রাত পোহালেই আইনজীবী সমিতির নির্বাচন, অথচ কেমন যেন নীরব আদালত প্রাঙ্গণ। প্রচারণায় বিরল নিরবতা। তবে প্রাঙ্গণ নীরব হলেও আশপাশের রেস্টুরেন্টগুলোতে নির্বাচনের আমেজ টের পাওয়া যাচ্ছে ভালো করেই।
নির্বাচনের তফসিল ঘোষণার পর থেকে প্রার্থীদের কোনো মিছিল মিটিং করতে দেখা যায়নি আদালত প্রাঙ্গণে। ইতিপূর্বে নির্বাচনগুলোতে ভোটগ্রহণের আগের দিনগুলোতে যে উৎসবের আমেজ থাকতো এ বছর তা দেখা যায়নি।
সুপ্রিমকোর্ট আইনজীবী সমিতির ২০১৭-২০১৮ মেয়াদের নির্বাচনে পাঁচ হাজার ৮০ জন আইনজীবী তাদের ভোটাধিকার প্রয়োগ করবেন। দুই দিনব্যাপী ভোটগ্রহণ করা হবে। বুধবার সকাল ১০টা থেকে ভোটগ্রহণ শুরু চলবে বিকাল ৫টা পর্যন্ত। বৃহস্পতিবারও একইভাবে ভোটগ্রহণ করা হবে। তবে দুপুরে নামাজ ও খাবারের জন্য এক ঘণ্টার বিরতি দেয়া হবে। সুপ্রিমকোর্ট বার এর কার্যনির্বাহী কমিটির ১৪ টি পদে এ নির্বাচন অনুষ্ঠিত হবে। এর মধ্যে সাতটি সম্পাদকীয় ও সাতটি নির্বাহী সদস্যের পদ রয়েছে।
এবার নীল-সাদা প্যানেলের জন্য ক্যাপ ও টি-শার্ট পরে ভোট প্রার্থণা করতে দেখা যায়নি প্রার্থী ও তাদের সমর্থক আইনজীবীদের। আইনজীবীদের কাছে ব্যক্তিগত ভোট প্রার্থণা ছাড়া আর কোনো কার্যক্রম দেখা যায়নি। আদালত প্রাঙ্গনে প্যানেলভিত্তিক পরিচিতি সভা না করলেও আলোচনা সভা বা অন্য নামে প্যানেল পরিচিতি অনুষ্ঠান করেছে আওয়ামী লীগ ও বিএনপি সমর্থিত প্রার্থীরা। আদালত প্রাঙ্গণের বাইরে অভিজাত হোটেলে আইনজীবীদেরকে দাওয়াত দিয়ে ভুরিভোজ করানো হয়েছে।
গতকাল সোমবার রাতে ধানমন্ডির ৮ নম্বর রোডে হোটেল জিংজিয়াংয়ে ‘নিম্ম আদালতের বিচারকদের সংগঠন জুডিসিয়াল সার্ভিস এসোসিয়েশন ভবন’ হিসেবে পরিচিত, আইনজীবীদের ভুরিভোজ করান আওয়ামী লীগ সমর্থিত সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ প্যানেলের প্রার্থীরা। সেখানে প্যানেল পরিচিতি ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন উপলক্ষে আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়।
আর ধানমন্ডি ২৭ হোটেল জিনজিয়াং এ বিএনপি সমর্থিত (জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য) প্যানেলের প্রার্থীরা আইনজীবীদের জন্য খানাপিনার আয়োজন করে।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী গোলাম সরওয়ার পায়েল বলেন, এবার থেকে সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির নির্বাচন অনেকটা ব্যতিক্রম। প্যানেল দেয়া হয়নি, মিছিল মিটিং, পোস্টার, ব্যানার নিষিদ্ধ ছিল। নির্বাচনকে কেন্দ্র করে যে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা ছিল তা বন্ধ ছিল।
সুপ্রিম কোর্টের এ আইনজীবী জানান, প্রকাশ্যে এসব বন্ধ থাকলেও গোপনে সবকিছুই চলেছে। আলোচনা সভার নামে তারা প্যানেল পরিচিতি অনুষ্ঠান করেছে। অভিজাত হোটেলে ভুরিভোজ করানো হয়েছে। অনেক আইনজীবীর রুমেও ব্যক্তিগতভাবে খাবার পৌঁছানো হয়েছে।
নির্বাচন প্রচারণার শেষ দিন মঙ্গলবার সকাল থেকে বিকেল পর্যন্ত সুপ্রিম কোর্ট প্রাঙ্গণে দেখা যায়, প্রার্থীরা ভোট চাইতে আইনজীবীদের চেম্বারগুলোতে যাচ্ছেন। ভোটারদের নানা প্রতিশ্রুতি দিচ্ছেন। তবে প্রতিবারের মতো এবার কোনো মিছিল দেখা যায়নি। প্রতি বছর নীল ও সাদা ক্যাপ পরে যে প্রচারণা চালানো হতো এবার সেটি দেখা যায়নি। প্রতি বছর আইনজীবী ভবনের বাইরে প্যান্ডেল করে ভোটগ্রহণ করা হতো। সেটি বাদ দিয়ে এবছর আইনজীবী ভবনে শহীদ শফিউর রহমান মিলনায়তনের ভোটগ্রহণের ব্যবস্থা করা হয়েছে। প্যানেলের পক্ষ থেকে আইনজীবী ভবনের বাইরে বিশাল যে প্যান্ডেল করা হতো এ বছর তা দেখা যায়নি।
নির্বাচন পরিচালনা কমিটির সদস্য বিএম ইলিয়াছ কচি বলেন, এ বছর প্রচারণা নিয়ে কিছু নিয়ম করে দেয়া হয়েছিল। নির্বাচনের আগের দিনগুলোতে আদালত প্রাঙ্গণে বেশ খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা থাকতো। তবে এ বছর প্রার্থীদের পক্ষ থেকে আইনজীবীদের খাবার প্রদানে নিষেধাজ্ঞা রয়েছে। সোমবার ৫০ প্যাকেট খাবার জব্দ করা হয়েছে।
তিনি বলেন, প্রচারণার ক্ষেত্রেও বাধানিষেধ ছিল এবার। আদালত প্রাঙ্গণে মিছিল, মিটিং ও সভা করা নিষিদ্ধ ছিল। প্রতি বছর প্যানেল করে যে প্রচারণা চালনো হতো এবছর তাও নিষিদ্ধ ছিল। সকল প্রার্থী শুধুমাত্র নির্দিষ্ট আকারের হলুদ লিফলেটের মাধ্যমে প্রচারণা চালিয়েছে। প্রার্থীদের পক্ষ থেকে কারা প্রচারণা চালাবে তাদেরকে আইডি কার্ড করে দেয়া হয়েছিল।
তিনি জানান, সুপ্রিম কোর্টের আইনে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচন করার কোনো নিয়ম নেই। ১৯৯৬ সাল পর্যন্ত প্যানেল ছাড়া নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৭ সাল থেকে প্যানেলভিত্তিক নির্বাচন শুরু হয়।
সুপ্রিম কোর্ট বার তত্ত্বাবধায়ক নিমেষ চন্দ্র দাস জানান, এবারের ১৪টি পদের বিপরীতে ৩১ জন প্রার্থী নির্বাচন করছেন। আওয়ামী লীগ ও বিএনপি প্যানেল ছাড়াও স্বতন্ত্রভাবে সভাপতি পদে একজন এবং সম্পাদক পদে দু’জন অংশগ্রহণ করছেন।
তিনি জানান, এ ওয়াই মশিহুজ্জামানকে আহ্বায়ক করে সাত সদস্যের নির্বাচন পরিচালনা উপ-কমিটি গঠন করা হয়েছে। তারা ইতোমধ্যে নির্বাচনের সব প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন।
আওয়ামী লীগ সমর্থিত (সম্মিলিত আইনজীবী সমন্বয় পরিষদ) প্যানেলে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন আবদুল মতিন খসরু। অন্যান্য পদের মধ্যে সহ-সভাপতি অজিবউল্লাহ ও হোসনে আরা, সম্পাদক রবিউল আলম বুদু, কোষাধ্যক্ষ রফিকুল ইসলাম হিরু, সহ-সম্পাদক শফিকুল ইসলাম ও সেলিম আজাদ প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। আর কার্যনির্বাহী সদস্য হিসেবে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন কুমার দেবুল দে, এ বি এম নূরে আলম উজ্জ্বল, হাসিনা মমতাজ, রুহুল আমিন তুহিন, হাবিবুর রহমান হাবিব, মাহমুদুন্নবী উজ্জ্বল ও শেখ মো. মাজু মিয়া।
বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন মো. জয়নুল আবেদীন। এছাড়া সহ-সভাপতি পদে উম্মে কুলসুম বেগম (রেখা) ও ড. মো. গোলাম রহমান ভূঁইয়া, সম্পাদক পদে এ. এম. মাহবুবব উদ্দিন খোকন, কোষাধ্যক্ষ পদে এ বি এম রফিকুল ইসলাম তালুকদার (রাজা) এবং সহ-সম্পাদক পদে কাজী জয়নুল আবদীন ও শামীমা সুলতানা (দীপ্তি) প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। সদস্য পদে লড়ছেন শেখ তাহসিন আলী, মো. এমাদুল হক, আয়েশা আক্তার, মো. আহসানউল্লাহ, মো. মুসাব্বির হাসান ভূঁইয়া (রোমান), মোহাম্মদ হাসিবুর রহমান ও মৌসুমী আখতার।
দুই প্যানেলের বাইরে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে সভাপতি পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন ইউনুছ আলী আকন্দ, সম্পাদক পদে আছেন অশোক কুমার ঘোষ ও মো. আবু এহিয়া দুলাল।
বিএনপি সমর্থিত জাতীয়তাবাদী আইনজীবী ঐক্য প্যানেলে সম্পাদক পদে প্রার্থী এ. এম. মাহবুবব উদ্দিন খোকন ঢাকাটাইমসকে বলেন, ‘নির্বাচন কমিশনের পক্ষ থেকে প্যানেল দেয়া নিষেধ ছিল। তবে আমরা বিভিন্ন জায়গায় প্রচারণা চালাচ্ছি প্যানেল হিসেবে’।
হোটেল জিনজিংয়াং এ আপনাদের কী প্রোগ্রাম ছিল, জানতে চাইলে তিনি বলেন, সেখানে তাদের প্যানেল পরিচিতি ছিল।
তিনি বলেন, ‘নীল প্যানেল আসার পরে গত কয়েক বছরে সুপ্রিম কোর্টের উন্নয়ন, আইনজীবীদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধি করা, বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, দেশের চলমান রাজনীতি সবকিছু মিলে আমরা আশা করছি এ নির্বাচনে পূর্ণ প্যানেলে জিতবো।
২০১৬-২০১৭ সেশনের নির্বাচন ২৩ ও ২৪ মার্চ অনুষ্ঠিত হয়েছিল। ওই নির্বাচনে সভাপতি পদে নির্বাচিত হয়েছিলেন আওয়ামী লীগের উপদেষ্টা পরিষদের সদস্য অ্যাডভোকেট ইউসুফ হোসেন হুমায়ুন ও সম্পাদক পদে বিএনপির যুগ্ম মহাসচিব মাহবুব উদ্দিন খোকন।