রফিকুল ইসলামঃ ‘সত্যের জন্য সবকিছু ত্যাগ করা যায়, কিন্তু সবকিছুর জন্য সত্যকে ত্যাগ করা যায় না।’ এ বাক্যটি দৈববাণীতুল্যে আঁকড়ে ধরে রেখেছেন বঙ্গবন্ধুর সর্বকনিষ্ঠ বিশ্বস্ত সহচর ও মুক্তিযুদ্ধের অন্যতম সংগঠক ভাটির শার্দূল খ্যাত হাওরের স্বপ্নদ্রষ্টা মহামান্য রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদ। গুরু-শিষ্যের যুগপৎ অবস্থান পরিলক্ষিত হয় তাঁর লালিত রাজনৈতিক দর্শনে– ‘সংখ্যাগরিষ্ঠতার গণতন্ত্র নয়, চাই ন্যায্যতার গণতন্ত্র।’
চলছে মুজিববর্ষ। ন্যায্যতার গণতন্ত্রের শেষ কথা স্মরণ ও মানা যায় বাঙালি জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর ভাষণকেই। তাঁর ভাষণ যতই শোনা হয়, ততই খুলে যায় অন্তর্দৃষ্টি। রাজনৈতিক কবি হিসেবে বিশ্ব মিডিয়ায় ভূষিত ন্যায়পাল বঙ্গবন্ধুর উচ্চকিতকণ্ঠ– ‘আমি বললাম, এ্যাসেম্বলির মধ্যে আলোচনা করবো; এমনকি আমি এ পর্যন্তও বললাম, যদি কেউ ন্যায্য কথা বলে, আমরা সংখ্যায় বেশি হলেও একজনও সে হয়, তার ন্যায্য কথা আমরা মেনে নেবো।’
সেই ন্যায্যতার গণতন্ত্র হালে বিকশিত হচ্ছে অনেকক্ষেত্রে বিকৃত চর্চায়। আবার ষড়যন্ত্র তত্ত্বের বেড়াজালে পড়েও। মুজিববর্ষ পেরোলেই বেজে উঠবে সংসদীয় নির্বাচনের সানাই। আত্মতুষ্টিতে সেই সুর ২০০১ সালের মতো শিবরঞ্জনীর বেহাগের করুণ সুরে পরিণত হবার আগেই প্রতিটি সংসদীয় আসনের নির্বাচনী মাঠের উপযোগিতার দিকে ফিরে তাকানো ফেলনা নয়। যেহেতু শেখ হাসিনার দূরদর্শী নেতৃত্বে টানা তিনবার ক্ষমতায়নে উন্নয়নের অভিযাত্রায় ক্ষুধা ও দারিদ্র্যমুক্ত মধ্যম আয়ের দেশ গঠনের সফলতায় আওয়ামী লীগের স্বপ্ন রয়েছে উন্নত রাষ্ট্র গঠনের অভিপ্রায়ে ২০৪১ সাল নাগাদ ক্ষমতায় থেকে দেশ পরিচালনা করার।
দৃশ্যত, বাস্তবতার ফারাক না খতিয়ে উন্নয়নের আত্মপ্রসাদ ও আবেগের দোলায় দুলছে দলটি। স্বপ্ন তো বহুদূর, আগে সামনের বৈতরণী পার হতে নৌকার নোঙর হওয়া চাই জনান্তরে। কেননা, ক্ষমতার উৎস জনগণ আর মূলের ভিত্তি যে তৃণমূল। ৩০০ জন এমপি’র মধ্যে প্রায় ২৬৫ জন এমপি নির্বাচিত হন তৃণমূল থেকে, যার গুরুত্ব অগাধ। অবজ্ঞার অবকাশ নেই– ‘আয় বৈষম্য, প্রবৃদ্ধি, উন্নয়ন ও জনমত একত্রে চলে না’।
রাজনীতির হিসাব বড়ই জটিল ও কটিল।রাজনীতির বেশকিছু হিসাব থাকে, যা চর্মচোখে বা সাদাচোখে দেখার হিসাব সবসময় বনে না। যেটা আমরা শুনছি, যেটা আমরা দেখছি, যেটা আমরা জানছি সেটাই সত্য নয়। সুতরাং যখন কোনো প্রমাণ থাকে না, তখনো বলা হয় থাকবেই তো না। এখানে কিন্তু ষড়যন্ত্র, এটা গোপনে করা হয়েছে; এটি চক্রান্ত। প্রখ্যাতিতে সম্মোহিত হয়ে পড়লে তো চোখ থাকতেও যে অন্ধ। আওয়ামী লীগের দূর্গতেই চোখফেরানো যাক, যেখানে প্রখ্যাতির অন্তরালে চলছে রাজৈতিক অনুগামী বিভাজনের মেরুকরণ। কেবল আত্মীয়তা নয়, লেখালেখির সুবাদে পূর্বেগড়া নুনের ভালোবাসা ও বিবেকের দায়বদ্ধতা থেকে হাওরের রাজনীতিকে গলাকাটা হতে বাঁচাতে আঙ্গুলকাটা মেনে নিয়েই শঙ্কর রায়ের ভাষায় বলতে চাই,– ‘সব কৃতিত্ব তৃপ্তির, আমি নিমিত্ত।’
‘শঠতা আর কপটতার অলিগলি পথ বেছে বের করা হয়ে গেছে হাওরে রাজনীতি শিক্ষার প্রথম পাঠ’, যা হালে সত্যিই বড় ডিফিকাল্ট হয়ে পড়েছে।অথচ এই কিম্বুতকিমাকার ‘ডিফিকাল্ট পলিটিক্স’র প্রবক্তা স্বাধীনতা-উত্তর বাংলাদেশে প্রথম সামরিক শাসক। বোলচালে এর আগে বিশ্বাস ঘাতকতা শব্দটির ব্যাপ্তি ঘটে নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার অযাচিত পরিণতিতে। আর Conspiracies শব্দটি বাঙালিপনা পায় ‘ষড়যন্ত্র তত্ত্বে’, আগস্ট ট্রাজেডিতে সপরিবারে জাতির জনক বঙ্গবন্ধুর হত্যার পথ ধরে। নবাব সিরাজ-উদ-দৌলার পাশে ছিল মীর জাফর, জগৎ শেঠ, ঘসেটি বেগমরা। আর বঙ্গবন্ধুর পাশে ছিল মোশতাক ও তাহের ঠাকুররা। পরিণতি জানা থাকা সত্ত্বেও ওই প্রেতাত্মাদেরই রুদ্ধগতি পরিলক্ষিত।
প্রসঙ্গত, ডিফিকাল্ট ফ্রন্টের বিএনপি সময়ের ব্যবধানে ফল্টে পড়ে এখন অনেকটাই ‘নাই মামা’। আর আওয়ামী লীগও ষড়যন্ত্র তত্ত্বের আতিথেয়তায় অনেকটাই ‘কানা মামা’। যদিওবা বলা হয়ে থাকে– ‘নাই মামার চাইতে কানা মামা ভালো’। হাওরের নির্মল রাজনীতিতেও এই ষড়যন্ত্র তত্ত্ব যে কতখানি কণ্টকাকীর্ণ করে তুলছে তলেতলে, সেটি বুঝাতে বা বিশ্বাসের ঘরে সিঁধকাটার দৃষ্টান্তে আলোচনার বিষয়বস্তুর উদ্দীপক হিসেবে একটা বিখ্যাত বিস্ট ফ্যাবলের আশ্রয় নেয়া যাক। যেখানে কুমির মা তার সাত কুমির বাচ্চাকে শেয়াল পন্ডিতের কাছে গচ্ছিত রাখে। আর শেয়ালপন্ডিত একে একে ছয়টিকে খেয়ে একটিকে বাঁচিয়ে রাখে এবং কুমির মা সন্তানের খুঁজ নিতে এলে ধূর্ত শেয়াল একটি কুমিরছানাকে বারবার দেখিয়ে ধোঁকা দেয় মাকে।
এই দেশে কোনো দল রাজনীতি করতে চাইলে সবার আগে আদর্শের মূল দুটি ভিত্তি গড়ে তুলতে হবে। একটি হচ্ছে মুক্তিযুদ্ধ, অন্যটি বঙ্গবন্ধু। বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধু দুটি নাম, একটি সত্তা। সেই সত্তার আদর্শিক কান্ডারি রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের স্পষ্টবাদীতা, স্বদেশপ্রেম, মা মাটি ও মানুষের প্রতি ব্যাকুলতা, ভাষা আন্দোলন, মুক্তিযুদ্ধ ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় উজ্জীবিত এবং রাজনৈতিক দল আওয়ামী লীগ, বঙ্গবন্ধু ও তাঁর পরিবারের প্রতি অনুরাগে শত জেল-জুলুম, সামরিক শাসকদের মন্ত্রীত্বের টোপ এবং রক্তচক্ষুকে তোয়াক্কা না করে কতো যে দলীয় নীতিতে নিষ্ঠাবান ছিলেন তাঁর স্পষ্ট ও সত্যবাকেই তা প্রতীয়মান হয়– ‘লাইগ্যা থাকলে মাইগ্যা খায় না।’
তাঁর এই আপ্তবাক্যের প্রতি আজীবন অটুট থেকে সকল প্রকার কলুষতা, সংকীর্ণতা, হীনতা ও ভেদবুদ্ধির ঊর্ধ্বে ওঠে মানুষের বৃহত্তর কল্যাণ সাধনে আত্মনিয়োগ করে এবং সে সাধনায় ব্রত থাকায় তিনি দ্বিতীয় দফা রাষ্ট্রপ্রধান হয়ে সাফল্যের শীর্ষত্বে দেশীয় গন্ডি পেরিয়ে বিশ্বসভায় নিজেকে অধিষ্ঠিত করেছেন একটি প্রতিষ্ঠান হিসেবে।
আদর্শিক রাজনীতির সারথি ও আলোকিত অন্তরের অধিকারী সর্বজনগ্রহণযোগ্য রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের সাবেক সংসদীয় আসন কিশোরগঞ্জ-৪। অর্থাৎ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম উপজেলা। তথাকথিত শহুরেদের ‘ভাইট্ট্যা গাবর উত্তইরা ভূত’– নৃ-গোষ্ঠীর চেয়েও অধিক তুচ্ছতাচ্ছিল্যকে জনসেবার একাগ্র তপস্যাতে আধুনিক যোগাযোগ ব্যবস্থা ও শতাধিক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করে আলোকিত হাওর গড়ে এবং ভাইট্টা ভাষাকে শৈল্পিক রূপ দিয়ে তিনি পরিণত হয়েছেন দিকপালে।
‘কথা এবং কাজের মধ্যে মিল’– তাঁর দুর্লভ গুণ। তিনি এলাকায় বিভিন্ন সময়ে সফরকালে ও মিঠামইনে রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ পল্লীতে অনুষ্ঠিত ‘ইত্যাদি’ অনুষ্ঠানে এবং বিগত দিনগুলোতে আমার সাথে আলাপচারীতায় ও সাক্ষাৎকারে যেসব কথা বলেছেন তা হাওরবাসীর কেবল নয়, জাতিরই কণ্ঠস্বর।
‘রাজনীতিতে জনগণই মুখ্য’ গণ্যে তাঁর রাষ্ট্রপতি হবার গোমর ফাঁস করে দিয়ে আবদুল হামিদ বলেছেন, ‘লোকটি (আবদুল হামিদ) কারো উপকার করতে না পারুক কিন্তু কারো কোনো ক্ষতি করবে না’– এই ভরসা ও বিশ্বাস থেকে বড় মায়া করে এলাকার মানুষ আমাকে বারবার নৌকায় ভোট দিয়ে নির্বাচিত করে জাতীয় সংসদে পাঠিয়েছেন। নীতিতে অটুট থাকায় হাওর থেকে বঙ্গভবনের বাসিন্দা হয়েছি। ডেপুটি স্পিকার, স্পিকার, বিরোধীদলীয় উপনেতা সর্বোপরি রাষ্ট্রপতি হয়েছি ব্যাকব্যাঞ্চের এমপি থেকে। বঙ্গভবন ইঁনাদের জন্য অবারিত করে দেয়ায় লোকে কয়– ‘আমি নাকি স্যান্ডেলপড়া গরিবের রাষ্ট্রপতি।’
রাজনীতিতে সততা, একনিষ্ঠতা, নীতি ও আদর্শের প্রতি একাগ্রতার দোসরা নেই মন্তব্য করে মহামান্য রাষ্ট্রপতি বলেছেন, রাজনীতি হালে ‘পলিট্রিক্স’ হয়ে গেছে। রাজনীতিতে ‘বহুমুখী’ কৌশল থাকবে বৈ-কী; কিন্তু ‘বহুরূপী’ কৌশলে রাজনীতি জনমনে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে।
তিনি দৃঢ়চিত্তে বলেন, প্রায়ই দেখছি অনেক রাজনীতিকের ‘পেডের ভিত্তে দাঁত’। অর্থাৎ বাইরের রূপ এক এবং ভিতরে আরেক। এই কারণেই রাজনীতি বা পলিটিক্স ও নেতাদেরকে এখন ঘৃণার চোখে দেখছে মানুষ। ফলে পলিটিশিয়ান বা রাজনীতিবিদদের ওপর মানুষের আস্থা ও বিশ্বাস ক্রমেই ওঠে যাচ্ছে বলে উদ্বেগও প্রকাশ করেন রাষ্ট্রপতি।
মানবসত্তার অধিকারী এই রাষ্ট্রনায়ক বিষয়টি খোলাসা করতে গিয়ে বলেন, কারো কথা ও কাজে গড়মিল দেখলে লোকে একজন আরেকজনকে বলছে আমার সাথে ‘রাজনীতি’ করছ? আর কৌশল পরিলক্ষিত হলে বলছে ‘পলিট্রিক্স’ করছ? তাছাড়া বেডাগিরি বা ক্ষমতা প্রকাশ পেলে বলছে ‘নেতাগিরি’ করছ?
তিনি অভিপ্রায় ব্যক্ত করে বলেন, এতে নেতা, রাজনীতি ও পলিটিক্স শব্দগুলা পরিণত হয়েছে গালিতে– রাজাকারী করা ও মীরজাফরী করা; অন্যদিকে হিটলারী বুদ্ধি ও কিসিঞ্জারী বুদ্ধি বিশেষণে। এর জন্য রাজনীতির ভুল চর্চা ও অপপ্রয়োগকে দায়ি করেছেন রাষ্ট্রপতি। সেজন্য উত্তরণের পথে এগোতে লীগ নেতাকর্মীদের ‘মুই কি হনুরে’ ভাবসাব ছেড়ে কারোর ‘ক্ষতির চিন্তা’ বাদ দিয়ে জনকল্যাণে ব্রত হয়ে ভাবমূর্তি পুনরুদ্ধারের জোর তাগিদ দেন তিনি।
কিসিঞ্জারীতে ওই ক্ষতিগ্রস্ত কারা হচ্ছেন এবং কাদের দ্বারা হচ্ছেন– এক দশকের নিবিড় পর্যবেক্ষণ থেকে সে তথ্য সংযুক্তি ও এর জের নিয়েই নিবন্ধের অবতারণা কেবল নয়, সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতৃত্বর মোহভঙ্গ করাও মূখ্য। কবি দাউদ হায়দারের তৃপ্তির উৎস বুঝে ‘নি:নায়ের অনেক নাও’ সেজে কিছুসংখ্যক স্ট্রিম ও সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যক্তি তোষামোদির প্রোপাগান্ডায় সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতৃত্ব যে অনেকটাই ‘হিপ্নোটাইজড’ বা সম্মোহিত। এতে ‘নায়ের এক নাও’ ওয়ালারা সৃষ্ট ‘নীরুর বাঁশি’ উপাখ্যানে হতাশাগ্রস্ত। শঙ্কিতও। কেননা, নেতৃত্বের দৃষ্টি যেখানে বহুদূর; নিকটে না নৌকা নোঙর হারায়!
কার্যত মহামান্য রাষ্ট্রপতি ২০১৩ সাল থেকে মাঠের রাজনীতির বাইরে। ফলে প্রকৃত পরিস্থিতি তাঁর অজানা থাকাটাই স্বাভাবিক। যা বলেছেন দূরদর্শিতা ও বিচক্ষণতা থেকে। তাঁর সাথে সাক্ষাৎপ্রার্থী যারা হন, তারা ব্যক্তিস্বার্থে ‘বাইলের বৈঠা’ বাইয়া আসেন। আর নেতা হলে তো ‘পাল উড়ায়’।
সমাজের বাস্তবতা বড় কটিল ও অত্যুগ্র। জনসেবা রাজনৈতিক উদ্দেশ্য সিদ্ধ করার ছদ্মবেশ মাত্র, যা ড্র্রোন ক্যামেরায় ধরা পড়ার নয়। দলের প্রভাব খাটিয়ে স্বার্থান্বেষী কতিপয় নেতা মেতে উঠেছে ব্যক্তি ক্ষমতাধর হওয়ার প্রতিযোগিতায়। তজ্জন্য সাবোটাজ বা অন্তর্ঘাতে ব্যক্তি অনুগামী তৈরিতে রাজনৈতিক জনবিভাজন চালানো হচ্ছে দলীয় নেতাকর্মী, সমর্থক, অনুগামী, শুভার্থী শিক্ষকসহ পেশাজীবী-চাকরিজীবী চিন্তকদের ভিতরে। এতে দলীয় কল্যাণমুখী রাজনীতিতে অভিষেক না হয়ে অভিষেক হচ্ছে ‘ইগো-সেন্ট্রিক পলিটিক্সে’। ব্যক্তি অনুগামীতার মেরুকরণে শক্তিমান হচ্ছে ফ্রাঙ্কেনস্টাইন নেতৃত্ব। দলীয় চিন্তকদের মতে, সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতৃত্ব প্রখ্যাতিতে মজে ‘লিডার ইজ নেভার রং, লিডার ইজ অলওয়েজ কারেক্ট’ দৃষ্টভঙ্গি পোষণ করায় এবং প্রশংসা শুনতে অভ্যস্ত ও নেতিবাচক মন্তব্য বদহজমের সুযোগে ‘হ বুবু বা জ্বি হুজুর’ চক্রের চামচিকাদের জন্ম। কবি দাউদ হায়দারের ভাষায়, ‘তৃপ্তিই তেলের শিশির উৎস’।
রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ জনসংসর্গস্পর্শী ছিলেন বলে বঙ্গভবনকে তুলনা করেছেন কারাগারের সাথে। তিনি জনগণের কাছে নির্ভরশীল থাকলেও মাকাল নেতৃত্বের কবলে পড়ে হাওরপাড়ের মানুষ হালে শরৎচন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘পল্লীসমাজ’ প্রবন্ধের মতো চরিত্র চিত্রায়ণে ‘স্কেপগোট’ বা বলিরপাঁঠা। যেখানে কল্যাণমুখী নেতৃত্বের ওপর নির্ভর করে সমাজের সুখ-সমৃদ্ধি; সেখানে তাদের ধ্যান, জ্ঞান, খেয়াল সবকিছু দিয়ে সর্বদা মানুষের শুধু ক্ষতি করার চেষ্টা। এ হেনস্তায় বাদ যাচ্ছে না গ্রামের দলীয় ত্যাগী নেতাকর্মী, সমর্থক, অনুগামী ও শুভার্থীসহ পেশাজীবী-চাকরিজীবী, শিক্ষক, চিন্তকরাও। এজন্য ‘দুধে কাটা বাছা হচ্ছে’। অর্থাৎ নানান ছুঁততে খুঁত ধরা হচ্ছে আতশীকাঁচে। নিরুপায়ে পেশাদারিত্ব ও জনসেবা নিরাপত্তা পাচ্ছে ব্যক্তি বিশেষের দাসত্বে। এছাড়া ব্যতিক্রম বাদে সমাজে সালিশী বিচারব্যবস্থাকেও বশ্যতার স্ট্যাম্পকার্ড বানিয়ে একে আবর্তিত করে সত্যতা যাচাই করা হচ্ছে শক্তি-গোষ্ঠী, সংখ্যাগরিষ্ঠতা ও ব্যক্তি অনুগামীতার বিচারে রাজনৈতিক রং লেপে এবং ‘খাইট্টা লাগিয়ে আইট্টা গিয়া ভাইঙ্গা দিয়া আসার’ ফকিরের ক্যারামতির দ্বিচারীতা কারো বুঝতে বাকি না থাকলেও ‘নেতার কাম লাগদোনা’ জুজুর ডর দেখানোই জিম্মি লোকজন। ক্ষমতা ও দম্ভের কাছে স্তব্ধ প্রতিবাদের ভাষা। এতে সংক্ষুব্ধ জনমনে ক্রমেই বাড়ছে দূরত্ব ও সংশ্লিষ্ট শীর্ষ নেতৃত্বের প্রতি চাপা ক্ষোভ, যা গড়াচ্ছে অভিশাপে।
রাজনীতি সম্ভাব্যতার শিল্প। রাজনৈতিক দল ও নেতারা যেকোন পরিস্থিতিতে সম্ভাবনা জাগিয়ে তুলতে পারে। এক দশকের ব্যবধানে পুরো সমাজব্যবস্থায় যথার্থ রাজনৈতিক শিক্ষার ঘাটতি ও চর্চাতে একটি বৃহত্তর এবং গভীরতর প্রশ্ন উঠেছে– কোন্ সম্ভাব্যতা জাগিয়ে তোলা হচ্ছে রাষ্ট্রপতির স্বপ্নের হাওরে? এই নতুন রাজনৈতিক প্রেক্ষিত থেকে ঠিক কী অপেক্ষা করছে আমাদের ভবিষ্যদিনের জন্য? আগামীতে কারা রাজনীতিতে আসবে, তারা কোন্ শ্রেণির প্রতিনিধিত্ব করবে, তাদের রাজনৈতিক আচরণ কতটা রাজনৈতিক আর কতটা সুবিধা আহরককেন্দ্রিক হবে? নেতার নীতির রূপায়ণ না করা গেলে শুধু শুধু নীতিবাক্য কপচানোর মধ্যে ফায়দাইবা কি?
রাষ্ট্রবিজ্ঞানে রাজনীতিতে নেতা হচ্ছে কাজ পরিচালনা করা, নিয়ন্ত্রণ করা ও কর্মীদের অনুপ্রাণিত করার প্রক্রিয়া। অন্যদিকে নেতৃত্ব গড়ে উঠার জন্য আবশ্যক তিনটি উপাদান– নেতা, অনুগামী ও পরিস্থিতি। আর নেতার কাজ হচ্ছে অনুগামীদের দলের প্রতি অনুপ্রাণিত করা ও পরিস্থিতি অনুকূলে রাখা।
বটে! এক্ষেত্রে বিশ্বস্ত সেজে শীর্ষ নেতৃত্বকে প্রখ্যাতি ও উন্নয়নস্থূতিতে মোহাবিষ্টে ফেলে দলেরই কৃপা পেয়ে কতিপয় নেতা রাজনৈতিক, সামাজিক, প্রাতিষ্ঠানিক, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত বিভিন্ন কমিটি, সামাজিক নিরাপত্তামূলক কর্মসূচি ও পঞ্চায়েতসহ হাওরবাসীর জনজীবনে অবকাঠামোগত উন্নয়নের সুবাদে বিভিন্ন সুবিধাজনক খাতগুলোতে কেষ্টবিষ্টু বনে পরিস্থিতি অনুকূলে রাখছেন ঠিকি; কিন্তু দলীয় অনুগামী তৈরির ক্ষেত্রে নয়, ব্যক্তি অনুগামী তৈরির মাধ্যমে ‘দলের চেয়ে ব্যক্তি’ ইমেজ গড়তে। দল তো ঢাল এখানে।
পুরো প্রক্রিয়াগুলোই সাবোটাজ বা অন্তর্ঘাতমূলক তৎপরতা, যা ধরাছোঁয়া বাইরে থাকলেও লক্ষ্যভেদে অব্যর্থ। এর মাধ্যমেই প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলৎসিনকে ভাঁজে এনে পরাক্রমশালী সোভিয়েত ইউনিয়নকে পর্যন্ত ভেঙে খানখান করতে পেরেছিল আমেরিকা, যা আদৌ সম্ভব হতো না সাবভারশন বা নাশকতা দিয়ে। গ্রামের সাধারণ মানুষটিও এখন একটি ঘটনা আরেকটি ঘটনার সাথে মিলিয়ে ‘জেনারেলাইজ’ করে বা মিলিয়ে দেখে। শীর্ষ নেতৃত্বের কাছে দু’চারজন মিলে গিয়ে দেখাচ্ছেন ‘মুই এলাকা ধরে রাখছি; অন্যদিকে এলাকায় ফিরে ‘অমুক-তমুকসহ মুই হামিদ সা’বের (রাষ্ট্রপতি) লোক’ — দুই খানে দুই কথা বেচার ধূর্ততা লোকে ধরতে পারলেও অসহায়। হিংস্র বাঘকে প্রশ্রয় দিলে নিরীহ হরিণের পরিণতির ন্যায় যে আর্তনাদ, তা শেষতক ফিনিশ না হয়ে ফিনিক্স হয়ে ঝড় তুলে!
আসনটি পাদপ্রদীপের নিচে হলেও দরদি প্রদীপটি নিভতে বসেছে। নৌকার কাণ্ডারি এখন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদের জ্যেষ্ঠপুত্র তিনবারের নির্বাচিত এমপি প্রকৌশলী রেজওয়ান আহাম্মদ তৌফিক। বাবার মতো সাদাসিধে, জনমুখী ও কাজপাগল মানুষ বলে প্রত্যন্ত হাওর এখন উন্নয়নের জোয়ারে ভাসছে, যা দেশি-বিদেশি পর্যটকদের কাছে পরিণত হয়েছে দর্শনীয় ও তীর্থ স্থানে। ‘হাওর এখন শহুরে হাওর’ হলেও তা মনে শান্তি বিনষ্টে বিষিয়ে ওঠা বিধ্বস্ত জনমনে আর্দ্র করছে না দারোগার নায়ের মাঝিদের দৌরাত্ম্যে ও ‘গাঁজার নাও পাহাড় ডিঙাতে দেখে’। কেননা, স্বপ্নের সাথে মনের যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য থাকায় রাষ্ট্রপতির স্বপ্নের হাওর উন্নয়নের জোয়ারে ভাসলেও দিচ্ছে অশনিসঙ্কেত।
নেতৃত্ব পাঁচ ধরনের– গণতান্ত্রিক, ক্যারিশমাটিক, স্বৈরতান্ত্রিক, পরিস্থিতিভিত্তিক ও নির্জীব নেতৃত্ব। তবে হাওরে চলছে জাতীয়তাবাদী কিম্ভুতকিমাকার
‘ডিফিকাল্ট পলিটিক্স’। যে চর্চার দ্রোহে মনের মুক্তি শৃঙ্খলাবদ্ধ, যা সুকুমার রায়ের ভাষায়- ‘মনে কতো প্রশ্ন জাগে দিচ্ছে না কেউ জবাব তার।’
এ নিয়ে হিতাকাঙ্ক্ষীদের মনে ভর করছে বিষাদ এবং হতাশার কালো মেঘ। বই মেলায় সারা জাগানো নতুন প্রজন্মের উদয়মান কবি ও কথাসাহিত্যিক মিঠা মামুনের ভাষায়, ‘হবে না রে ভাই কেন হবে বল/এখানে আজ সাধুর বেশে চামচিকাদের দল/চল, তবে দূরে কোথাও চল/যদি থাকে মনোবল/মানুষ হতে গেলে মানুষ বলবেই পাগল।’
তাই ‘চেনা বামনের অচেনা রূপ’ চিনে নিয়ে ‘আই হেটস্ পলিটিক্স’ এবং ‘ডিনিয়াল সিন্ড্রোম’ থেকেও বেরিয়ে এসে আদর্শিক রাজনীতির পুরোধা রাষ্ট্রপতি মো: আবদুল হামিদের লেগাসিতে ব্রতী এবং অনুসরণ ও অনুকরণের বিকল্প নেই। কেননা, দেবতার আড়ালে যে অসুর হাসছে। রাজনৈতিক দল একটি কর্পোরেশন নয় যে কিছুসংখ্যক দক্ষ লোক সেটি কর্পোরেট কায়দায় চালিয়ে নেয়া যাবে। সবার আগে তাদের প্রয়োজন কিছু আদর্শের। নতুবা তা দিয়ে আস্তাকুঁড় ভরা যাবে হয়তো, কিন্তু রাজনৈতিক দল টিকিয়ে রাখা যাবে না। অতএব, সময় থাকতে সাধু সাবধান!
পোড়খাওয়া দক্ষ রাজনীতিক-সংগঠক রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বুঝতেন, একমাত্র নেতাকর্মীরাই অনুগামী তৈরি করে না, একটি দেশে রাজনৈতিক দল ও মতাদর্শকে এগিয়ে নিতে সকল শ্রেণি মানুষ-চিন্তকদের অংশগ্রহণ আবশ্যক। যে কারণে ‘ফেসভেলু’ রাজনীতি নয়, ‘বেস্টওয়ান’ও নয়, নেতাকর্মী-অনুগামী-শুভার্থী চিন্তকদের সমমূল্যায়ন করতেন এবং দেখতেন উদার দৃষ্টিভঙ্গিতে। একই মোহনায় সবাইকে ধরে রাখতেন হ্যামিলনের বাঁশির সম্মোহনীর শক্তিতে। ‘কান কথায় কান’ দিতেন না যেমন, তেমনি কেউ সুযোগ পেতেন না ‘দারোগা নায়ের মাঝি’ সাজার।
তাঁর ‘মানুষ’ চেনার অভিজ্ঞা অসাধারণ। মানুষের মন, নাড়ি ও গতিবিধি বুঝতেন। বলতে গেলে প্রতিটি গ্রামের প্রায় প্রতিটি মানুষকে নামে চিনতেন। গ্রামের কেউ তাঁর সাক্ষাৎপ্রার্থী হলে অন্যথা ফেলে আন্তরিকায় নামধরে বলতেন, অমুক-তমুকদের তো লগে দেখছি না! তারা আইছেনা ক্যারে? ক্যামন আছে, ভালা-নি? গিয়া আমার ছালাম/আদাব জানাইবা, আইতে কইবা। ব্যস! ‘মুই কি হনুরে’ ও ‘বেস্টওয়ান’ বনা এবং ‘ফেসভেলু’ তৈরির দুরভিসন্ধি খতম; ইগো-সেন্ট্রিক পলিটিক্স’ তো দূরে থাক– ‘এমনি মহান তুমি /ছাড়া সদগতি, /স্বীয় স্বার্থসিদ্ধিতে /করো না কারো ক্ষতি। /দাঁড় করালে হাওর /শিকড় থেকে শিখর। /কুর্নিশ রাষ্ট্রপতি /জিইয়ো তুমি।’
লেখক: জ্যেষ্ট সাংবাদিক ও কলামিস্ট।
সহযোগী সম্পাদক, আজকের সূর্যোদয়