রোল অব কনফ্লিক্ট দেখেছিলাম, ঋতুপর্ণ ঘোষের উনিশে এপ্র্র্রিল-এ। শ্রাস্ত্রীয় নাচের শিল্পী সরোজীনির (অপর্ণা সেন) কাছে নাচটা শুধুই পারফর্মিং আর্টস নয়, প্রার্থনার মতো। আসলে প্রার্থনাও কম বলা হয়; এটা হলো তার প্যাশন, আবেগমিশ্রিত ভালোবাসা এই শিল্পের প্রতি। সরোজীনির স্বামী এসব নিয়ে চিল্লাপাল্লা করে না সরোজীনির সাথে, আজকালকার “আধুনিক” পুরুষরা তা করেও না। কিন্তু মানসিকভাবে অসহযোগিতা করতে করতে তাকে খাদের কিনারে নিয়ে যায়। একসময় নাচ ছেড়েও দিতে চায় সরোজীনি। স্বামীকে বলে, “দ্যাখো এটা তো সাধনার বিষয়, এইযে আমি নাচটা ছাড়বো এর জন্য মানসিক শক্তি দরকার, পার্টনার হিসেবে সেই সহযোগিতাটা তুমি কর।”
সরোজীনির স্বামী মুখ আমসি করে রেখেছিল। সংসার আসলে তাকে নেয়নি আনন্দের সাথে। সরোজীনি নাচ ছাড়েনি। স্বামীও নয়, একসময় সমস্যা হয়ে দাঁড়ায় একমাত্র কন্যা মিঠু (দেবশ্রি রায়)। মিঠু দেখে তার মা নাচ নিয়ে ব্যস্ত, বাবা এই বিষয়টা পছন্দ করছে না বলে মা-বাবার সম্পর্ক ভালো না, সর্বোপরি তাকে সময় বেশি দিচ্ছে বাবা।
মিঠুকে দেখাশোনা করে বাড়ির পরিচারিকা। বলতে গেলে তার কাছেই মানুষ। তার সাথেই সমস্ত বোঝাপড়া মিঠুর। বুঝতে শেখার পর থেকেই মায়ের প্রতি একধরনের অসূয়া বোধ করে মিঠু। তার বাবা যখন হঠাৎ অসুস্থ হয়ে মারা যায়, মা সরোজীনি তখন নাচের একটা শো করতে আরেক শহরে। সেই থেকে মার কাছ থেকে আরও দূরে সরার শুরু মিঠুর। মাকে সে রীতিমতো অপছন্দ করতে শুরু করে। সরোজীনির জীবন কিন্তু বহমান। সে নাচটাকে আরও গভীরভাবে আঁকড়ে ধরে, নাচের স্কুল চালায়, মেয়েকে ডাক্তারি পড়ায়। আর তার আছে বহুমাত্রিক সম্পর্কের বন্ধু সোমনাথ ( দীপক দে)। আর মিঠু তার বাবার মৃত্যুর জন্য মনে মনে দায়ী করে মাকে। মিঠু তখন সংসারে থেকেও অনেক দূরের হয়ে যায়।
সিনেমায় অপর্না সেন তথা সরোজীনির সেই অমোঘ উচ্চারণ মনে পড়ে, “মাঝে মাঝে মনে হয় বিয়ে টিয়ে করাই আমার উচিত হয়নি মিঠু!” রোল অব কনফ্লিক্ট। একজন নারীকে কত ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে হয়। মা, স্ত্রী, তার কর্মজীবন আর যদি থাকে কোন প্যাশন তাহলেই সেরেছে। একজন পুরুষ যদি ভালো বাবা বা স্বামী হয় তো ভালো, তার সেটা এক্সট্রা গুন হিসেবে দেখা হয়, সেই পুরুষকে সবাই ধন্য ধন্য করে। কিন্তু একজন নারী এইসব ভূমিকায় নামতে বাধ্য। তা না হলে তার গায়ে ছাপ পড়বে, দায়িত্বহীন মা, সংসারে অমনোযোগী, বহির্মুখী, উচ্ছৃঙ্খল স্ত্রীলোক হিসেবে। এইসব ভাবছিলাম, সেদিন বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রের ছাদে বসে। সকাল সাতটায় অফিসে এসেছি। বিকেলে যখন বের হতে যাবো তখন হঠাৎ মিটিং। আরও একঘণ্টা পর যখন কেন্দ্রের ছাদে গেলাম ততক্ষণে বেলা পড়ে এসেছে। বাসায় আমার হাজবেন্ড নেই, অফিস ট্যুরে দেশের বাইরে। আমি আমার থেকে বয়সে ছোট কিন্তু চিন্তা করার ধরনে আর মননে বড় দুই বন্ধুর সাথে আড্ডার লোভে কেন্দ্রে গিয়েছি। স্বামী আমাকে বাসায় ফেরার জন্য তাড়া দেননি কিন্তু মনের ভেতর ঘুমন্ত মেয়ের মুখ বারবার কড়া নাড়ছিল। সেই ভোরে রেখে এসেছি, তুমুল আড্ডা আর চা সিঙ্গারার ফাঁকে আমি বারবারই অন্যমনস্ক হয়ে যাচ্ছিলাম। মেয়েটা বাসায় পরিচারিকার কাছে।
মাকে সে মিস করছে, এই মিস করাটা তার অন্যায় না।সেও সারাদিন স্যাক্রিফাইস করেছে, একা থেকেছে। মাঝে মাঝে পাগল পাগল লাগে। একদিন তো ইচ্ছে করতেই পারে আমি কারো হবো না, ইচ্ছে করতেই পারে অফিস শেষে শাহবাগে সিগারেট ফুঁকে, আড্ডা দিয়ে রিকশায় করে গায়ে হাওয়া লাগিয়ে রাত এগারোটায় বাড়ি ফিরবো। একদিন ইচ্ছা করতেই পারে একট সিনেমা বড় পর্দায় মুগ্ধ হয়ে দেখবো টানা তিনঘণ্টা। মুভি শেষে কফি খাবো রসিয়ে তারপর বাড়ি ফিরবো তাড়াহীন। পুরুষেরা কিন্তু পারে। তারা সকালে বেরিয়ে রাত ১১টায় আমি যা যা বললাম তার সবকিছু করে বাড়ি ফিরতে পারে, তার রোল অব কনফ্লিক্ট কালেভদ্রে হয়। আর মেয়েদের জন্য লাইফস্টাইল ম্যাগাজিনগুলো টাইম ম্যানেজমেন্ট শেখায়। বলে, আপনি যদি সময় ভাগ করে নেন, তাহলে সংসারও সুখের হবে, আপনার কাজও স্মুথলি চলবে।
এই ম্যানেজমেন্টের মধ্যে বন্ধুর সাথে তুমুল আড্ডা দেয়ার কোনো শিডিউল নাই, একদিন সারাদিন বই পড়ে কাটানোর কোন শিডিউল নাই, একদিন একটু আলসেমি করে কবিতা পড়ে বা মিউজিক ছেড়ে নাচার শিডিউল নাই। আমি হলফ করে বলতে পারি, আমার মতো আরও অনেক নারীরই এইরকম ইচ্ছা হয়। পুরুষেরও হয়। রোল অব কনফ্লিক্ট কিছুটা তাদেরও হয় কিন্তু সেটা রিলিজ করার জন্য সমাজ কিছু ব্যবস্থাও রেখেছে। বাচ্চাকে বাড়িতে রেখে বন্ধুদের সাথে আড্ডা দিতে একটা পুরুষের কোন অপরাধবোধের মুখোমুখি হতে হয় না, নারীকে হতে হয়। এখন আপনি বলতেই পারেন, ভুগো না অপরাধবোধে, কে তোমারে বলছে ভুগতে? না আধুনিক পার্টনাররা কখনও নারীকে কর্মক্ষেত্রে যেতে বাঁধা দ্যায় না অথবা সরোজীনির স্বামীর মতো বউয়ের সাফল্যে ঈর্ষান্বীতও হয় না। বরং সফল স্ত্রীকে নিয়ে তারা গর্ব করে। কিন্তু এই সাফল্যটা নারীকে অর্জন করার জন্য সংসারের কোথাও বিচ্যুতিও কিন্তু পুরুষরা মানবেন না। অর্থাৎ তুমি সফল হও কিন্তু তোমার ওপর অর্পিত সকল দায়িত্ব পালন করে তারপর। অর্থাৎ আজকের দিনে প্রায় প্রতিটি নারীকে সফল হতে হলে একধরনের সুপার উইম্যান হতে হয়। সব সামলে তাকে এগুতে হয়। এগুলে তাকে ধন্য ধন্য করা হয় বটে। এখন এইসব দৌড়ের মধ্যে নারীর মনের খোরাকিটা কোথায়? না কি বলবেন, যে সমাজে পুরুষের মনের স্বাস্থ্য নিয়েই ভাবার মতো সংকুলান নাই সেখানে নারীর মনের খোরাকি নিয়ে চিন্তা করাটা বিলাসিতা? নারী এবং পুরুষ দুইয়ের সমস্যা নিয়েই ভাবাটা কিন্তু সমাজের কর্তব্য। সেই কর্তব্য থেকে এই সমাজটা ক্রমশ:ই পলায়নপর হচ্ছে। আর পালাচ্ছে বলেই নতুন নতুন অদ্ভুত ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হচ্ছে।এবং মজার বিষয় হচ্ছে, সমস্যাগুলো যে তৈরি হচ্ছে তা স্বীকারই করছে না সমাজ! সমাধানের কথা ভাবা তো দূরের কথা।