ঢাকা , শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কচুরিপানা ও কাঁঠাল সমাচার

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বাংলাদেশ মেধাবীদের দেশ। এ দেশে চারদিকে কেবল মেধা আর মেধা। সমাজ, শিক্ষাঙ্গন, বিচারাঙ্গন, সরকার, গণমাধ্যম, টকশো, সংসদ, কেবিনেটসহ সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছেন মেধাবীরা। এসব মেধাবীর পেছনে জনসমর্থন থাক বা না থাক, এদের মেধার উৎকর্ষ নিয়ে বিতর্ক নেই।

অতি সম্প্রতি মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মেধার প্রমাণ রেখেছেন। এ মেধাবী মন্ত্রী হলেন পরিকল্পনামন্ত্রী জনাব আবদুল মান্নান। মন্ত্রীমহোদয় ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ‘রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন।

ওই অনুষ্ঠানে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এমএ রহিমকে রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ) অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। তবে অনুষ্ঠানে কে কী অবদানের জন্য আরডিএফ অ্যাওয়ার্ড পেলেন, সে বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্য। কেন মন্ত্রীর বক্তব্য এতটা গুরুত্ব পেল, তা তার বক্তব্যের বিষয়বস্তুতেই নিহিত।

এ মেধাবী মন্ত্রী গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘কচুরিপানার পাতা খাওয়া যায় না কেন। গরু তো খায়। গরু খেতে পারলে মানুষ খেতে পারবে না কেন? মানুষের খাবার উপযোগী করা যায় কিনা, এ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে।’

এ সঙ্গে কাঁঠালের আকার ছোট, গোল ও সুন্দর করা যায় কিনা, সে বিষয়ে গবেষণার ওপরও মন্ত্রী মহোদয় গুরুত্বারোপ করেন। মন্ত্রীর এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

একটি দেশের মন্ত্রিসভার সদস্যদের মেধা ও মনন কত উঁচুতে পৌঁছলে একজন গুরুত্বপূর্র্ণ মন্ত্রী দেশের চলমান সংকটগুলো এড়িয়ে গিয়ে কচুরিপানাকে গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যযোগ্য করতে এবং কাঁঠালের আকৃতিকে একই প্রক্রিয়ায় ছোট ও সুদৃশ্য করতে পরামর্শ দিতে পারেন, তা অনুমান করা যায়।

মন্ত্রী কচুরিপানাকে খাবার হিসেবে তৈরি করার প্রক্রিয়ায় যে যুক্তি দিয়েছেন, তাও শানিত। গরু যদি কচুরিপানা খেতে পারে, তাহলে মানুষ তা খেতে পারবে না কেন? এমন অকাট্য যুক্তি কি কেউ খণ্ডন করতে পারবেন? কাঁঠালের আকৃতি নিয়েও মন্ত্রীর অনেক কল্যাণচিন্তা!

কাঁঠাল ত্যাড়াবেকা হবে কেন? কেন তার আকৃতিকে গবেষণার মাধ্যমে ছোট, গোল ও সুদৃশ্য করা যাবে না? মন্ত্রীর সৌন্দর্যজ্ঞান অবশ্যই প্রশংসনীয়। দেশে বড় বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট ও সমস্যা থাকতে মন্ত্রী মহোদয় কচুরিপানাকে খাদ্যযোগ্য করা ও কাঁঠালের আকৃতি চিন্তায় ব্যাকুল হলেন কেন, সে বিষয়ে পৃথক গবেষণা হতে পারে।

মন্ত্রী যদি বলতেন, মুজিব শতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধের ভূলুণ্ঠিত চেতনাকে কী করে জাগ্রত করা যায়, অথবা ভেঙে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থায় কী করে জনগণের আস্থা ফেরানো যায়, কী করে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিকে নিশ্চিত করা যায়, আপনারা এসব বিষয়ে গবেষণা করুন- তাহলে তার বক্তব্য গুরুত্ব পেত।

তার বক্তব্য অধিকতর প্রশংসিত হতো যদি তিনি বলতেন, কীভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার করা যায়, কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা যায়, কীভাবে জাতীয় সংসদকে প্রাণবন্ত করা যায়- আসুন আমরা সে বিষয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করি। কিন্তু দেশে এতসব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীর কচুরিপানা ও কাঁঠালের আকৃতি নিয়ে বক্তব্য দেয়ায় সাধারণ মানুষের ওই প্রবাদটিই মনে পড়েছে-‘রোম যখন পোড়ে, নিরো তখন বাঁশি বাজায়।’

মন্ত্রীর এ বক্তব্যের সমালোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত প্রসারিত হয়। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সমাপনী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘গরু যদি কচুরিপানা খেতে পারে তাহলে মানুষ কেন খেতে পারবে না। আমাদের দেশে কি এখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে যে কচুরিপানা খেতে হবে? আজ তো পরিকল্পনামন্ত্রী আসেননি। আমরা তো কিছু কচুরিপানা নিয়ে আসছিলাম।

উনাকে দিতাম’ (মানবজমিন ১৮-০২-২০২০)। বাংলাদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের মেধা নিয়ে সংশয় নেই। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি বিশ্ববাসীকে নতুন করে জানান দিয়েছেন। তাছাড়া জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও সাধনায় বাংলাদেশিরা যে বিশ্বব্যাপী অবদানমূলক ভূমিকা পালন করেছেন এবং করছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

তবে ভালো এবং মন্দ দু’দিকেই বাংলাদেশিদের মেধা চর্চিত হচ্ছে। ভালোর মধ্যে বাংলাদেশি যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে লেখাপড়া করতে যান, তাদের প্রায় সবাই মেধার পরিচয় দিয়ে ভালো ফলাফল করেন।

বাংলাদেশের যেসব শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে কাজ করতে যান, তাদের পরিশ্রমী হিসেবে সুনাম আছে। এ দেশের যেসব দেশপ্রেমিক সেনাসদস্য জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যান, তাদের কর্মনিষ্ঠাও বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

তবে নেতিবাচক দিকেও বাংলাদেশিরা কম মেধা খাটান না। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাট হয়। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকেও ডিজিটাল হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লুট হয়ে যায়। রাজধানীতে ক্যাসিনো কালচার গড়ে তোলা সম্ভব হয়। সম্প্রতি দেশে যেমন দুর্নীতি বেড়েছে, তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়নও যে হচ্ছে না, তা নয়।

একদিকে যেমন রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার হচ্ছে; তেমনি অন্যদিকে রাহাজানি, খুন, গুম, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, কারচুপিও বাড়ছে ব্যাপকভাবে। চুরি-চামারির ব্যাপকতার কারণে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বেড়েছে অনেক। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। প্রশাসন এবং রাজনীতিও আজ কলুষিত। মাছ-তরকারি থেকে শুরু করে প্রেম-ভালোবাসা পর্যন্ত সব কিছুতেই আজ ভেজাল।

চারদিকে মাদকের কেনাবেচা, স্কুল-কলেজে ছড়িয়ে পড়েছে নেশা, বাতাসে বেড়েছে সিসা। শহরের দূষিত পরিবেশ থেকে গ্রামের মুক্ত হাওয়ায় যাওয়ারও উপায় নেই। স্টেশনে গেলে টিকিট পাওয়া যাবে না। ট্রেনের টিকিটেও কালোবাজারি। তরকারিতে কীটনাশক, ফলে কেমিক্যাল, মাছে ফরমালিন, দেশি ফলে কার্বাইড, মুড়িতে ইউরিয়া, খেজুরের গুড়ে আর মধুতে চিনি, ওষুধে নকল, এমনকি প্রেম-ভালোবাসায়ও ভেজাল।

কিশোর প্রেমিক যাকে ভালোবাসছে, সে প্রেমিকাকেই আবার ব্লাকমেইল করে ধর্ষণ করছে। কোমলমতি স্কুলছাত্রীরা প্রায়ই এমন শিকারে পরিণত হচ্ছে। এ বছর ভালোবাসা দিবসে খুলনার দিঘলিয়ার চন্দনিমহল এলাকায় সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হলে বন্ধুরা সারা দিন ঘুরেফিরে তাকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। এ কেমন বন্ধুত্ব! এ কেমন ভালোবাসা!!

মেধা কেবল বাংলাদেশের সমাজ, শিক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েনি।

মেধা সংক্রামিত হয়েছে এ দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও প্রশাসকদের মধ্যেও। সারা বিশ্বে ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় উৎসবের আগে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দিলেও বাংলাদেশের মেধাবী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটেন। শিক্ষকরা একজনের লেখা থেকে চুরি করে প্রবন্ধ লিখে নিজের লেখা বলে চালিয়ে দেন।

কেউ কেউ নকল করে লিখেন পিএইচডি থিসিস। ক্রমান্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমার কথা হলেও বারবার নতুন তালিকা করে সে সংখ্যা বৃদ্ধি করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপদের দিনগুলোতে সহায়তাকারী বিদেশি নাগরিকদের সোনা-রুপার ক্রেস্ট দিয়ে সম্মানিত করার কথা বলে সোনা চুরি করে দস্তা, তামা, পিতল আর নিকেল দিয়ে ওই ক্রেস্ট তৈরি করিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ‘গণতন্ত্র’কে শক্তিশালী করার পরিবর্তে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠাতে পারেন।

গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজনীয় জেনেও বিরোধী দলগুলোকে হামলা-মামলায় জর্জরিত করার মধ্য দিয়ে নিষ্ক্রিয় করেন। অসাংবিধানিক ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রুজুকৃত সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি মামলাকে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা’ আখ্যায়িত করে খারিজ করে দিলেও অন্য দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ওই সময়ে রুজুকৃত একই মেরিটযুক্ত মামলাগুলো বহাল রাখেন।

অনুসন্ধান কমিটির বায়োস্কোপ দেখিয়ে সরকারপ্রধানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্বল ও নতজানু নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও ভোটার না চাইলেও কাগজের ব্যবহারবিহীন ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একগুঁয়েমি করে সিইসি ও ইসি কমিশনাররা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রবিমুখ করতে ভূমিকা রাখেন। এভাবে চারদিকে মেধার নেতিবাচক ব্যবহারে দেশ এখন আর মেধার ভার সইতে পারছে না। মন্ত্রিসভায়ও মেধাবীরা তাদের মেধার পরিচয় রাখছেন।

কেবল পরিকল্পনামন্ত্রীই যে মেধার পরিচয় দিয়েছেন, এমন নয়। গত এক দশকে বা তার আগেও বিভিন্ন সময় মন্ত্রিসভার সদস্যদের কেউ কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত ও আজগুবি বক্তব্য দিয়ে নিজ মেধার পরিচয় দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, বিএনপি আমলের মেধাবী মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন’ বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জিয়াউর রহমানের কবরে তার দেহ নেই উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করছি। ডিএনএ টেস্ট করান। যদি সেখানে জিয়ার দেহ থাকে, তাহলে নাকে খত দিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইব’।

২০১৮ সালের মধ্য জুনে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জাতীয় সংসদে বলেন, ‘সারা দেশে মাত্র ৯৬টি অনুমোদিত বার রয়েছে। অথচ এর বাইরে অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁয় মদ বিক্রি হয়। কিন্তু লাইসেন্স না থাকায় তারা ট্যাক্স দেয় না।

তাই যারা মদ বিক্রি করছে সবাইকে লাইসেন্স প্রদান করা হোক। পাশাপাশি মদের ওপর আরোপিত ট্যাক্স কমানো হোক’। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ডিসিসি নির্বাচনে যারা ভোট দিতে আসেননি, তারা বাসায় কোর্মা-পোলাও খাচ্ছেন বলে বক্তব্য দেন এক মেধাবী মন্ত্রী। অবশ্য মেধাবী তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদের মতে বিএনপির হাঙ্গামার আশঙ্কায় মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসেননি।

এভাবে বিভিন্ন শাসনামলে মন্ত্রীরা মেধার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। যতই দিন যাচ্ছে, মন্ত্রিসভায় ততই মেধাবীদের সমাগম বাড়ছে। আমগাছে এখন মুকুল ধরেছে। পরিকল্পনামন্ত্রী তার আগামী কোনো বক্তব্যে বিরাজিত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এড়িয়ে ফজলি বা ল্যাংড়া আমের স্বাদ বা আকৃতিতে পরিবর্তন আনতে কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণার পরামর্শ দিলে অবাক হব না।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

কচুরিপানা ও কাঁঠাল সমাচার

আপডেট টাইম : ০২:৩৪ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ২৪ ফেব্রুয়ারী ২০২০

বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বাংলাদেশ মেধাবীদের দেশ। এ দেশে চারদিকে কেবল মেধা আর মেধা। সমাজ, শিক্ষাঙ্গন, বিচারাঙ্গন, সরকার, গণমাধ্যম, টকশো, সংসদ, কেবিনেটসহ সর্বত্রই ছড়িয়ে পড়েছেন মেধাবীরা। এসব মেধাবীর পেছনে জনসমর্থন থাক বা না থাক, এদের মেধার উৎকর্ষ নিয়ে বিতর্ক নেই।

অতি সম্প্রতি মন্ত্রিসভার একজন গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রী মেধার প্রমাণ রেখেছেন। এ মেধাবী মন্ত্রী হলেন পরিকল্পনামন্ত্রী জনাব আবদুল মান্নান। মন্ত্রীমহোদয় ১৭ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর এনইসি সম্মেলন কক্ষে অনুষ্ঠিত ‘রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট অ্যাওয়ার্ড’ পদক প্রদান অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্য প্রদান করেন।

ওই অনুষ্ঠানে সাধারণ অর্থনীতি বিভাগের সদস্য (সিনিয়র সচিব) ড. শামসুল আলম ও বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ড. এমএ রহিমকে রিসোর্স ডেভেলপমেন্ট ফাউন্ডেশন (আরডিএফ) অ্যাওয়ার্ড প্রদান করা হয়। তবে অনুষ্ঠানে কে কী অবদানের জন্য আরডিএফ অ্যাওয়ার্ড পেলেন, সে বিষয়ের চেয়ে বেশি গুরুত্ব পায় অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি পরিকল্পনামন্ত্রীর বক্তব্য। কেন মন্ত্রীর বক্তব্য এতটা গুরুত্ব পেল, তা তার বক্তব্যের বিষয়বস্তুতেই নিহিত।

এ মেধাবী মন্ত্রী গবেষণার ওপর গুরুত্বারোপ করে বলেন, ‘কচুরিপানার পাতা খাওয়া যায় না কেন। গরু তো খায়। গরু খেতে পারলে মানুষ খেতে পারবে না কেন? মানুষের খাবার উপযোগী করা যায় কিনা, এ নিয়ে গবেষণার প্রয়োজন আছে।’

এ সঙ্গে কাঁঠালের আকার ছোট, গোল ও সুন্দর করা যায় কিনা, সে বিষয়ে গবেষণার ওপরও মন্ত্রী মহোদয় গুরুত্বারোপ করেন। মন্ত্রীর এ বক্তব্য সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে আলোড়ন সৃষ্টি করে।

একটি দেশের মন্ত্রিসভার সদস্যদের মেধা ও মনন কত উঁচুতে পৌঁছলে একজন গুরুত্বপূর্র্ণ মন্ত্রী দেশের চলমান সংকটগুলো এড়িয়ে গিয়ে কচুরিপানাকে গবেষণার মাধ্যমে খাদ্যযোগ্য করতে এবং কাঁঠালের আকৃতিকে একই প্রক্রিয়ায় ছোট ও সুদৃশ্য করতে পরামর্শ দিতে পারেন, তা অনুমান করা যায়।

মন্ত্রী কচুরিপানাকে খাবার হিসেবে তৈরি করার প্রক্রিয়ায় যে যুক্তি দিয়েছেন, তাও শানিত। গরু যদি কচুরিপানা খেতে পারে, তাহলে মানুষ তা খেতে পারবে না কেন? এমন অকাট্য যুক্তি কি কেউ খণ্ডন করতে পারবেন? কাঁঠালের আকৃতি নিয়েও মন্ত্রীর অনেক কল্যাণচিন্তা!

কাঁঠাল ত্যাড়াবেকা হবে কেন? কেন তার আকৃতিকে গবেষণার মাধ্যমে ছোট, গোল ও সুদৃশ্য করা যাবে না? মন্ত্রীর সৌন্দর্যজ্ঞান অবশ্যই প্রশংসনীয়। দেশে বড় বড় অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সংকট ও সমস্যা থাকতে মন্ত্রী মহোদয় কচুরিপানাকে খাদ্যযোগ্য করা ও কাঁঠালের আকৃতি চিন্তায় ব্যাকুল হলেন কেন, সে বিষয়ে পৃথক গবেষণা হতে পারে।

মন্ত্রী যদি বলতেন, মুজিব শতবর্ষে মুক্তিযুদ্ধের ভূলুণ্ঠিত চেতনাকে কী করে জাগ্রত করা যায়, অথবা ভেঙে পড়া নির্বাচনী ব্যবস্থায় কী করে জনগণের আস্থা ফেরানো যায়, কী করে ভোটকেন্দ্রে ভোটার উপস্থিতিকে নিশ্চিত করা যায়, আপনারা এসব বিষয়ে গবেষণা করুন- তাহলে তার বক্তব্য গুরুত্ব পেত।

তার বক্তব্য অধিকতর প্রশংসিত হতো যদি তিনি বলতেন, কীভাবে নির্বাচনী ব্যবস্থায় সংস্কার করা যায়, কোন প্রক্রিয়ায় নির্বাচন কমিশনকে শক্তিশালী করা যায়, কীভাবে জাতীয় সংসদকে প্রাণবন্ত করা যায়- আসুন আমরা সে বিষয়ে নতুন করে গবেষণা শুরু করি। কিন্তু দেশে এতসব অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক সমস্যা থাকা সত্ত্বেও মন্ত্রীর কচুরিপানা ও কাঁঠালের আকৃতি নিয়ে বক্তব্য দেয়ায় সাধারণ মানুষের ওই প্রবাদটিই মনে পড়েছে-‘রোম যখন পোড়ে, নিরো তখন বাঁশি বাজায়।’

মন্ত্রীর এ বক্তব্যের সমালোচনা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম থেকে জাতীয় সংসদ পর্যন্ত প্রসারিত হয়। রাষ্ট্রপতির ভাষণের ওপর সমাপনী বক্তব্য রাখতে গিয়ে বিরোধীদলীয় নেতা রওশন এরশাদ বলেন, ‘আমাদের পরিকল্পনামন্ত্রী বলেছেন, ‘গরু যদি কচুরিপানা খেতে পারে তাহলে মানুষ কেন খেতে পারবে না। আমাদের দেশে কি এখন দুর্ভিক্ষ দেখা দিয়েছে যে কচুরিপানা খেতে হবে? আজ তো পরিকল্পনামন্ত্রী আসেননি। আমরা তো কিছু কচুরিপানা নিয়ে আসছিলাম।

উনাকে দিতাম’ (মানবজমিন ১৮-০২-২০২০)। বাংলাদেশে বসবাসকারী নাগরিকদের মেধা নিয়ে সংশয় নেই। বিষয়টি আন্তর্জাতিকভাবেও স্বীকৃত। ড. মুহাম্মদ ইউনূস নোবেল পুরস্কার অর্জনের মধ্য দিয়ে এ বিষয়টি বিশ্ববাসীকে নতুন করে জানান দিয়েছেন। তাছাড়া জ্ঞানবিজ্ঞান চর্চা ও সাধনায় বাংলাদেশিরা যে বিশ্বব্যাপী অবদানমূলক ভূমিকা পালন করেছেন এবং করছেন, সে বিষয়ে সন্দেহ নেই।

তবে ভালো এবং মন্দ দু’দিকেই বাংলাদেশিদের মেধা চর্চিত হচ্ছে। ভালোর মধ্যে বাংলাদেশি যেসব শিক্ষার্থী বিদেশে লেখাপড়া করতে যান, তাদের প্রায় সবাই মেধার পরিচয় দিয়ে ভালো ফলাফল করেন।

বাংলাদেশের যেসব শ্রমজীবী মানুষ বিদেশে কাজ করতে যান, তাদের পরিশ্রমী হিসেবে সুনাম আছে। এ দেশের যেসব দেশপ্রেমিক সেনাসদস্য জাতিসংঘ মিশনে শান্তিরক্ষী বাহিনীর সদস্য হিসেবে দায়িত্ব পালন করতে যান, তাদের কর্মনিষ্ঠাও বিশ্বব্যাপী প্রশংসিত।

তবে নেতিবাচক দিকেও বাংলাদেশিরা কম মেধা খাটান না। এ কারণে আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলোতে লুটপাট হয়। শেয়ারবাজার কেলেঙ্কারি হয়, এমনকি বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ থেকেও ডিজিটাল হ্যাকিংয়ের মাধ্যমে অর্থ লুট হয়ে যায়। রাজধানীতে ক্যাসিনো কালচার গড়ে তোলা সম্ভব হয়। সম্প্রতি দেশে যেমন দুর্নীতি বেড়েছে, তেমনি অবকাঠামোগত উন্নয়নও যে হচ্ছে না, তা নয়।

একদিকে যেমন রাস্তাঘাট, ফ্লাইওভার হচ্ছে; তেমনি অন্যদিকে রাহাজানি, খুন, গুম, সন্ত্রাস, ধর্ষণ, কারচুপিও বাড়ছে ব্যাপকভাবে। চুরি-চামারির ব্যাপকতার কারণে ধনী-দরিদ্র বৈষম্য বেড়েছে অনেক। দেশের শিক্ষা, স্বাস্থ্য থেকে শুরু করে প্রতিটি প্রতিষ্ঠানে শৃঙ্খলা ভেঙে পড়েছে। প্রশাসন এবং রাজনীতিও আজ কলুষিত। মাছ-তরকারি থেকে শুরু করে প্রেম-ভালোবাসা পর্যন্ত সব কিছুতেই আজ ভেজাল।

চারদিকে মাদকের কেনাবেচা, স্কুল-কলেজে ছড়িয়ে পড়েছে নেশা, বাতাসে বেড়েছে সিসা। শহরের দূষিত পরিবেশ থেকে গ্রামের মুক্ত হাওয়ায় যাওয়ারও উপায় নেই। স্টেশনে গেলে টিকিট পাওয়া যাবে না। ট্রেনের টিকিটেও কালোবাজারি। তরকারিতে কীটনাশক, ফলে কেমিক্যাল, মাছে ফরমালিন, দেশি ফলে কার্বাইড, মুড়িতে ইউরিয়া, খেজুরের গুড়ে আর মধুতে চিনি, ওষুধে নকল, এমনকি প্রেম-ভালোবাসায়ও ভেজাল।

কিশোর প্রেমিক যাকে ভালোবাসছে, সে প্রেমিকাকেই আবার ব্লাকমেইল করে ধর্ষণ করছে। কোমলমতি স্কুলছাত্রীরা প্রায়ই এমন শিকারে পরিণত হচ্ছে। এ বছর ভালোবাসা দিবসে খুলনার দিঘলিয়ার চন্দনিমহল এলাকায় সপ্তম শ্রেণির এক ছাত্রী বন্ধুদের সঙ্গে ঘুরতে বের হলে বন্ধুরা সারা দিন ঘুরেফিরে তাকে সবাই মিলে ধর্ষণ করে ফেলে রেখে যায়। এ কেমন বন্ধুত্ব! এ কেমন ভালোবাসা!!

মেধা কেবল বাংলাদেশের সমাজ, শিক্ষা ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে ছড়িয়ে পড়েনি।

মেধা সংক্রামিত হয়েছে এ দেশের রাজনীতিবিদ, ব্যবসায়ী ও প্রশাসকদের মধ্যেও। সারা বিশ্বে ব্যবসায়ীরা ধর্মীয় উৎসবের আগে জিনিসপত্রের দাম কমিয়ে দিলেও বাংলাদেশের মেধাবী ব্যবসায়ীরা সিন্ডিকেট করে জিনিসপত্রের দাম বাড়িয়ে জনগণের পকেট কাটেন। শিক্ষকরা একজনের লেখা থেকে চুরি করে প্রবন্ধ লিখে নিজের লেখা বলে চালিয়ে দেন।

কেউ কেউ নকল করে লিখেন পিএইচডি থিসিস। ক্রমান্বয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের সংখ্যা কমার কথা হলেও বারবার নতুন তালিকা করে সে সংখ্যা বৃদ্ধি করেন।

স্বাধীনতা যুদ্ধের বিপদের দিনগুলোতে সহায়তাকারী বিদেশি নাগরিকদের সোনা-রুপার ক্রেস্ট দিয়ে সম্মানিত করার কথা বলে সোনা চুরি করে দস্তা, তামা, পিতল আর নিকেল দিয়ে ওই ক্রেস্ট তৈরি করিয়ে দেন। মুক্তিযুদ্ধের মূল চেতনা ‘গণতন্ত্র’কে শক্তিশালী করার পরিবর্তে ইলেকশন ইঞ্জিনিয়ারিং করে গণতন্ত্রের প্রাণভোমরা নির্বাচনকে নির্বাসনে পাঠাতে পারেন।

গণতন্ত্র বিকশিত হওয়ার জন্য শক্তিশালী বিরোধী দল প্রয়োজনীয় জেনেও বিরোধী দলগুলোকে হামলা-মামলায় জর্জরিত করার মধ্য দিয়ে নিষ্ক্রিয় করেন। অসাংবিধানিক ফখরুদ্দীন-মইনুদ্দিন সরকারের সময় ক্ষমতাসীন আওয়ামী লীগ নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে রুজুকৃত সাড়ে ৭ হাজারেরও বেশি মামলাকে ‘রাজনৈতিক হয়রানিমূলক মামলা’ আখ্যায়িত করে খারিজ করে দিলেও অন্য দলীয় নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে ওই সময়ে রুজুকৃত একই মেরিটযুক্ত মামলাগুলো বহাল রাখেন।

অনুসন্ধান কমিটির বায়োস্কোপ দেখিয়ে সরকারপ্রধানের ইচ্ছানুযায়ী দুর্বল ও নতজানু নির্বাচন কমিশন গঠন করেন। অধিকাংশ রাজনৈতিক দল, প্রার্থী ও ভোটার না চাইলেও কাগজের ব্যবহারবিহীন ইভিএমের মাধ্যমে নির্বাচন অনুষ্ঠানের একগুঁয়েমি করে সিইসি ও ইসি কমিশনাররা ভোটারদের ভোটকেন্দ্রবিমুখ করতে ভূমিকা রাখেন। এভাবে চারদিকে মেধার নেতিবাচক ব্যবহারে দেশ এখন আর মেধার ভার সইতে পারছে না। মন্ত্রিসভায়ও মেধাবীরা তাদের মেধার পরিচয় রাখছেন।

কেবল পরিকল্পনামন্ত্রীই যে মেধার পরিচয় দিয়েছেন, এমন নয়। গত এক দশকে বা তার আগেও বিভিন্ন সময় মন্ত্রিসভার সদস্যদের কেউ কেউ অনাকাঙ্ক্ষিত ও আজগুবি বক্তব্য দিয়ে নিজ মেধার পরিচয় দিয়েছেন।

উল্লেখ্য, বিএনপি আমলের মেধাবী মন্ত্রী আলতাফ হোসেন চৌধুরী একটি মৃত্যুকে কেন্দ্র করে ‘আল্লাহর মাল আল্লাহ নিয়ে গেছেন’ বক্তব্য দিয়ে সমালোচিত হয়েছিলেন। ২০১৬ সালের নভেম্বরে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক জিয়াউর রহমানের কবরে তার দেহ নেই উল্লেখ করে বলেন, ‘আমি চ্যালেঞ্জ করছি। ডিএনএ টেস্ট করান। যদি সেখানে জিয়ার দেহ থাকে, তাহলে নাকে খত দিয়ে জাতির কাছে ক্ষমা চাইব’।

২০১৮ সালের মধ্য জুনে গৃহায়ন ও গণপূর্তমন্ত্রী ইঞ্জিনিয়ার মোশাররফ হোসেন জাতীয় সংসদে বলেন, ‘সারা দেশে মাত্র ৯৬টি অনুমোদিত বার রয়েছে। অথচ এর বাইরে অনেক হোটেল-রেস্তোরাঁয় মদ বিক্রি হয়। কিন্তু লাইসেন্স না থাকায় তারা ট্যাক্স দেয় না।

তাই যারা মদ বিক্রি করছে সবাইকে লাইসেন্স প্রদান করা হোক। পাশাপাশি মদের ওপর আরোপিত ট্যাক্স কমানো হোক’। ২০২০ সালের ১ ফেব্রুয়ারি ডিসিসি নির্বাচনে যারা ভোট দিতে আসেননি, তারা বাসায় কোর্মা-পোলাও খাচ্ছেন বলে বক্তব্য দেন এক মেধাবী মন্ত্রী। অবশ্য মেধাবী তথ্যমন্ত্রী হাসান মাহমুদের মতে বিএনপির হাঙ্গামার আশঙ্কায় মানুষ ভোটকেন্দ্রে আসেননি।

এভাবে বিভিন্ন শাসনামলে মন্ত্রীরা মেধার পরিচয় দিয়ে চলেছেন। যতই দিন যাচ্ছে, মন্ত্রিসভায় ততই মেধাবীদের সমাগম বাড়ছে। আমগাছে এখন মুকুল ধরেছে। পরিকল্পনামন্ত্রী তার আগামী কোনো বক্তব্যে বিরাজিত গুরুত্বপূর্ণ সমস্যা এড়িয়ে ফজলি বা ল্যাংড়া আমের স্বাদ বা আকৃতিতে পরিবর্তন আনতে কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণার পরামর্শ দিলে অবাক হব না।