ঢাকা , বুধবার, ২৩ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

শেখ কামাল পড়ে যাবার পর আবার গুলি করে ক্যাপ্টেন হুদা

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। ভয়াবহ সেই দিনটির কথা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের জবানবন্দিতে। জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায় সেদিনের ভয়াবহতার চিত্র। জানা যায় ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন ৩২ নম্বরের বাড়িটির ভেতরে-বাইরে। সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে চ্যানেল আই অনলাইনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব।

প্রসিকিউশনের ৫নং সাক্ষী সুবেদার গনি আদালতকে জানান, কুমিল্লা ১ ফিল্ড আর্টিলারিতে মেজর ডালিম ও ক্যাপ্টেন হুদা তাদের অফিসার ছিল। কিছুদিন পরে মেজর ডালিমের চাকরি চলে যায়। ক্যাপ্টেন হুদা ঢাকায় বদলি হয়ে আসে। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ক্যাপ্টেন বাশারের নেতৃত্বে ঢাকায় গণভবনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা ডিউটির জন্য তাদের রেজিমেন্টের ১০৫/১০৬ জনের এক কোম্পানি ফোর্সকে ঢাকায় বদলি করা হয়। আগস্টের ১/২ তারিখ থেকে তারা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ডিউটি করতে থাকে। ডিউটি শেষে ধানমন্ডির ৩১ নং রোডের একটি বাড়িতে থাকতো তারা। একদলে হাবিলদার কুদ্দুস এবং আরেক দলে তিনি গার্ড কমান্ডার ছিলেন।

১৪ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে ডিউটি করতে করতে বিকেল প্রায় ৪টার দিকে তাদের আগের কমান্ডিং অফিসার ডালিমকে মোটর সাইকেলে করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে ঘোরা-ফেরা করতে দেখেন। বিকেল প্রায় সাড়ে ৫টার দিকে তাদের আগের এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন হুদাকে মোটর সাইকেলে করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে দিয়ে যেতে দেখেন। ১৫ আগস্ট ভোর সোয়া ৪টার দিকে তাদের রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদার এসে তাদের গার্ড চেক করে এবং বলে, ‘তোমাদের পুরাতন গুলি দিয়ে দাও, আমি নতুন গুলি দিচ্ছি’। এই বলে পুরাতন গুলি নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যায়। কিন্তু পরিবর্তে নতুন গুলি দেয়নি।

সুবেদার গনি বলেন, আনুমানিক পৌনে ৫টার দিকে হাবিলদার কুদ্দুস তার গার্ড দল নিয়ে ডিউটির জন্য এলে সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদার গুলি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাকে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য বলেন। পতাকা উত্তোলনের শেষ পর্যায়ে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড গুলি আসতে থাকে। ৫/৭ মিনিট পর গুলি বন্ধ হলে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে দেখেন ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর হাতে স্টেনগান এবং ৭/৮ জন খাকী ও কালো পোশাকধারী ফোর্স হাতে রাইফেলসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে গাড়ি থেকে নামছে। তাকে দেখে ক্যাপ্টেন হুদা বলেন ‘কি গনি, কি খবর?’ তারপর তিনি ওয়ারলেসে কথা বলতে থাকেন।

কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ল্যান্সারের মেজর মুহিউদ্দিন কিছু ফোর্সসহ পূর্ব দিক থেকে দ্রুত হেঁটে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে ‘হ্যান্ডস-আপ, হ্যান্ডস-আপ’ বলে গুলি করতে করতে বাসভবনের ভিতরে ঢোকে। তখন সেন্ট্রিসহ তিনি দক্ষিণ দিকে গার্ড রুমে চলে যান। ল্যান্সারের কিছু ফোর্স সকাল ৭টা পর্যন্ত তাদের ৭ জনকে গার্ড রুমে ঘেরাও করে রাখে। সোহরাব নামে একজন গার্ড ভিতরে ছিল। গার্ড রুম থেকে কিছুক্ষণ পর পর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গুলির শব্দ ও মহিলাদের আর্ত-চিৎকার শোনা যায়।

সুবেদার গনি আদালতকে জানান, সকাল ৭টার পর ল্যান্সারের ফোর্স চলে গেলে তিনি গার্ড রুম থেকে বের হয়ে পেট্রোল ডিউটির সিপাহী সামসুর গুলিবিদ্ধ লাশ ও অপর একজনকে আহত দেখেন। বাসভবনের ভিতরে গিয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধুসহ সকলকে

গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারপর তার গার্ড দল নিয়ে ৩১ নং রোডের বাড়িতে চলে যান। হাবিলদার কুদ্দুস তার গার্ড দল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ডিউটি করিতে থাকেন।

প্রসিকিউশনের ৬নং সাক্ষী হাবিলদার সোহরাব আলী আদালতকে জানান, ১৯৭৫ সনের জুলাই মাসের শেষের দিকে কুমিল্লা ১ ফিল্ড আর্টিলারি থেকে অন্যদের সঙ্গে তাকেও ঢাকায় গণভবন ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা ডিউটির জন্য বদলি করা হয়। ক্যাপ্টেন বাশার তাদের নেতৃত্ব দেন। তাদের ২৫ জনের একদল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পালাক্রমে ডিউটি করে।

১৪ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে হাবিলদার গনির নেতৃত্বে তাদের ডিউটি শুরু হয়। ১৫ আগস্ট সকাল ৬টা পর্যন্ত তাদের ডিউটিতে থাকার কথা ছিল। ২ ঘণ্টা পরপর তাদের ডিউটি বদলির নিয়ম ছিল। সে কারণে ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ২-৪টার দিকে তার ডিউটি শেষ হলে তিনি গার্ড রুমে চলে যান। তখন পুলিশের ডিউটিও ছিল। আনুমানিক সাড়ে ৪ টার সময় তাদের কাছ থেকে গুলি জমা নেয়া হয়। তারপর তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

কিছুক্ষণ পর পরবর্তী গার্ড দল আসে। তিনি দেখেন, কালো পোশাক পরা আর্মির কিছু ফোর্স ২/৩ টা ট্রাকে করে পূর্বদিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ২/১টা বাড়ির পশ্চিমে গিয়ে থামে। তখন লেকের দক্ষিণ দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গুলি আসতে থাকে। তখন ভয়ে বঙ্গবন্ধু বাসভবনের পূর্বদিকে দেওয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ৫/৬ মিনিট পর গুলি বন্ধ হয়। তখন বঙ্গবন্ধুকে রিসিপশন রুম থেকে বের হয়ে দোতলার দিকে যেতে দেখেন। একটু পরে রিসেপশন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে শেখ কামাল বলেন ‘আর্মি-পুলিশ ভাই আপনারা আমার কাছে আসেন।’

এই সময় খাকী পোশাকধারী ক্যাপ্টেন হুদাসহ খাকী ও কালো পোশাকে আরো অফিসার এবং কিছু সৈনিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ভেতরে ঢুকে ক্যাপ্টেন হুদা ও অন্য অফিসার শেখ কামালকে গুলি করে। শেখ কামাল চিৎকার দিয়ে রিসিপশন রুমের দরজার কাছে পড়ে যান। ক্যাপ্টেন হুদা আবার তাকে গুলি করে। তারপর ক্যাপ্টেন হুদাই বাড়ির কাজের লোকদেরকে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দোতলায় যায়। কিছুক্ষণ পরপর দোতলায় গুলি ও আর্ত-চিৎকারের শব্দ শোনেন।

২০/২৫ মিনিট পর হত্যাকারীরা দোতলা থেকে নিচে নেমে গেটের দিকে যায়। তিনি দোতলার সিঁড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেন। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে দোতলায় না গিয়ে গেটের কাছে চলে আসেন। তখন ক্যাপ্টেন হুদা কোন সিভিলিয়ান যাতে বাড়িতে ঢুকতে না পারে সেজন্য তাদের গার্ডদের পাহারা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন হুদার সঙ্গে মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদারকে ঘুরতে দেখেন। একসময় গেটের সামনে ল্যান্সারের একজন অফিসার ক্যাপ্টেন হুদার ব্যাজ বদল করে তাকে মেজরের ব্যাজ এবং হুদার ব্যাজ খুলে জোয়ারদারকে পরিয়ে দেয়। তারপর সামনে ট্যাংকের শব্দ শুনে বাড়ির উত্তর পাশে ডিউটি পোস্টে ডিউটি করতে থাকেন।

সোহরাব আলী আদালতকে জানান, ১৬ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর লাশ বাদে বাকি লাশগুলি একটি আর্মি ট্রাকে করে নিয়ে যেতে দেখেন। ১৬ আগস্ট আনুমানিক ৯.৩০ টার দিকে একটি আর্মির পিকআপে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যায়। ১৬ আগস্ট বিকালে গণভবনে এবং ১৭ আগস্ট দিবাগত রাতে রাতে কুমিল্লায় চলে যান।

প্রসিকিউশনের ৩৩ নং সাক্ষী হাবিলদার সেলিম উদ্দিন জানান, ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে ২৭/২৮ তারিখে কুমিল্লা ১ম ফিল্ড আর্টিলারির ক্যাপ্টেন বাশারের নেতৃত্বে ১০৫ জন ফোর্স গণভবন ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা ডিউটিতে আসে। ১৪ আগস্ট বিকেল ৫:৩০ টায় ধানমন্ডির ৩২নং রোডের বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নং বাড়ির চার পাশে পেট্রোল ডিউটি করার জন্য ৬ জন সিপাহীসহ তাকে পাঠায়। তাদের কাছে এসএলআর ছিল। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরের দিন সকাল ৬টা পর্যন্ত তাদের ডিউটি ছিল।

তখন গনির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা ডিউটি চলছিল। তিনি পালাক্রমে রাত ১১টা পর্যন্ত ডিউটি করে পরবর্তী সিপাহীদের পালাক্রমে ডিউটি করার নির্দেশ দিয়ে দক্ষিণ দিকের বেডে ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর হাবিলদার গনি কোথায় ছিল বলতে পারেন না। ১৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক পৌনে ৫টার সময় হালকা হাতিয়ারের ও গুলির আওয়াজ শুনে দ্রুত ৪জন সিপাহীসহ বাইরে আসেন। তখন পেট্রোলরত ২ জন সিপাহী দৌড়ে এসে তাকে বলে ‘ট্যাংকের আওয়াজ হচ্ছে ফায়ারিং-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে।’ ঠিক সেই মুহূর্তে আর্টিলারির কামানের গোলা এসে তাদের আস্তানায় ১৫/২০ গজ পূর্বদিকে ব্লাস্ট হয়।

গোলার টুকরা তাদের ৪ জনকে আহত করে, সিপাহী সামসু ঘটনাস্থলেই নিহত হন। সিপাহী মোফাজ্জল গুরুতর এবং অন্য ২ জন সামান্য আহত হন। তখন ফায়ারিং চলছিল। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ৭.৩০/৮ টার সময় জ্ঞান ফিরলে নিজেকে গণভবনের ব্যারাকে শোয়া অবস্থায় দেখেন। তখন জানতে পারেন যে, সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।

প্রসিকিউশনের ৩৬ নং সাক্ষী নেওয়াজ আহমেদ ওরফে গর্জন বলেন- ধানমন্ডির ৩২নং রোডে বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭নং বাড়ির লাগোয়া পূর্বদিকে তাদের বাড়ি। তিনি একজন ব্যবসায়ী। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে নিজেদের বাড়িতে ছিলেন। ঐ রাতে বাসায় তার বড় ভাই-বোন ও ফুফাত ভাই আমিনুল হক বাদশাসহ আরো কয়েকজন আত্মীয় ছিলেন। তার বাবা ঐ সময় সরকারি কাজে দেশের বাইরে ছিলেন। ১৫ আগস্ট ভোর বেলা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বিউগলের আওয়াজে তার ঘুম ভাঙে। ঠিক এই সময় একটি জীপ মিরপুর থেকে খুব দ্রুত পশ্চিম দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে এসে সেন্ট্রির সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় লেকের পাড় দিয়া কালো পোশাকধারী বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্যকে ক্রলিং করে এগোতে দেখেন। ওই কালো পোশাকধারী আর্মিদের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে অবিরাম গুলি করতেও দেখেন।

সেইসময় কামানের গুলিও হচ্ছিল। এমন সময় তাদের বাসায় এক ভাবী ফোনে জানান ‘এই মাত্র শেখ মনিকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতর থেকে স্টেনগানের গুলির আওয়াজ শোনেন। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতরে কালো পোশাকধারী আর্মি অফিসার বাইরের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। একজন আর্মি তাকে দেখে বলে- বের হও, ঘরে যারা আছ বের হও, নাহলে গুলি করব।

গর্জন আদালতকে জানান, নিচে এলে একজন নিজেকে মেজর বলে পরিচয় দেয়। তখনও বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতর থেকে গুলির আওয়াজ শোনেন। এরপরে সব চুপ। কিছুক্ষণ পরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দোতলায় বারান্দায় কয়েকজন আর্মিকে দেখেন। একজন আর্মি অফিসার তার ফুফাত ভাই আমিনুল হক বাদশাকে দেখে বলে, আপনার নাম কি? বাদশা ভাই তার নাম বলার পর ওই অফিসার বলল, আমি-তো আপনাকে চিনি। জবাবে বাদশা ভাই বলল- আমিও আপনাকে চিনি। এই কথা শোনার পর অফিসারটি নরম হয়। পরে বাদশা ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারেন ওই অফিসারের নাম মেজর বজলুল হুদা।-চ্যানেল আই

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

শেখ কামাল পড়ে যাবার পর আবার গুলি করে ক্যাপ্টেন হুদা

আপডেট টাইম : ০২:০৭ অপরাহ্ন, বৃহস্পতিবার, ৩ অগাস্ট ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ  ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে সপরিবার হত্যা করা হয়। ভয়াবহ সেই দিনটির কথা উঠে এসেছে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় সাক্ষীদের জবানবন্দিতে। জবানবন্দি থেকে পাওয়া যায় সেদিনের ভয়াবহতার চিত্র। জানা যায় ঠিক কী ঘটেছিল সেদিন ৩২ নম্বরের বাড়িটির ভেতরে-বাইরে। সাক্ষীদের জবানবন্দির ভিত্তিতে চ্যানেল আই অনলাইনের ধারাবাহিক প্রতিবেদনের তৃতীয় পর্ব।

প্রসিকিউশনের ৫নং সাক্ষী সুবেদার গনি আদালতকে জানান, কুমিল্লা ১ ফিল্ড আর্টিলারিতে মেজর ডালিম ও ক্যাপ্টেন হুদা তাদের অফিসার ছিল। কিছুদিন পরে মেজর ডালিমের চাকরি চলে যায়। ক্যাপ্টেন হুদা ঢাকায় বদলি হয়ে আসে। ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসের শেষ সপ্তাহে ক্যাপ্টেন বাশারের নেতৃত্বে ঢাকায় গণভবনে তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা ডিউটির জন্য তাদের রেজিমেন্টের ১০৫/১০৬ জনের এক কোম্পানি ফোর্সকে ঢাকায় বদলি করা হয়। আগস্টের ১/২ তারিখ থেকে তারা বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ডিউটি করতে থাকে। ডিউটি শেষে ধানমন্ডির ৩১ নং রোডের একটি বাড়িতে থাকতো তারা। একদলে হাবিলদার কুদ্দুস এবং আরেক দলে তিনি গার্ড কমান্ডার ছিলেন।

১৪ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে ডিউটি করতে করতে বিকেল প্রায় ৪টার দিকে তাদের আগের কমান্ডিং অফিসার ডালিমকে মোটর সাইকেলে করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে ঘোরা-ফেরা করতে দেখেন। বিকেল প্রায় সাড়ে ৫টার দিকে তাদের আগের এ্যাডজুটেন্ট ক্যাপ্টেন হুদাকে মোটর সাইকেলে করে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে দিয়ে যেতে দেখেন। ১৫ আগস্ট ভোর সোয়া ৪টার দিকে তাদের রেজিমেন্টের সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদার এসে তাদের গার্ড চেক করে এবং বলে, ‘তোমাদের পুরাতন গুলি দিয়ে দাও, আমি নতুন গুলি দিচ্ছি’। এই বলে পুরাতন গুলি নিয়ে গাড়িতে উঠে চলে যায়। কিন্তু পরিবর্তে নতুন গুলি দেয়নি।

সুবেদার গনি বলেন, আনুমানিক পৌনে ৫টার দিকে হাবিলদার কুদ্দুস তার গার্ড দল নিয়ে ডিউটির জন্য এলে সুবেদার মেজর আবদুল ওহাব জোয়ারদার গুলি নিয়ে যাওয়ার কথা বলে তাকে জাতীয় পতাকা উত্তোলনের জন্য বলেন। পতাকা উত্তোলনের শেষ পর্যায়ে দক্ষিণ দিক থেকে প্রচণ্ড গুলি আসতে থাকে। ৫/৭ মিনিট পর গুলি বন্ধ হলে ঘর থেকে বাইরে গিয়ে দেখেন ক্যাপ্টেন হুদা ও মেজর নূর হাতে স্টেনগান এবং ৭/৮ জন খাকী ও কালো পোশাকধারী ফোর্স হাতে রাইফেলসহ বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে গাড়ি থেকে নামছে। তাকে দেখে ক্যাপ্টেন হুদা বলেন ‘কি গনি, কি খবর?’ তারপর তিনি ওয়ারলেসে কথা বলতে থাকেন।

কথা শেষ হওয়ার সাথে সাথে ল্যান্সারের মেজর মুহিউদ্দিন কিছু ফোর্সসহ পূর্ব দিক থেকে দ্রুত হেঁটে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনে এসে ‘হ্যান্ডস-আপ, হ্যান্ডস-আপ’ বলে গুলি করতে করতে বাসভবনের ভিতরে ঢোকে। তখন সেন্ট্রিসহ তিনি দক্ষিণ দিকে গার্ড রুমে চলে যান। ল্যান্সারের কিছু ফোর্স সকাল ৭টা পর্যন্ত তাদের ৭ জনকে গার্ড রুমে ঘেরাও করে রাখে। সোহরাব নামে একজন গার্ড ভিতরে ছিল। গার্ড রুম থেকে কিছুক্ষণ পর পর বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গুলির শব্দ ও মহিলাদের আর্ত-চিৎকার শোনা যায়।

সুবেদার গনি আদালতকে জানান, সকাল ৭টার পর ল্যান্সারের ফোর্স চলে গেলে তিনি গার্ড রুম থেকে বের হয়ে পেট্রোল ডিউটির সিপাহী সামসুর গুলিবিদ্ধ লাশ ও অপর একজনকে আহত দেখেন। বাসভবনের ভিতরে গিয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধুসহ সকলকে

গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। তারপর তার গার্ড দল নিয়ে ৩১ নং রোডের বাড়িতে চলে যান। হাবিলদার কুদ্দুস তার গার্ড দল নিয়ে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে ডিউটি করিতে থাকেন।

প্রসিকিউশনের ৬নং সাক্ষী হাবিলদার সোহরাব আলী আদালতকে জানান, ১৯৭৫ সনের জুলাই মাসের শেষের দিকে কুমিল্লা ১ ফিল্ড আর্টিলারি থেকে অন্যদের সঙ্গে তাকেও ঢাকায় গণভবন ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা ডিউটির জন্য বদলি করা হয়। ক্যাপ্টেন বাশার তাদের নেতৃত্ব দেন। তাদের ২৫ জনের একদল বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে পালাক্রমে ডিউটি করে।

১৪ আগস্ট সকাল ৬টা থেকে হাবিলদার গনির নেতৃত্বে তাদের ডিউটি শুরু হয়। ১৫ আগস্ট সকাল ৬টা পর্যন্ত তাদের ডিউটিতে থাকার কথা ছিল। ২ ঘণ্টা পরপর তাদের ডিউটি বদলির নিয়ম ছিল। সে কারণে ১৪ আগস্ট দিবাগত রাত ২-৪টার দিকে তার ডিউটি শেষ হলে তিনি গার্ড রুমে চলে যান। তখন পুলিশের ডিউটিও ছিল। আনুমানিক সাড়ে ৪ টার সময় তাদের কাছ থেকে গুলি জমা নেয়া হয়। তারপর তিনি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের সামনের রাস্তায় দাঁড়িয়ে ছিলেন।

কিছুক্ষণ পর পরবর্তী গার্ড দল আসে। তিনি দেখেন, কালো পোশাক পরা আর্মির কিছু ফোর্স ২/৩ টা ট্রাকে করে পূর্বদিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ২/১টা বাড়ির পশ্চিমে গিয়ে থামে। তখন লেকের দক্ষিণ দিক থেকে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে গুলি আসতে থাকে। তখন ভয়ে বঙ্গবন্ধু বাসভবনের পূর্বদিকে দেওয়ালের পাশে গিয়ে দাঁড়ান। ৫/৬ মিনিট পর গুলি বন্ধ হয়। তখন বঙ্গবন্ধুকে রিসিপশন রুম থেকে বের হয়ে দোতলার দিকে যেতে দেখেন। একটু পরে রিসেপশন রুমের সামনে দাঁড়িয়ে শেখ কামাল বলেন ‘আর্মি-পুলিশ ভাই আপনারা আমার কাছে আসেন।’

এই সময় খাকী পোশাকধারী ক্যাপ্টেন হুদাসহ খাকী ও কালো পোশাকে আরো অফিসার এবং কিছু সৈনিক বঙ্গবন্ধুর বাসভবনের ভেতরে ঢুকে ক্যাপ্টেন হুদা ও অন্য অফিসার শেখ কামালকে গুলি করে। শেখ কামাল চিৎকার দিয়ে রিসিপশন রুমের দরজার কাছে পড়ে যান। ক্যাপ্টেন হুদা আবার তাকে গুলি করে। তারপর ক্যাপ্টেন হুদাই বাড়ির কাজের লোকদেরকে নিয়ে লাইনে দাঁড় করিয়ে দোতলায় যায়। কিছুক্ষণ পরপর দোতলায় গুলি ও আর্ত-চিৎকারের শব্দ শোনেন।

২০/২৫ মিনিট পর হত্যাকারীরা দোতলা থেকে নিচে নেমে গেটের দিকে যায়। তিনি দোতলার সিঁড়িতে গিয়ে বঙ্গবন্ধুর লাশ দেখেন। এই মর্মান্তিক দৃশ্য দেখে দোতলায় না গিয়ে গেটের কাছে চলে আসেন। তখন ক্যাপ্টেন হুদা কোন সিভিলিয়ান যাতে বাড়িতে ঢুকতে না পারে সেজন্য তাদের গার্ডদের পাহারা দেওয়ার নির্দেশ দিয়ে চলে যায়। কিছুক্ষণ পর ক্যাপ্টেন হুদার সঙ্গে মেজর আবদুল ওয়াহাব জোয়ারদারকে ঘুরতে দেখেন। একসময় গেটের সামনে ল্যান্সারের একজন অফিসার ক্যাপ্টেন হুদার ব্যাজ বদল করে তাকে মেজরের ব্যাজ এবং হুদার ব্যাজ খুলে জোয়ারদারকে পরিয়ে দেয়। তারপর সামনে ট্যাংকের শব্দ শুনে বাড়ির উত্তর পাশে ডিউটি পোস্টে ডিউটি করতে থাকেন।

সোহরাব আলী আদালতকে জানান, ১৬ আগস্ট ভোরে বঙ্গবন্ধুর লাশ বাদে বাকি লাশগুলি একটি আর্মি ট্রাকে করে নিয়ে যেতে দেখেন। ১৬ আগস্ট আনুমানিক ৯.৩০ টার দিকে একটি আর্মির পিকআপে বঙ্গবন্ধুর লাশ নিয়ে যায়। ১৬ আগস্ট বিকালে গণভবনে এবং ১৭ আগস্ট দিবাগত রাতে রাতে কুমিল্লায় চলে যান।

প্রসিকিউশনের ৩৩ নং সাক্ষী হাবিলদার সেলিম উদ্দিন জানান, ১৯৭৫ সালের জুলাই মাসে ২৭/২৮ তারিখে কুমিল্লা ১ম ফিল্ড আর্টিলারির ক্যাপ্টেন বাশারের নেতৃত্বে ১০৫ জন ফোর্স গণভবন ও তৎকালীন রাষ্ট্রপতি বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা ডিউটিতে আসে। ১৪ আগস্ট বিকেল ৫:৩০ টায় ধানমন্ডির ৩২নং রোডের বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭ নং বাড়ির চার পাশে পেট্রোল ডিউটি করার জন্য ৬ জন সিপাহীসহ তাকে পাঠায়। তাদের কাছে এসএলআর ছিল। ১৪ আগস্ট সন্ধ্যা ৬টা থেকে পরের দিন সকাল ৬টা পর্যন্ত তাদের ডিউটি ছিল।

তখন গনির নেতৃত্বে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে নিরাপত্তা ডিউটি চলছিল। তিনি পালাক্রমে রাত ১১টা পর্যন্ত ডিউটি করে পরবর্তী সিপাহীদের পালাক্রমে ডিউটি করার নির্দেশ দিয়ে দক্ষিণ দিকের বেডে ঘুমিয়ে পড়েন। তারপর হাবিলদার গনি কোথায় ছিল বলতে পারেন না। ১৫ আগস্ট সকাল আনুমানিক পৌনে ৫টার সময় হালকা হাতিয়ারের ও গুলির আওয়াজ শুনে দ্রুত ৪জন সিপাহীসহ বাইরে আসেন। তখন পেট্রোলরত ২ জন সিপাহী দৌড়ে এসে তাকে বলে ‘ট্যাংকের আওয়াজ হচ্ছে ফায়ারিং-এর শব্দ শোনা যাচ্ছে।’ ঠিক সেই মুহূর্তে আর্টিলারির কামানের গোলা এসে তাদের আস্তানায় ১৫/২০ গজ পূর্বদিকে ব্লাস্ট হয়।

গোলার টুকরা তাদের ৪ জনকে আহত করে, সিপাহী সামসু ঘটনাস্থলেই নিহত হন। সিপাহী মোফাজ্জল গুরুতর এবং অন্য ২ জন সামান্য আহত হন। তখন ফায়ারিং চলছিল। তিনি জ্ঞান হারিয়ে ফেলেন। ৭.৩০/৮ টার সময় জ্ঞান ফিরলে নিজেকে গণভবনের ব্যারাকে শোয়া অবস্থায় দেখেন। তখন জানতে পারেন যে, সপরিবার বঙ্গবন্ধুকে হত্যা করা হয়েছে।

প্রসিকিউশনের ৩৬ নং সাক্ষী নেওয়াজ আহমেদ ওরফে গর্জন বলেন- ধানমন্ডির ৩২নং রোডে বঙ্গবন্ধুর ৬৭৭নং বাড়ির লাগোয়া পূর্বদিকে তাদের বাড়ি। তিনি একজন ব্যবসায়ী। ১৯৭৫ সালের ১৪ আগস্ট দিবাগত রাতে নিজেদের বাড়িতে ছিলেন। ঐ রাতে বাসায় তার বড় ভাই-বোন ও ফুফাত ভাই আমিনুল হক বাদশাসহ আরো কয়েকজন আত্মীয় ছিলেন। তার বাবা ঐ সময় সরকারি কাজে দেশের বাইরে ছিলেন। ১৫ আগস্ট ভোর বেলা বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে বিউগলের আওয়াজে তার ঘুম ভাঙে। ঠিক এই সময় একটি জীপ মিরপুর থেকে খুব দ্রুত পশ্চিম দিকে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির গেটের সামনে এসে সেন্ট্রির সঙ্গে কথাবার্তা বলার সময় লেকের পাড় দিয়া কালো পোশাকধারী বেশ কিছু সংখ্যক সৈন্যকে ক্রলিং করে এগোতে দেখেন। ওই কালো পোশাকধারী আর্মিদের বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দিকে অবিরাম গুলি করতেও দেখেন।

সেইসময় কামানের গুলিও হচ্ছিল। এমন সময় তাদের বাসায় এক ভাবী ফোনে জানান ‘এই মাত্র শেখ মনিকে মেরে ফেলা হয়েছে।’ কিছুক্ষণ পর বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতর থেকে স্টেনগানের গুলির আওয়াজ শোনেন। জানালার পাশে দাঁড়িয়ে দেখেন বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতরে কালো পোশাকধারী আর্মি অফিসার বাইরের দিকে বন্দুক তাক করে দাঁড়িয়ে আছে। একজন আর্মি তাকে দেখে বলে- বের হও, ঘরে যারা আছ বের হও, নাহলে গুলি করব।

গর্জন আদালতকে জানান, নিচে এলে একজন নিজেকে মেজর বলে পরিচয় দেয়। তখনও বঙ্গবন্ধুর বাড়ির ভিতর থেকে গুলির আওয়াজ শোনেন। এরপরে সব চুপ। কিছুক্ষণ পরে বঙ্গবন্ধুর বাড়ির দোতলায় বারান্দায় কয়েকজন আর্মিকে দেখেন। একজন আর্মি অফিসার তার ফুফাত ভাই আমিনুল হক বাদশাকে দেখে বলে, আপনার নাম কি? বাদশা ভাই তার নাম বলার পর ওই অফিসার বলল, আমি-তো আপনাকে চিনি। জবাবে বাদশা ভাই বলল- আমিও আপনাকে চিনি। এই কথা শোনার পর অফিসারটি নরম হয়। পরে বাদশা ভাইয়ের কাছ থেকে জানতে পারেন ওই অফিসারের নাম মেজর বজলুল হুদা।-চ্যানেল আই