ঢাকা , রবিবার, ২৯ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৫ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কবরের পাশে দিন-রাত বসে থাকি, ছেলে তো আর ফিরে না

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত ৫ আগস্ট ঢাকার বাড্ডায় গুলিতে নিহত হন সোহাগ মিয়া (২৩)। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সোহাগ ছিলেন দ্বিতীয়। তবে, পরিবারের আশা-ভরসা ছিল তাকে নিয়েই।

সোহাগ মিয়া সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার গোলামীপুর গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। ৫ আগস্টের আগে সোহাগের পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় থাকলেও বর্তমানে সবাই গ্রামে থাকেন।

সোহাগের মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘‘সোহাগকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এক দালালকে দিয়েছিলাম। কিন্তু, সেই লোক সোহাগকে বিদেশ নিতে পারেনি আর টাকাও ফেরত দেয়নি। পরে ঋণের চাপে বাধ্য হয়ে সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকা চলে যাই।’’

‘‘ঢাকায় সোহাগ একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। সেখানে আমাদের দিন ভালোই চলছিল। কিন্তু, এরই মধ্যে দেশে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়। সোহাগ প্রতিদিনই আন্দোলনে যোগ দিত। ৫ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিতে আমার দুই ছেলে বাসা থেকে বের হয়। বিকেলের দিকে সেজ ছেলে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাসায় ফিরলেও সোহাগ আর ফিরে না। পরে আমার বড় ছেলে সোহাগের নম্বরে কল দেয়। তখন এক ছাত্র কল ধরে বলে, সোহাগের গুলি লেগেছে; অবস্থা খারাপ আপনারা হাসপাতালে আসেন। বড় ছেলে হাসপাতালে গিয়ে দেখা, সোহাগ মারা গেছে।’’- যোগ করেন তিনি।

রোকেয়া বেগম বলেন, ‘‘সোহাগকে নিয়েই আমাদের সব আশা-ভরসা ছিল। ভেবেছিলাম, ছেলেটা বিদেশে যেতে পারলে ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করব। পরে আর একটা ছেলেকে বিদেশে পাঠাব। কিন্তু, সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলেটাও নাই, তার ওপর ঋণের বোঝা তো আছেই।’’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলেটারে পাঁচটা গুলি মারছে। একটা মানুষরে মারতে কয়টা গুলি করা লাগে? ছেলেটা গুলি খেয়ে উঠে আর দৌড় দিতে পারে নায়, জায়গাই পড়ে গেছে। ছেলের কথা মনে হলে দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে যায়।’’

‘‘ছেলের কবরের পাশে দিন-রাতে বসে থাকি, ছেলেকে ডাকি। কিন্তু, ছেলে তো আর ফিরে না। দুঃখের কথা আর কার কাছে বলব। ছেলের কথা মনে হলে কন্না করি। সারা দিন কবরের পাশে যাই, বাড়িতে আসি।’’- বলেন রোকেয়া বেগম।

ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলে যে কারণে জীবন দিয়েছে, সেই বাংলাদেশ যেন আর ফিরে না আসে। দেশের মানুষ যেন স্বাধীনভাবে চলতে পারে।’’

সোহাগ মিয়ার বড় ভাই বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই আমরা ভাইয়েরা সম্পৃক্ত ছিলাম। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দুই ভাই শুভ ও সোহাগ সংসদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেয়। বাড্ডা এলাকায় পৌঁছানের পর পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। তখন সেজ ভাই শুভর পায়ে দুটি গুলি লাগে। সে আহতাবস্থায় বাসায় আসলে জানতে চাই, সোহাগ কোথায়? উত্তর দেয়, জানে না। তখন সোহাগকে কল দেই। এক জন কল ধরে বলে, সোহাগের অবস্থা ভালো না দ্রুত ইবনে সিনা হাসপাতালে আসেন। গিয়ে দেখি, সোহাগ আর বেঁচে নেই।’’

তিনি বলেন, ‘‘সোহাগ হত্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করে বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেছি। মামলা দায়েরের পর বিভিন্ন হুমকি-ধমকি পেয়েছি। তবে, এখন আর হুমকি আসে না।’’

বিল্লাল মিয়া আরো বলেন, ‘‘আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ সেজ ভাইয়ের হাঁটাচলায় অনেক সমস্যা হচ্ছে। অন্য কোনো কাজ করতে না পারায় বর্তমানে অটোরিকশা চালাচ্ছে।’’

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুশফিকীন নূর বলেন, ‘‘শহীদ সোহাগ মিয়ার পরিবারকে আমাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকার অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসক বলেছেন, নিহতের পরিবার যদি জায়গা দেখায় তাহলে একটি আবাসিক ভবন করে দেওয়া হবে।’’

সুনামগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সুনামগঞ্জ জেলার তিন জন অন্য জেলায় শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৮৫ জন।’’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

কবরের পাশে দিন-রাত বসে থাকি, ছেলে তো আর ফিরে না

আপডেট টাইম : ০৫:২৪ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ২৮ ডিসেম্বর ২০২৪

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে যোগ দিয়ে গত ৫ আগস্ট ঢাকার বাড্ডায় গুলিতে নিহত হন সোহাগ মিয়া (২৩)। পাঁচ ভাই-বোনের মধ্যে সোহাগ ছিলেন দ্বিতীয়। তবে, পরিবারের আশা-ভরসা ছিল তাকে নিয়েই।

সোহাগ মিয়া সুনামগঞ্জ জেলার জামালগঞ্জ উপজেলার গোলামীপুর গ্রামের আবুল কালামের ছেলে। ৫ আগস্টের আগে সোহাগের পরিবারের সদস্যরা ঢাকায় থাকলেও বর্তমানে সবাই গ্রামে থাকেন।

সোহাগের মা রোকেয়া বেগম বলেন, ‘‘সোহাগকে বিদেশে পাঠানোর জন্য ৫ লাখ ৮০ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে এক দালালকে দিয়েছিলাম। কিন্তু, সেই লোক সোহাগকে বিদেশ নিতে পারেনি আর টাকাও ফেরত দেয়নি। পরে ঋণের চাপে বাধ্য হয়ে সুনামগঞ্জ থেকে ঢাকা চলে যাই।’’

‘‘ঢাকায় সোহাগ একটি গার্মেন্টসে চাকরি নেয়। সেখানে আমাদের দিন ভালোই চলছিল। কিন্তু, এরই মধ্যে দেশে ছাত্রদের আন্দোলন শুরু হয়। সোহাগ প্রতিদিনই আন্দোলনে যোগ দিত। ৫ আগস্ট আন্দোলনে যোগ দিতে আমার দুই ছেলে বাসা থেকে বের হয়। বিকেলের দিকে সেজ ছেলে পায়ে গুলিবিদ্ধ হয়ে বাসায় ফিরলেও সোহাগ আর ফিরে না। পরে আমার বড় ছেলে সোহাগের নম্বরে কল দেয়। তখন এক ছাত্র কল ধরে বলে, সোহাগের গুলি লেগেছে; অবস্থা খারাপ আপনারা হাসপাতালে আসেন। বড় ছেলে হাসপাতালে গিয়ে দেখা, সোহাগ মারা গেছে।’’- যোগ করেন তিনি।

রোকেয়া বেগম বলেন, ‘‘সোহাগকে নিয়েই আমাদের সব আশা-ভরসা ছিল। ভেবেছিলাম, ছেলেটা বিদেশে যেতে পারলে ধীরে ধীরে ঋণ পরিশোধ করব। পরে আর একটা ছেলেকে বিদেশে পাঠাব। কিন্তু, সব শেষ হয়ে গেছে। ছেলেটাও নাই, তার ওপর ঋণের বোঝা তো আছেই।’’

কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলেটারে পাঁচটা গুলি মারছে। একটা মানুষরে মারতে কয়টা গুলি করা লাগে? ছেলেটা গুলি খেয়ে উঠে আর দৌড় দিতে পারে নায়, জায়গাই পড়ে গেছে। ছেলের কথা মনে হলে দুনিয়াটা অন্ধকার হয়ে যায়।’’

‘‘ছেলের কবরের পাশে দিন-রাতে বসে থাকি, ছেলেকে ডাকি। কিন্তু, ছেলে তো আর ফিরে না। দুঃখের কথা আর কার কাছে বলব। ছেলের কথা মনে হলে কন্না করি। সারা দিন কবরের পাশে যাই, বাড়িতে আসি।’’- বলেন রোকেয়া বেগম।

ছেলে হত্যার বিচার চেয়ে তিনি বলেন, ‘‘আমার ছেলে যে কারণে জীবন দিয়েছে, সেই বাংলাদেশ যেন আর ফিরে না আসে। দেশের মানুষ যেন স্বাধীনভাবে চলতে পারে।’’

সোহাগ মিয়ার বড় ভাই বিল্লাল মিয়া বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনের শুরু থেকেই আমরা ভাইয়েরা সম্পৃক্ত ছিলাম। ৫ আগস্ট সরকার পতনের পর দুই ভাই শুভ ও সোহাগ সংসদ ভবনের দিকে যাওয়ার জন্য রওয়ানা দেয়। বাড্ডা এলাকায় পৌঁছানের পর পুলিশ এলোপাথাড়ি গুলি চালায়। তখন সেজ ভাই শুভর পায়ে দুটি গুলি লাগে। সে আহতাবস্থায় বাসায় আসলে জানতে চাই, সোহাগ কোথায়? উত্তর দেয়, জানে না। তখন সোহাগকে কল দেই। এক জন কল ধরে বলে, সোহাগের অবস্থা ভালো না দ্রুত ইবনে সিনা হাসপাতালে আসেন। গিয়ে দেখি, সোহাগ আর বেঁচে নেই।’’

তিনি বলেন, ‘‘সোহাগ হত্যায় সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নাম উল্লেখ করে বাড্ডা থানায় একটি মামলা করেছি। মামলা দায়েরের পর বিভিন্ন হুমকি-ধমকি পেয়েছি। তবে, এখন আর হুমকি আসে না।’’

বিল্লাল মিয়া আরো বলেন, ‘‘আন্দোলনে যোগ দিয়ে গুলিবিদ্ধ সেজ ভাইয়ের হাঁটাচলায় অনেক সমস্যা হচ্ছে। অন্য কোনো কাজ করতে না পারায় বর্তমানে অটোরিকশা চালাচ্ছে।’’

জামালগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী অফিসার (ইউএনও) মুশফিকীন নূর বলেন, ‘‘শহীদ সোহাগ মিয়ার পরিবারকে আমাদের উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে এক লাখ টাকার অনুদান দেওয়া হয়েছে। এছাড়া জেলা প্রশাসক বলেছেন, নিহতের পরিবার যদি জায়গা দেখায় তাহলে একটি আবাসিক ভবন করে দেওয়া হবে।’’

সুনামগঞ্জ জেলা সিভিল সার্জন ডা. জসীম উদ্দিন বলেন, ‘‘বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে যোগ দিয়ে সুনামগঞ্জ জেলার তিন জন অন্য জেলায় শহীদ হয়েছেন। আহত হয়েছেন ১৮৫ জন।’’