শুধু পেটের তাগিদে দিন-রাত হাড়ভাঙা খাটুনি। শরীরের রক্তকে পানি করে জীবনধারণ। জীবন নিয়ে তাদের কোন আশা বা স্বপ্নও নেই। শুধু জঠরের জ্বালা। এই জ্বালা বড়ই বেদনাদায়ক। যতক্ষণ না পেটে গিয়ে কিছু পড়বে ততক্ষণ নিস্তার নেই।
পীড়ার জ্বালা ভোগ করে চলতেই হবে। এই নরকজ্বালা থেকে রেহাই পেতে সামান্য অর্থের বিনিময়ে তাই ওরা শ্রম বিক্রি করতে বাধ্য হয়। আর মধ্যস্বত্ত্বভোগীরা ওই সুযোগটা লুফে নিয়ে সামান্য অর্থের বিনিময়ে শ্রম কিনে নিয়ে নিজেদের ভুড়ির আয়তন বাড়িয়ে চলেছে।
এক ভোরে বেরিয়ে ওদের দেখা মিলল গাবতলীর আমিনবাজারের ব্রিজের নিচে কয়লার হাটে। পায়ে নীল রঙের কালি মাখানো ছেড়া চপ্পল, হেঁটে চলেছে পাতলা তক্তার ওপর দিয়ে। বিনা ট্রেনিংয়ে অনেকটা সার্কাসের শারীরিক কসরত দেখানোর মতো। জাহাজ থেকে আঁটসাট কোনো ব্যবস্থা ছাড়াই পারাপারের জন্য ডাঙার সঙ্গে মিলিয়ে বসানো হয়েছে পাতলা তক্তা, হাঁটার তালে তালে দুলছে তক্তা, মুহূর্তে পা ফসকে হতে পারে দুর্ঘটনা, কদমে কদমে এগিয়ে চলা।
দরদর করে ঘাম ঝড়ছে, মাথার ঘাম নুয়ে পড়ছে পায়ের তলা অবধি। পাতলা ছিলছিলে রোগাকান্ত শরীরটা বহন করছে মাথায় ভারি টুপড়ি। সেই ভারের চাপে কখনো কখনো বেঁকে যাচ্ছে শরীর, তবু্ও মাথার ভারি টুপড়িটা ঠিকঠাক মতো বসিয়ে রাখার অভ্যাসটা রপ্তটা ইতোমধ্যে আপনাআপনি হয়ে গিয়েছে। তাকে নড়ানোর কার সাধ্য । এ যে জীবনকে বাঁচিয়ে রাখার সংগ্রাম। তাকে টলানোর সাধ্য কারো নেই।
যতো টুপড়ি ততো টাকা। টুপড়ি গোনেই উঠবে ঘামের দাম। তাই দম নেয়ার সময় কোথায়। এক মুহূর্ত নষ্ট করা চলবে না। ঘরে অভুক্ত ছেলে-মেয়ে আর বৃদ্ধ বাবা-মা।
দিনশেষে যে টাকা মিলবে তাই দিয়ে চাল-ডাল, খাবার কিনে ঘরে গেলে সবার শুকনো মুখে মহাতৃপ্তির হাসি ফুটবে।এ হাসি মহামূল্যবান। স্বর্গীয় পরিতৃপ্তির হাসি।
কয়লা মাখা জীবনটা ওদের। বৈশাখের কাঠফাটা রোদে শরীরের ওপর শত কষ্ট সহ্য করে ওরা নিরন্তর মুখ বুজে কাজ করে যায়।কাজ করলেও মনের ভেতরের কষ্ট জানান দেয় ঘর্মাক্ত শরীরের ভাজে ভাজে। বাড়ি ফেরা না অবধি শ্রমের হাতে গোনা কয়েকটা টাকা পেয়ে কষ্ট ভেজা মুখটায় কখনো হাসি ফোটে না, কেননা ওরা তিন টাকার শ্রমিক বলে……….।
গাবতলীর বুড়িগঙ্গা নদীর কয়লার ঘাটের চিত্র এটি। প্রতিদিন দেশ-বিদেশ থেকে হাজারো কয়লার জাহাজ নোঙর করে এই ঘাটে। জীবন ও জীবিকার তাগিদে প্রতিদিন এই সস্তা পয়সায় শ্রম বিক্রি করেন কয়েক’শ নারী শ্রমিক।
কয়লার ঘাটে প্রায় ৫ বছর ধরে কাজ করছেন ফুলবানু। পরনের তেনা হয়ে যাওয়া ছেঁড়া শাড়িটা ঘামে ভিজে শরীরের সঙ্গে লেপ্টে আছে।
ফুলবানু জানান, পেটের খাবার যোগাতেই এই কঠিন জীবন তার। রোগে-ভুগে টাকার অভাবে বিনা চিকিৎসায় সময় না আসতেই স্বামী আক্কাস পাড়ি জমিয়েছেন পরপারে। স্বামী বেঁচে গেলেও অথৈ সমুদ্রে পড়েছেন ফুলবানু। ঘাড়ে পড়েছে সংসার। তখন থেকে শুরু ফুলবানুর জীবনযুদ্ধ। তিন সন্তান নিয়ে তার অভাবের সংসার। ঘরে আছেন বৃদ্ধ বাবা-মা। দিন এনে দিন খাওয়া সংসার। যে দিন কাজে জোটে ওই দিন খাওয়া চলে নয়তো উপোস থাকতে হয়।
ফুলবানু জানান, আল্লায় আমাগো গরিব বানায়ছে, এক কাপড়েই কয়েক বছর পার। দেখছেন পরনের কাপটা তেনা হয়ে গেছে। তাকালেই ঘামে ভেজা শরীরের মাংসের ভাজ বোঝা যায়। কাম করি পেটের দায়ে। পর পুরুষে নজর দেয়। কাপড় পইড়া বসবার পাড়ি না। টান লাগলেই ছিড়া যায়। এই হলো আমগো জীবন। বলতেই দু’চোখের পানি ছেড়ে দেয় ফুলবানু।
অশ্রুশিক্ত নয়নে ফুলবানু জানায়, পেটের দায়ে কাম করি। যে কাম করি তা দিয়ে তো তিন বেলা খাওয়াই চলে না। আমগো শ্রমের কোনো দাম নাই, শরীরেও দাম নাই। জীবনডা মিথ্যা। মিথ্যা জীবনের গল্প শুনইয়া কী লাভ? আমগো দুঃখ দেখার কেউ নাই। শ্রমের টাকাও ঠিকঠাক পায় না ফুলবানু।
হতভাগা এই নারী শ্রমিক জানান, মাইয়া মানুষ বইলা শ্রমের দাম কম। আমি তো শ্রম কম দেই না। কিন্তু বেডা গো থেকইয়া আমগো পয়সা কম দেয়। এ কেমন বিচার?
তিনি বলেন, ভিক্ষা চাই না শ্রমের দাম চাই। বলতেই ঘামে ভেজা শাড়ির আঁচল দিয়ে চোখ মোছেন ফুলবানু।
ঘরে তিন সন্তান আনু, মনি, কমলা আর বৃদ্ধ বাবা-মাকে রেখে সকালে কাজে বের হন ফুলবানু।
অবুঝ সন্তানরা সারা দিন ঘরে বসে অপেক্ষা করতে থাকে মা কখন খাবার নিয়ে ঘরে ঢুকবেন। সারা দিন শ্রম বেঁচে সন্ধ্যায় ঘরে ফেরেন ফুলবানু। উনুনে হাড়ি চড়াতে চড়াতে কোন কোনদিন ক্ষুধা নিয়ে ঘুমিয়ে পরে ফুলবানুর সন্তানরা।
ফুলবানু বলেন, ‘বাচ্চাগুলারে লেখাপড়া করাইতে মন চায়। কিন্তু আমার তো সাধ আছে কিন্তু সাধ্য নাই। ’
প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার কথা উল্লেখ করে ফুলবানু বলেন, ‘হাসিনা মায়েরে বইলেন, বড় কষ্টে আছি।’
ফুলবানুর মতো আরো অনেক নারী শ্রমিক কাজ করছে গাবতলীর এই কয়লার হাটে। তাদের ঘামে শ্রমে লাভবান হচ্ছে কয়লার ব্যবসায়ী ও মহাজনরা। কিন্তু এই নারীদের জীবনের কোনো পরিবর্তন নেই। দিন এনে দিন খেয়েই কোনো মতে পার হচ্ছে তাদের জীবন।
গাবতলীর এই ঘাটে কাজ করেন আরেক নারী শ্রমিক মুন্নি। সকাল থেকে সন্ধ্যা অবধি টুপড়ি মাথায় কয়লা টানার কাজ করেন মুন্নি। কাজের ফাঁকে টুপড়ি হাতে নিয়ে গাছের ছায়ায় দাঁড়িয়ে আছেন মুন্নি।
মুন্নি জানান, কয়লার টুপড়ি মাথায় টানা বড় কষ্ট। কিন্তু পেট তো কোন কষ্ট বুঝতে চায় না। সে হুধু খাউন চায়।
অন্য কাজ রেখে টুপড়ি মাথায় কয়লা টানার মতো এই কঠিন কাজ করেন কেন- এমন প্রশ্নের জবাবে ওই নারী শ্রমিক বলেন, ‘বাসা বাড়িতে কাজ করলে মানুষ খারাপ ব্যবহার করে। গৃহকর্তা নানা অজুহাতে গায়ে হাত তোলে। তাই পরিশ্রম কম হলেও এমন কঠিন কাজে নেমেছি। অন্তত বন্দিঘরে দিনরাত ফাই ফরমায়েস করতে হয় না।