মঙ্গলে সভ্যতার ‘দ্বিতীয় উপনিবেশ’ গড়ে তোলার দিকে কি আমরা আরও একটু এগিয়ে গেলাম? হয়তো।
মঙ্গলের মাটিতে ফলল মুলো, টোম্যাটো, মটর দানা আর ডালের মতো দানাশস্য! তার সঙ্গে ফলল মোট ১০ রকমের আনাজ। টাটকা, তরতাজা। তার মধ্যে ৪টি যে খাওয়া যায় আর তা খেয়ে সুস্থও থাকা যায়, তা পরীক্ষায় প্রমাণিতও হয়েছে।
আর তা শুধুই ফলানো নয়। সাজিয়ে রাখার জন্যও নয়। সেই সব আনাজ, শস্য খেয়ে নেওয়া যায় দিব্যি! আর তা খেয়ে দিব্যি সুস্থও থাকা যায়! এখানেই শেষ নয়। এই বাসযোগ্য গ্রহে আমাদের ফলানো মুলো, টোম্যাটো, মটর দানা আর ডালের মতো দানাশস্যের যা খাদ্য-গুণ, তার চেয়ে অনেক বেশি ‘উপকারী’ মঙ্গলের মাটিতে ফলানো ওই আনাজ আর শস্যগুলো! লোহার মতো কয়েকটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ধাতু আর তাদের যৌগ প্রচুর পরিমাণে থাকে মঙ্গলের মাটিতে ফলানো আনাজ আর শস্যগুলোতে।
কোনও কল্প-কাহিনী নয়। নয় কোনও রূপকথা। মঙ্গলের মাটিতে ফলানো গিয়েছে মোট ১০ রকমের আনাজ, শস্য। তার মধ্যে অন্তত চারটি আনাজ ও শস্য দিব্যি খাওয়া যায় আর সে সব খেয়ে সুস্থও থাকা যায় বলে পরীক্ষায় প্রমাণিত হয়েছে।
সাম্প্রতিক ওই পরীক্ষার ফলাফল নিয়ে তুমুল আলোড়ন শুরু হয়ে গিয়েছে বিশ্ব জুড়ে। মঙ্গল আর আমাদের চাঁদের মাটিতে ফসল ফলানো যেতে পারে, বেশ কয়েক বছর ধরেই একটু একটু করে সেই বিশ্বাস জোরদার হচ্ছিল বিজ্ঞানীদের। কিন্তু তাঁদের ঘোর সন্দেহ-সংশয় ছিল, ওই সব আনাজ আর শস্য সত্যি-সত্যিই আমরা খেতে পারি কি না। খেয়ে সুস্থ থাকতে পারি কি না, তা নিয়ে রীতিমতো সংশয়ে ছিলেন বিজ্ঞানীরা। কিন্তু হালের একটি পরীক্ষার ফলাফল তাঁদের আশার আলো দেখিয়েছে।
নেদারল্যান্ডসের ওয়াগেনিগেন বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক ইকোলজিস্ট ওয়াইগার ওয়েমলিঙ্ক আর তাঁর সতীর্থদের গবেষণা এই নজরকাড়া তথ্যকে সামনে এনেছে। গবেষকদলের অন্যতম সদস্য আমেরিকার জন্স হপকিন্স বিশ্ববিদ্যালয়ের ইকোলজিস্ট শ্রাবণী পাঠকের কথায়, ‘‘যে ১০ রকমের আনাজ আর দানাশস্য আমরা ফলাতে পেরেছি, তার মধ্যে অন্তত ৪টির খাদ্য-গুণমান গবেষণাগারে পরীক্ষা করে দেখা হয়েছে। ওই পরীক্ষাগুলো করা হয়েছে ‘ডাচ ফুড এজেন্সি’ আর আমেরিকার ‘ফুড অ্যান্ড ড্রাগ অ্যাডমিনিস্ট্রেশন’ (এফডিএ)-এর গবেষণাগারে। তাতে দেখা গিয়েছে, মঙ্গলের মাটিতে ফলানো আনাজ ও দানাশস্যগুলোতে প্রতুর পরিমাণে রয়েছে ভারী মৌল (হেভি এলিমেন্টস্)। আর সেই পরিমাণ যতটা, পৃথিবীর মাটিতে ফলানো আনাজ ও দানাশস্যগুলোতেও ওই ভারী মৌলগুলো থাকে প্রায় একই পরিমাণে। আর তা মোটেই ক্ষতিকারক নয়। আমরা ওই আনাজ আর দানাশস্যগুলো দিব্যি খেতে পারি। আর সে সব খেয়ে আমরা দিব্যি সুস্থও থাকতে পারি। শুধু দেখা গিয়েছে, মঙ্গলের মাটিতে ফলানো আনাজ আর দানাশস্যগুলোর মধ্যে শুধু মুলোতেই লোহা, অ্যালুমিনিয়াম আর নিকেল থাকে স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি পরিমাণে। তবে চাঁদের মাটিতে মুলো ফলানো একটু মুশকিল।তাতে লোহা, অ্যালুমিনিয়াম আর নিকেল থাকে একটু বিপজ্জনক মাত্রায়। তবে মঙ্গলের মাটিতে ফলানো মুলোয় যে ভারী মৌলগুলোর পরিমাণ স্বাভাবিকের চেয়ে একটু বেশি রয়েছে, তা নিয়ে অবশ্য খুব চিন্তার কিছু নেই। সেই মাটি ভাল করে ধুয়ে নেওয়া হলে ওই ভারী মৌলগুলোর পরিমাণ কমিয়ে আনা যায়।’’
শ্রাবণী আরও জানাচ্ছেন, ‘‘আমরা অবাক হয়ে দেখেছি, মঙ্গলের মাটিতে ফলানো আনাজ আর দানাশস্যগুলোর মধ্যে সীসা, আর্সেনিক, তামা ও ক্যাডমিয়ামের মতো ‘বিষাক্ত’ মৌলগুলো যতটা থাকে, তার চেয়ে ওই মৌলগুলো অনেক বেশি থাকে পৃথিবীর কোনও কোনও প্রান্তের মাটিতে। বিশেষ করে এশিয়া ও আফ্রিকার মাটিতে। তবে এ ক্ষেত্রে আমরা এখনো কিছুটা সন্দেহ-সংশয়ে রয়েছি। কারণ, আমরা মঙ্গল আর চাঁদে যে রকমের মাটি রয়েছে, তার মধ্যে যে যে মৌলগুলোর যতটা পরিমাণে থাকা উচিত, ঠিক সেই পরিমাণেই মৌলগুলোকে রেখে গবেষণাগারে ওই মাটি বানিয়েছি। আর তাতে ওই সব ফসল ফলিয়েছি। মঙ্গলের প্রায় শূন্য অভিকর্ষে (মাইক্রো-গ্র্যাভিটি) সেই মৌলগুলো মঙ্গল বা চাঁদের মাটিতে একেবারে ‘অন-সাইট’ ফসল ফলানোর সময় কতটা সক্রিয় থাকবে, সেটা কিন্তু পরীক্ষা করে দেখার সুযোগ আমরা এখনও পাইনি।’’