রোববার রাজধানীর হোটেল ইন্টারকন্টিনেন্টালে বাংলাদেশে কর্মরত বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রদূত, হাইকমিশনার এবং আন্তর্জাতিক সংস্থার প্রধানদের ব্রিফ করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। ব্রিফে তিনি বলেছেন, শেখ হাসিনার স্বৈরশাসনে দেশের সব প্রতিষ্ঠান প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে।
রাষ্ট্রের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের প্রয়োজনীয় সংস্কারের পরই দেশে নির্বাচনের আয়োজন করা হবে বলে তিনি মন্তব্য করেন। কাজগুলো যত দ্রুত সম্ভব করা হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেছেন, নির্বাচন হবে অবাধ, সুষ্ঠু, গ্রহণযোগ্য ও অংশগ্রহণমূলক। প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সংস্কারের আওতায় আসবে বিচার বিভাগ, নির্বাচন কমিশন, বেসামরিক প্রশাসন, নিরাপত্তা বাহিনী, গণমাধ্যম ইত্যাদি। তবে তিনি এও বলেন, এ মুহূর্তে অগ্রাধিকার হলো আইনশৃঙ্খলা রক্ষা, সরবরাহব্যবস্থা ঠিক রাখা এবং অর্থনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করা।
দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রধান উপদেষ্টার এটাই ছিল কূটনীতিকদের সঙ্গে প্রথম আনুষ্ঠানিক ব্রিফিং। অনুষ্ঠানে তিনি দেশ পরিচালনায় বিদেশিদের পাশে থাকারও আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি তার ব্রিফিংয়ে আরও অনেক কথাই বলেছেন। তবে তার মূল কথাগুলো বিশ্লেষণের দাবি রাখে। প্রকৃতপক্ষে তিনি ক্ষমতা গ্রহণের আগে দেশের অবস্থা কী ছিল এবং এখন কী করণীয়, সেসব কথা বলেছেন যথার্থভাবেই। বলার অপেক্ষা রাখে না, গত ১৬ বছরের শাসন ছিল চরম স্বৈরতান্ত্রিক এবং সরকার ছিল দুষ্টচক্র পরিবেষ্টিত। জনগণের সমর্থনের তোয়াক্কা না করে রাষ্ট্রযন্ত্রকে ব্যবহার করে ভিন্নমতকে যেভাবে দমন করা হয়েছে, তা এককথায় অবিশ্বাস্য।
পরপর তিনটি প্রহসনের নির্বাচন অনুষ্ঠান করে এ সরকার নিজেকে গণতান্ত্রিক দাবি করেছে। সরকারের পৃষ্ঠপোষকতায় ব্যাংক লুট থেকে শুরু করে সর্বক্ষেত্রে হরিলুট চালিয়েছে ক্ষমতাচ্যুত প্রধানমন্ত্রীর ঘনিষ্ঠজনরা। অনেকে এমনও আশঙ্কা করেছেন, অর্থনীতিকে যে অবস্থায় নিয়ে যাওয়া হয়েছে, তাতে দেশটা হয়তো অচিরেই শ্রীলংকার পরিণতি ভোগ করবে। সরকারের অজনপ্রিয় হওয়ার পেছনে আরেকটি কারণ ছিল রাষ্ট্রের স্বার্থ জলাঞ্জলি দেওয়া পররাষ্ট্রনীতি।
অবশেষে ছাত্র-জনতার অবিস্মরণীয় আন্দোলনের মুখে সরকারের পতন হয়েছে এবং শেখ হাসিনা দেশ ছাড়তে বাধ্য হয়েছেন। সরকারের পতনের পর যে অন্তর্বর্তী সরকার গঠিত হয়েছে, সেটি অরাজনৈতিক; তবে এ সরকারের প্রধান এবং অন্যান্য সদস্য সমাজে সম্মানিত ও যোগ্য ব্যক্তি। প্রধান উপদেষ্টা একজন নোবেল বিজয়ীও বটে এবং তিনি সারা পৃথিবীতে একজন সমাদৃত ব্যক্তি। তার চিন্তা ও উদ্ভাবনী ক্ষমতাও প্রশংসার যোগ্য।
আমরা আশা করতেই পারি, তার নেতৃত্বে ধ্বংসস্তূপ থেকে জেগে উঠবে ফিনিক্স পাখি। সবচেয়ে বড় যে সংকট তা হলো, দেশের গণতান্ত্রিক ও অন্যান্য প্রতিষ্ঠান প্রায় ধ্বংস হয়ে গেছে। অবস্থা এমন ছিল যে, এক প্রধান বিচারপতির ন্যায়নিষ্ঠতার মূল্যায়ন না করে তাকে জোরপূর্বক দেশত্যাগে বাধ্য করা হয়েছিল। শত শত ছাত্রের বুকে গুলি চালানোর নির্দেশ দিতে এতটুকুও শঙ্কাবোধ করেনি সরকার।
অপশাসনের কারণে রাষ্ট্রের সর্বক্ষেত্রে যে ক্ষত সৃষ্টি হয়েছে, তা সারাতে হলে বর্তমান সরকারকে বিচক্ষণতার পরিচয় দিতে হবে অবশ্যই। রাজনৈতিক দলগুলোরও উচিত হবে সরকারকে সর্বাত্মক সহযোগিতা করা। নির্বাচন আয়োজনের লক্ষ্যে প্রয়োজনীয় সংস্কারের জন্য যতটা সময় দরকার হবে, রাজনৈতিক দলগুলোকে ততদিন অপেক্ষা করতে হবে বৈকি। আমরা একটি কল্যাণকর, আধুনিক ও গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র দেখার অপেক্ষায় থাকলাম।