জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার (এফএও) হিসাবমতে চালের বৈশ্বিক দাম পৌঁছেছে ১৫ বছরের মধ্যে সর্বোচ্চে। সরকারি সংস্থা বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) তথ্য মোতাবেক দেশের প্রায় প্রতি পাঁচজন মানুষের মধ্যে একজন খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। অর্থাৎ মোট জনসংখ্যার প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ মাঝারি ধরনের খাদ্য নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছেন। সরকারপ্রধান মার্চে দেশে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কা দেখছেন। এমন অবস্থা মোকাবিলায় আমাদের প্রধানত জোর দিতে হবে আসন্ন মৌসুমে বোরো ফসলের সর্বোচ্চ পরিমাণ উৎপাদন নিশ্চিতকরণে। এজন্য কী করণীয় তা আলোচনা করাই এ নিবন্ধের উদ্দেশ্য।
খাদ্যের একাধিক উপাদান থাকলেও দেশে খাদ্য বলতে মূলত কার্বোহাইড্রেট বা শর্করা উপাদানসমৃদ্ধ চাল তথা চাল থেকে তৈরি ভাতকে বোঝায়। দেশের কম-বেশি ৯০ শতাংশ মানুষের প্রধান খাদ্য ভাত। দেহের মোট ক্যালোরি চাহিদার ৬০ থেকে ৭০ শতাংশ আসে শর্করা থেকে এবং ভাতের অবদান এখানে সবচেয়ে বেশি। দেশে উৎপাদিত চালের কম-বেশি ৫৫ শতাংশ আসে বোরো থেকে। আর দেশে চালের কম-বেশি ৪০ শতাংশ উৎপাদন করে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে আমন। বাকিটুকু আসে আউশ থেকে।
বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউটের (ব্রি) মতে, আউশ ও আমনের তুলনায় বোরো মৌসুমে নির্বিঘ্নে ধান চাষ করা যায় এবং যথাযথ পদ্ধতিতে বোরো ধান চাষ করা হলে আকস্মিক বন্যা, শৈত্যপ্রবাহ, শিলাবৃষ্টি, লবণাক্ততা, জলোচ্ছ্বাসের মতো ঝুঁকি এড়িয়ে কাক্সিক্ষত ফলন অর্জন সম্ভব হয়। বোরোর ফলন আমন ও আউশের চেয়ে ভালো। বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সমীক্ষা-২০২৩-এর তথ্য মোতাবেক ২০১৯-২০, ২০২০-২১ ও ২০২১-২২ অর্থবছরে যখন বোরো চালের উৎপাদন দাঁড়ায় যথাক্রমে ২ কোটি ১ লাখ ৮১ হাজার টন, ১ কোটি ৯৮ লাখ ৮৫ হাজার টন এবং ২ কোটি ৯ লাখ ৭৭ হাজার টনে, তখন আমনের উৎপাদন ছিল যথাক্রমে ১ কোটি ৫০ লাখ টন, ১ কোটি ৪৪ লাখ ৩৮ হাজার টন এবং ১ কোটি ৪৯ লাখ ৫৮ হাজার টন। বোরোর ভালো ফলন যেমন চাষিদের মুখে হাসি ফুটিয়ে তোলে, তেমনি দেশের খাদ্য নিরাপত্তাকে জোরদার করে।
চলতি মৌসুমে আমন উৎপাদনের পরিমাণ নিয়ে এখন পর্যন্ত দু’ধরনের তথ্য পাওয়া যাচ্ছে। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর (ডিএই) আশা করছে, চলতি আমন মৌসুমে প্রায় ১ কোটি ৭৫ লাখ টন চাল উৎপাদন হবে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে প্রায় ৩ লাখ টন বেশি। এদিকে মার্কিন কৃষি বিভাগের (ইউএসডিএ) সাম্প্রতিক এক প্রতিবেদনের বরাত দিয়ে ২৯ ডিসেম্বর দ্য ডেইলি স্টারের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, এবার মৌসুমের শুরুতে প্রয়োজনীয় বৃষ্টির অভাবে একদিকে যেমন আমন রোপা কার্যক্রম দেরিতে শুরু হয়, তেমনি অন্যদিকে আমন চাষের জমির পরিমাণ ২ দশমিক ৫৪ শতাংশ হ্রাস পেয়ে ৫৭ দশমিক ৫০ লাখ হেক্টরে দাঁড়ায়। তাছাড়া নভেম্বরের তৃতীয় সপ্তাহে ঘূর্ণিঝড় মিধিলির কারণে দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় জেলাগুলোর দণ্ডায়মান ধান ফসলের ৫ থেকে ১০ শতাংশ ক্ষতিগ্রস্ত হয়। এসব কারণে ইউএসডিএ বাংলাদেশে এ বছর আমনের উৎপাদন আগের প্রাক্কলন থেকে ১ লাখ টন কমিয়ে ১ কোটি ৩৯ লাখ টনে নির্ধারণ করেছে। চলতি মৌসুমে আমনের প্রকৃত উৎপাদনের তথ্য জানতে আমাদের বিবিএসের চূড়ান্ত হিসাবের জন্য অপেক্ষা করতে হবে।
চলতি অর্থবছরে দেশে কোনো চাল আমদানি না হওয়ায় এখন শুধু আমন চালের ওপর নির্ভর করতে হচ্ছে। সাধারণভাবে আমন ধান কাটামাড়াই শুরুর সময় থেকে বোরো ধান কাটামাড়াই শুরুর আগ পর্যন্ত অর্থাৎ ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে আমন চালের ব্যবহার হয়। বিবিএসের খানা আয় ও ব্যয় জরিপ ২০১৬ অনুযায়ী, জাতীয় পর্যায়ে মাথাপিছু দৈনিক চাল ভোগের পরিমাণ দাঁড়ায় ৩৭৭.২ গ্রামে, যা ২০১০ সালে ছিল ৪১৬ গ্রাম। সে হিসাবে চলতি অর্থবছরের ডিসেম্বর-এপ্রিল সময়ে দেশের ১৭ কোটি মানুষের জন্য প্রয়োজন কম-বেশি ১ কোটি ৫০ লাখ টন চাল। ধরা যাক বিবিএসের হিসাবে এবার আমন চাল উৎপাদনের পরিমাণ দাঁড়াল ১ কোটি ৫০ লাখ টনে। আমনের এ উৎপাদনকে প্রয়োজনের তুলনায় যথেষ্ট মনে করা সংগত হবে না। বাফার স্টক প্রয়োজন। আমদানির অবর্তমানে চালের বাফার স্টক তৈরি হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে আর যে বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার তা হলো, আমাদের দ্বিতীয় খাদ্যশস্য আমদানিনির্ভর গমের দাম বেশিরভাগ মানুষের প্রধান খাবার মোটা চালের দামের চেয়ে বেশি হওয়ায় চালের ওপর চাপ বেড়েছে। এসব কারণেও আসন্ন মৌসুমে বোরোতে সর্বোচ্চ উৎপাদনের প্রয়োজনীয়তা দেখা দিয়েছে। আর চালের বাজারে ঊর্ধ্বমুখিতা রোধে কিছু পরিমাণ চাল আমদানি করা আবশ্যক হয়ে পড়েছে।
বোরোর উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বাড়াতে স্বল্পমেয়াদি ও দীর্ঘমেয়াদি কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে। স্বল্পমেয়াদি কার্যক্রমগুলোর মধ্যে রয়েছে-এক. আসন্ন মৌসুমে বোরো চাষে জমির পরিমাণ বৃদ্ধি করতে হবে। গত মৌসুমে ৪৮ লাখ ৫২ হাজার হেক্টর জমিতে বোরো আবাদ হয় বলে জানা যায়। এবার অতিরিক্ত এক থেকে দুই লাখ হেক্টর জমি বোরো চাষের আওতায় নিয়ে আসার বিষয়টি ভেবে দেখা যেতে পারে। উৎপাদনে প্রবৃদ্ধি হার বৃদ্ধির জন্য হাইব্রিড জাতের ধান চাষ বাড়াতে হবে। দুই. এল নিনো ফিরে এসেছে মর্মে আন্তর্জাতিক গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। বিশ্বের প্রতিটি প্রান্তেই প্রভাব ফেলবে এল নিনো। বিজ্ঞানীদের আশঙ্কা, চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার জন্য ২০২৪ সাল হতে পারে পৃথিবীর সবচেয়ে উষ্ণ বছর। বিশ্বের কয়েকটি অঞ্চলের মতো দক্ষিণ এশিয়ায় বৃষ্টিপাত অনেক কমে যাবে বলে বিজ্ঞানীরা ধারণা করছেন। দক্ষিণ এশিয়ার দেশ হিসাবে ২০২৪ সালে বাংলাদেশেও অনেক কম বৃষ্টিপাত হতে পারে। যদিও বোরো সেচনির্ভর ফসল, তথাপি বৃষ্টিপাত কমে গেলে সেচের ওপর নির্ভরশীলতা আরও বেড়ে যাবে। এজন্য বোরো চাষে পানি সেচের জন্য ব্যবহৃত বিদ্যুৎচালিত সেচযন্ত্রগুলোয় নিরবচ্ছিন্ন সরবরাহের ব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। দেশে বিদ্যুৎ সরবরাহে ঘাটতি দেখা দিলে আবাসিক বিদ্যুৎ সরবরাহ কমিয়ে দিয়ে বোরো চাষের চাহিদা মেটাতে হবে। তিন. ধান উৎপাদনে রাসায়নিক সার গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। প্রাপ্ত তথ্য অনুযায়ী, দেশে রাসায়নিক সারের চাহিদার প্রায় ৮০ শতাংশ আমদানি করতে হয়। আমদানিকৃত রাসায়নিক সারের অন্যতম হিসাবে বিবেচিত হয় চারটি-ইউরিয়া, ট্রিপল সুপার ফসফেট (টিএসপি), ডাই-অ্যামোনিয়াম ফসফেট (ডিএপি) ও মিউরেট অব পটাশ (এমওপি)। দেশে সারের কোনো অভাব নেই বলে সরকার থেকে বলা হলেও নিকট অতীতে আমরা কিছুটা সার সংকট দেখেছি। আসন্ন বোরো মৌসুমে রাসায়নিক সারের যেন কোনো ঘাটতি না দেখা দেয়, সেজন্য প্রয়োজনীয় মজুত গড়ে তোলা নিশ্চিত করতে হবে। শুধু সারের মজুত গড়ে তুললে হবে না, নির্ধারিত দামে কৃষক পর্যায়ে রাসায়নিক সারের প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে হবে। রাজনৈতিক পরিচয়ে নিয়োগপ্রাপ্ত অনেক ডিলারের সার কারসাজির খবর পত্রপত্রিকায় অহরহ প্রকাশিত হয়। এ রকম ঘটনার যেন পুনরাবৃত্তি না হয় তা নিশ্চিত করতে হবে। চার. চালসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদন ও উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য চলতি বাজেটে যেসব ভর্তুকি, প্রণোদনা দেওয়ার কথা বলা হয়েছে, সেগুলোর যথাযথ বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে হবে।
দীর্ঘমেয়াদি ব্যবস্থাগুলোর মধ্যে রয়েছে-ক. কৃষি জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় চলতি অর্থবছরের বাজেট বক্তৃতায় অর্থমন্ত্রী যেসব কর্মসূচির বাস্তবায়ন শুরুর কথা বলেছেন, সেগুলোর সফল বাস্তবায়ন সম্পন্ন করতে হবে। এগুলোর মধ্যে একটি হলো লবণাক্ততাসহ বিভিন্ন প্রতিকূলতা-সহিষ্ণু ধানের চাষ। এ কর্মসূচির সফল বাস্তবায়ন দেশে ধানের, বিশেষ করে বোরো ধানের উৎপাদন বাড়াবে। খ. অষ্টম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় (জুলাই ২০২০-জুন ২০২৫) নিু উৎপাদনশীলতা কৃষি খাতের শস্য উপখাতের একটি চ্যালেঞ্জ হিসাবে চিহ্নিত হয়েছে। জমি স্বল্পতার কারণে আমাদের চাল, গম ও অন্যান্য খাদ্যপণ্যের উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। গ. চালসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদন বৃদ্ধিতে কৃষিজমি অকৃষি খাতে চলে যাওয়া যথাসম্ভব বন্ধ করতে হবে। ঘ. চালসহ কৃষিপণ্যের উৎপাদন বাড়াতে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে কৃষি খাতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে। ঙ. জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ শতাংশের নিচে নিয়ে আসতে সর্বাত্মক প্রচেষ্টা নিতে হবে।
এ প্রসঙ্গে আর যে বিষয়টি উল্লেখ করা দরকার তা হলো, উৎপাদন বৃদ্ধি বা আমদানির মাধ্যমে খাদ্যশস্যের (চাল, গম) লভ্যতা নিশ্চিতকরণ সম্ভাব্য ‘মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা’ তথা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলার জন্য যথেষ্ট নয়। দরকার খাদ্য কেনার সামর্থ্য। আইএলও’র এক রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২২ সালে বাংলাদেশে প্রকৃত মজুরি প্রবৃদ্ধির হার ছিল ঋণাত্মক। তাই সম্ভাব্য মারাত্মক খাদ্য নিরাপত্তাহীনতা তথা দুর্ভিক্ষ মোকাবিলায় অভ্যন্তরীণ উৎপাদন বৃদ্ধি ও আমদানির মাধ্যমে খাদ্যের লভ্যতা নিশ্চিতকরণের সঙ্গে সঙ্গে চলমান মূল্যস্ফীতির ঊর্ধ্বগতি (ডিসেম্বরে ৯.৪১ শতাংশ) উল্লেখযোগ্য পরিমাণে হ্রাসসহ সাধারণ মানুষের ক্রয়ক্ষমতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা নিতে হবে।
আবদুল লতিফ মন্ডল : সাবেক খাদ্য সচিব, কলাম লেখক
latifm43@gmail.com