ঢাকা , শনিবার, ২৭ জুলাই ২০২৪, ১২ শ্রাবণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

অসহায় কৃষক ও ভোক্তা, মধ্যস্বত্বভোগীর পেটে সবজির মুনাফা

সবজির ভর মৌসুম চলছে। শীতের সবজি বাজারে এসে গেছে। উৎপাদন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। কিন্তু এসব সবজি কৃষকের মাঠ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে সড়কে চাঁদাবাজিসহ চার থেকে পাঁচবার হাত বদল হচ্ছে। এতে বাজারে ভোক্তাকে এখনো চড়া দামে সবজি কিনতে হচ্ছে।

এছাড়া ভোক্তা চড়া দামে কিনলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষক নায্যমূল্য পাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ও ভোগের সঙ্গে জড়িত দুই পক্ষই ঠকছেন। মাঝপথে বাজার ব্যবস্থাপনা কূটকৌশলের মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তার পকেটে থাবা দিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অর্থাৎ ত্র“টিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে মাঠে কৃষক ও বাজারে ভোক্তাদের ঠকতে হচ্ছে।

যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। পাশাপাশি সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সবজির দামসংক্রান্ত শেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেও দেখা গেছে এমন চিত্র।

শুধু তাই নয়, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীও সবজির দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে পরিবহণ চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। তবে বছরের পর বছর এমন চিত্র দেখা গেলেও সরকারের সংশ্লিষ্টরা একরকম নির্বিকার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পণ্য উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হচ্ছে। এর মধ্যে আছে-স্থানীয় ব্যবসায়ী, মজুতদার, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী, প্রক্রিয়াজাতকারী, কেন্দ্রীয় বাজার বা টার্মিনাল, খুচরা বাজার, খুচরা ব্যবসায়ী ইত্যাদি। প্রতিটি ধাপেই সবজির মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আছে নামে-বেনামে চাঁদাবাজি।

মহাসড়কে, টার্মিনালে, ফেরিঘাটে, নগরীর প্রবেশমুখে সবজি বোঝাই ট্রাকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি পাইকারি আড়তে সরাসরি পণ্য বিক্রিতে কমিশন বাণিজ্যে পণ্য খালাস করতে হচ্ছে। এছাড়া চলমান হরতাল ও অবরোধে ট্রাক ভাড়া নতুন করে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়েছে। ফলে এসব কিছু যোগ করে সবজির দাম নির্ধারণ হচ্ছে। এর সঙ্গে লাভ যোগ করে খুচরা বিক্রেতা ভোক্তার হাতে পণ্য তুলে দিচ্ছেন। এতে বেশি টাকায় ক্রেতাকে পণ্য কিনতে হচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি কেজি বেগুনের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ২৬ পয়সা। একজন ব্যবসায়ী যশোরে পাইকারি বাজার থেকে প্রতি কেজি বেগুন ২৫-২৮ টাকায় কিনে রাজধানীর পাইকারি আড়তে ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করেন। পরে রাজধানীর পাইকারি বাজারে এই বেগুন কেজিপ্রতি বিক্রি হয় ৫০-৫৫ টাকায়। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি।

একইভাবে প্রতি পিস বড় আকারের লাউয়ের উৎপাদন খরচ ১৩ টাকা ২০ পয়সা। গ্রামের পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

প্রতিকেজি শিমের উৎপাদন খরচ ৬ টাকা ৮৮ পয়সা। গ্রামের পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৩৬ টাকা। সেই শিম গ্রাম থেকে এনে রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৫০-৫৮ টাকায়। আর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬০-৭০ টাকা। প্রতিকেজি মুলার উৎপাদন খরচ সাড়ে ৫ টাকা। গ্রামের পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২-২৪ টাকায়। সেই মুলা রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা।

আরও জানা গেছে, প্রতি কেজি ঢেঁড়সের উৎপাদন খরচ ১২ টাকা ৪০ পয়সা। একজন ব্যবসায়ী যশোরে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ঢেঁড়স ৩০-৩২ টাকায় বিক্রি করছেন। রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা।

জানতে চাইলে কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, মাঠে কৃষক আর বাজারে ভোক্তা ঠকেই যাচ্ছেন। এর প্রতিকার মিলছে না। ধারাবাহিকভাবে সব সময় এ ধরনের আচরণ চলতে পারে না। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা লুটছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজার কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি রাস্তায় নামে বেনামে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যদি কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রির উপায় বের করা যায় তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা করতে পারবে না।

সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি কেজি পটল উৎপাদনে চাষির খরচ সাড়ে সাত টাকা। গ্রামের পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ১৪-১৫ টাকায়। ঢাকার কাওরান বাজারে পাইকারিতে দাম মানভেদে ৩৫-৪০ টাকা। আর খুচরা বাজারে সেই পটল কিনতে একজন ভোক্তাকে গুনতে হয় ৭০-৮০ টাকা। অর্থাৎ সাড়ে ৭ টাকার পটলে কৃষক পাচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ টাকা।

জানা গেছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা বিভিন্ন পর্যায়ে সবজির দাম বৃদ্ধির পেছনে পরিবহণ চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলো প্রতিকার করতে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছেন। কিন্তু তার সুফল স্থায়ী হয়নি। ব্যবস্থা নেওয়ার পর সাময়িকভাবে বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়লেও কিছু দিনের মধ্যে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে যায়। বছরের পর বছর এমন চিত্র দেখা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল শুধু আদেশ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। কিন্তু এই আদেশ কার্যকরে সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল যুগান্তরকে বলেন, বাজারে সবজির কোনো সংকট নেই। কিছু সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। তবে কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত দামের ব্যবধান খতিয়ে দেখা হবে। অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

যশোরের সবজির সবচেয়ে বড় মোকাম বাড়িনগর সাধারণ হাট কাঁচাবাজার। সেখানে সবজি বিক্রি করতে এসেছেন মো. রাজু মিয়া।

তিনি জানান, ৪ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বেগুন চাষ করেছি। সেগুলো ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। অবরোধের কারণে তারা ঢাকায় নিতে পারছে না বলে কম দাম বলছে। বাড়িতে ফেরত নিতে পারছি না। পচে যাবে। ফলে কম দামেই বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু ঢাকায় শুনছি অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

যশোর থেকে সবজি কিনে ঢাকার আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন ব্যবসায়ী মো. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে ৩ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া ছিল ১৩ হাজার টাকা। কিছু দিন আগেও ১৫-১৬ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আর চলমান হরতাল অবরোধের কারণে এখন ২২ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ টনের ট্রাক ভাড়া ৩০-৩২ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। যা কিছু দিন আগেও ২০-২১ হাজার টাকা ছিল। আর জ্বালানি তেলে দাম বৃদ্ধির  আগে ১৭-১৮ হাজার টাকা ছিল। এছাড়া যশোর থেকে একটি ট্রাক ঢাকায় আসতে পদ্মা সেতুতে টোল দিতে হয়। আর পথে যাত্রাবাড়ীতে সিটি করপোরেশনের লোগো সংবলিত পোশাক পড়ে ১৫০-২০০ টাকা চাঁদা তোলে। ট্রাক যাত্রাবাড়ী পাইকারি আড়তে গেলে লোড আনলোডে আবার ১০০ টাকা দিতে হয়। সবজির ট্রাক যদি কাওরান বাজারে আসে সেখানে গোপনে ১০০-২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। আর শ্যামবাজারে গেলে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া মোড় থেকে একটু সামনে টোকেন দিয়ে ২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে আড়তে ব্যাপারিরা কমিশন বাণিজ্য করে। ট্রাক থেকে সবজি নামাতে ১০০ টাকা কমিশন দিয়ে বিক্রি করতে হয়। যেখানে বিক্রি করব সেখানের ভাড়া দিতে হয়। সাথে ২-৩ জন থাকি। তাদের থাকা খাওয়ার খরচ। সব মিলে কেনা দামের চেয়ে তিনগুণ বেড়ে যায়।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, উৎপাদন খরচের চেয়ে ৬ থেকে ১২ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। অনেকে বলেছেন, সবজি পচনশীল পণ্য। দ্রুত পচে যায়। এ কারণে অপচয়জনিত খরচও দামের সঙ্গে যুক্ত হয়। এছাড়া সবজি বোঝাই ট্রাক বা পিকআপ দুর্ঘটনা, নানা কারণে আটকে থাকায়ও খরচ বাড়ে।

সম্প্রতি জাতীয় সবজি মেলা উদ্বোধনকালে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, সবজির বিপণনে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবহণ চাঁদাবাজি হচ্ছে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান করতে পারলে সবজির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কৃষককে লাভবান করতে ইতোমধ্যে কৃষকের বাজার স্থাপন করা হয়েছে। আর এ ধরনের বাজার প্রত্যেকটি জেলায় করা হবে। যাতে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে পারেন। এতে কৃষকের সঙ্গে ভোক্তাও লাভবান হবেন।

রাজশাহী ব্যুড়ো জানায়, রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ খড়খড়িতে এ এলাকার সবচেয়ে বড় সবজির মোকাম। প্রতিদিন কয়েক হাজার কৃষক এ মোকামে সবজি বিক্রি করতে আসেন। মোকামের আড়তদার আব্দুর রহিম বলেন, রাজশাহীর খড়খড়ি, মোহনপুর, দুর্গাপুর এবং বিভিন্ন উপজেলার সবজির আড়ত থেকে প্রতিদিন ২০০ ট্রাকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু অবরোধ চলার কারণে ট্রাক মালিকরা ঝুঁকি নিচ্ছেন না। মাত্র ৩০ থেকে ৪০টি ট্রাক রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে আড়তে প্রচুর পরিমাণে সবজির আমদানি হলেও সেগুলো বিক্রি হচ্ছে না। তাছাড়া শীতের সবজি বাজারে ব্যাপকভাবে নামতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে সবজির দামে নেমেছে ধস।

 

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

অসহায় কৃষক ও ভোক্তা, মধ্যস্বত্বভোগীর পেটে সবজির মুনাফা

আপডেট টাইম : ০৬:২৩ অপরাহ্ন, শুক্রবার, ১০ নভেম্বর ২০২৩

সবজির ভর মৌসুম চলছে। শীতের সবজি বাজারে এসে গেছে। উৎপাদন বেড়েছে রেকর্ড পরিমাণে। কিন্তু এসব সবজি কৃষকের মাঠ থেকে ভোক্তার কাছে পৌঁছাতে সড়কে চাঁদাবাজিসহ চার থেকে পাঁচবার হাত বদল হচ্ছে। এতে বাজারে ভোক্তাকে এখনো চড়া দামে সবজি কিনতে হচ্ছে।

এছাড়া ভোক্তা চড়া দামে কিনলেও মাঠ পর্যায়ে কৃষক নায্যমূল্য পাচ্ছে না। ফলে উৎপাদন ও ভোগের সঙ্গে জড়িত দুই পক্ষই ঠকছেন। মাঝপথে বাজার ব্যবস্থাপনা কূটকৌশলের মাধ্যমে কৃষক ও ভোক্তার পকেটে থাবা দিয়েছে মধ্যস্বত্বভোগীরা। হাতিয়ে নিচ্ছে মোটা অঙ্কের টাকা। অর্থাৎ ত্র“টিপূর্ণ বাজার ব্যবস্থার কারণে মাঠে কৃষক ও বাজারে ভোক্তাদের ঠকতে হচ্ছে।

যুগান্তরের নিজস্ব অনুসন্ধানে পাওয়া গেছে এসব তথ্য। পাশাপাশি সরকারি সংস্থা কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের সবজির দামসংক্রান্ত শেষ প্রতিবেদন বিশ্লেষণ করেও দেখা গেছে এমন চিত্র।

শুধু তাই নয়, সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীও সবজির দাম বৃদ্ধির নেপথ্যে পরিবহণ চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। তবে বছরের পর বছর এমন চিত্র দেখা গেলেও সরকারের সংশ্লিষ্টরা একরকম নির্বিকার।

অনুসন্ধানে জানা যায়, পণ্য উৎপাদনকারী থেকে ভোক্তা পর্যায়ে আসতে বেশ কয়েকটি ধাপ পেরোতে হচ্ছে। এর মধ্যে আছে-স্থানীয় ব্যবসায়ী, মজুতদার, আড়তদার, পাইকারি ব্যবসায়ী, প্রক্রিয়াজাতকারী, কেন্দ্রীয় বাজার বা টার্মিনাল, খুচরা বাজার, খুচরা ব্যবসায়ী ইত্যাদি। প্রতিটি ধাপেই সবজির মূল্য বেড়ে যাচ্ছে। এর সঙ্গে আছে নামে-বেনামে চাঁদাবাজি।

মহাসড়কে, টার্মিনালে, ফেরিঘাটে, নগরীর প্রবেশমুখে সবজি বোঝাই ট্রাকে টাকা আদায় করা হচ্ছে। পাশাপাশি পাইকারি আড়তে সরাসরি পণ্য বিক্রিতে কমিশন বাণিজ্যে পণ্য খালাস করতে হচ্ছে। এছাড়া চলমান হরতাল ও অবরোধে ট্রাক ভাড়া নতুন করে ৬ থেকে ৭ হাজার টাকা বেড়েছে। ফলে এসব কিছু যোগ করে সবজির দাম নির্ধারণ হচ্ছে। এর সঙ্গে লাভ যোগ করে খুচরা বিক্রেতা ভোক্তার হাতে পণ্য তুলে দিচ্ছেন। এতে বেশি টাকায় ক্রেতাকে পণ্য কিনতে হচ্ছে।

কৃষি বিপণন অধিদপ্তর নিজস্ব অনুসন্ধানে জানা গেছে, প্রতি কেজি বেগুনের উৎপাদন খরচ ১০ টাকা ২৬ পয়সা। একজন ব্যবসায়ী যশোরে পাইকারি বাজার থেকে প্রতি কেজি বেগুন ২৫-২৮ টাকায় কিনে রাজধানীর পাইকারি আড়তে ৩০-৪০ টাকায় বিক্রি করেন। পরে রাজধানীর পাইকারি বাজারে এই বেগুন কেজিপ্রতি বিক্রি হয় ৫০-৫৫ টাকায়। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৭০-৮০ টাকা কেজি।

একইভাবে প্রতি পিস বড় আকারের লাউয়ের উৎপাদন খরচ ১৩ টাকা ২০ পয়সা। গ্রামের পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ২৫-৩০ টাকা। রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪৫-৫০ টাকা। খুচরা পর্যায়ে ৬০-৭০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

প্রতিকেজি শিমের উৎপাদন খরচ ৬ টাকা ৮৮ পয়সা। গ্রামের পাইকারি বাজারে তা বিক্রি হচ্ছে ৩৫-৩৬ টাকা। সেই শিম গ্রাম থেকে এনে রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি করা হচ্ছে ৫০-৫৮ টাকায়। আর খুচরা বাজারে প্রতিকেজি বিক্রি হচ্ছে সর্বোচ্চ ৬০-৭০ টাকা। প্রতিকেজি মুলার উৎপাদন খরচ সাড়ে ৫ টাকা। গ্রামের পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ২২-২৪ টাকায়। সেই মুলা রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৩০-৩৫ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৫০-৫৫ টাকা।

আরও জানা গেছে, প্রতি কেজি ঢেঁড়সের উৎপাদন খরচ ১২ টাকা ৪০ পয়সা। একজন ব্যবসায়ী যশোরে পাইকারি পর্যায়ে প্রতি কেজি ঢেঁড়স ৩০-৩২ টাকায় বিক্রি করছেন। রাজধানীর পাইকারি বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৪০-৪৫ টাকা। আর খুচরা বাজারে বিক্রি হচ্ছে ৬০-৬৫ টাকা।

জানতে চাইলে কনজিউমার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সভাপতি গোলাম রহমান যুগান্তরকে বলেন, মাঠে কৃষক আর বাজারে ভোক্তা ঠকেই যাচ্ছেন। এর প্রতিকার মিলছে না। ধারাবাহিকভাবে সব সময় এ ধরনের আচরণ চলতে পারে না। বাজার ব্যবস্থাপনার দুর্বলতার কারণে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা লুটছে। এদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে হবে। বাজার কাঠামোতেও পরিবর্তন আনতে হবে। পাশাপাশি রাস্তায় নামে বেনামে চাঁদাবাজি বন্ধ করতে হবে।

তিনি আরও বলেন, যদি কৃষক পর্যায় থেকে সরাসরি পাইকারি ও খুচরা বাজারে পণ্য বিক্রির উপায় বের করা যায় তাহলে মধ্যস্বত্বভোগীরা অতি মুনাফা করতে পারবে না।

সম্প্রতি কৃষি বিপণন অধিদপ্তরের প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রতি কেজি পটল উৎপাদনে চাষির খরচ সাড়ে সাত টাকা। গ্রামের পাইকারি বাজারে বিক্রি হয় ১৪-১৫ টাকায়। ঢাকার কাওরান বাজারে পাইকারিতে দাম মানভেদে ৩৫-৪০ টাকা। আর খুচরা বাজারে সেই পটল কিনতে একজন ভোক্তাকে গুনতে হয় ৭০-৮০ টাকা। অর্থাৎ সাড়ে ৭ টাকার পটলে কৃষক পাচ্ছে সর্বোচ্চ ১০ টাকা।

জানা গেছে, সরকারের সংশ্লিষ্ট নীতিনির্ধারকরা বিভিন্ন পর্যায়ে সবজির দাম বৃদ্ধির পেছনে পরিবহণ চাঁদাবাজি ও মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যার কথা তুলে ধরেছেন। সেগুলো প্রতিকার করতে কিছু ব্যবস্থাও নিয়েছেন। কিন্তু তার সুফল স্থায়ী হয়নি। ব্যবস্থা নেওয়ার পর সাময়িকভাবে বাজারে কিছুটা প্রভাব পড়লেও কিছু দিনের মধ্যে আগের চেয়ে খারাপ অবস্থায় চলে যায়। বছরের পর বছর এমন চিত্র দেখা সরকারের ঊর্ধ্বতন মহল শুধু আদেশ দিয়েই নিজেদের দায়িত্ব শেষ করেছেন। কিন্তু এই আদেশ কার্যকরে সংশ্লিষ্টরা নির্বিকার।

জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক আব্দুল জব্বার মন্ডল যুগান্তরকে বলেন, বাজারে সবজির কোনো সংকট নেই। কিছু সবজির দাম কমতে শুরু করেছে। তবে কৃষক পর্যায় থেকে ভোক্তা পর্যন্ত দামের ব্যবধান খতিয়ে দেখা হবে। অনিয়ম পেলে শাস্তির আওতায় আনা হবে।

যশোরের সবজির সবচেয়ে বড় মোকাম বাড়িনগর সাধারণ হাট কাঁচাবাজার। সেখানে সবজি বিক্রি করতে এসেছেন মো. রাজু মিয়া।

তিনি জানান, ৪ বিঘা জমি বর্গা নিয়ে বেগুন চাষ করেছি। সেগুলো ফড়িয়াদের কাছে বিক্রি করে উৎপাদন খরচই উঠছে না। অবরোধের কারণে তারা ঢাকায় নিতে পারছে না বলে কম দাম বলছে। বাড়িতে ফেরত নিতে পারছি না। পচে যাবে। ফলে কম দামেই বিক্রি করে দিয়েছি। কিন্তু ঢাকায় শুনছি অনেক বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে।

যশোর থেকে সবজি কিনে ঢাকার আড়তদারদের কাছে বিক্রি করেন ব্যবসায়ী মো. আতিউর রহমান। তিনি বলেন, জ্বালানি তেলের মূল্যবৃদ্ধির আগে ৩ টনের একটি ট্রাকের ভাড়া ছিল ১৩ হাজার টাকা। কিছু দিন আগেও ১৫-১৬ হাজার টাকা দিতে হয়েছে। আর চলমান হরতাল অবরোধের কারণে এখন ২২ হাজার টাকা গুনতে হচ্ছে। পাশাপাশি ৫ টনের ট্রাক ভাড়া ৩০-৩২ হাজার টাকা দিতে হচ্ছে। যা কিছু দিন আগেও ২০-২১ হাজার টাকা ছিল। আর জ্বালানি তেলে দাম বৃদ্ধির  আগে ১৭-১৮ হাজার টাকা ছিল। এছাড়া যশোর থেকে একটি ট্রাক ঢাকায় আসতে পদ্মা সেতুতে টোল দিতে হয়। আর পথে যাত্রাবাড়ীতে সিটি করপোরেশনের লোগো সংবলিত পোশাক পড়ে ১৫০-২০০ টাকা চাঁদা তোলে। ট্রাক যাত্রাবাড়ী পাইকারি আড়তে গেলে লোড আনলোডে আবার ১০০ টাকা দিতে হয়। সবজির ট্রাক যদি কাওরান বাজারে আসে সেখানে গোপনে ১০০-২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। আর শ্যামবাজারে গেলে গুলিস্তান ফুলবাড়িয়া মোড় থেকে একটু সামনে টোকেন দিয়ে ২০০ টাকা চাঁদা তোলা হয়। এছাড়া মাঝে মাঝে আড়তে ব্যাপারিরা কমিশন বাণিজ্য করে। ট্রাক থেকে সবজি নামাতে ১০০ টাকা কমিশন দিয়ে বিক্রি করতে হয়। যেখানে বিক্রি করব সেখানের ভাড়া দিতে হয়। সাথে ২-৩ জন থাকি। তাদের থাকা খাওয়ার খরচ। সব মিলে কেনা দামের চেয়ে তিনগুণ বেড়ে যায়।

অনুসন্ধানে পাওয়া তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায়, উৎপাদন খরচের চেয়ে ৬ থেকে ১২ গুণ বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। অনেকে বলেছেন, সবজি পচনশীল পণ্য। দ্রুত পচে যায়। এ কারণে অপচয়জনিত খরচও দামের সঙ্গে যুক্ত হয়। এছাড়া সবজি বোঝাই ট্রাক বা পিকআপ দুর্ঘটনা, নানা কারণে আটকে থাকায়ও খরচ বাড়ে।

সম্প্রতি জাতীয় সবজি মেলা উদ্বোধনকালে কৃষিমন্ত্রী ড. মো. আবদুর রাজ্জাক বলেছেন, সবজির বিপণনে কিছুটা সমস্যা রয়েছে। এর মধ্যে পরিবহণ চাঁদাবাজি হচ্ছে। পাশাপাশি মধ্যস্বত্বভোগীসহ অনেক সমস্যা মোকাবেলা করতে হচ্ছে। এসব সমস্যার সমাধান করতে পারলে সবজির ন্যায্যমূল্য নিশ্চিত করা সম্ভব হবে। কৃষককে লাভবান করতে ইতোমধ্যে কৃষকের বাজার স্থাপন করা হয়েছে। আর এ ধরনের বাজার প্রত্যেকটি জেলায় করা হবে। যাতে কৃষক তাদের উৎপাদিত পণ্য সরাসরি ভোক্তার কাছে বিক্রি করতে পারেন। এতে কৃষকের সঙ্গে ভোক্তাও লাভবান হবেন।

রাজশাহী ব্যুড়ো জানায়, রাজশাহী মহানগরীর উপকণ্ঠ খড়খড়িতে এ এলাকার সবচেয়ে বড় সবজির মোকাম। প্রতিদিন কয়েক হাজার কৃষক এ মোকামে সবজি বিক্রি করতে আসেন। মোকামের আড়তদার আব্দুর রহিম বলেন, রাজশাহীর খড়খড়ি, মোহনপুর, দুর্গাপুর এবং বিভিন্ন উপজেলার সবজির আড়ত থেকে প্রতিদিন ২০০ ট্রাকে ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সবজি সরবরাহ করা হয়। কিন্তু অবরোধ চলার কারণে ট্রাক মালিকরা ঝুঁকি নিচ্ছেন না। মাত্র ৩০ থেকে ৪০টি ট্রাক রাজশাহী থেকে ছেড়ে যাচ্ছে। এর ফলে আড়তে প্রচুর পরিমাণে সবজির আমদানি হলেও সেগুলো বিক্রি হচ্ছে না। তাছাড়া শীতের সবজি বাজারে ব্যাপকভাবে নামতে শুরু করেছে। সব মিলিয়ে সবজির দামে নেমেছে ধস।