ঢাকা , রবিবার, ১৭ নভেম্বর ২০২৪, ৩ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

কুটিরশিল্প বাঁচাতে হবে

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ একসময় কুটিরশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল আমাদের দেশ। এর সুনাম ছিল সারা বিশ্বে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার বিখ্যাত ‘কিতাবুল হিন্দ’ গ্রন্থে বাংলার কুটিরশিল্পের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। এ দেশের মসলিন ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। গ্রামবাংলার ললনারা চড়কায় সুতা কাটতে কাটতে গল্প করত। তখন মানুষের কোনো অভাব ছিল না।

বাংলার তাঁতশিল্পের কদর ছিল সর্বত্র। ঢাকা, নরসিংদী, রায়পুরা, ডেমরা, টাঙ্গাইল, শাহজাদপুর, বেড়া, মুরাদনগর, কুমারখালী, মাগুরা, রাজশাহী, খাদিমনগর, মীরগড়, নাসিরনগর ইত্যাদি অঞ্চল ছিল তাঁতশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।

বিভিন্ন নকশায় উৎপাদিত হতো শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, মশারি, তোয়ালে, মসলিন, জামদানি, কাতান, মলমল, খদ্দর ও উপজাতীয় বস্ত্র। বাংলার ঢাকাই শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানি, পাবনার শাড়ি আজও দেশে-বিদেশে বিখ্যাত।

তাঁতশিল্পের মতো মৃৎশিল্পেও এ অঞ্চল বিখ্যাত ছিল। ঢাকার রায়েরবাজার, কুমিল্লার বিজয়পুর, পটুয়াখালীর মদনপুরা, ফেনীর চম্পকনগর এবং শরীয়তপুরের কার্ত্তিকপুরে গড়ে উঠেছিল মৃৎশিল্প পল্লী। কুমাররা বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা, পুতুল, দেবদেবীর মূর্তি, গার্হস্থ্য দ্রব্যাদি, মাটির ভাস্কর্য, টালি, শখের হাঁড়ি, মনশাঘট ও ফুলদানি তৈরি করত। সিলেটের শীতলপাটি ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। সেখানকার মোরতা গাছের ছাল দিয়ে এই শীতলপাটি তৈরি করেন ওই অঞ্চলের কুটিরশিল্পীরা। বিভিন্ন নকশায় ফুটিয়ে তোলেন গ্রামবাংলার প্রকৃতি। লাল, নীল, সবুজ, কালো ও বেগুনি রঙের বাহার থাকে এসব নকশায়। সিলেটের রাজনগর, বালাগঞ্জ, বড়লেখা ও মোল্লার বাজারে এ শিল্পের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।

এছাড়া নোয়াখালীর সোনাগাজী ও রায়পুর, বরিশালের স্বরূপকাঠি ও নীলগাতি এবং ফরিদপুরের সাতেচে উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরি হতো। বাঁশ ও বেত শিল্প ছিল পল্লী অঞ্চলের লোকজনের একচেটিয়া ব্যবসা। তারা বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ দিয়ে তৈরি করত নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ।

এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল চাটাই, মাছ ধরার ফাঁদ, হাতপাখা, মোড়া, সোফাসেট, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, ছাইদানি, ঝুড়ি ইত্যাদি। কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে ছিল এই শিল্পের ব্যাপক প্রচলন। পাটজাত শিল্পেও ছিল আমাদের রমরমা অবস্থা। পাটের ব্যাপক উৎপাদন এই শিল্পকে পৌঁছে দিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়। পাট দিয়ে তৈরি করা হতো বিভিন্ন ধরনের সিকা, টেবিলম্যাট, শতরঞ্জি, কার্পেট, শৌখিন হ্যান্ডব্যাগ, থলে ইত্যাদি।

কাঁসা ও পিতল শিল্প ছিল এ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঢাকার ধামরাই, সাভার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুরের ইসলামপুর, রংপুর, টাঙ্গাইল ও শরীয়তপুরে পারিবারিক শিল্প হিসেবে বংশপরম্পরায় চলত কাঁসা শিল্পের ব্যবসা। তৈরি হতো বিভিন্ন ধরনের বিলাসসামগ্রী।

এরকম অসংখ্য কুটিরশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল আমাদের গ্রামবাংলার জনপদ। বর্তমানে অনেক কুটিরশিল্প কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কতিপয় কুটিরশিল্প মৃতপ্রায়। কুটিরশিল্পীরা হতদরিদ্র হয়ে পড়েছেন। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ভুলতে বসেছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শোভা পাচ্ছে বিদেশি আসবাবপত্র। দেশে তৈরি ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রতি রয়েছে উদাসীনতা ও অবহেলা। গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য রক্ষায় অবিলম্বে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কুটিরশিল্প গড়ে তোলা দরকার।

মো. মাহবুবুর রহমান সাজিদ : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

কুটিরশিল্প বাঁচাতে হবে

আপডেট টাইম : ০৫:৪৯ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ২৫ সেপ্টেম্বর ২০১৮

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ একসময় কুটিরশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল আমাদের দেশ। এর সুনাম ছিল সারা বিশ্বে। বিখ্যাত পর্যটক ইবনে বতুতা তার বিখ্যাত ‘কিতাবুল হিন্দ’ গ্রন্থে বাংলার কুটিরশিল্পের বিশদ বর্ণনা দিয়েছেন। এ দেশের মসলিন ছিল পৃথিবী বিখ্যাত। গ্রামবাংলার ললনারা চড়কায় সুতা কাটতে কাটতে গল্প করত। তখন মানুষের কোনো অভাব ছিল না।

বাংলার তাঁতশিল্পের কদর ছিল সর্বত্র। ঢাকা, নরসিংদী, রায়পুরা, ডেমরা, টাঙ্গাইল, শাহজাদপুর, বেড়া, মুরাদনগর, কুমারখালী, মাগুরা, রাজশাহী, খাদিমনগর, মীরগড়, নাসিরনগর ইত্যাদি অঞ্চল ছিল তাঁতশিল্পের জন্য প্রসিদ্ধ।

বিভিন্ন নকশায় উৎপাদিত হতো শাড়ি, লুঙ্গি, ধুতি, গামছা, মশারি, তোয়ালে, মসলিন, জামদানি, কাতান, মলমল, খদ্দর ও উপজাতীয় বস্ত্র। বাংলার ঢাকাই শাড়ি, টাঙ্গাইলের শাড়ি, জামদানি, পাবনার শাড়ি আজও দেশে-বিদেশে বিখ্যাত।

তাঁতশিল্পের মতো মৃৎশিল্পেও এ অঞ্চল বিখ্যাত ছিল। ঢাকার রায়েরবাজার, কুমিল্লার বিজয়পুর, পটুয়াখালীর মদনপুরা, ফেনীর চম্পকনগর এবং শরীয়তপুরের কার্ত্তিকপুরে গড়ে উঠেছিল মৃৎশিল্প পল্লী। কুমাররা বিভিন্ন ধরনের হাঁড়ি-পাতিল, খেলনা, পুতুল, দেবদেবীর মূর্তি, গার্হস্থ্য দ্রব্যাদি, মাটির ভাস্কর্য, টালি, শখের হাঁড়ি, মনশাঘট ও ফুলদানি তৈরি করত। সিলেটের শীতলপাটি ইউনেস্কো কর্তৃক ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ হিসেবে স্বীকৃত হয়েছে। সেখানকার মোরতা গাছের ছাল দিয়ে এই শীতলপাটি তৈরি করেন ওই অঞ্চলের কুটিরশিল্পীরা। বিভিন্ন নকশায় ফুটিয়ে তোলেন গ্রামবাংলার প্রকৃতি। লাল, নীল, সবুজ, কালো ও বেগুনি রঙের বাহার থাকে এসব নকশায়। সিলেটের রাজনগর, বালাগঞ্জ, বড়লেখা ও মোল্লার বাজারে এ শিল্পের ব্যাপক প্রচলন রয়েছে।

এছাড়া নোয়াখালীর সোনাগাজী ও রায়পুর, বরিশালের স্বরূপকাঠি ও নীলগাতি এবং ফরিদপুরের সাতেচে উন্নতমানের শীতলপাটি তৈরি হতো। বাঁশ ও বেত শিল্প ছিল পল্লী অঞ্চলের লোকজনের একচেটিয়া ব্যবসা। তারা বিভিন্ন প্রজাতির বাঁশ দিয়ে তৈরি করত নিত্যপ্রয়োজনীয় বিভিন্ন উপকরণ।

এগুলোর মধ্যে অন্যতম ছিল চাটাই, মাছ ধরার ফাঁদ, হাতপাখা, মোড়া, সোফাসেট, টেবিলম্যাট, ওয়ালম্যাট, ট্রে, ফুলদানি, ছাইদানি, ঝুড়ি ইত্যাদি। কুমিল্লা, সিলেট, চট্টগ্রাম ও নোয়াখালী অঞ্চলে ছিল এই শিল্পের ব্যাপক প্রচলন। পাটজাত শিল্পেও ছিল আমাদের রমরমা অবস্থা। পাটের ব্যাপক উৎপাদন এই শিল্পকে পৌঁছে দিয়েছিল অনন্য উচ্চতায়। পাট দিয়ে তৈরি করা হতো বিভিন্ন ধরনের সিকা, টেবিলম্যাট, শতরঞ্জি, কার্পেট, শৌখিন হ্যান্ডব্যাগ, থলে ইত্যাদি।

কাঁসা ও পিতল শিল্প ছিল এ দেশের সংস্কৃতি ও ঐতিহ্যের সঙ্গে ওতপ্রোতভাবে জড়িত। ঢাকার ধামরাই, সাভার, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, জামালপুরের ইসলামপুর, রংপুর, টাঙ্গাইল ও শরীয়তপুরে পারিবারিক শিল্প হিসেবে বংশপরম্পরায় চলত কাঁসা শিল্পের ব্যবসা। তৈরি হতো বিভিন্ন ধরনের বিলাসসামগ্রী।

এরকম অসংখ্য কুটিরশিল্পে সমৃদ্ধ ছিল আমাদের গ্রামবাংলার জনপদ। বর্তমানে অনেক কুটিরশিল্প কালের গর্ভে বিলীন হয়ে গেছে। কতিপয় কুটিরশিল্প মৃতপ্রায়। কুটিরশিল্পীরা হতদরিদ্র হয়ে পড়েছেন। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারে আমরা আমাদের হাজার বছরের ঐতিহ্যকে ভুলতে বসেছি। আমাদের দৈনন্দিন জীবনে শোভা পাচ্ছে বিদেশি আসবাবপত্র। দেশে তৈরি ঐতিহ্যবাহী শিল্পের প্রতি রয়েছে উদাসীনতা ও অবহেলা। গ্রামবাংলার এই ঐতিহ্য রক্ষায় অবিলম্বে সরকারি ও বেসরকারিভাবে কুটিরশিল্প গড়ে তোলা দরকার।

মো. মাহবুবুর রহমান সাজিদ : শিক্ষার্থী, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়