এ যেন হিন্দি চলচ্চিত্রের কোনো কাহিনী! ধনাঢ্য পিতার বেপরোয়া জীবনাচরণে বখে যাওয়া এক ধনীর দুলালের গল্প! রাতভর মদের নেশায় চুর হয়ে মধ্য রাতে পিতার ঘরে ফেরা। মদের আসরে নর্তকীর প্রেমে পড়ে তাকে নিয়ে টানা হেঁচড়া করে নিরাপত্তারক্ষীদের রোষানলে পড়া। আর সেই সংবাদ পেয়ে ছেলে ছুটে গিয়ে বাবাকে উদ্ধার করা! এ কোনো হিন্দি চলচ্ছিত্রের কাহিনী নয়। এটা চাঞ্চল্যকর বনানী ধর্ষণের মূল আসামি সাফাত আহমেদ আর তার বাবা আপন জুয়েলার্সের মালিক দিলদার আহমেদ সেলিমের।
বাবার পদাঙ্ক অনুসরণ করে ছেলেও। মদ-নারী আর বেপরোয়া জীবনযাপনে অভ্যস্ত হয়ে পড়েন সাফাতও। দিনের পর দিন এসব অপরাধকে তিনি কখনো অপরাধ বলেই ভাবেননি। অর্থ দিয়ে যে কোনো ধরনের অন্যায়কেই জায়েজ করা যায়- এ রকম ভাবনাতেই বড় হয়ে ওঠেন সাফাত। এই ভাবনাই দৃঢ় হয়ে ওঠে তার মধ্যে।
পুলিশ রিমান্ডের প্রথম দিনে সাফাত আহমেদ ও সাদমান সাকিফ জিজ্ঞাসাবাদে পুলিশকে জানিয়েছেন তাদের পারিবারিক জীবন এবং বড় হয়ে ওঠার নানা কাহিনী। বিশেষ করে সাফাতের মুখে তার বড় হয়ে ওঠার কাহিনী শুনে নড়েচড়ে বসেন তদন্ত কর্মকর্তারা। তিনি অকপটে বলে যান সেদিনকার ঘটনা সম্পর্কে তার দৃষ্টিভঙ্গি।
সাফাত স্বীকার করেছেন, তিনি ভাবেননি এই ঘটনা এতদূর গড়াবে। কারণ এর আগেও তিনি ওই হোটেল মদ-নারীর আসর বসাতেন। অর্থের বিনিময়ে মেয়েদের নিয়ে রাত কাটাতেন। আর এ সবকিছুকেই তিনি শুধুমাত্র দেখতেন বিনোদন হিসেবেই। জিজ্ঞাসাবাদে সাফাত গুলশান-বনানী এলাকায় তার মতো এ রকম অনেক তরুণের কাহিনীও জানিয়েছেন গোয়েন্দাদের।
গোয়েন্দা সূত্রে জানা যায়, সাফাত ধর্ষণের কথা স্বীকার করলেও অস্ত্র ঠেকিয়ে ধর্ষণের কথা অস্বীকার করেছেন। এমন কি ধর্ষণের ঘটনা ভিডিও করার কথা অস্বীকার করেছেন। তবে গোয়েন্দা সূত্রে প্রাপ্ত তথ্যে জানা যায়, বনানীর যে হোটেলে (দ্য রেইনট্রি) ঘটনাটি ঘটেছিল সেই হোটেলের মালিকের ছেলে মিহির ছিল সাফাতের বন্ধু। সাফাত ও তার বন্ধুরা প্রায়ই সেই হোটেলের কক্ষ ভাড়া নিয়ে নেশাজাতীয় দ্রব্য নিয়ে হোটেলে রাত কাটাতেন। হোটেল কর্তৃপক্ষও বিষয়টি ভালোভাবেই অবগত ছিল। কিন্তু মালিকের ছেলের বন্ধু হওয়ায় তারা বিষয়গুলো জেনেও না জানার ভান করে থাকত। গোয়েন্দারাও হোটেল কর্তৃপক্ষের অবগত থাকার বিষয়ে প্রমাণ পেয়েছেন বলে সূত্র জানায়। হোটেল কর্তৃপক্ষ এখন নানা কথা বলে সাফাতকে বাঁচাতে এবং ঘটনাটিকে ভিন্ন দিকে নেয়ার চেষ্টা করছে বলে প্রমাণ পাওয়া গেছে। গোয়েন্দারা এ বিষয়ে হোটেল কর্তৃপক্ষকেও জিজ্ঞাসাবাদ করবেন বলে জানা গেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্র এবং সাফাতের সাবেক স্ত্রী ফারিয়া মাহবুব পিয়াসার সূত্রে জানা যায়, সাফাতের বাবা স্বর্ণ ব্যবসায়ী দিলদার আহমেদের নিজেরও মদ ও নারী আসক্তি রয়েছে। গুলশানের একটি মদের আসরে মদপান করে মাতাল হয়ে দিলদার আহমেদ একবার এক ড্যান্সারকে (নর্তকী) ভালো লেগে গেলে তিনি ওই নারীকে নিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করেন। পরে হোটেল কর্তৃপক্ষ দিলদারকে বাধা দেন এবং সেখানে আটকে রাখেন। সংবাদ পেয়ে সাফাত ছুটে গিয়ে বাবাকে (দিলদার) সেখানে থেকে উদ্ধার করে নিয়ে আসেন। দিলদারের নারী বন্ধুর সংখ্যও অনেক। কোনো পার্টিতে গেলে সেখানে তিনি নারী খুঁজে বেড়ান। তার নারী আসক্তি এতটাই প্রবল যে তিনি ছেলে সাফাতের বন্ধু নাঈম আশরাফ ওরফে আব্দুল হালিমকে (মামলার দ্বিতীয় অসামি) দিয়ে উঠতি মডেলদের ভাড়া করে তাদের নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যেতেন। সম্প্রতি সাফাতও বাবার পথ অনুসরণ করেছেন বলে জানান তার সাবেক স্ত্রী পিয়াসা।
তিনি বলেন, সাফাতও আপন জুয়েলার্সের মডেলদের নিয়ে বিদেশ ভ্রমণে যাওয়া শুরু করেছেন। সম্প্রতি সাফাত তাকে ডিভোর্স লেটার পাঠিয়ে এ রকম এক মডেলকে নিয়ে ভারত ভ্রমণে যান এবং সেখানে ওই মডেলকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুলে তা ফেইসবুকে পোস্টও করেন। পিয়াসা আরো জানান, বাবার কারণেই ছেলে খারাপ হয়েছে। এখন সাফাতের ছোট ভাই ইফাতও এই পথ ধরছে।
সম্প্রতি দিলদার আহমেদ ছেলের পক্ষে সাফাই গাইতে গিয়ে গণমাধ্যমের কাছে বড়াই করে বলেছেন, ‘পোলা আকাম (ধর্ষণ) করছে তো কি হইছে। জোয়ান পোলা এ রকম একটু আধটু তো করবই আমিও করি…’।
তবে পিয়াসার বিরুদ্ধে পাল্টা অভিযোগ করেছেন দিলদার আহমেদ। তিনি শুরু থেকেই বলে আসছেন তার ছেলের সাবেক স্ত্রী পিয়াসা ষড়যন্ত্রমূলকভাবে এসব কিছু করছে। তিনি জানান, ‘মামলা হওয়ার পর ওই মাইয়া (পিয়াসা) আমারে মোবাইলে মেসেজ পাঠাইয়া কইছে সে সবকিছু মিটমাট কইরা দিব। বিনিময়ে তারে বউ হিসেবে ঘরে তইলা নিতে হইবো। সে (পিয়াসা) ভাবছে আমরা বিপদে পড়ছি…’।
বনানীতে দুই ছাত্রী ধর্ষণ মামলার প্রথম আসামি সাফাত আহমেদ আর তৃতীয় আসামি সাদমান সাকিফ বর্তমানে পুলিশ রিমান্ডে আছেন। মহানগর গোয়েন্দা পুলিশ (ডিবি) এবং ভিকটিম সাপোর্ট সেন্টার যৌথভাবে তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করছে। গতকাল শনিবার ছিল রিমান্ডের প্রথম দিন।
সাদমান সাকিফ পিকাসো রেস্তোরাঁর অন্যতম মালিক ও রেগনাম গ্রুপের পরিচালক মোহাম্মদ হোসেন জনির ছেলে।
২৮ মার্চ বনানীর দ্য রেইনট্রি হোটেলে জন্মদিনের অনুষ্ঠানের নিমন্ত্রণ করে অস্ত্রের মুখে রাতভর আটকে রেখে ধর্ষণ করা হয় বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয়ের দুই ছাত্রীকে। এ ঘটনায় ৬ মে বনানী থানায় ৫ জনকে আসামি করে মামলা করেন ঘটনার শিকার ওই ছাত্রীরা। মামলার পাঁচ আসামি হলেন সাফাত আহমেদ, নাঈম আশরাফ, সাদমান সাকিফ, সাফাতের গাড়িচালক বিল্লাল ও তার দেহরক্ষী আবুল কালাম আজাদ। ঘটনার ৪৪ এবং মামলার ৬ষ্ঠ দিনে বৃহস্পতিবার গ্রেফতার করা হয় দুই আসামিকে। শুক্রবার সাফাতকে ছয় দিনের ও সাদমানকে পাঁচ দিনের রিমান্ডের আদেশ দেন আদালত। তবে এখনো অধরা আছেন ৩ জন।