দেখো, এ বাড়িতে ‘খোকা হও’ পাখি ডেকেছিল, খোকা না হয়ে যাবে কোথায়।” এ বিশ্বাস আদ্যকালের। যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংক্রমিত হয়ে হয়েছে বিশ্বাসের ভিত। এই ডিজিটাল যুগে এসেও সে বিশ্বাস কিছুটা হয়তো নড়চড় হয়েছে, তবে একেবারে ধুয়েমুছে যায়নি।

আমার দ্বিতীয় ক্যামেরা কেনার আগেই ঠিক করেছিলাম এবার উদ্ভিদের সঙ্গে সঙ্গে মেঠোপাখি নিয়েও কাজ করব। কিন্তু বসন্তে বাড়ি গিয়ে বেনেবউ পাখির ছবি তুলতে গিয়ে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অতি সহজে চোখগেল, বসন্তবৌরির মতো পাখির ছবি কবজা করতে পেরেছি। কিন্তু বেনেবউয়ের ছবি তুলতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। এ পাখি বড়ই লাজুক। ছবি তোলার জন্য ন্যূনতম সময়টুকু দেয় না। তা ছাড়া ক্যামেরায় আমার হাত একেবারে কাঁচা। প্রথম পাঁচ দিনে বেনেবউয়ের কোনো ছবিই তুলতে পারিনি।

২০১৫ সালের ২৮ মার্চ আমার ক্যামেরায় প্রথম ধরা পড়ল বেনে বউ। খবর পেয়েছি, আমাদের গ্রামের বিলে প্রচুর শরালি হাঁসের আড্ডা। সেখানে যাচ্ছিলাম। খালাতো ভাই শাহেদকে সাথে নিয়ে। রাস্তায় পেয়ে গেলাম বেনেবউয়ের একটা ঝাঁক। একটা সজনে গাছে পাঁচ-ছয়টা হলদে পাখি খেলছে। হলদে পাখি দলবদ্ধভাবে থাকে না। বড়জোর একজোড়া একসঙ্গে থাকে। তখন প্রজনন মৌসুম, মন দেওয়া-নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে বেনেবউয়ের দল। ওখানে স্ত্রী পাখি হয়তো মাত্র একটা। বাকিরা রোমিওর দল!

বিলটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। তাই মাঝখানে অনেকটা পথ আমাদের হাঁটতে হলো। রাস্তার মাঝে একটা বাবলাগাছে পেলাম আরেকটা। ইনি মুখ বাড়িয়ে কী একটা খাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

বিলে শরালি, জলকবুতর আর পানকৌড়ির ছবি নিলাম। এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথ ধরলাম অন্য পথে। যদি অন্য কোনো প্রজাতির গাছ কিংবা পাখির ছবি নেওয়া যায়!

সকালে আকাশটা মেঘলা ছিল। কিন্তু ফেরার সময় মার্চের আগুনঝরা রোদ একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। হাঁটার ক্লান্তি আর তৃষ্ণা দুটোই আমাদের গতিরোধ করল। ততক্ষণে গ্রামের পুব প্রান্তে ঢুকে পড়েছি। একটা দোকান পেয়ে গেলাম। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তি তিনেরই উপশম করার সুযোগ একসাথে। বসলাম দোকানের সামনে পাতা খাটের সমান মাচায়। দোকানটার তিন পাশে মাঠ। বড় বড় গাছও আছে। একটা বেনেবউ যেন কোথায় ডেকে উঠল।

আমরা দুভাই সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে চলেছি চারপাশে। হঠাৎ আমার চোখেই পড়ল বাসাটা। একটা আমগাছের ডালে। ক্যামেরা বাগিয়ে ধরলাম সেদিকে। বেনেবউটা ধীর পায়ে ডাল বেয়ে এগিয়ে গেল বাসাটার দিকে। বিভিন্ন গাছের শুকনো পাতা দিয়ে বানানো ছোট্ট বাসাটা দেখতে ভারি সুন্দর। টপাটপ কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।

ততক্ষণে আশপাশের লোকজনের চোখেও পড়ে গেছে বাসাটা। এক মহিলা তো চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘এত কাছে হলদে পাখির বাসা! ওমা কবে করল!’ আমাকে বলল, ‘তোমার সেরাম চোখ বাপু!’ তারপর মহিলা হাঁকল তার ছেলেকে। বাসাটা দেখাবে। তারপর গোটা পাড়ার মহিলা আর শিশুরা জুটল হলদে পাখির বাসা দেখার জন্য। ছোট ভাই বলল সর্বনাশ, ‘এ পাখিটার কপালে দুঃখ আছে। বাসাটা গেল!’

ভেতরে ভেতরে একটা অনুশোচনাবোধ জেগে উঠল। আমি যদি বাসাটা না দেখতাম তবে নির্বিঘ্নে পাখিটা এই বাসায় মৌসুমটা পার করে দিত। এখন কে জানে বাসা আর পাখিটার কপালে কী আছে? এখন যদি পোলাপান কিছু না-ও করে, ডিম পাড়লে কিংবা ছানা ফুটলে নির্ঘাৎ বিচ্ছুর দল সেটা খেলার ছলে ধ্বংস করবে! ফেরার সময় বলে এলাম, বাসাটা যেন কেউ না ভাঙে। শুধু অনুরোধে কাজ হবে না বলে হুমকিও দিয়ে এলাম, ‘আমি মাঝে মাঝেই এসে দেখে যাব। বাসাটা যদি না থাকে, একেবারে দশ বছর জেল!’ জানি হুমকিতে কাজ হবে না। কিন্তু কী আর করা!

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

হলদে পাখির বাসা দেখেছেন কেউ

আপডেট টাইম : ০৪:৩৬ অপরাহ্ন, সোমবার, ১৫ জানুয়ারী ২০২৪
গ্রামেই আমাদের অনেক আত্মীয়-স্বজন। আমার এক চাচার বাড়ি বড় একটা শিমুলগাছ ছিল। এখন সেটা আছে কি না ঠিক জানি না। বসন্তকালে শিমুলগাছে ফুল ফোটে।

লাল লাল বড় পুরু ফুল। ছোট ছোট তালের মতো কুঁড়ি। বসন্তে পাখিরা শিমুল গাছে ভিড় করে। কেউ শিমুলের ফুলের মধু চুষতে আসে।
কেউ বা আসে পোকার লোভে। মধুপায়ী পোকাদের আনাগোনা কম নয় শিমুলগাছে। কিছু পাখি আসে স্রেফ ভালোবাসার টানে। তবে ভালোবাসাটা তাদের শিমুলের প্রতি নয়।
সঙ্গিনীর টানে আসে ওইসব পাখিরা। চোখগেল, বসন্তবৌরি, বেনেবউ পাখিগুলো কিছুটা লাজুক প্রকৃতির।এরা মাঠের পাশাপাশি সঙ্গিনীর দৃষ্টি আকর্ষণ করার জন্য বেছে নেয় লোকালয়। মানুষকে এড়িয়ে চলা পাখি। যে-সে গাছে বসলে মানুষের সান্নিধ্যে চলে আসার আশঙ্কা আছে।

তাই বেছে নেয় শিমুলের মতো উঁচু গাছ। চোখগেল আর বসন্তবৌরি শিমুলের মগডালে বসে তারস্বরে চিৎকার করে। তবে ওদের কণ্ঠ মধুমাখা। আর বেনেবউ, যাকে আমরা হলদে পাখি বলি–ওদের গলায় অত জোর নেই। তাই সব সময় এক জায়গায় বসে ডাকে না। এ গাছে, সে গাছে ঘুরে ঘুরে ‘খোকা হও… খোকা হও’ স্বরে ডেকে বেড়ায়। আমার ওই চাচার বাড়ি প্রায়ই একটা বেনেবউ ডেকে বেড়ায়। শুধু সে বাড়িই নয়, আশপাশের সব বাড়িরই মেহমান সে।এমনিতে ওদের ওই ডাকে কেউ পাত্তা দিত না। কিন্তু যে বাড়ি নতুন বউ আছে, সে বাড়িতে খুশির রোল পড়ে যেত। সবাই ধরেই নিত্যনতুন বউয়ের গর্ভে একটা পুত্রসন্তান আসছে। পরে নতুন বউয়ের মেয়ে সন্তান জন্মালে বেনেবউয়ের কথা কেউ মনে রাখত না। তবে ছেলে হলে বলত, “ওই দেখো, এ বাড়িতে ‘খোকা হও’ পাখি ডেকেছিল, খোকা না হয়ে যাবে কোথায়।” এ বিশ্বাস আদ্যকালের। যুগ যুগ ধরে বাংলার ঘরে ঘরে প্রজন্ম থেকে প্রজন্মে সংক্রমিত হয়ে হয়েছে বিশ্বাসের ভিত। এই ডিজিটাল যুগে এসেও সে বিশ্বাস কিছুটা হয়তো নড়চড় হয়েছে, তবে একেবারে ধুয়েমুছে যায়নি।

আমার দ্বিতীয় ক্যামেরা কেনার আগেই ঠিক করেছিলাম এবার উদ্ভিদের সঙ্গে সঙ্গে মেঠোপাখি নিয়েও কাজ করব। কিন্তু বসন্তে বাড়ি গিয়ে বেনেবউ পাখির ছবি তুলতে গিয়ে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অতি সহজে চোখগেল, বসন্তবৌরির মতো পাখির ছবি কবজা করতে পেরেছি। কিন্তু বেনেবউয়ের ছবি তুলতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। এ পাখি বড়ই লাজুক। ছবি তোলার জন্য ন্যূনতম সময়টুকু দেয় না। তা ছাড়া ক্যামেরায় আমার হাত একেবারে কাঁচা। প্রথম পাঁচ দিনে বেনেবউয়ের কোনো ছবিই তুলতে পারিনি।

২০১৫ সালের ২৮ মার্চ আমার ক্যামেরায় প্রথম ধরা পড়ল বেনে বউ। খবর পেয়েছি, আমাদের গ্রামের বিলে প্রচুর শরালি হাঁসের আড্ডা। সেখানে যাচ্ছিলাম। খালাতো ভাই শাহেদকে সাথে নিয়ে। রাস্তায় পেয়ে গেলাম বেনেবউয়ের একটা ঝাঁক। একটা সজনে গাছে পাঁচ-ছয়টা হলদে পাখি খেলছে। হলদে পাখি দলবদ্ধভাবে থাকে না। বড়জোর একজোড়া একসঙ্গে থাকে। তখন প্রজনন মৌসুম, মন দেওয়া-নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে বেনেবউয়ের দল। ওখানে স্ত্রী পাখি হয়তো মাত্র একটা। বাকিরা রোমিওর দল!

বিলটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। তাই মাঝখানে অনেকটা পথ আমাদের হাঁটতে হলো। রাস্তার মাঝে একটা বাবলাগাছে পেলাম আরেকটা। ইনি মুখ বাড়িয়ে কী একটা খাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।

বিলে শরালি, জলকবুতর আর পানকৌড়ির ছবি নিলাম। এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথ ধরলাম অন্য পথে। যদি অন্য কোনো প্রজাতির গাছ কিংবা পাখির ছবি নেওয়া যায়!

সকালে আকাশটা মেঘলা ছিল। কিন্তু ফেরার সময় মার্চের আগুনঝরা রোদ একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। হাঁটার ক্লান্তি আর তৃষ্ণা দুটোই আমাদের গতিরোধ করল। ততক্ষণে গ্রামের পুব প্রান্তে ঢুকে পড়েছি। একটা দোকান পেয়ে গেলাম। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তি তিনেরই উপশম করার সুযোগ একসাথে। বসলাম দোকানের সামনে পাতা খাটের সমান মাচায়। দোকানটার তিন পাশে মাঠ। বড় বড় গাছও আছে। একটা বেনেবউ যেন কোথায় ডেকে উঠল।

আমরা দুভাই সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে চলেছি চারপাশে। হঠাৎ আমার চোখেই পড়ল বাসাটা। একটা আমগাছের ডালে। ক্যামেরা বাগিয়ে ধরলাম সেদিকে। বেনেবউটা ধীর পায়ে ডাল বেয়ে এগিয়ে গেল বাসাটার দিকে। বিভিন্ন গাছের শুকনো পাতা দিয়ে বানানো ছোট্ট বাসাটা দেখতে ভারি সুন্দর। টপাটপ কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।

ততক্ষণে আশপাশের লোকজনের চোখেও পড়ে গেছে বাসাটা। এক মহিলা তো চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘এত কাছে হলদে পাখির বাসা! ওমা কবে করল!’ আমাকে বলল, ‘তোমার সেরাম চোখ বাপু!’ তারপর মহিলা হাঁকল তার ছেলেকে। বাসাটা দেখাবে। তারপর গোটা পাড়ার মহিলা আর শিশুরা জুটল হলদে পাখির বাসা দেখার জন্য। ছোট ভাই বলল সর্বনাশ, ‘এ পাখিটার কপালে দুঃখ আছে। বাসাটা গেল!’

ভেতরে ভেতরে একটা অনুশোচনাবোধ জেগে উঠল। আমি যদি বাসাটা না দেখতাম তবে নির্বিঘ্নে পাখিটা এই বাসায় মৌসুমটা পার করে দিত। এখন কে জানে বাসা আর পাখিটার কপালে কী আছে? এখন যদি পোলাপান কিছু না-ও করে, ডিম পাড়লে কিংবা ছানা ফুটলে নির্ঘাৎ বিচ্ছুর দল সেটা খেলার ছলে ধ্বংস করবে! ফেরার সময় বলে এলাম, বাসাটা যেন কেউ না ভাঙে। শুধু অনুরোধে কাজ হবে না বলে হুমকিও দিয়ে এলাম, ‘আমি মাঝে মাঝেই এসে দেখে যাব। বাসাটা যদি না থাকে, একেবারে দশ বছর জেল!’ জানি হুমকিতে কাজ হবে না। কিন্তু কী আর করা!