মা দিবসে দেখতে পারেন মাকে নিয়ে নির্মিত সেরা ১০টি সিনেমা

আজ বিশ্ব মা দিবস। মা শব্দটি একেবারে ছোট। কিন্তু এ শব্দটি এতই বিস্তৃত যে, সাগরের একূল থেকে যেমন ওকূল কিছুই দেখা যায় না। শুধু টেউয়ের পর ঢেউ আছড়ে পড়ে।

মাত্র একটি শব্দে মা আবদ্ধ হয়েও এর ব্যাপকতা সাগরের চেয়েও বিশাল। এ শব্দের চেয়ে আপন আর শব্দ নেই। বাংলাদেশসহ পুরো বিশ্বে মাকে স্মরণ করে আজ (১২ মে) পালিত হচ্ছে ‘বিশ্ব মা দিবস’। এ দিনে সন্তানেরা মায়েদেরকে একটু ভিন্নভাবে স্মরণ করেন, সম্মান জানিয়ে থাকেন।
যারা সিনেমাপ্রেমী, তারা আজকের এই বিশেষ দিনটিতে মাকে সম্মান জানাতে পারেন একটু ভিন্নভাবে। মা দিবসে মায়ের সঙ্গে বসে উপভোগ করতে পারেন কিছু দুর্দান্ত সিনেমা।হলিউড ও বলিউডসহ বিশ্বের বিভিন্ন চলচ্চিত্রাঙ্গনে মাকে নিয়ে নির্মিত হয়েছে অনেক সিনেমা। এর মধ্যে দর্শকপ্রিয়তায় ও সাফল্যের দিক থেকে সেরা ১০টি সিনেমার খোঁজ জেনে নিন –

মাদার (১৯৫৮)
রুশ উপন্যাসিক ম্যাক্সিক গোর্কির বিখ্যাত উপন্যাস ‌‘মাদার’।

এটি অবলম্বনে চিত্রনাট্য লেখেন জার্মান কবি-নাট্যকার বের্টল্ট ব্রেখট। আর তা যৌথভাবে পরিচালনা করেছেন হ্যারি ব্রেমার ও ম্যানফ্রেড উইকওয়ার্থ। সিনেমাটি একজন মায়ের চলমান গল্প বলে। যেখানে দেখা যায় সন্তানের আদর্শের কারণে নিজেও বৈপ্লবিক রাজনীতিতে জড়িয়ে পড়েন। ১৯৫৮ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমার বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন হেলেন উইগেল, ফ্রেড ডুরেন, নরবার্ট ক্রিশ্চিয়ান প্রমুখ।
হাজার চৌরাসি কা মা (১৯৯৮)
সত্তরের দশকের কলকাতা। অন্য অনেক তরুণের মতো কলেজপড়ুয়া ব্রতিও গিয়েছিল ছাত্র আন্দোলনে। কিন্তু বাড়িতে খবর এল, সে ফিরেছে লাশ হয়ে। নকশালবাড়ি আন্দোলনে ছেলে হারানো এক মায়ের মর্মস্পর্শী এই গল্প লিখেছিলেন মহাশ্বেতা দেবী, তাঁর ‘হাজার চুরাশির মা’ উপন্যাসে। সেই গল্প থেকেই ভারতে ১৯৯৮ সালে নির্মিত হয় ‘হাজার চৌরাসি কা মা’। প্রায় ১৮ বছর পর সেলুলয়েডের জগতে ফিরে শোকাহত সেই মায়ের ভূমিকায় অভিনয় করেছিলেন জয়া বচ্চন। কলকাতায় ষাট থেকে আশির দশকের মধ্যে বামপন্থী নকশালদের আন্দোলনে পুলিশি অত্যাচার এবং গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছিল এ রকম অসংখ্য তরুণ। গুমোট এই পরিস্থিতির বেদনাবহুল প্রেক্ষাপট পরিষ্কারভাবেই ধরা পড়েছিল জয়া বচ্চনের সুজাতা চ্যাটার্জি চরিত্রটিতে। সিনেমাটি জিতে নিয়েছিল ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার।

আম্মাজান (১৯৯৯)
অপরাধধর্মী নাট্য চলচ্চিত্র এটি। ১৯৯৯ সালে মুক্তি পাওয়া এ সিনেমা পরিচালনা করেছেন কাজী হায়াৎ। বাংলাদেশে এ পর্যন্ত মাকে নিয়ে যত চলচ্চিত্র তৈরি হয়েছে, তার মধ্যে ‘আম্মাজান’কে সেরা চলচ্চিত্র হিসেবে ধরা হয়। এতে রক কিংবদন্তি আইয়ুব বাচ্চুর গাওয়া ‘আম্মাজান’ গানটি ব্যাপক জনপ্রিয়তা পায়। মান্নার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন শবনম। অন্যান্য চরিত্রে অভিনয় করেছেন মৌসুমী, ডিপজলসহ অনেকে।

মায়ের অধিকার (১৯৯৬)
শিবলী সাদিক পরিচালিত ‘মায়ের অধিকার’ এই সিনেমার মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন ববিতা। মায়ের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য সন্তানের লড়াই নিয়েই ছবির গল্প। ১৯৯৬ সালে মুক্তি পাওয়া ছবিটি রেকর্ড পরিমাণ ব্যবসা করে। এতে আরও অভিনয় করেছিলেন আলমগীর, সালমান শাহ, শাবনাজ, ফেরদৌসী মজুমদার, হুমায়ুন ফরীদি, নাসির খান প্রমুখ।

মাদার ইন্ডিয়া (১৯৫৭)
‘মাদার ইন্ডিয়া’ মাকে নিয়ে নির্মিত বলিউডের এক মহাকাব্যিক সিনেমা। এটি পরিচালনা করেছেন মেহবুব খান। রাধা নামে এক দারিদ্র্যপীড়িত গ্রামের নারীকে নিয়ে গড়ে উঠেছে এর গল্প। স্বামীর অনুপস্থিতিতে সে কীভাবে ছেলেদের লালন-পালন করে এবং ধূর্ত-ধনদাতার বিরুদ্ধে বেঁচে থাকার লড়াই করে—সেটাই দেখানো হয়েছে। এতে মায়ের চরিত্রে অভিনয় করেন নার্গিস। সিনেমাটি আজও বলিউডের কালজয়ী সিনেমার মধ্যে অন্যতম।

টার্মস অব এনডিয়ারমেন্ট (১৯৮৩)
আমেরিকান উপন্যাসিক ও চিত্রনাট্যকার ল্যারি ম্যাকমুর্ট্রির ১৯৭৫ সালের উপন্যাস ‌‘টার্মস অব এনডিয়ারমেন্ট’ অবলম্বনে তৈরি হয় সিনেমাটি। ১৯৮৩ সালের নভেম্বরে সিনেমাটি মুক্তি পায়। ডিসেম্বরের মধ্যে এটি ১৬ কোটি ৫০ লাখ ডলারের ব্যবসা করে, যা ওই বছর দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ৫৬তম অস্কারে এটি ১১টি ক্যাটাগরিতে মনোনয়ন পায়। পাঁচ ক্যাটাগরিতে পুরস্কার অর্জন করে। বিধবা মা অরোরা গ্রিনওয়ে ও তার তরুণী মেয়ে এমার ৩০ বছরের সম্পর্কের চড়াই-উতরাই দেখানো হয়েছে টার্মস অব এনডিয়ারমেন্টে। জীবনের যাবতীয় তিক্ততা সত্ত্বেও যেখানে শেষ পর্যন্ত ভালোবাসারই জয় হয়। সিনেমাটিতে অরোরার চরিত্রে অভিনয় করেছেন শার্লি ম্যাকলাইন। আর মেয়ে এমার ভূমিকায় অভিনয় করেছেন ডেব্রা উইঙ্গার।

টু উইমেন (১৯৬০)
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ভয়াবহতার শিকার এক বিধবা মা ও তাঁর কিশোরী মেয়ের করুণ গল্পের চিত্রায়ন ‌‘টু উইমেন’। ইতালীয় উপন্যাসিক আলবার্তো মোরাভিয়ার লেখা ‘টু উইমেন’ উপন্যাস অবলম্বনে নির্মিত এটি। নির্মাণ করেছেন ইতালীয় নির্মাতা ভিত্তোরিও ডি সিকা। সিনেমায় দেখা যায়, নাৎসিবাহিনীর আক্রমণে দিশাহারা হয়ে অন্যান্য রোমবাসীর সঙ্গে লাতসিও এলাকায় পালিয়ে আসে মা সেসিরা ও তাঁর ১২ বছর বয়সী মেয়ে রোসেত্তা। সেখানে মিশেল নামে এক কমিউনিস্ট বুদ্ধিজীবীর সঙ্গে তাদের পরিচয় হয়। মিশেলকে নিজের বাবার মতো মনে করতে থাকে পিতৃহীন রোসেত্তা। একপর্যায়ে মিশেলকে জার্মান বাহিনী ধরে নিয়ে যায়। ফলে তারা আলাদা হয়ে যায়। কাহিনীর এ পর্যায়ে মিত্রবাহিনী রোম দখল করে। রোমকে নিরাপদ ভেবে ফিরতে যায় সিসেরা ও রোসেত্তা। পথিমধ্যে একটি গির্জায় স্থানীয় সশস্ত্রগোষ্ঠীর হাতে মা ও মেয়ে ধর্ষণের শিকার হয়। এ ঘটনায় স্বাভাবিক ভারসাম্য হারিয়ে ফেলে তাঁরা। মা-মেয়ের এই অবর্ণনীয় কষ্ট ও সংগ্রামের গল্প দুর্দান্তভাবে ফুটিয়ে তোলা হয়েছে সিনেমাটিতে। ‘টু উইমেন’ মুক্তি পায় ১৯৬০ সালে। এ সিনেমায় মা সেসিরার ভূমিকায় অভিনয় করেন কিংবদন্তি অভিনেত্রী সোফিয়া লরেন। অসাধারণ অভিনয় তাঁকে এনে দিয়েছিল অস্কারসহ অনেকগুলো আন্তর্জাতিক পুরস্কার।

আকিলাহ অ্যান্ড দ্য বি (২০০৬)
আকিলাহর জাতীয় পর্যায়ে বানান প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ এবং সেখানে মেয়েকে বিজয়ী দেখতে মায়ের চেষ্টা নিয়ে নির্মিত চলচ্চিত্র ‘আকিলাহ অ্যান্ড দ্য বি’। সন্তানের স্বপ্নপূরণ করতে মায়েদের পরিশ্রমের কথাই উঠে এসেছে এ চলচ্চিত্রে। ২০০৬ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এ সিনেমা পরিচালনা করেন ডুগ অ্যাটকিসন। এ চলচ্চিত্রে অভিনয় করেছেন কেকে পালমার, অ্যাঞ্জেলা ব্যাসেট প্রমুখ।

দ্য ব্লাইন্ড সাইড (২০০৯)
মা দিবসে দেখার মতো আরেকটি সিনেমা ‘দ্য ব্লাইন্ড সাইড’। ২০০৯ সালে মার্কিন পরিচালক জন লি হ্যানকক এটি পরিচালনা করেন। তিন বছর আগে একই শিরোনামে প্রকাশিত সাংবাদিক মাইকেল লুইসের একটি উপন্যাস থেকে সিনেমাটির চিত্রনাট্য তৈরি করা হয়। দ্য ব্লাইন্ড সাইডে যাবতীয় প্রতিকূলতাকে জয় করে একটি কৃষ্ণাঙ্গ শিশুর আমেরিকার জাতীয় ফুটবল লীগের খেলোয়াড় হয়ে ওঠার গল্প বলা হয়েছে। মাইকেলের খেলাধুলায় ঝোঁক ও বেড়ে ওঠা তার বাবার এক বন্ধু লক্ষ্য করেন। তিনি মাইকেলকে স্থানীয় একটি স্কুলের ফুটবল ক্লাবে ভর্তির ব্যবস্থা করেন। সেখানে এক শ্বেতাঙ্গ সতীর্থের সঙ্গে মাইকেলের সখ্য হয়। ওই শ্বেতাঙ্গ ছেলেটির মা মাতৃস্নেহে মাইকেলের পাশে দাঁড়ায়। দ্য ব্লাইন্ড সাইডের পটভূমি মূলত আমেরিকান সমাজের অন্যতম বড় সমস্যা বর্ণবাদ নিয়ে। মায়ের স্নেহ, ভালোবাসা দিয়ে বর্ণবাদ জয় করার একটি বার্তা দেওয়া হয়েছে সিনেমায়। দুই কোটি ৯০ লাখ ডলারে তৈরি সিনেমাটি মুক্তির বছরেই ৩০ কোটি ৯০ লাখ ডলারের ব্যবসা করে। অর্জন করে বেশ কিছু পুরস্কার।

উত্তর ফাল্গুনী (১৯৬৩)
শ্রেণি বৈষম্য ও সংগ্রামের এক করুণ চালচিত্র হিসেবেই নির্মাতা অসিত রায় পরিচালনা করেছেন তাঁর ‘উত্তর ফাল্গুনী’ চলচ্চিত্রটি। যেখানে নিজের ক্যারিয়ারের সবচেয়ে চ্যালেঞ্জিং চরিত্রে অভিনয় করেছেন মহানায়িকা সুচিত্রা সেন। দ্বৈত চরিত্রে তিনি ছিলেন একজন মা, আবার একই সঙ্গে সেই মায়ের সন্তানও। দারিদ্র্য, নিপীড়নের হাত থেকে শুধু মেয়ের ভবিষ্যতের দিকে তাকিয়ে পালিয়ে এসেছিলেন মদ্যপ স্বামীর আশ্রয় থেকে। হয়ে যান পরপুরুষের বিনোদনের খোরাক এক বাঈজি। ষাটের দশকে কলকাতার প্রেক্ষাপটে এমন এক গল্প সাড়া ফেলে দিয়েছিল সর্বত্র। ভারতের জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে সেরা বাংলা সিনেমা হিসেবে স্বীকৃতি পেয়েছিল ১৯৬৩ সালে মুক্তিপ্রাপ্ত এই সিনেমা।

এ ছাড়াও মাকে নিয়ে নির্মিত সাড়া জাগানো বাংলাদেশি চলচ্চিত্রের মধ্যে রয়েছে দেলোয়ার হোসেন দুলালের ‘বড় মা’, আওকাত হোসেনের ‘মায়ের দাবি’, দীলিপ বিশ্বাসের ‘মায়ের মর্যাদা’, মোস্তাফিজুর রহমান মানিকের ‘মা আমার চোখের মণি’, মনতাজুর রহমান আকবরের ‘আমার মা’ ও ‘মায়ের চোখ’, জাকির হোসেনের ‘মা আমার স্বর্গ’, শেখ নজরুল ইসলামের ‘মা বড় না বউ বড়’ প্রভৃতি।

এই ক্যাটাগরীর আরো খবর