ঢাকা , শুক্রবার, ১৫ নভেম্বর ২০২৪, ১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

মহামান্য রাষ্ট্রপতি

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান এবং ক্ষমতাধর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য-অহংকারের প্রতীক। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার আর কোনো দল-সংগঠন থাকে না। তিনি আর সংসদ সদস্যও থাকেন না। তার বিশাল হৃদয়ের ক্যানভাসে তখন গোটা বাংলাদেশ ও ষোল কোটি জনগণ। প্রজাতন্ত্রের সব সচেতন নাগরিকের কর্তব্য তার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা রাজ্য থাকলে রাজা থাকবেন।

রাষ্ট্র থাকলে রাষ্ট্রপতি থাকবেন। দেশে দেশে, যুগে যুগে রাজার নানা রকম নামকরণ হয়েছে। রাজা-বাদশাহ-সম্রাট-খলিফা-সুলতান কত পদবি। সময়ের বিবর্তনে রাজ্য পরিচালনার পদ্ধতি বা কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র। কখনও কখনও সামরিক শাসনে ভিন্ন ব্যবস্থা দেখা যায়। রাজতন্ত্রে রাজা বংশানুক্রমিক বা গদিনশিন সূত্রে রাজা হন। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান দুইভাবে নির্বাচিত হন। যদি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। আর যদি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতি জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বর্তমান আইন অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত (অনুচ্ছেদ ৪৮(১)। প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান।

রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্রপতি বলা হয় কেন? ইংরেজি President শব্দের বাংলাকরণ কে করেছে জানি না। তবে নামকরণটি যথাথই সঠিক। রাষ্ট্রের প্রধান যদি রাষ্ট্রের পতি হন তাহলে রাষ্ট্র কি স্ত্রী লিঙ্গ? অবশ্যই রাষ্ট্র বা দেশ হচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমি-জন্মভূমি মা-জননী। এ ভূমিই জন্ম দেয় তার নাগরিকদের। তার উদরেই ফলে সোনার ফসল, যা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে তার সন্তানরা। আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছিলেন। ইজ্জত-আব্রু গেছে ২ লাখ মা-বোনের।

মাতৃভূমির নিরাপত্তা রক্ষায় সর্বদাই সচেষ্ট থাকে আমাদের বীর সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী। মাকে চারদিকে ঘিরে রাখে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি)। মাতৃভূমির সাফল্য জাতির সাফল্য, জনগণের সাফল্য। তাই ক্রিকেটে যখন বাংলাদেশ জিতে, তখন দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু নেচে-গেয়ে ওঠে। আনন্দে আত্মহারা হয় সারা দেশ। উৎসবের আমেজে রঙিন হয়ে ওঠে পরিবেশ। আবার বন্যা-বানভাসি-সন্ত্রাস-জঙ্গি হামলা হলে মায়ের মুখখানি মলিন হয়ে পড়ে। আমাদের জাতীয় সংগীতই বলে দেয়, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।’ তাই সন্তানদের উচিত মায়ের বদন যেন কখনোই মলিন না হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে কাজটিতে হাত দিতে হয়, তা হলো দেশ কীভাবে চলবে তার জন্য একটি কিতাব রচনা করা। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণই মূলত এ কিতাবের রচয়িতা। এ কিতাবে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ খুঁটিনাটি সব বিষয়ের উল্লেখ থাকে। এ কিতাব রচনা হওয়ার পরে আবার জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা তা অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। এ কিতাবই হলো আমাদের সংবিধান। এ কিতাব সহজে পরিবর্তনীয় নয়। এ কিতাবের বিধান অলঙ্ঘনীয়। তবে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কিতাবের শরীরে ছোটখাটো অপারেশন করা যেতে পারে। যাকে বলে সংশোধনী।

দুই-তৃতীয়াংশ জনপ্রতিনিধির সম্মতিতে তা হয়ে থাকে। আমাদের প্রিয় সংবিধানে এরই মধ্যে বেশকিছু মেজর-মাইনর অপারেশন হয়েছে। না করে উপায় ছিল না। রাজা তার রাজ্য পরিচালনার জন্য কিছু কিছু আইন-বিধিবিধান তৈরি করেন। আগের দিনের রাজারা স্বীয় মেধা, প্রজ্ঞা ও পারিষদদের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক তা নির্ধারণ করতেন। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে এসব আইনকানুন প্রণয়নের জন্য একটি আইনসভা থাকে। বাংলাদেশের আইনসভার নাম জাতীয় সংসদ। সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদ জাতীয় সংসদ গঠন ও এর আইন প্রণয়ন ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেয়।

সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করার এখতিয়ার প্রদান করে। বর্তমানে জাতীয় সংসদের সদস্য সংখ্যা ৩০০ জন এবং সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্য ৫০ জন। তাদের সংসদ সদস্য বলা হয়। একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাগুলো থেকে জনগণ দ্বারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ জন সদস্য নির্বাচিত হন।

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি দেশের প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার স্থান। যতই সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হোক না কেন, তার সম্মতি সবক্ষেত্রে অপরিহার্য। সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা পর্যায়ের সব নিয়োগ-পদোন্নতি-বরখাস্ত তার অনুমোদনে হয়। বিদেশের সঙ্গে চুক্তি করবেন তা-ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগবে। বিদেশি রাষ্ট্র থেকে কোনো সম্মান, পুরস্কার, খেতাব বা ভূষণ গ্রহণ করতেও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগবে (অনুচ্ছেদ ৩০)।

রাষ্ট্রপতি দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বা Chancellor এর দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদ আহ্বানের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। সাধারণ নির্বাচনের পর প্রথম অধিবেশনের সূচনালগ্নে এবং প্রতি বছরের শুরুতে প্রথম অধিবেশনের সূচনায় তিনি সংসদের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন (অনুচ্ছেদ ৭৩(২)। তার ভাষণের ওপর সংসদ সদস্যরা আলোচনা করেন। সংসদ কর্তৃক প্রণীত সব বিল তার অনুমোদনের পর আইন হিসেবে বলবৎ হবে।

তবে রাষ্ট্রপতি যদি কোনো বিলে স্বাক্ষর না করে সংসদে ফেরত পাঠান তবে বিলটি সংসদে ফের আলোচিত হবে। এভাবে দুইবার প্রত্যাখ্যানের পর তৃতীয়বারে বিলটিতে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তা সংসদে আইন হিসেবে অভিহিত হবে। যখন সংসদ অধিবেশন বন্ধ থাকে, তখন জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি নিজ ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন (অনুচ্ছেদ ৯৩ (১), যা সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে পাস করিয়ে নিতে হয়। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বলীয়ান।

সংবিধানই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উৎস। তবে সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) অনুসারে শুধু প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শদান করেছেন কি না এবং করে থাকলে কী পরামর্শদান করেছেন, কোনো আদালত সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবে না (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)। সবাই কি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন? না।

রাষ্ট্রপতি হতে হলে তার বয়স অন্যূন ৩৫ বছর হতে হবে। কোনো বালক রাষ্ট্রপতি হতে পারবে না। তাকে জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। সংবিধানে প্রণীত ধারামতে, আগে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে অপসারিত ব্যক্তি ফের রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না (অনুচ্ছেদ ৪৮(৪)। রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ ৫ বছর, তবে এক্ষেত্রে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি শপথ নেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকতে পারবেন (অনুচ্ছেদ ৫০(১)। দুইবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হতে পারবেন না (অনুচ্ছেদ ৫০(২)।

রাষ্ট্রপতি যদি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করার ইচ্ছে পোষণ করেন, তাহলে তিনি স্পিকারের উদ্দেশে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করতে পারবেন (অনুচ্ছেদ ৫০(৩)। সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদের হানি না ঘটিয়ে সংবিধানের ৫১(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির দায়মুক্তির বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণ ব্যতীত রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় কার্যের জন্য দায়ী করা যাবে না বা কোনো আদালতে জবাবদিহি করতে হবে না। তবে এ ধারা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যধারা গ্রহণে কোনো ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ করবে না (অনুচ্ছেদ ৫১(১)।

রাষ্ট্রপতির কার্যভারকালে তার বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো প্রকার ফৌজদারি কার্যধারা দায়ের করা বা চালু রাখা যাবে না এবং তাকে গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোনো আদালত থেকে পরোয়ানা জারি করা যাবে না (অনুচ্ছেদ ৫১(২)। শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপরাসরণের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের স্বাক্ষরিত প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে প্রেরণ করতে হবে (অনুচ্ছেদ ৫৩(১)। এছাড়া সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের লিখিত ও স্বাক্ষরযুক্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যেতে পারে (অনুচ্ছেদ ৫২(১)।

যদিও বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতিকে এ পর্যন্ত ইমপিচমেন্টের বা অভিশংসনের মোকাবিলা করতে হয়নি। তবে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের একটি নজির রয়েছে। যদি কোনো দৈবদুর্বিপাকে রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হয় অথবা রাষ্ট্রপতির অসুস্থতা, অনুপস্থিতি বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি পদ সাময়িকভাবে শূন্য থাকে, তাহলে সে শূন্যস্থান পূরণের জন্য সংবিধানের শর্তানুযায়ী জাতীয় সংসদের স্পিকার রাষ্ট্রপতির পদের সাময়িক দায়িত্ব পালন করবেন।

সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উৎস দুইটি এক. সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা, দুই. অন্য কোনো আইন দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতা। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা আবার পাঁচভাগে বিভক্ত ১. নির্বাহী ক্ষমতা, ২. আইন প্রণয়নবিষয়ক ক্ষমতা, ৩. অর্থবিষয়ক ক্ষমতা, ৪. বিচার বিভাগ সম্পর্কিত ক্ষমতা, ৫. বিবিধ ক্ষমতা।
সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রের প্রধান বা পতি হিসেবে বরণ করেছে। আবার সংবিধানের ৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হবেন দেশের ‘সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক’ (Supreme Commander of the Defence Services)।

রাজ্যের সব সৈন্যসামন্ত তার অধীন। অন্যদিকে সংবিধানের ৫৫(৪) অনুচ্ছেদ সব নির্বাহী কার্যক্রম রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত বা সম্পন্ন হয়েছে বলে অনুমোদন দেয়। রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন রাজা। তিনি কি সারাক্ষণ এ আদেশ, সে আদশ, এ কাজে, সে কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন? না, তা হয় না। তাই তিনি রাষ্ট্রপতির জন্য প্রযোজ্য সব সরকারি কাজ Allocation and Transaction of the Business এর সূত্রে নির্বাহী আদেশবলে ভাগ-বণ্টন করে দেন।

সংবিধানের ৫৫(৬) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে এ ক্ষমতা প্রদান করেছে। দেশে নির্বাচন হলে, যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাদের সংসদীয় দলের প্রধান রাষ্ট্রপতি বরাবরে সশরীরে হাজির হয়ে দালিলিক প্রমাণসহ অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন যে, তিনি সংসদের বেশিরভাগ সদস্যের দ্বারা সমর্থিত ও নির্বাচিত এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ওই সংসদ সদস্যকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের আস্থাভাজন বলে প্রতীয়মান হলে তিনি তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগদান করতে পারেন (অনুচ্ছেদ ৫৬(৩)। এছাড়া সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীকে নিয়োগদান করবেন।

তবে শর্ত থাকে যে, তাদের সংখ্যার নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে নিযুক্ত হবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মনোনীত হতে পারবেন, যাকে আমরা Technocrat Quota বলে থাকি। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার, মহাহিসাব নিরীক্ষক বা Auditor General,, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগদান করেন (ধারা ৬৪, ৯৫, ১১৮(১), ১২৭(১) ও ১৩৮(১)।

সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগদান করবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শপূর্বক অন্য বিচারকদের নিয়োগদান করবেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য ও সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিতদের শপথবাক্য পাঠ করান। বিভিন্ন জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজে রাষ্ট্রপতি সালাম গ্রহণ করেন। আমাদের দেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের দূতদের তার কাছেই প্রথমে পরিচয়পত্র পেশ করতে হয়।

বিদেশি দূতদের তাই রাজবাড়ির প্রবেশপথ থেকেই (বঙ্গভবনের প্রধান ফটক) সুসজ্জিত ঘোড়-সওয়ার বাহিনী দ্বারা স্কট করে নির্ধারিত মঞ্চে উপস্থিত করতে হয়। এ সময় রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকেন। তার সম্মানে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে তার পরিচয়পত্র (Credential) গ্রহণ করেন।
আগের দিনের রাজারা যেমন মর্জি-মাফিক অর্থ ব্যয় করতে পারতেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রপতির সে ক্ষমতা নেই। তবে সব অর্থবিল সংসদে উপস্থাপনের আগে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৮২)। সংসদ কর্তৃক ওই অর্থবিল পাস হলে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হলে ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি প্রদান করবেন।

ব্যক্তিগত জীবনে রোগবালাই-মামলা-মোকদ্দমা-দুর্ঘটনা-মৃত্যুসহ বিবিধ কারণে যেমন ‘আপদ’ নেমে আসে, রাষ্ট্রীয় জীবনেও মাঝে মাঝে এ রকম অনাকাক্সিক্ষত ‘আপদ’ নেমে আসে। বহিরাক্রমণ, ব্যাপক অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, সন্ত্রাস প্রভৃতির কারণে যদি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১৪১ক(১) অনুচ্ছেদের আলোকে সারা দেশে বা দেশের কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় অনধিক ১২০ দিনের জন্য জরুরি আইন ঘোষণা করতে পারেন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর প্রয়োজন হবে। জরুরি অবস্থা জারি থাকাকালীন কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার রহিত করা হয়।

The Presidents (Remuneration and privileges) Act 1975 ১৯৭৫ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির সুযোগ-সুবিধা ব্যাপক। তিনি সরকারি বাড়িতে থাকবেন। তার আসবাবপত্র সাজসজ্জা সব সরকারের। যদি তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে ইচ্ছুক হন, তাহলে সে বাড়িটিকেও এমনভাবে সুসজ্জিত করতে হবে, যা সরকারি আবাসনের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, টেলিফোন বিলসহ যাবতীয় বিল সরকারের।

রাষ্ট্রপতিকে সর্বাপেক্ষা উন্নতমানের ও নিরাপদ পরিবহন সুবিধা দেওয়া হবে। স্থল, জল ও আকাশপথে তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রপতির ব্যবহৃত গাড়ির কোনো লাইসেন্স প্লেট নেই। গাড়ির সম্মুখে-পশ্চাতে রাষ্ট্রপতি মনোগ্রাম সংযোজন করা থাকে। রাষ্ট্রপতি গাড়িতে আরোহন করলে গাড়ির সম্মুখে রাষ্ট্রপতির পতাকা ও জাতীয় পতাকা উড্ডীন থাকে। জলপথে ও আকাশপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

রাষ্ট্রপতির নিজ পরিবারের সব ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করবে। পরিবার বলতে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা ও তার ওপর নির্ভরশীল অবিবাহিত ভাইবোনকে বোঝাবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দেশি-বিদেশি অতিথি আপ্যায়নের সব ব্যয়ভার রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বঙ্গভবনের সবুজ চত্বরে বৈকালিক চা-পানের আয়োজন করেন। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা, স্পিকার, প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিরা, সামরিক-বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ক্রীড়াবিদ, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশে বেড়াতে এলে রাষ্ট্রপতি তাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান।

রাষ্ট্রপতিকে কোনো আয়কর দিতে হয় না (রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রপতি পদ-সংশ্লিষ্ট পদের প্রাপ্য সব আয়ের ওপর কোনো আয়কর দিতে হয় না)। তবে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থাকলে তার ওপর কর দিতে হবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার কর, ভ্যাট, শুল্ক, ডেভেলপমেন্ট সারচার্জ প্রযোজ্য হবে না। রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার দেশে সর্বোচ্চ উন্নত চিকিৎসা এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিদেশে রাষ্ট্রীয় খরচে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা পাবেন।

ক্ষমা ও ক্ষমতা একই বৃন্তের দুটি ফুল। যার ক্ষমতা থাকে তিনিই ক্ষমা করতে পারেন। দুর্বলের ক্ষমা করার সুযোগ নেই। গরিবের যেমন ভিক্ষা দেওয়ার তৌফিক নেই। তাই আমাদের রাষ্ট্রপতির বিচারিক ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করছে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রাণভিক্ষা প্রদান-সংক্রান্ত সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদটি। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দ-দান স্থগিতকরণ ((Reprieves)) দ-দানে বিরতি প্রদান (Respites ক্ষমা করা ((Remit)) এবং সর্বোপরি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিকে রাষ্ট্রপতি বরাবরে স্বহস্তে লিখিত প্রাণভিক্ষার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জগতের সবচেয়ে মূল্যবান ভিক্ষা (প্রাণভিক্ষা) প্রদানের অধিকার রাষ্ট্রপতিকে প্রদান করা হয়েছে। এটাকেই বলা হয় Pardoning power or the prerogative of mercy(দ-িত অপরাধীকে ক্ষমা করার অধিকার)।

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২২তম রাষ্ট্রপতি। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালনগর গ্রামে ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি। তার বাবা হাজী মো. তৈয়ব (মরহুম) এবং মা তমিজা খাতুন (মরহুমা)। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আবদুল হামিদ ‘ভাটির শার্দুল’ নামে অধিক পরিচিত। জীবনের কোনো নির্বাচনে তিনি পরাজয় বরণ করেননি। পর পর সাতটি সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়ী হন।

তিনি সপ্তম জাতীয় সংসদে ১৩ জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১০ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ১২ জুলাই ২০০১ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০০১ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। ১ নভেম্বর ২০০১ থেকে ২৭ অক্টোবর ২০০৬ পর্যন্ত তিনি অষ্টম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত নবম জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল মো. আবদুল হামিদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সহজ-সরল সাধারণ বাঙালির তিনি মূর্ত প্রতিচ্ছবি। তার জীবনাচারে এ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের গর্বিত জনক। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদক ২০১৩ প্রদান করা হয়। আমরা তার সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি।
রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান এবং ক্ষমতাধর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য-অহংকারের প্রতীক। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার আর কোনো দল-সংগঠন থাকে না। তিনি আর সংসদ সদস্যও থাকেন না। তার বিশাল হৃদয়ের ক্যানভাসে তখন গোটা বাংলাদেশ ও ষোল কোটি জনগণ। প্রজাতন্ত্রের সব সচেতন নাগরিকের কর্তব্য তার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা।

যেজন্য শিশুদের পাঠ্যক্রমে প্রথম থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশের রাষ্ট্রপতিদের নাম অন্তর্র্ভুক্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, নামের আগে কততম রাষ্ট্রপতি, সে সংখ্যাটিও উল্লেখ থাকে। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে রাজধানীর একটি ইংলিশ স্কুলের নবম/দশম শ্রেণির কয়েক শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম জিজ্ঞেস করলে তারা বলতে পারেনি। তবে যথার্থই বারাক ওবামার নাম বলতে পেরেছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হয়! এ দুর্ভাগ্য থেকে জাতি মুক্তি পাক এটাই প্রত্যাশা।

আমিনুল ইসলাম মিলন সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

মহামান্য রাষ্ট্রপতি

আপডেট টাইম : ০৪:২৩ পূর্বাহ্ন, শনিবার, ৬ জানুয়ারী ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান এবং ক্ষমতাধর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য-অহংকারের প্রতীক। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার আর কোনো দল-সংগঠন থাকে না। তিনি আর সংসদ সদস্যও থাকেন না। তার বিশাল হৃদয়ের ক্যানভাসে তখন গোটা বাংলাদেশ ও ষোল কোটি জনগণ। প্রজাতন্ত্রের সব সচেতন নাগরিকের কর্তব্য তার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা রাজ্য থাকলে রাজা থাকবেন।

রাষ্ট্র থাকলে রাষ্ট্রপতি থাকবেন। দেশে দেশে, যুগে যুগে রাজার নানা রকম নামকরণ হয়েছে। রাজা-বাদশাহ-সম্রাট-খলিফা-সুলতান কত পদবি। সময়ের বিবর্তনে রাজ্য পরিচালনার পদ্ধতি বা কাঠামো পরিবর্তিত হয়েছে। রাজতন্ত্র থেকে গণতন্ত্র। কখনও কখনও সামরিক শাসনে ভিন্ন ব্যবস্থা দেখা যায়। রাজতন্ত্রে রাজা বংশানুক্রমিক বা গদিনশিন সূত্রে রাজা হন। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে রাষ্ট্রপ্রধান দুইভাবে নির্বাচিত হন। যদি রাষ্ট্রপতি শাসিত সরকার থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতি জনগণের প্রত্যক্ষ ভোটে নির্বাচিত হন। আর যদি সংসদীয় পদ্ধতির সরকার থাকে তাহলে রাষ্ট্রপতি জনপ্রতিনিধিদের ভোটে নির্বাচিত হন। বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি বর্তমান আইন অনুযায়ী জাতীয় সংসদের সদস্যদের দ্বারা নির্বাচিত (অনুচ্ছেদ ৪৮(১)। প্রধানমন্ত্রী সরকারপ্রধান।

রাষ্ট্রপ্রধানকে রাষ্ট্রপতি বলা হয় কেন? ইংরেজি President শব্দের বাংলাকরণ কে করেছে জানি না। তবে নামকরণটি যথাথই সঠিক। রাষ্ট্রের প্রধান যদি রাষ্ট্রের পতি হন তাহলে রাষ্ট্র কি স্ত্রী লিঙ্গ? অবশ্যই রাষ্ট্র বা দেশ হচ্ছে প্রিয় মাতৃভূমি-জন্মভূমি মা-জননী। এ ভূমিই জন্ম দেয় তার নাগরিকদের। তার উদরেই ফলে সোনার ফসল, যা খেয়ে-পরে বেঁচে থাকে তার সন্তানরা। আমাদের মাতৃভূমিকে স্বাধীন করতে ১৯৭১ সালে ৩০ লাখ মুক্তিযোদ্ধা প্রাণ দিয়েছিলেন। ইজ্জত-আব্রু গেছে ২ লাখ মা-বোনের।

মাতৃভূমির নিরাপত্তা রক্ষায় সর্বদাই সচেষ্ট থাকে আমাদের বীর সেনা-নৌ-বিমানবাহিনী। মাকে চারদিকে ঘিরে রাখে আমাদের সীমান্তরক্ষী বাহিনী (বিজিবি)। মাতৃভূমির সাফল্য জাতির সাফল্য, জনগণের সাফল্য। তাই ক্রিকেটে যখন বাংলাদেশ জিতে, তখন দল-মত-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে নারী-পুরুষ-বৃদ্ধ-শিশু নেচে-গেয়ে ওঠে। আনন্দে আত্মহারা হয় সারা দেশ। উৎসবের আমেজে রঙিন হয়ে ওঠে পরিবেশ। আবার বন্যা-বানভাসি-সন্ত্রাস-জঙ্গি হামলা হলে মায়ের মুখখানি মলিন হয়ে পড়ে। আমাদের জাতীয় সংগীতই বলে দেয়, ‘মা তোর বদনখানি মলিন হলে আমি নয়ন জলে ভাসি।’ তাই সন্তানদের উচিত মায়ের বদন যেন কখনোই মলিন না হয়।

দেশ স্বাধীন হওয়ার পর প্রথম যে কাজটিতে হাত দিতে হয়, তা হলো দেশ কীভাবে চলবে তার জন্য একটি কিতাব রচনা করা। জনপ্রতিনিধিদের মাধ্যমে জনগণই মূলত এ কিতাবের রচয়িতা। এ কিতাবে রাষ্ট্র পরিচালনাসহ খুঁটিনাটি সব বিষয়ের উল্লেখ থাকে। এ কিতাব রচনা হওয়ার পরে আবার জনপ্রতিনিধিদের দ্বারা তা অনুমোদন করিয়ে নিতে হয়। এ কিতাবই হলো আমাদের সংবিধান। এ কিতাব সহজে পরিবর্তনীয় নয়। এ কিতাবের বিধান অলঙ্ঘনীয়। তবে বিশেষ অবস্থার পরিপ্রেক্ষিতে এ কিতাবের শরীরে ছোটখাটো অপারেশন করা যেতে পারে। যাকে বলে সংশোধনী।

দুই-তৃতীয়াংশ জনপ্রতিনিধির সম্মতিতে তা হয়ে থাকে। আমাদের প্রিয় সংবিধানে এরই মধ্যে বেশকিছু মেজর-মাইনর অপারেশন হয়েছে। না করে উপায় ছিল না। রাজা তার রাজ্য পরিচালনার জন্য কিছু কিছু আইন-বিধিবিধান তৈরি করেন। আগের দিনের রাজারা স্বীয় মেধা, প্রজ্ঞা ও পারিষদদের সঙ্গে আলোচনাপূর্বক তা নির্ধারণ করতেন। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্রে এসব আইনকানুন প্রণয়নের জন্য একটি আইনসভা থাকে। বাংলাদেশের আইনসভার নাম জাতীয় সংসদ। সংবিধানের ৬৫(১) অনুচ্ছেদ জাতীয় সংসদ গঠন ও এর আইন প্রণয়ন ক্ষমতাকে স্বীকৃতি দেয়।

সংবিধানের ৭২(১) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে সংসদ আহ্বান, স্থগিত ও ভঙ্গ করার এখতিয়ার প্রদান করে। বর্তমানে জাতীয় সংসদের সদস্য সংখ্যা ৩০০ জন এবং সংরক্ষিত আসনে মহিলা সদস্য ৫০ জন। তাদের সংসদ সদস্য বলা হয়। একক আঞ্চলিক নির্বাচনী এলাকাগুলো থেকে জনগণ দ্বারা প্রত্যক্ষ নির্বাচনের মাধ্যমে ৩০০ জন সদস্য নির্বাচিত হন।

সংবিধান অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি দেশের প্রথম ও প্রধান ব্যক্তি। সবকিছুর ঊর্ধ্বে তার স্থান। যতই সংসদীয় পদ্ধতির সরকার হোক না কেন, তার সম্মতি সবক্ষেত্রে অপরিহার্য। সামরিক-বেসামরিক কর্মকর্তা পর্যায়ের সব নিয়োগ-পদোন্নতি-বরখাস্ত তার অনুমোদনে হয়। বিদেশের সঙ্গে চুক্তি করবেন তা-ও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগবে। বিদেশি রাষ্ট্র থেকে কোনো সম্মান, পুরস্কার, খেতাব বা ভূষণ গ্রহণ করতেও রাষ্ট্রপতির অনুমোদন লাগবে (অনুচ্ছেদ ৩০)।

রাষ্ট্রপতি দেশের সব সরকারি ও বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের আচার্য বা Chancellor এর দায়িত্ব পালন করবেন। সংসদ আহ্বানের এখতিয়ার রাষ্ট্রপতির। সাধারণ নির্বাচনের পর প্রথম অধিবেশনের সূচনালগ্নে এবং প্রতি বছরের শুরুতে প্রথম অধিবেশনের সূচনায় তিনি সংসদের মাধ্যমে জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন (অনুচ্ছেদ ৭৩(২)। তার ভাষণের ওপর সংসদ সদস্যরা আলোচনা করেন। সংসদ কর্তৃক প্রণীত সব বিল তার অনুমোদনের পর আইন হিসেবে বলবৎ হবে।

তবে রাষ্ট্রপতি যদি কোনো বিলে স্বাক্ষর না করে সংসদে ফেরত পাঠান তবে বিলটি সংসদে ফের আলোচিত হবে। এভাবে দুইবার প্রত্যাখ্যানের পর তৃতীয়বারে বিলটিতে রাষ্ট্রপতি সম্মতিদান করেছেন বলে গণ্য হবে এবং তা সংসদে আইন হিসেবে অভিহিত হবে। যখন সংসদ অধিবেশন বন্ধ থাকে, তখন জরুরি প্রয়োজনে রাষ্ট্রপতি নিজ ক্ষমতাবলে অধ্যাদেশ জারি করতে পারেন (অনুচ্ছেদ ৯৩ (১), যা সংসদের পরবর্তী অধিবেশনে পাস করিয়ে নিতে হয়। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতাবলে রাষ্ট্রপতি বলীয়ান।

সংবিধানই রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উৎস। তবে সংবিধানের ৫৬ অনুচ্ছেদের (৩) অনুসারে শুধু প্রধানমন্ত্রী ও ৯৫ অনুচ্ছেদের ১ দফা অনুসারে প্রধান বিচারপতি নিয়োগের ক্ষেত্র ব্যতীত রাষ্ট্রপতি তার সব দায়িত্ব পালনে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী কাজ করবেন। তবে শর্ত থাকে যে, প্রধানমন্ত্রী রাষ্ট্রপতিকে আদৌ কোনো পরামর্শদান করেছেন কি না এবং করে থাকলে কী পরামর্শদান করেছেন, কোনো আদালত সে সম্পর্কে কোনো প্রশ্নের তদন্ত করতে পারবে না (অনুচ্ছেদ ৪৮(৩)। সবাই কি রাষ্ট্রপতি হতে পারেন? না।

রাষ্ট্রপতি হতে হলে তার বয়স অন্যূন ৩৫ বছর হতে হবে। কোনো বালক রাষ্ট্রপতি হতে পারবে না। তাকে জাতীয় সংসদের সদস্য হওয়ার মতো যোগ্যতাসম্পন্ন হতে হবে। সংবিধানে প্রণীত ধারামতে, আগে রাষ্ট্রপতি পদ থেকে ইমপিচমেন্টের মাধ্যমে অপসারিত ব্যক্তি ফের রাষ্ট্রপতি হতে পারবেন না (অনুচ্ছেদ ৪৮(৪)। রাষ্ট্রপতি পদের মেয়াদ ৫ বছর, তবে এক্ষেত্রে পরবর্তী রাষ্ট্রপতি শপথ নেওয়ার আগে পর্যন্ত তিনি রাষ্ট্রপতি পদে আসীন থাকতে পারবেন (অনুচ্ছেদ ৫০(১)। দুইবারের বেশি কেউ রাষ্ট্রপতি পদে আসীন হতে পারবেন না (অনুচ্ছেদ ৫০(২)।

রাষ্ট্রপতি যদি ব্যক্তিগত কারণে পদত্যাগ করার ইচ্ছে পোষণ করেন, তাহলে তিনি স্পিকারের উদ্দেশে স্বাক্ষরযুক্ত পত্রযোগে পদত্যাগ করতে পারবেন (অনুচ্ছেদ ৫০(৩)। সংবিধানের ৫২ অনুচ্ছেদের হানি না ঘটিয়ে সংবিধানের ৫১(১) অনুচ্ছেদে রাষ্ট্রপতির দায়মুক্তির বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণ ব্যতীত রাষ্ট্রপতিকে স্বীয় কার্যের জন্য দায়ী করা যাবে না বা কোনো আদালতে জবাবদিহি করতে হবে না। তবে এ ধারা সরকারের বিরুদ্ধে কার্যধারা গ্রহণে কোনো ব্যক্তির অধিকার ক্ষুণ করবে না (অনুচ্ছেদ ৫১(১)।

রাষ্ট্রপতির কার্যভারকালে তার বিরুদ্ধে কোনো আদালতে কোনো প্রকার ফৌজদারি কার্যধারা দায়ের করা বা চালু রাখা যাবে না এবং তাকে গ্রেফতার বা কারাবাসের জন্য কোনো আদালত থেকে পরোয়ানা জারি করা যাবে না (অনুচ্ছেদ ৫১(২)। শারীরিক বা মানসিক অসামর্থ্যরে কারণে রাষ্ট্রপতিকে তার পদ থেকে অপরাসরণের লক্ষ্যে জাতীয় সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের স্বাক্ষরিত প্রস্তাবের নোটিশ স্পিকারের কাছে প্রেরণ করতে হবে (অনুচ্ছেদ ৫৩(১)। এছাড়া সংবিধান লঙ্ঘন বা গুরুতর অসদাচরণের অভিযোগে সংসদের সংখ্যাগরিষ্ঠ সদস্যের লিখিত ও স্বাক্ষরযুক্ত অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে রাষ্ট্রপতিকে অভিশংসিত করা যেতে পারে (অনুচ্ছেদ ৫২(১)।

যদিও বাংলাদেশের কোনো রাষ্ট্রপতিকে এ পর্যন্ত ইমপিচমেন্টের বা অভিশংসনের মোকাবিলা করতে হয়নি। তবে স্বেচ্ছায় পদত্যাগের একটি নজির রয়েছে। যদি কোনো দৈবদুর্বিপাকে রাষ্ট্রপতি পদ শূন্য হয় অথবা রাষ্ট্রপতির অসুস্থতা, অনুপস্থিতি বা অন্য কোনো কারণে রাষ্ট্রপতি পদ সাময়িকভাবে শূন্য থাকে, তাহলে সে শূন্যস্থান পূরণের জন্য সংবিধানের শর্তানুযায়ী জাতীয় সংসদের স্পিকার রাষ্ট্রপতির পদের সাময়িক দায়িত্ব পালন করবেন।

সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতির ক্ষমতার উৎস দুইটি এক. সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা, দুই. অন্য কোনো আইন দ্বারা প্রদত্ত ক্ষমতা। সংবিধান প্রদত্ত ক্ষমতা আবার পাঁচভাগে বিভক্ত ১. নির্বাহী ক্ষমতা, ২. আইন প্রণয়নবিষয়ক ক্ষমতা, ৩. অর্থবিষয়ক ক্ষমতা, ৪. বিচার বিভাগ সম্পর্কিত ক্ষমতা, ৫. বিবিধ ক্ষমতা।
সংবিধানের ৪৮(২) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রের প্রধান বা পতি হিসেবে বরণ করেছে। আবার সংবিধানের ৬১ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি হবেন দেশের ‘সশস্ত্র বাহিনীর সর্বাধিনায়ক’ (Supreme Commander of the Defence Services)।

রাজ্যের সব সৈন্যসামন্ত তার অধীন। অন্যদিকে সংবিধানের ৫৫(৪) অনুচ্ছেদ সব নির্বাহী কার্যক্রম রাষ্ট্রপতির নামে গৃহীত বা সম্পন্ন হয়েছে বলে অনুমোদন দেয়। রাষ্ট্রপতি হচ্ছেন রাজা। তিনি কি সারাক্ষণ এ আদেশ, সে আদশ, এ কাজে, সে কাজে নিজেকে ব্যস্ত রাখবেন? না, তা হয় না। তাই তিনি রাষ্ট্রপতির জন্য প্রযোজ্য সব সরকারি কাজ Allocation and Transaction of the Business এর সূত্রে নির্বাহী আদেশবলে ভাগ-বণ্টন করে দেন।

সংবিধানের ৫৫(৬) অনুচ্ছেদ রাষ্ট্রপতিকে এ ক্ষমতা প্রদান করেছে। দেশে নির্বাচন হলে, যে দল সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়, তাদের সংসদীয় দলের প্রধান রাষ্ট্রপতি বরাবরে সশরীরে হাজির হয়ে দালিলিক প্রমাণসহ অভিপ্রায় ব্যক্ত করবেন যে, তিনি সংসদের বেশিরভাগ সদস্যের দ্বারা সমর্থিত ও নির্বাচিত এবং মহামান্য রাষ্ট্রপতির কাছে ওই সংসদ সদস্যকে সংখ্যাগরিষ্ঠদের আস্থাভাজন বলে প্রতীয়মান হলে তিনি তাকে প্রধানমন্ত্রী পদে নিয়োগদান করতে পারেন (অনুচ্ছেদ ৫৬(৩)। এছাড়া সংবিধানের ৫৬(২) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রী, অন্যান্য মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রী, উপমন্ত্রীকে নিয়োগদান করবেন।

তবে শর্ত থাকে যে, তাদের সংখ্যার নয়-দশমাংশ সংসদ সদস্যের মধ্য থেকে নিযুক্ত হবেন এবং অনধিক এক-দশমাংশ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হওয়ার যোগ্য ব্যক্তিদের মধ্য থেকে মনোনীত হতে পারবেন, যাকে আমরা Technocrat Quota বলে থাকি। অনুরূপভাবে রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীর সুপারিশে অ্যাটর্নি জেনারেল, সুপ্রিমকোর্টের বিচারপতি, প্রধান নির্বাচন কমিশনার, নির্বাচন কমিশনার, মহাহিসাব নিরীক্ষক বা Auditor General,, সরকারি কর্মকমিশনের চেয়ারম্যান ও সদস্যদের নিয়োগদান করেন (ধারা ৬৪, ৯৫, ১১৮(১), ১২৭(১) ও ১৩৮(১)।

সংবিধানের ৯৫(১) অনুচ্ছেদ অনুযায়ী রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রধান বিচারপতি পদে নিয়োগদান করবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শপূর্বক অন্য বিচারকদের নিয়োগদান করবেন। রাষ্ট্রপতি প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সব সদস্য ও সাংবিধানিক পদে অধিষ্ঠিতদের শপথবাক্য পাঠ করান। বিভিন্ন জাতীয় দিবসের কুচকাওয়াজে রাষ্ট্রপতি সালাম গ্রহণ করেন। আমাদের দেশে নিযুক্ত বিভিন্ন দেশের দূতদের তার কাছেই প্রথমে পরিচয়পত্র পেশ করতে হয়।

বিদেশি দূতদের তাই রাজবাড়ির প্রবেশপথ থেকেই (বঙ্গভবনের প্রধান ফটক) সুসজ্জিত ঘোড়-সওয়ার বাহিনী দ্বারা স্কট করে নির্ধারিত মঞ্চে উপস্থিত করতে হয়। এ সময় রাষ্ট্রপতি উপস্থিত থাকেন। তার সম্মানে গার্ড অব অনার দেওয়া হয়। পরে রাষ্ট্রপতি আনুষ্ঠানিকভাবে তার পরিচয়পত্র (Credential) গ্রহণ করেন।
আগের দিনের রাজারা যেমন মর্জি-মাফিক অর্থ ব্যয় করতে পারতেন, গণতান্ত্রিক ব্যবস্থাপনায় রাষ্ট্রপতির সে ক্ষমতা নেই। তবে সব অর্থবিল সংসদে উপস্থাপনের আগে রাষ্ট্রপতির সম্মতির প্রয়োজন রয়েছে (অনুচ্ছেদ ৮২)। সংসদ কর্তৃক ওই অর্থবিল পাস হলে এবং রাষ্ট্রপতির কাছে উপস্থাপন করা হলে ১৫ দিনের মধ্যে রাষ্ট্রপতি তাতে সম্মতি প্রদান করবেন।

ব্যক্তিগত জীবনে রোগবালাই-মামলা-মোকদ্দমা-দুর্ঘটনা-মৃত্যুসহ বিবিধ কারণে যেমন ‘আপদ’ নেমে আসে, রাষ্ট্রীয় জীবনেও মাঝে মাঝে এ রকম অনাকাক্সিক্ষত ‘আপদ’ নেমে আসে। বহিরাক্রমণ, ব্যাপক অভ্যন্তরীণ গোলযোগ, সন্ত্রাস প্রভৃতির কারণে যদি রাষ্ট্রের স্বাভাবিক কার্যক্রম ব্যাহত হয়, জনজীবন বিপর্যস্ত হয়, তাহলে রাষ্ট্রপতি সংবিধানের ১৪১ক(১) অনুচ্ছেদের আলোকে সারা দেশে বা দেশের কোনো নির্দিষ্ট এলাকায় অনধিক ১২০ দিনের জন্য জরুরি আইন ঘোষণা করতে পারেন। তবে শর্ত থাকে যে, অনুরূপ ঘোষণার বৈধতার জন্য ঘোষণার আগেই প্রধানমন্ত্রীর প্রতিস্বাক্ষর প্রয়োজন হবে। জরুরি অবস্থা জারি থাকাকালীন কিছু কিছু ক্ষেত্রে মৌলিক অধিকার রহিত করা হয়।

The Presidents (Remuneration and privileges) Act 1975 ১৯৭৫ অনুযায়ী, রাষ্ট্রপতির সুযোগ-সুবিধা ব্যাপক। তিনি সরকারি বাড়িতে থাকবেন। তার আসবাবপত্র সাজসজ্জা সব সরকারের। যদি তিনি নিজ বাড়িতে অবস্থান করতে ইচ্ছুক হন, তাহলে সে বাড়িটিকেও এমনভাবে সুসজ্জিত করতে হবে, যা সরকারি আবাসনের ক্ষেত্রে করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিল, গ্যাস বিল, টেলিফোন বিলসহ যাবতীয় বিল সরকারের।

রাষ্ট্রপতিকে সর্বাপেক্ষা উন্নতমানের ও নিরাপদ পরিবহন সুবিধা দেওয়া হবে। স্থল, জল ও আকাশপথে তা নিশ্চিত করতে হবে। রাষ্ট্রপতির ব্যবহৃত গাড়ির কোনো লাইসেন্স প্লেট নেই। গাড়ির সম্মুখে-পশ্চাতে রাষ্ট্রপতি মনোগ্রাম সংযোজন করা থাকে। রাষ্ট্রপতি গাড়িতে আরোহন করলে গাড়ির সম্মুখে রাষ্ট্রপতির পতাকা ও জাতীয় পতাকা উড্ডীন থাকে। জলপথে ও আকাশপথে ভ্রমণের ক্ষেত্রেও তা প্রযোজ্য।

রাষ্ট্রপতির নিজ পরিবারের সব ব্যয়ভার রাষ্ট্র বহন করবে। পরিবার বলতে রাষ্ট্রপতির স্ত্রী, সন্তান, মা-বাবা ও তার ওপর নির্ভরশীল অবিবাহিত ভাইবোনকে বোঝাবে। রাষ্ট্রপতি কর্তৃক দেশি-বিদেশি অতিথি আপ্যায়নের সব ব্যয়ভার রাষ্ট্রের। রাষ্ট্রপতি স্বাধীনতা দিবস, বিজয় দিবসসহ বিভিন্ন জাতীয় দিবসে বঙ্গভবনের সবুজ চত্বরে বৈকালিক চা-পানের আয়োজন করেন। প্রধানমন্ত্রীসহ মন্ত্রিসভার সদস্যরা, স্পিকার, প্রধান বিচারপতিসহ বিচারপতিরা, সামরিক-বেসামরিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা, মুক্তিযোদ্ধা, ব্যবসায়ী, শিক্ষক, ক্রীড়াবিদ, কবি-সাহিত্যিক-শিল্পীসহ সমাজের বিভিন্ন পেশার বিশিষ্টজনদের অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানানো হয়। বিদেশি কোনো রাষ্ট্রপ্রধান বাংলাদেশে বেড়াতে এলে রাষ্ট্রপতি তাকে নৈশভোজে আমন্ত্রণ জানান।

রাষ্ট্রপতিকে কোনো আয়কর দিতে হয় না (রাষ্ট্রপতিকে রাষ্ট্রপতি পদ-সংশ্লিষ্ট পদের প্রাপ্য সব আয়ের ওপর কোনো আয়কর দিতে হয় না)। তবে রাষ্ট্রপতির ব্যক্তিগত কোনো ব্যবসায়িক প্রতিষ্ঠান থাকলে তার ওপর কর দিতে হবে। রাষ্ট্রপতির ক্ষেত্রে কোনো প্রকার কর, ভ্যাট, শুল্ক, ডেভেলপমেন্ট সারচার্জ প্রযোজ্য হবে না। রাষ্ট্রপতি ও তার পরিবার দেশে সর্বোচ্চ উন্নত চিকিৎসা এবং প্রয়োজন হলে চিকিৎসকের পরামর্শ অনুযায়ী বিদেশে রাষ্ট্রীয় খরচে উন্নত চিকিৎসা সুবিধা পাবেন।

ক্ষমা ও ক্ষমতা একই বৃন্তের দুটি ফুল। যার ক্ষমতা থাকে তিনিই ক্ষমা করতে পারেন। দুর্বলের ক্ষমা করার সুযোগ নেই। গরিবের যেমন ভিক্ষা দেওয়ার তৌফিক নেই। তাই আমাদের রাষ্ট্রপতির বিচারিক ক্ষমতার শীর্ষবিন্দুতে অবস্থান করছে রাষ্ট্রপতি কর্তৃক প্রাণভিক্ষা প্রদান-সংক্রান্ত সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদটি। সংবিধানের ৪৯ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী দ-দান স্থগিতকরণ ((Reprieves)) দ-দানে বিরতি প্রদান (Respites ক্ষমা করা ((Remit)) এবং সর্বোপরি কোনো আদালত, ট্রাইব্যুনাল বা অন্য কোনো কর্তৃপক্ষ কর্তৃক মৃত্যুদ-প্রাপ্ত আসামিকে রাষ্ট্রপতি বরাবরে স্বহস্তে লিখিত প্রাণভিক্ষার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে জগতের সবচেয়ে মূল্যবান ভিক্ষা (প্রাণভিক্ষা) প্রদানের অধিকার রাষ্ট্রপতিকে প্রদান করা হয়েছে। এটাকেই বলা হয় Pardoning power or the prerogative of mercy(দ-িত অপরাধীকে ক্ষমা করার অধিকার)।

বাংলাদেশের প্রথম রাষ্ট্রপতি জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান। বর্তমান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ ২২তম রাষ্ট্রপতি। তিনি একজন বীর মুক্তিযোদ্ধা। তার জন্ম কিশোরগঞ্জ জেলার মিঠামইন উপজেলার কামালনগর গ্রামে ১৯৪৪ সালের ১ জানুয়ারি। তার বাবা হাজী মো. তৈয়ব (মরহুম) এবং মা তমিজা খাতুন (মরহুমা)। বর্ণাঢ্য রাজনৈতিক জীবনের অধিকারী আবদুল হামিদ ‘ভাটির শার্দুল’ নামে অধিক পরিচিত। জীবনের কোনো নির্বাচনে তিনি পরাজয় বরণ করেননি। পর পর সাতটি সংসদ নির্বাচনে তিনি জয়ী হন।

তিনি সপ্তম জাতীয় সংসদে ১৩ জুলাই ১৯৯৬ থেকে ১০ জুলাই ২০০১ পর্যন্ত ডেপুটি স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। পরে তিনি ১২ জুলাই ২০০১ থেকে ২৮ অক্টোবর ২০০১ পর্যন্ত জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন। ১ নভেম্বর ২০০১ থেকে ২৭ অক্টোবর ২০০৬ পর্যন্ত তিনি অষ্টম জাতীয় সংসদের বিরোধীদলীয় উপনেতার দায়িত্ব পালন করেন। তিনি ২০০৯ থেকে ২০১৩ পর্যন্ত নবম জাতীয় সংসদের স্পিকারের দায়িত্ব পালন করেন।

২০১৩ সালের ২৪ এপ্রিল মো. আবদুল হামিদ গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতি পদের দায়িত্ব গ্রহণ করেন। সহজ-সরল সাধারণ বাঙালির তিনি মূর্ত প্রতিচ্ছবি। তার জীবনাচারে এ দেশের ৮০ শতাংশ মানুষের প্রতিচ্ছবি ফুটে ওঠে। তিনি স্ত্রী, তিন ছেলে ও এক কন্যাসন্তানের গর্বিত জনক। দেশের স্বাধীনতা ও মুক্তিযুদ্ধে অসামান্য অবদানের জন্য তাকে সর্বোচ্চ বেসামরিক পদক স্বাধীনতা পদক ২০১৩ প্রদান করা হয়। আমরা তার সুস্থতা এবং দীর্ঘায়ু কামনা করি।
রাষ্ট্রপতি দেশের সর্বোচ্চ সম্মান এবং ক্ষমতাধর গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। তিনি রাষ্ট্রের স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্ব ও জাতীয় ঐক্য-অহংকারের প্রতীক। রাষ্ট্রপতি নির্বাচিত হওয়ার পর তার আর কোনো দল-সংগঠন থাকে না। তিনি আর সংসদ সদস্যও থাকেন না। তার বিশাল হৃদয়ের ক্যানভাসে তখন গোটা বাংলাদেশ ও ষোল কোটি জনগণ। প্রজাতন্ত্রের সব সচেতন নাগরিকের কর্তব্য তার সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান রাখা।

যেজন্য শিশুদের পাঠ্যক্রমে প্রথম থেকে ধারাবাহিকভাবে দেশের রাষ্ট্রপতিদের নাম অন্তর্র্ভুক্ত করা হয়। শুধু তাই নয়, নামের আগে কততম রাষ্ট্রপতি, সে সংখ্যাটিও উল্লেখ থাকে। সম্প্রতি একটি টেলিভিশন চ্যানেলে রাজধানীর একটি ইংলিশ স্কুলের নবম/দশম শ্রেণির কয়েক শিক্ষার্থীকে বাংলাদেশের রাষ্ট্রপতির নাম জিজ্ঞেস করলে তারা বলতে পারেনি। তবে যথার্থই বারাক ওবামার নাম বলতে পেরেছে। এর চেয়ে দুর্ভাগ্য আর কী হয়! এ দুর্ভাগ্য থেকে জাতি মুক্তি পাক এটাই প্রত্যাশা।

আমিনুল ইসলাম মিলন সাবেক প্রধান তথ্য কর্মকর্তা