বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ শরণার্থীদের যাঁরা ভয় পান, তাঁরা কি এই নামগুলোকেও ভয় পান? স্টিভ জবস, অ্যাপল কোম্পানির প্রতিষ্ঠাতা কিংবা আন্দালুসিয়ায় আলোকিত মুর সভ্যতার প্রতিষ্ঠাতা খলিফা আবদুর রহমান? দুজনই ইতিহাসের দুই পর্বে হয়েছিলেন সিরীয় বংশোদ্ভূত শরণার্থী। বিজ্ঞানী আইনস্টাইন ছিলেন জার্মান শরণার্থী। শরণার্থী দলের পায়ের সঙ্গেই চলেছে ইতিহাস। যুগে যুগে তারাই সভ্যতার অচলাবস্থা কাটিয়ে দিয়েছে। হজরত মুসা (আ.) ও তাঁর জাতি শরণার্থী ছিলেন, মহামতি যিশু ও বুদ্ধও ছিলেন শরণাগত পরিব্রাজক। মধ্যযুগের মুসলমান জ্ঞানীরা ইউরোপে ছড়িয়ে গিয়ে রেনেসাঁ ও আলোকায়নের বীজ বুনেছিলেন। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে বিতাড়িত ইউরোপীয় ইহুদি জ্ঞানী-বিজ্ঞানীরা যুক্তরাষ্ট্রকে এগিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন। কার্ল মার্ক্স, লেনিন-ট্রটস্কি থেকে থিওডর অ্যাডর্নো, ওয়াল্টার বেনিয়ামিন হয়ে এডওয়ার্ড সাইদ এবং ফিলিস্তিনি কবি মাহমুদ দারবিশও ছিলেন নির্বাসিত। সেকালের পূর্ববঙ্গের উদ্বাস্তুরাই কিন্তু পশ্চিমবঙ্গের চিন্তা ও সমাজে রক্তপ্রবাহ জুগিয়েছিল। যেমন পাকিস্তানে তা করেছিল পাঞ্জাবি শরণার্থীরা। সভ্যতার অন্যতম চালিকাশক্তিও ছিল শরণার্থীরা। শরণ তথা বাঁচার জন্য পরদেশে অভিবাসন ছাড়া পৃথিবী এগোত কি? ভারতবর্ষের বৌদ্ধরা গণহত্যার শিকার হয়ে বিশাল পূর্ব এশিয়ায় ছড়িয়ে পড়েছিল। সেদিন যদি ওসব দেশ তাদের আশ্রয় না দিত, তাহলে পৃথিবী থেকে একটি ধর্মের ঐতিহ্য হারিয়ে যেত। আর্য ও মোগলরা ভারতে শরণার্থী হয়েই এসেছিল।
মানবসমাজ চিরকালই অভিবাসনপ্রবণ ছিল। যখন রাষ্ট্র ও সীমান্তের এত প্রতাপ ছিল না, তখন হরহামেশাই এক সমাজের মানুষ অন্য সমাজে গিয়ে বসতি গেড়েছে এবং সমাদর পেয়েছে। বর্মীদের অত্যাচারে মিয়ানমারের রাখাইনরা যেমন বাংলাদেশে বসতি করে, তেমনি অনেক বার্মিজ জাতিগোষ্ঠী কম্বোডিয়া-ভিয়েতনাম প্রভৃতি অঞ্চল থেকে আজকের মিয়ানমারে এসে থিতু হয়। বাংলাদেশ তথা পূর্ববঙ্গ ছিল বিভিন্ন জাতির ঐতিহাসিক অভিবাসনের শেষ গন্তব্য। পূর্ব থেকে এসেছে লুঙ্গি পরা ধানচাষি মঙ্গোলয়েডরা, পশ্চিম থেকে এসেছে আর্য, আরব-তুর্কি-পারস্যবাসী এবং সর্বশেষ ইংরেজরা। আদিবাসী ও বহিরাগত জাতি-গোষ্ঠী মিলেই আজকের বাংলাদেশ। আজকের বাংলাদেশিরা যে অভিবাসী ও শরণার্থীদের প্রতি উদার, তার কারণ হয়তো এই ঐতিহাসিক অভিজ্ঞতা।
মিসরীয় অর্থনীতিবিদ সামির আমিন তাঁর দ্য লিবারেল ভাইরাস বইতে দেখান, ১৮১৮ সালের আগে মানুষ যত অভিবাসী হয়েছে, বর্তমান হার তার থেকে কম। প্রায় সব দেশেই অভিবাসনের মাধ্যমে বিবিধ সংস্কৃতির সমন্বয়ে সমাজের গঠন ও বিকাশ ঘটেছে। তাই উদ্বাস্তু, বিদেশি, ভিনধর্মী, ভিন ভাষা ও রঙের মানুষকে ভয় পেয়ো না। হোক সে রোহিঙ্গা বা সিরীয় বা সোমালিয়ান। সে হয়তো তোমার আশীর্বাদ হয়ে উঠবে। সভ্যতার সংঘাতের বিরুদ্ধে তারা হলো সভ্যতার সমন্বয়ের অগ্রদূত।
শরণার্থীরা কোনো দেশ কি দখল করতে পারে? হ্যাঁ পারে। যুক্তরাষ্ট্র, অস্ট্রেলিয়া, দক্ষিণ আফ্রিকা ও ইসরায়েল। কিন্তু এরা ব্যতিক্রম। স্থানীয় লোকদের সরিয়ে হত্যা করে তিনটি দেশই প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছিল সাম্রাজ্যবাদী ব্রিটেনের অসাধু পরিকল্পনায়। আজকের যুগে এর পুনরাবৃত্তি করা অসম্ভব। তা ছাড়া আরব-আফ্রিকা ও এশিয়ার কোনো শরণার্থীই কোনো সাম্রাজ্যের হাতিয়ার তো নয়ই, বরং তারা নয়া সাম্রাজ্যবাদের মর্মান্তিক শিকার। সিরীয় শরণার্থী বা রোহিঙ্গা শরণার্থীদের সঙ্গে বর্ণবাদী ও জায়নবাদীদের কোনো তুলনা চলে না।
২.শরণার্থীরা মানববর্জ্য নয় যে তারা জাতির মধ্যে মানবদূষণ ঘটাবে। তা ছাড়া বাঙালিরাও কোনো রেস বা একক নৃতাত্ত্বিক জনগোষ্ঠী নয়। পৃথিবীতে কোনো বিশুদ্ধ ‘স্বজাতি’ নেই; বাঙালিরাও তার বাইরে নয়। হরহামেশাই হাজার বছরের বাঙালির কথা আমরা শুনি। এর মাধ্যমে কী বোঝায়, তা এর প্রবক্তারা পরিষ্কার করতে পারেননি। জাতিগত ঐক্য জাগাতে তাঁরা হয়তো চাইছিলেন বাঙালি জাতীয়তাবাদের শক্তিমান মিথ সৃষ্টি করতে। অথচ আজ বাঙালি বলতে যা বোঝায়, মধ্যযুগের সুলতানি আমলে তা ছিল না, আবার বাংলা ভাষার প্রাচীনতম নিদর্শন চর্যাপদের যুগে—দশম-একাদশ শতকে তা বোঝাত অন্য কিছু। এখন বোঝানো হয় সাংস্কৃতিক জাতি, চর্যার যুগে বোঝানো হতো নিম্নবর্গীয় জনজাতির ধারণা।
চর্যার ৪৯ নম্বর কবিতায় ভুসুকুপা যা বলেছেন তার মর্মার্থ হলো: পদ্মা খাল দিয়ে বজরা নৌকায় যাচ্ছিলাম। পথে নির্দয় দস্যু দেশ লুট করে নিল। সেই দুঃখে ভুসুকু নতুন আশ্রয়ে বাঙালি হলো। আভিজাত্য ছেড়ে ঘর করল চণ্ডালির সঙ্গে। নতুন জীবনে স্বার্থবোধ রইল না। কেবল রইল বিরাট এক পরিবার। সেখানে মহাস্নেহে সবাই জড়িত। একেই কবি বলছেন, ‘আমি ভুসু বঙ্গালী ভইলী’, অর্থাৎ আমি ভুসুকু সবার সাথে এক হলাম। জাতির ঘরে না জন্মালে নাকি জাতির সদস্য হওয়া যায় না। তাহলে ভুসুকু যে বাঙালি হলেন, তা নিশ্চয় জাতি নয়, নতুন ও উদার এক চেতনা অর্জনের কথাই হয়তো কবি বোঝাতে চেয়েছেন।
বাঙালিরা রক্তের সম্পর্কের জাত বা প্রাকৃতিক জাতি নয়। পরাধীনতা ও শোষণের বিরুদ্ধে, বর্ণপ্রথা ও জাতপাতের বাড়াবাড়ি অস্বীকার করে নিম্নবর্গীয় বনবাসী, আদিবাসী মানুষেরা যে পরিচয় একদা নিয়েছিল, তারই নাম বাঙাল বা বাঙালি। ইংরেজ বা আর্য বা পাঞ্জাবি বা আরবদের মতো জৈবিক জাতি বা রেস এরা নয়। বাঙালি পরিচয় ও ভাষা বরং অনেক জাতি–ধর্ম আর ভাষার মিলনের ফল। বাঙালি হলো সেই প্রতিবাদী ঐক্যের নাম। এই ঐক্য বর্ণবাদ, সাম্প্রদায়িকতা ও রেসিজম তথা নৃতাত্ত্বিক অহংকারের বিরুদ্ধে। তা যদি হয়, তাহলে কেন আমাদের কারও কারও মধ্যে আদিবাসী, পাহাড়ি এবং সর্বশেষ রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে ঘৃণা ও সন্দেহ উঁকি দেয়? এর পেছনের বর্ণবাদী, জাত্যাভিমানী ও সাম্প্রদায়িক কোন মন ঘাপটি মেরে লুকিয়ে আছে? এর পরিশোধন ছাড়া আমাদের রাষ্ট্র ও রাজনৈতিক জাতিগঠন জোরদার হওয়ার নয়।
এই ভূখণ্ডে যতবারই গণহত্যা চলেছে, ততবারই ‘বাঙালি’ নামটি উচ্চারিত হয়েছে। রোহিঙ্গা গণহত্যার সময়ও হলো। একাদশ–দ্বাদশ শতকে সেন রাজাদের হাতে বৌদ্ধদের গণহত্যার সময়, একাত্তরে ইসলামের নামে পাকিস্তানের গণহত্যার সময় বাঙালি ধ্বনি উঠেছিল। সাবেক আরাকানেও বর্মী বৌদ্ধ জাতীয়তাবাদের নামে রোহিঙ্গা গণহত্যার সময়ও ‘বাঙালি’র নাম উঠেছে। মুসলমানদের পাশাপাশি হিন্দুদের হত্যা ও বিতাড়ন থেকেই বোঝা যায়, আক্রোশ মুসলমানের বিরুদ্ধে যেমন, বাঙালির বিরুদ্ধেও তেমন। বাঙালি আসামে আছে, ত্রিপুরায় আছে, আন্দামানে আছে, পশ্চিম বাংলায় আছে। তাই বলে এদের সবাই কি বাংলাদেশি বাঙালি? বাংলাদেশের পাহাড় ও সমতলের অবাঙালি জাতিগোষ্ঠীর অনেকেও সে সময় শরণের আশায় দেশ ছেড়েছিল। ভারতের অনেকেও তখন বাঙাল, নকশাল, মুসলমান অপবাদ দিয়ে ঠেকাতে চেয়েছিল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত জিতেছে মানবতা। আজও বাঙালি নেত্রী শেখ হাসিনা ও মমতা বন্দ্যোপাধ্যায় যে রোহিঙ্গা বাঙালির পক্ষে দাঁড়িয়েছেন, সেটাও বাঙালি মানবতার যৌথবোধেরই পরিচয়, শরণার্থীদের প্রতি ঐতিহাসিক আবেগেরই প্রকাশ।
৩. বাংলাদেশ যখন বুক পেতে রোহিঙ্গাদের ঢল নিচ্ছে, তখন আরব, ভারত ও পশ্চিমের ধনী দেশগুলোর নীতিনির্ধারকেরা ‘দুর্গ মানসিকতা’র পরিচয় দিচ্ছেন। আর শরণার্থী শিবিরের মানুষেরা স্থায়ীভাবে ‘অস্থায়ী দশা’য় ঝুলে থাকছেন। এঁরা নৈরাষ্ট্রের নৈনাগরিক, এঁরা খরচযোগ্য। এরা ভূরাজনীতি, নেতিবাচক বিশ্বায়ন এবং সাম্প্রদায়িক জাতীয়তাবাদের শিকার। এঁরা নিজ সমাজ হারিয়েছেন, নতুন সমাজেও তাঁদের দেখা হয় মানব-বর্জ্য হিসেবে। প্রশ্নটাও আর মানবিকতার থাকছে না, করা হচ্ছে রাজনৈতিক। শরণার্থীদের বিরুদ্ধে চালানো হচ্ছে ভয়ের সংস্কৃতির চাষবাস। বহিরাগত আতঙ্ক জাগিয়ে লাভবান হচ্ছে ডানপন্থী উগ্র জাতীয়তাবাদ: মিয়ানমার ও ভারত হয়ে ইউরোপ-আমেরিকা অবধি। অভিবাসী শরণার্থী ঠেকাতে যে ঘৃণা ও শত্রুতার আবেগ উসকানো হচ্ছে, তা নেশনের আচরণ নয়, জাতির আচরণ নয়। সমাজতাত্ত্বিক জিগম্যুন্ট বাউমান বলছেন, এই পুনর্জাগ্রত কুসংস্কার ও শত্রুতার চরিত্র ‘ট্রাইবাল’। এবং তার পরিণতি প্রায়ই গণহত্যা।
মিয়ানমারের রোহিঙ্গাদের দেখুন। আন্তর্জাতিক আইনে শরণার্থী মর্যাদার পূর্ণ দাবিদার হওয়া সত্ত্বেও ধর্মীয় পরিচয়ের কারণে এবং পরাশক্তিগুলোর ভূরাজনৈতিক লীলাখেলার রসদ হয়েছে তারা। তাদের মারলে কোনো দোষ নেই। তাদের জন্য জাতিসংঘের শান্তিরক্ষী হস্তক্ষেপ কিংবা উদ্বাস্তু তহবিলের টাকার টানাটানি কখনো শেষ হয় না। এখানেই প্রাসঙ্গিক ইতালীয় রাজনৈতিক দার্শনিক আগামবেনের হোমো সাসেরের ধারণা। রোমান সাম্রাজ্যের আইনে একধরনের মানুষকে ‘হোমো সাসের’ (Homo Sacer) বর্গভুক্ত করা হতো। এই হোমো সাসেরদের হত্যায় অপরাধ হতো না, আত্মপক্ষ সমর্থনের কোনো বালাই তাদের জন্য খাটবে না। এমনকি শহীদ বা মার্টায়ার হওয়ার মতো পবিত্র ছিল না তাদের দেহ। তারা ছিল মানুষ ও জড় বস্তুর মাঝামাঝি কোনো অবস্থার জীব। আজ দেখা যাচ্ছে, কালো, মুসলিম, আরব, রোহিঙ্গা, দরিদ্র ও ক্ষমতাবঞ্চিত মানুষের স্ট্যাটাস হোমো সাসেরের স্ট্যাটাস। তাদের খরচযোগ্য, মানব–বর্জ্য, ‘নিউ ক্রিমিনাল’ ভাবা তাদের হত্যাকারীদের নৈতিক শক্তি জোগানোর শামিল।