আমার দ্বিতীয় ক্যামেরা কেনার আগেই ঠিক করেছিলাম এবার উদ্ভিদের সঙ্গে সঙ্গে মেঠোপাখি নিয়েও কাজ করব। কিন্তু বসন্তে বাড়ি গিয়ে বেনেবউ পাখির ছবি তুলতে গিয়ে বেশ কাঠখড় পোড়াতে হয়েছে। অতি সহজে চোখগেল, বসন্তবৌরির মতো পাখির ছবি কবজা করতে পেরেছি। কিন্তু বেনেবউয়ের ছবি তুলতে গিয়ে হিমশিম খেতে হয়েছে। এ পাখি বড়ই লাজুক। ছবি তোলার জন্য ন্যূনতম সময়টুকু দেয় না। তা ছাড়া ক্যামেরায় আমার হাত একেবারে কাঁচা। প্রথম পাঁচ দিনে বেনেবউয়ের কোনো ছবিই তুলতে পারিনি।
২০১৫ সালের ২৮ মার্চ আমার ক্যামেরায় প্রথম ধরা পড়ল বেনে বউ। খবর পেয়েছি, আমাদের গ্রামের বিলে প্রচুর শরালি হাঁসের আড্ডা। সেখানে যাচ্ছিলাম। খালাতো ভাই শাহেদকে সাথে নিয়ে। রাস্তায় পেয়ে গেলাম বেনেবউয়ের একটা ঝাঁক। একটা সজনে গাছে পাঁচ-ছয়টা হলদে পাখি খেলছে। হলদে পাখি দলবদ্ধভাবে থাকে না। বড়জোর একজোড়া একসঙ্গে থাকে। তখন প্রজনন মৌসুম, মন দেওয়া-নেওয়ার প্রতিযোগিতায় নেমেছে বেনেবউয়ের দল। ওখানে স্ত্রী পাখি হয়তো মাত্র একটা। বাকিরা রোমিওর দল!
বিলটা আমাদের বাড়ি থেকে প্রায় তিন কিলোমিটার দূরে। তাই মাঝখানে অনেকটা পথ আমাদের হাঁটতে হলো। রাস্তার মাঝে একটা বাবলাগাছে পেলাম আরেকটা। ইনি মুখ বাড়িয়ে কী একটা খাওয়ার চেষ্টা করছিলেন।
বিলে শরালি, জলকবুতর আর পানকৌড়ির ছবি নিলাম। এবার ফেরার পালা। ফিরতি পথ ধরলাম অন্য পথে। যদি অন্য কোনো প্রজাতির গাছ কিংবা পাখির ছবি নেওয়া যায়!
সকালে আকাশটা মেঘলা ছিল। কিন্তু ফেরার সময় মার্চের আগুনঝরা রোদ একেবারে জাঁকিয়ে বসেছে। হাঁটার ক্লান্তি আর তৃষ্ণা দুটোই আমাদের গতিরোধ করল। ততক্ষণে গ্রামের পুব প্রান্তে ঢুকে পড়েছি। একটা দোকান পেয়ে গেলাম। ক্ষুধা-তৃষ্ণা-ক্লান্তি তিনেরই উপশম করার সুযোগ একসাথে। বসলাম দোকানের সামনে পাতা খাটের সমান মাচায়। দোকানটার তিন পাশে মাঠ। বড় বড় গাছও আছে। একটা বেনেবউ যেন কোথায় ডেকে উঠল।
আমরা দুভাই সতর্ক দৃষ্টি বুলিয়ে চলেছি চারপাশে। হঠাৎ আমার চোখেই পড়ল বাসাটা। একটা আমগাছের ডালে। ক্যামেরা বাগিয়ে ধরলাম সেদিকে। বেনেবউটা ধীর পায়ে ডাল বেয়ে এগিয়ে গেল বাসাটার দিকে। বিভিন্ন গাছের শুকনো পাতা দিয়ে বানানো ছোট্ট বাসাটা দেখতে ভারি সুন্দর। টপাটপ কয়েকটা ছবি তুলে নিলাম।
ততক্ষণে আশপাশের লোকজনের চোখেও পড়ে গেছে বাসাটা। এক মহিলা তো চিৎকার দিয়ে উঠল, ‘এত কাছে হলদে পাখির বাসা! ওমা কবে করল!’ আমাকে বলল, ‘তোমার সেরাম চোখ বাপু!’ তারপর মহিলা হাঁকল তার ছেলেকে। বাসাটা দেখাবে। তারপর গোটা পাড়ার মহিলা আর শিশুরা জুটল হলদে পাখির বাসা দেখার জন্য। ছোট ভাই বলল সর্বনাশ, ‘এ পাখিটার কপালে দুঃখ আছে। বাসাটা গেল!’
ভেতরে ভেতরে একটা অনুশোচনাবোধ জেগে উঠল। আমি যদি বাসাটা না দেখতাম তবে নির্বিঘ্নে পাখিটা এই বাসায় মৌসুমটা পার করে দিত। এখন কে জানে বাসা আর পাখিটার কপালে কী আছে? এখন যদি পোলাপান কিছু না-ও করে, ডিম পাড়লে কিংবা ছানা ফুটলে নির্ঘাৎ বিচ্ছুর দল সেটা খেলার ছলে ধ্বংস করবে! ফেরার সময় বলে এলাম, বাসাটা যেন কেউ না ভাঙে। শুধু অনুরোধে কাজ হবে না বলে হুমকিও দিয়ে এলাম, ‘আমি মাঝে মাঝেই এসে দেখে যাব। বাসাটা যদি না থাকে, একেবারে দশ বছর জেল!’ জানি হুমকিতে কাজ হবে না। কিন্তু কী আর করা!