ড. গোলসান আরা বেগমঃ পৃথিবীর উষা লগ্ন থেকেই বহু চড়াই উৎরাইয়ের মাধ্যমে নারী পুরুষের যৌত প্রচেষ্টায় সামাজিক জীবন বিনির্মিত হয়েছে। আমাদের পবিত্র সংবিধানের গুরুত্বপূর্ণ মুলনীতি হলো-নারী পুরুষের মধ্যে কোন বৈষম্য করা যাবে না।কর্মে, ধর্মে, মানানসই সকল কার্যকলাপে নারী পুরুষে সমপর্যায়ের অংশিদারিত্ব থাকবে। ঘরে বাইরে,কর্ম ক্ষেত্রে, উন্নয়নে, অর্থনৈতিক সুবিধায় নারীরা পুরুষের সমপর্যায়ে মুল্যায়িত হবে। কিন্ত কেতাব,দলিল,দস্তাবেজ,নথি পত্রের আইনে বিধিটি লিখা থাকলেও, বাস্তব প্রেক্ষাপট ভিন্ন আঙ্গিকে চলছে।
জাতীয় নারী উন্নয়ন নীতি ২০১১ কে প্রতিহত ও বাতিল করার উদ্দেশ্যে কট্টর ইসলাম ধর্মপন্থী মৌলবাদিরা ২০১৩ সালে প্রতিষ্টা করে অরাজনৈতিক হেফাজতে ইসলাম সংগঠন।। এই দলটি ক্রমে ক্রমে শক্তিশালী হয়ে সরকারকে বিভিন্ন ভাবে প্রভাবিত করতে থাকে, এমন কি ২০২১ সালে তাদের রাষ্টীয় ক্ষমতা দখল করার খায়েস হয়। তুচ্ছ ইসুকে কেন্দ্র করে তৈরী করে দেশের অভ্যন্তরে বৈরী পরিবেশ ও অস্থিতিশীল পরিস্থিতি। যা মুক্তিযোদ্ধের আদর্শের সরকারের পক্ষে সহনীয় নয়।
এই মৌলবাদীরা বলছে -নারী নেতৃত্ব,নারীর জন্য বহির্দুনিয়া জায়েজ নয়। নারীরা প্রাইমারী পাশের পর লেখাপড়া করবে না।নারীর দায়িত্ব হলো- ঘরে আবদ্ব থেকে সন্তান উৎপাদন করা – তাদের লালন পালন করা, রান্না করা, স্বামীর পরিচর্যা করা। প্রশ্ন হলো তথ্য প্রযুক্তির যুগে গ্লোবাল ভিলেজের অধিবাসি হয়ে, আমরা নারীকে স্রোতের অনুকুলে প্রবাহিত করবো, না সেই পেছনে ঠেলে গৃহবন্ধী করবো। বিষয়টি গুরুত্বপুর্ণ বলেই বিশ্বের সাথে সমতা রক্ষায় নারীকে ক্ষমতায়িত করতে হবে।আমি আশাবাদী নারীরা একদিন ইমামতি করবে ও জানাজা পড়াবে। সে দিন বেশী দুরে নয়।
নারীরা যদি রান্না ঘরে ১৪৪ ধারা জারি করে,বাসরের ফুল প্রত্যাখ্যান করে,আদমের প্রথম নারী সঙ্গী লিলিথের শক্তি অর্জন করে পুরুষের সঙ্গে পাঞ্জা লড়তে শুরু করে, তা হলে সামাজিক জীবনের চেহারা কেমন হবে। কোন কোন নারী তা করছে না যে, সত্য নয়। এ কারনেই কোন কোন পুরুষ চাচ্ছে -পুরুষ নির্যাতন বিরুধী আইন প্রনয়নের পক্ষে যুক্তি ও সুপারিশ। নারী পুরুষের আদিপত্যবাদী অাচরণ পাল্লা দিয়ে বাড়ছে। আরো বাড়ছে নারী হত্যা,নির্যাতন, অবমূল্যায় ও প্রতিরোধ। যার কোনটাই মানবীয় দৃষ্টিকোন থেকে যৌক্তিক নয়।
মুক্তিযুদ্ধের আদর্শে পরচালিত দেশটি যখন বিশ্বদরবারে উন্নয়নের রোল মডেলে পরিনত হয়েছে। বেড়েছে মাথপিছু আয়,সাধারণ জনগণ স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলছে। পৃথিবী বাসি মহামারী করোনাকে প্রতিরোধ করতে হিমশিম খাচ্ছে। তখন গত ১৩ জুন ২০২১ এ মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের একটি সুপারিশ দেখে বিস্মিত হয়েছি।
মহিলারা যেহেতু জানাজা পরাতে পারে না,তাই মহিলা ইউএনও দ্বারা মৃত মুক্তিযোদ্ধাদের গার্ড অব অনারে নেতৃত্ব দেয়াটা সঙ্গত নয়। যে সব স্থানে মহিলা ইউএনও আছেন বা থাকবেন সে সব স্থানে বিকল্প কোন পুরুষের নেতৃত্বে গার্ড অব অনারের ব্যবস্থা করা, গার্ড অব অনার রাতে না করে দিনে করা ইত্যাদি সুপারিশ উত্থাপন করে মুক্তি যুদ্ধ বিষয়ক মন্তণালয় ( ১৭ জুন, ২০২১, দৈনিক সংবাদ)। এটি একটি জামাতপন্তী প্রতিক্রিয়াশীল মতাদর্শের সাথে কূট ষঢ়যন্ত্র বৈ অন্য বিছু নয়। নারী সমাজকে যোজন যোজন ব্যাপী পেছন মুখী স্রোতে ঠেলে দেওয়া,দেশের জাতীয় উন্নয়ন প্রতিহত করাই এর মূল লক্ষ্য ও জনমনে বিভ্রান্তি তৈরীর অপকৌশল।
মুসলমান মৃত ব্যক্তির ক্ষত্রে এই বিধিটি যদি প্রযোজ্য হয়, তা হলে অন্য ধর্মাম্বলীদের ক্ষেত্রে কি হবে,তাও স্পষ্ট হওয়া দরকার।৭১ এ কি মুসলমানরাই যুদ্ধ করে দেশ স্বাধীন করেছিলো। সে প্রশ্নটিও সামনে চলে আসে। মহিলা পুলিশের প্যারেড অভিবাদনে – নারী ড্রাইভার ছিলেন প্যারেডের গাড়ী চালক, সালাম প্রদানকারী নারী, অভিবাদন গ্রহনকারীও নারী। সে ক্ষেত্রে কি ফতুয়া দিবেন।এ দেশ হিন্দু,বৌদ্ধ,মৃসলিম,কৃষ্টান, নারী, পুরুষ সকলের।নারী পুরুষের বৈষম্যের দেয়াল ভেঙ্গে ১৯৭২ এর জাতীয় চারনীতির আদর্শে চলতে হবে।
সুপারিশের ভিত্তিতে কি সিদ্ধান্ত বেরিয়ে আসবে জানি না। ইউএনও পদটি তো সাংবিধানিক ভাবে স্বীকৃত। এই পদের অধিকারী নারী যদি তার সকল দায়িত্ব পালন করতে পারে,তা হলে অনার দেয়ার কাজটি কেন করতে পারবে না। তা ছাড়া জানাজা ও অনার পর্ব দুইটি আলাদা প্রক্রিয়া। নারী সমাজের মর্যাদা,দেশের ভাবমুর্তি যেন ক্ষুন্ন না হয় সে দিকে খেয়াল রেখে চুডান্ত সিদ্ধান্ত নেয়া উচিৎ হবে। আমার দৃঢ় বিশ্বাস নারী বন্ধব বর্তমান সরকার এই সুপারিশের পক্ষে অভিমত দিবে না। তা ছাড়া নারী সমাজের স্বার্থ বিরুধী সিদ্ধান্ত নেয়া হলে,এ দেশের নারী সমাজ বিরুধীতা করে রাস্তায় নেমে আসবে,যা হবে সরকারের জন্য অস্বস্তিকর পরিবেশ।
প্রিয় পাঠক আপনারাই বলুন-নারীরা কি একাত্তরে মুক্তিযোদ্ধে অংশ গ্রহন করেনি।স্বাধীনতা অর্জনে নেই তাদের গর্বময় অবদান। ইতিহাস সাক্ষী হয়ে বলে – আড়াই লক্ষ মা বোন পাকিস্তানী ও স্থানীয় নর পশুদের দ্ধারা ধর্ষিত হয়েছিলো। বঙ্গবন্ধু তাদের উপাধি দিয়েছিলেন বিরাঙ্গনা নারী। পরবর্তী পর্যায়ে জননেত্রী শেখ হাসিনা মুক্তিযোদ্ধার স্বীকৃতি ও সুযোগ সুবিধা প্রদান করেন। তাছাড়াও নিমর্মভাবে হয়েছিলো নানামুখী অত্যাচারের শিকার। কেউ কেউ মুখে কালিমা লেপে দিয়ে আত্মহত্যা করেছিলো। যুদ্ধ শিশুর জন্ম দিয়েছিলো। নারীর এই অবদানকে এতো সহজেই গেলাম ভুলে।নারীকে, নারীর যোগ্যতাকে করছি অবমূল্যায়ন।এর পেছনের রহস্য কি? বর্তমান সরকারকে বিতর্কিত করার জন্যই কি বড় বড় রুই কাতলাকে ক্ষতায় বসিয়েছে। বি কেয়ারফুল শেখ হাসিনা সিদ্ধান্ত নিতে কার্পন্য করে না।দুধের মাছিদের ক্ষমা করবেন না।সময় থাকতে নড়ে চড়ে বসেন ও সোজা পাথে পা রাখেন।
নারী জাগরণের অগ্রদূত বেগম রোকেয়ার দুরদর্শি চিন্তা ভাবনার সুফল ভোগ করছে আজকের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের নারীরা। সমাজের রন্ধ্রে রন্ধ্রে নারীরা ক্ষমতায়িত হয়েছে বহুদুর।এ কারণেই আমরা পেয়েছি নারী প্রধানমন্ত্রী,নারী স্পিকার,নারী সচিব,নারী বিচারক, নারী মন্ত্রী ইত্যাদি। আরো বহু গুরুত্বপুর্ণ পদমর্যাদায় নারীরা কাজ করে বুদ্ধি মত্তার প্রতিফলন ঘটাচ্ছে। তৃণমুল পর্যায় থেকে শুরু করে কোথায় নেই নারীর কোমল হাতের ছোঁয়া? হিমালায় বিজয়,নভেল বিজয়,মহাশুণ্য জয় ইত্যাদি সকল অসাধ্য সাধনে রয়েছে নারীর গর্বময় পথ চলা। অতএব তুক ফুক নিয়ম নীতি প্রনয়ণ করে নারীর ক্ষমতায়নকে বাধা গ্রস্থ করা যাবে না।
পরিশেষে বলবো – আসুন নারী পুরুষে মিলে বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্থা গড়ে তুলি। একা হয়নি তো জয়ী পুরুষের তরবারি,সাহস যুগিয়েছে,প্রেরণা দিয়েছে বিজয় লক্ষী নারী। আরো বলবো কবির ভাষায় – বিশ্বের যা কিছু মহাণ চির কল্যাণকর,অর্ধেক তার করিয়াছে নারী অর্ধক নর। গুণীজনদের এ সব যুক্তি ও কথা আসুন মেনে নেই। সুখ শান্তি তখন আপনার আমার পায়ে পায়ে হাঁটবে।
লেখকঃ উপদেষ্টা সদস্য, বাংলাদেশ কৃষকলীগ। সিনেট সদস্য- জাবি।