বাংলাদেশের উত্তরপূর্বাঞ্চলের ৭টি জেলার ২৯টি উপজেলার প্রায় ৮৫৯,০০০ হেক্টর (৮,৫৯০ বর্গ কিলোমিটার) এলাকা ব্যাপী বিস্তীর্ণ নিম্নভূমিতে হাওরাঞ্চল অবস্থিত, যা বর্ণিত জেলাসমুহের মোট আয়তনের ৪৩%। প্রায় ২০ মিলিয়ন জনসংখ্যা অধ্যুষিত এ জেলাসমুহে অধিবাসীদের মধ্যে প্রায় ১০ মিলিয়ন হাওরাঞ্চলবাসী মানুষের প্রধান জীবিকা এক ফসলি বোরো ধান চাষাবাদ। সহযোগী জীবিকা হিসেবে কেউ কেউ প্রাকৃতিক উৎস থেকে মৎস্য আহরণ, গবাদিপশু ও হাঁস-মোরগ লালনপালন করে থাকেন।
২। হাওরে প্রধানত দুইটি ঋতু বা মৌসুম। শুকনাকাল বা শুষ্কমৌসুম ও বর্ষাকাল বা বর্ষামৌসুম। বর্ষামৌসুমের এ অঞ্চলের বেকারত্ব একটি যুগবাহিত সমস্যা। আনুমানিক ষোড়শ শতাব্দীর গোড়ার দিকেই আদি হাওরবাসীরা তাদের জীবনের, উৎপাদিত ফসল, ঘরবাড়ি, বসতভিটা ও সহায়সম্বলের ঝুঁকি নিয়ে প্রাকৃতিক দূর্যোগ মোকাবিলা করে হাওরাঞ্চলে স্থায়ীভাবে বসতি গড়ে তুলতে শুরু করছেন। তখন থেকেই বর্ষাকালে মৌসুমি বেকাত্ব তাদের জীবনযাত্রার অনুষঙ্গ হিসেবেই ছিল এবং এখনো আছে। এ সমস্যাটি নিয়ে রাষ্ট্রীয়, সামাজিক ও ব্যক্তি পর্যায়ে তেমনভাবে কখনো আলোচনা হয়নি। তার কারণ, এককালে হাওরের উর্বর ভূমির উৎপাদনশীলতা, জনসংখ্যার তুলনায় ভূমির আধিক্য, মৎস্য ও পশুসম্পদের প্রাচুর্ষ্য তাদের সচ্ছল ও সরল জীবযাপনের জন্য যথেষ্ট ছিল। কালক্রমে হাওরের জনসংখ্যাবৃদ্ধির ফলে মাথাপিছু আবাদযোগ্য জমির পরিমান হ্রাস, নদী-বিল-খাল-পুকুর-জলাশয়সমুহ ভরাট হয়ে যাওয়ায় মৎস সম্পদের উৎপাদন মারাত্মকভাবে হ্রাস পায়। প্রায় সকল পতিত জমি ও কান্দা লো-লিফট পাওয়ার পাম্পের সেচের মাধ্যমে বোরো ধান চাষের আওতায় চলে আসায় গবাদিপশুর অবাধ চারণভূমি বিলুপ্ত হয়ে যায়। ফলশ্রুতিতে হাওরাঞ্চলে পশুসম্পদ লালনপালনও হ্রাস পায়। অন্যদিকে ফিবছর আগাম বন্যা ও শিলাবৃষ্টিতে এক ফসলি ধানের ফলন ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় এবং ক্রমাগত কৃষি উপকরণ যথা বীজ, সার, ডিজেল/বিদ্যুৎ, কীটনাশকের, সেচপাম্প, পাওয়ার টিলারসহ অন্যান্য কৃষিযন্ত্রপাতি ও যন্ত্রাংশের মূল্যবৃদ্ধি ধানের উৎপাদন ব্যয় সাম্প্রতিক বছরগুলোতে মণ প্রতি টাকা ৭০০/- থেকে টাকা ৮০০/- দাঁড়িয়েছে। পক্ষান্তরে, গত দুই/তিন বছর যাবৎ ফসল তোলার মৌসুমে কৃষক পর্যায়ে প্রতিমণ বোরো ধানের বিক্রয়মূল্য থাকে ৫০০/- থেকে ৬০০/- টাকার মধ্যে। যদিও ফসল ঘরে তোলার ৩/৪ মাস পরে ধানের মূল্য কিছুটা বৃদ্ধি পায়, কিন্তু অভাবী ও চড়া সুদে ঋণগ্রস্ত প্রান্তিক ও মাঝারি চাষিদের পক্ষে ফসল নিজ ঘরে গুদামজাত করে রাখা সম্ভব হয় না মহাজনের ঋণ পরিশোধের তাড়ায়। এতে করে চাষিদেরকে প্রতিমন উৎপাদিত ধাণে ১৫০/- থেকে ২০০/- টাকা লোকসান দিয়ে ফঁড়িয়া/দাদন ব্যবসায়ী মহাজনদের কাছ ধান বিক্রি করতে হয়। সরকার নির্ধারিত মূল্যে ( এ বছরে কৃষক পর্যায়ে প্রতিমন ধানের ক্রয়মূল্য ১০৫০/- টাকা) ধান ও চাল সংগ্রহের কার্যক্রম শুরু করতে বিলম্ব হওয়া এবং মোট বিক্রয়যোগ্য ধাণের পরিমানের তুলনায় সরকারের সংগ্রহ লক্ষ্যমাত্রা খুবই কম থাকায় ও মধ্যস্বত্তভোগী ব্যবসায়ী-খাদ্য বিভাগীয় কর্মচারীদের দূর্নীতির জন্য সরকারের এই ভূর্তকি সুবিধা কৃষকের ঘরে পৌঁছে না।
৩। আমাদের ছেলে বেলায় বিগত শতাব্দীর ষাটের দশকের মাঝি থেকে ও সত্তরের৷ দশকের মাঝামাঝি সময় কালে দেখতাম শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিন এ তিন মাসের বিভিন্ন সময়ে হাওরের ভূমিহীন কিংবা প্রান্তিক চাষীগণ দলবেধে নৌকায় চাল, ডাল, মসলাপাতি, ডেক-ডেকছি, বিছানাপত্র ইত্যাদি নিয়ে বৃহত্তর সিলেট জেলার সুনামগঞ্জ, সিলেট, মৌলভিবাজার ও হবিগঞ্জ কিংবা কিশোরগঞ্জ ও ময়মনসিংহের উজান এলাকায় দৈনিক ভিত্তিতে কৃষিশ্রমিক হিসেবে কাজের সন্ধানে যেতেন। আবার কার্তিক মাসের শুরুতে হাওরের পানি নেমে যাওয়ার সাথে সাথে বাড়ি ফিরে আসতেন। তবে, অবস্থাপন্ন কৃষকের যুবক সন্তানেরা আরাম আয়েশে প্রধানত তাস, লুডু, বাঘবন্ধি, হাডুডু, গিলা (এক ধরনের শক্ত কাঠের চাকতি), মার্বেল, ক্যারম ইত্যাদি খেলা, নৌকাবাইচ এবং কিচ্ছাকাহিনী, জারিসারি ও পালাগানের আসর জমিয়ে সময় কাটাতো। শ্রাবণ, ভাদ্র ও আশ্বিণ মাসে বিয়ে-সাদির অনুষ্ঠানেরও ধুম পড়ে যেত। আর পেশাদার জেলে সম্প্রদায় ভরা বর্ষার গভীর জলে বড় ফাঁসের জাল দিয়ে রুই, কাতলা, মৃগেল, বাউস, আইর, চিতল, বোয়াল ইত্যাদি বড় মাছ ধরতেন। কেউবা ছিপ-বড়শি দিয়ে মোটা বাইন, কেউবা পানির নিচে মাটিতে আটকিয়ে ‘চাই’ নামক বাঁশের শলাকা দিয়ে তৈরি এক ধরনের ফাঁদ বসিয়ে প্রধানত চিংড়ি, ছোট বাইন, মেনি মাছ শিকার করতেন। আবার কেউ কেউ চারজনের টঙজাল দিয়ে জাঁকে জাঁকে স্বচ্ছ পানিতে সঞ্চরণশীল মাঝারি ধরনের মাছ যেমন সরপুঁটি, ঘইন্না, লাচুর, কালিবাউস, নলা মাছ ইত্যাদি এবং ক্ষুদ্র ও ঘন ফাঁসের জাল দিয়ে ভাসমান ছোটমাছ যথা মলা, ঢেলা, কাচকি, চাপিলা ইত্যাদি ধরতেন এবং পাইকারের কাছে অথবা স্থানীয় হাট-বাজারে বিক্রি করে জীবিকা নির্বাহ করতেন। ভূমিহীন ও প্রান্তিক কৃষিজীবীরাও মৌসুমি জেলে হিসেবে মাছ ধরে নিজেদের প্রোটিনের প্রয়োজন মিটিয়ে অবশিষ্ট মাছ গ্রামের বড় কৃষক ও ধনীদের কাছে অথবা বাজারে বিক্রি করে দুটো অতিরিক্ত পয়সা আয় করতেন। বর্তমানে এই দুই শ্রেনির মানুষের আর্থিক অবস্থা খুবই খারাপ হয়ে পড়েছে। কারণ, আগের মতো উন্মুক্ত পানিতে আর তেমন মাছ পাওয়া যায় না, প্রধানত কৃষিজমিতে অতিরিক্ত রাসায়নিক সার কীট ও বালাই নাশক ব্যবহারজনিত কারণে এবং নদী, বিল, খাল, পুকুর ও জলাশয়গুলো ক্রমাগত ভরাট হয়ে যাওয়ায় এবং শীতকালে পানির স্বল্পতায় মাতৃমাছ ও পোনামাছ ধরে ফেলায় মাছের বংশবৃদ্ধি বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
৪। কৃষি উপকরণ যথা- সার, ডিজেল, বিদ্যুৎ, কৃষি সেচ, চাষাবাদ ও ফসল মাড়াই যন্ত্রপাতির অতিরিক্ত মূল্যবৃদ্ধি, উৎপাদিত ধান/ফসলের উপযুক্ত মূল্য না পাওয়া, প্রায়শ ফিবছর আগাম বন্যায় অপরিপক্ক ফসলহানি প্রান্তিক ও ভাগ চাষীদের মেরুদন্ড ভেঙে গেছে। তাছাড়া, কৃষিকাজ দিন দিন অলাভজনক হয়ে পড়ায় জোতদার ও বড় কৃষকদের বেশীর ভাগ পরিবারই এখন আর সরাসরি কৃষিকাজের সাথে জড়িত নেই। তাদের সন্তানরা কেউ কেউ উচ্চশিক্ষা গ্রহন করে সরকারি, বেসরকারি চাকরি কিংবা ব্যবসায় পেশায় নিয়োজিত হয়ে জেলা, বিভাগীয় সদর বা রাজধানীতে কিংবা উপজেলা পর্যায়ে বা গ্রামের স্কুল-মাদ্রাসায় চাকরি করে জীবিকা নির্বাহ করছেন। কেউবা সপরিবারে শহুরে জীবনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছেন। তাদের একটি অংশ, যারা ছোট চাকরি বা ব্যবসায় নিয়োজিত, তারা পরিবার পরিজন হাওরে দেশের বাড়িতেই রাখেন। ছুটিতে বা উৎসব-পার্বণে তারা পরিবারের সাথে মিলিত হওয়ার জন্য হাওরের গ্রামের বাড়িতে আগমন করেন। বড় চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ীরাও ঈদ-পার্বণে বছরে দুই/একবার সপরিবারে গ্রামের বাড়ি বেড়াতে আসেন।
৫। ভূমিহীন ও প্রান্তিক চাষীদের একটি অংশ বর্ষাকালে মৌসুমি বেকারত্ব দূরীভূত করার জন্য এবং কিছু নগদ অর্থ উপার্জনের নিমিত্ত শহরে এসে রিক্সা বা স্কুটার চালনা, বাসের হেলপার কিংবা তৈরি পোষাকশিল্পের অদক্ষ শ্রমিক কিংবা নির্মাণশিল্পের অস্থায়ী শ্রমিক হিসেবে সাময়িক কর্মসংস্থান জোগার করে নেয়। মৌসুম শেষে আবার দেশে ফিরে গিয়ে কৃষিশ্রমিক হিসেবে নিয়োজিত হয়। আর একদল স্কুল ও কলেজ ড্রপআউট যুবক অদক্ষ শ্রমিক হিসেবে, কেউ কেউ দক্ষতা অর্জন করে বা দক্ষতার সার্টফিকেট কিনে ৫ থেকে ৭ লক্ষ টাকার বিনিময়ে আদমবেপারি কোম্পানি বা ব্যক্তি পর্যায়ের দালালের মাধ্যমে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কিংবা মালয়েশিয়া, সিংগাপুর বা ইউরোপের কোন কোন দেশে বৈধ কিংবা অবৈধ কর্মীর ভিসা কিংবা পর্যটক ভিসায় গমন করেন। অধিকাংশ (প্রায় ৮০%) ক্ষেত্রেই তারা দেশী ও বিদেশী আদম বেপারিদের খপ্পরে পড়ে সর্বশান্ত হয়ে ৩ থেকে ৬ মাসের মধ্যে দেশে ফিরে আসে। কেউ কেউ নৌপথে অবৈধভাবে ইউরোপের বিভিন্ন দেশে অনুপ্রবেশ করতে গিয়ে ভূমধ্য সাগরের নীল জলে সলিলসমাধি সৃষ্টি করেন। কেউ কেউ থাইল্যান্ডের গভীর জঙ্গলে অনাহারে, অর্ধাহারে, পোকামাকড়ের কামড়ে মৃত্যুবরণ করেন। আবার কেউবা মালয়েশিয়াসহ মধ্যপ্রাচ্যের অনেক দেশের কারাগারে বন্দি জীবন কাটান। শতকরা ২০ জন বৈধভাবে কঠোর শারীরিক পরিশ্রমের কাজ করে অতিকষ্টে দিনাতিপাত করে। দেশে মা-বাবা-ভাই-বোনদের সুখের জন্য এবং এ দেশের উন্নয়নের জন্য প্রয়োজনীয় বৈদেশিক মুদ্রার যোগান দেন তারাই। ফলশ্রুতিতে এ সকল পরিবার আর্থিকভাবে কিছুটা সুখের মুখ দেখে। এই শতকরা বিশটি পরিবারের সাময়িক সুখ-স্বাচ্ছন্দ দেখে অন্যান্য বেকার যুবকদের পরিবারও উৎসাহিত হয়ে নিজেদের জওয়ান সন্তানকে বৈধ কিংবা অবৈধ উপায়ে আরো অধিক টাকা ব্যয় করে বিদেশে পাঠাতে উদ্বুদ্ধ হয়। কিন্তু ৮০ জনের পরিবারের দুর্গতির কথা তাদের ভাবনায় আসে না। পরিণতি তথৈবচ।
৬। এ কথা সত্যি যে, বাধ্যতামূলক প্রাথমিক শিক্ষা এবং অষ্টম শ্রেণি পর্যন্ত মেয়েদের অবৈতনিক শিক্ষা ও উপবৃত্তি চালু করার ফলশ্রুতিতে হাওরে নারী-পূরুষের শিক্ষার হার ও চাকরিজীবীর সংখ্যা কিছুটা বৃদ্ধি পেয়েছে। তবে, শিক্ষার গুণগত মান অত্যন্ত নিম্নগামী। শিক্ষার হার বৃদ্ধির সাথে তাল মিলিয়ে হাওরে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি না পাওয়ায় শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বৃদ্ধি পাচ্ছে, যা অচিরেই প্রকট আকার ধারণ করবে। এই উদ্বৃত্ত ও বেকার জনশক্তির একটি ক্ষুদ্রাংশ বড় শহরে ও শিল্পাঞ্চলে কর্মসংস্থানের জন্য অভ্যন্তরীণ অভিবাসী হচ্ছেন
৭। হাওরাঞ্চলের মৌসুমি বেকারত্ব বিশেষত প্রান্তিকচাষী, ভূমিহীন ভাগচাষী ও ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকের বর্ষাকালীন সাময়িক বেকারত্ব এ হাওর জনপদের জন্য দীর্ঘকালীন চলমান একটি সাংবাৎসরিক জীবনযাপন প্রক্রিয়া। এ সমস্যা তারা স্থানীয়ভাবে বিকল্প উপায় ও কঠোর পরিশ্রম এবং প্রয়োজনে অন্যত্র সাময়িক কর্মসংস্থানের মাধ্যমে শতশত বছর ধরেই অভিযোজন করে আসছেন। তবে, সাম্প্রতিককালে উদ্ভূত শিক্ষিত নারীপূরুষের সার্বিক বেকারত্ব ও কর্মসংস্থানের উপায় নিয়ে রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি পর্যায়ে গভীরভাবে ভাবা ও সমাধানের উপায় বের করা অতি জরুরি। অন্যথায় আগামী ৫-৭ বছরের মধ্যে বিকল্প কর্মসংস্থান করতে না পারলে হাওরাঞ্চলে কর্মহীনতা ও কঠোর দরিদ্রতা সীমাহীনভাবে বেরে যাবে। প্রান্তিকচাষী ও ভূমিহীন কৃষিশ্রমিকরা কায়িক শ্রমের বিনিময়ে হাওরে কিংবা অন্যত্র ন্যূনতম কর্মসংস্থানের উপায় বের করতে পারলেও, শিক্ষিত (মাধ্যমিক, উচ্চমাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের) নারীপুরুষের কর্মসংস্থান খুবই কঠিন হয়ে যাবে। এর প্রধান কারণ হলো হাওরে শিক্ষিত এ জনগোষ্ঠির কর্মসংস্থানের জন্য সুযোগ খুবই সীমিত। এরা কিছুটা লেখাপড়া শিখে সার্টিফিকেটধারী হওয়ার ফলে নিজের পৈত্রিক ভূমিতে কিংবা ভাগচাষের জমিতে কৃষিকাজ করতে লজ্জাবোধ করবে এবং তাদের অভিভাবকবৃন্দও তাদেরকে কোন সরকারি বা বেসরকারি বা এনজিও অফিসে কর্মজীবী হিসেবে দেখতে প্রত্যাশী। এ সকল সার্টিফিকেট ও ডিগ্রিধারী যুবরা শতভাগই অকারিগরি সাধারণ শিক্ষায় শিক্ষিত হওয়ায় এবং হাওরাঞ্চলের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে মানসম্মত শিক্ষক, শিক্ষাউপকরণ ও অবকাঠামোগত পরিবেশের অভাব থাকায় তারা জাতীয় পর্যায়ে চাকরির প্রতিযোগিতায় শহুরে ও শিল্পাঞ্চলের সাধারণ ও কারিগরি শিক্ষায় শিক্ষিত ও দক্ষ প্রতিযোগিদের সাথে টিকতে না পেরে দীর্ঘদিন বেকারত্বের গ্লানি নিয়ে ঘুরে বেড়াবে এবং মানসিক ও শারীরিক দুঃখ-কষ্ট ও যাতনায় ভোগবে।
৮। স্বাস্থ্যসেবার অপ্রতুলতা হাওর জনজীবনের আরো একটি বড় সমস্য। প্রতিটি হাওর উপজেলা সদরে ৩০ বেডের হাসপাতালসহ একটি করে স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্র এবং প্রয়োজনীয় চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীর অনুমোদিত কাঠামো বিদ্যমান। কিন্তু সড়ক পথে যোগাযোগের ক্ষেত্রে দুর্গম এলাকা বিধায় যোগ্যতাসম্পন্ন চিকিৎসক ও সহায়ক স্বাস্থ্যকর্মীদের কর্মক্ষেত্রে নিয়মিত অনুপস্থিতি জনগণকে যথোপযুক্ত স্বাস্থ্যসেবা প্রাপ্তি থেকে বঞ্চিত করছে।
৯। বর্ণিত সমস্যাসমুহ দূরীকরণার্থে প্রাথমিকভাবে এক্ষুনি যা করা প্রয়োজন, তাহলো হাওরের প্রাথমিক, মাধ্যমিক ও স্নাতক পর্যায়ের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষক নিয়োগের ক্ষেত্রে কোন প্রকার স্বজনপ্রীতি, আঞ্চলিকতা, দলীয় আনুগত্য ও অবৈধ আর্থিক লেনদেন না করে সম্পূর্ণ মেধা, শিক্ষাগতযোগ্যতা, পেশাগত দক্ষতা ও নৈতিক মানদন্ডে ভিত্তিতে সম্পূর্ণ নিরপেক্ষভাবে শিক্ষক নিয়োগ, নিয়মিত ও কার্যকর পাঠদান, পাঠসহযোগী কার্যক্রমবৃদ্ধি এবং কারিগরি ও কর্মমুখী শিক্ষার প্রতি অধিক মনোযোগ দেয়া। যে সকল স্কুল ও কলেজে বিজ্ঞান, কারিগরি ও বানিজ্যশিক্ষার যথেষ্ট সুযোগসুবিধা ও উপযুক্ত শিক্ষকমন্ডলী বিদ্যমান নেই, সে সকল শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানসমুহকে বিশেষ বার্ষিক উন্নয়ন প্রকল্পের অধীনে এনে অবস্থার জরুরি উন্নয়ন সাধন করা।
১০। পাশাপাশা হাওরাঞ্চলের কোথাও কোন প্রকার কারিগরি শিক্ষা বা বৃত্তিমূলক প্রশিক্ষণ প্রতিষ্ঠান না থাকায় দক্ষ জনশক্তি সৃষ্টি করা সম্ভব হচ্ছে না। অতএব, প্রতিটি হাওর উপজেলা সদরে একটি করে সরকার ঘোষিত কারিগরি বিদ্যালয় বা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউট স্হাপনের অগ্রাধিকার প্রকল্প গ্রহন এবং তা দ্রুত বাস্তবায়ন করাও সময়ের দাবী। একই সাথে প্রতিটি হাওর উপজেলা সদরে একটি করে বিসিক শিল্পনগরী এবং সমগ্র হাওরাঞ্চলের জন্য অন্ততপক্ষে একটি ‘বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল’ প্রতিষ্ঠা করে হাওরে উৎপাদিত ও সহজলভ্য কাঁচামাল যথা ধান, মৎস্য, পানি, প্রানিজসম্পদ ভিত্তিক এবং সস্তাশ্রম ও শ্রমঘন শিল্প যথা তৈরিপোষাকশিল্প, অটোমেটিক রাইসমিলিং, মৎস্য, হাঁসমুরগী ও পশুসম্পদ লালনপালন ও এসব শিল্পের ফিডমিল স্থাপনের মধ্য ও দীর্ঘমেয়াদি প্রকল্প গ্রহন করা অতি জরুরি। এছাড়া, স্বল্পমেয়াদি পরিকল্পনা নিয়ে সরকারিভাবে বাংলাদেশ ব্যাংক কিংবা রাষ্ট্রায়ত্ব ব্যাংক ও অর্থলগ্নিকারী প্রতিষ্ঠানসমুহ, পিকেএসপি, ইডকল, এসএমই ফাউন্ডেশন, বিসিক ইত্যাদি প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণান্তে সম্ভাবনাময় নবীন ও বিদ্যমান ক্ষুদ্র ও মাঝারি উদ্যোক্তাদের যথাযথ তদারকির মাধ্যমে শিল্প ও ব্যবসা প্রতিষ্ঠান স্থাপন ও সফল পরিচালনায় পরামর্শ দেয়া যেতে পারে। প্রস্তাবিত এই কর্মসূচির অধীনে হাওর পর্যটন শিল্প, ইঞ্জিনিয়ারিং ওয়ার্কশপ, ইলেক্ট্রিক্যাল ও ইলেক্ট্রনিক্স যন্ত্রপাতি মেরামত ও সার্ভিসিং, সংযোজন, মৎস্য প্রক্রিয়াজাত ও হিমায়িতকরণ, মাছ ধরার জাল, মশারি, জানালার নেট ও পর্দা তৈরি, হোসিয়ারি শিল্প,, সোলার প্যানেল, এনার্জি সেভিং ল্যাম্প, যান্ত্রিক নৌযান তৈরি ও মেরামত, উন্নত ও দ্রুতগামী ও আরামদায়ক নৌপরিবহন, সড়ক পরিবহন শিল্প, একটিভেটেড কার্বন, চারকোল ব্লক ইত্যাদি শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে হাওরাঞ্চলে কর্মসংস্থান বৃদ্ধি, বেকারত্ব দূরীকরণ ও জাতীয় প্রবৃদ্ধি বাড়ানোতে অবদান রাখার সমুহ সুযোগ রয়েছে। তাছাড়া, পৃথিবী ব্যাপী চলমান পরিবেশবান্ধব ও নবায়নযোগ্য জ্বালানীর চাহিদাপূরণের কার্যক্রমের সাথে তাল মিলিয়ে হাওরাঞ্চলের উন্মুক্ত ও প্রখর সূ্র্যালোক ও বাধাহীন বায়ূশক্তিকে কাজে লাগিয়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনের মাধ্যমে স্থানীয় চাহিদা অনেকটা পূরণ করা যেতে পারে।
১১। ফিবছর আগাম বন্যায় নদীর কূল উপছে কিংবা অপরিকল্পিত মাটির বাধ ভেঙ্গে একমাত্র প্রধান ফসল অপরিপক্ক বোর ধান জলমগ্ন হয়ে বিনষ্ট হয়। সরকারের অপ্রতুল সাহায্য ও নিজেদের অপ্রতিরোধ্য জীবন সংগ্রামের ফলশ্রুতিতে ক্ষতিগ্রস্থ কৃষক আবার ঘুরে দাঁড়াতে চায়। বছর না ঘুরতেই আবার যদি একই বিপর্যয়ের মুখোমুখি হতে হয়, তখন সংগ্রামী কৃষকের মেরুদন্ড ভেঙ্গে পড়ে। মহাজনী ও ব্যাংকের ঋনের জালে আটকা পড়ে প্রান্তিকচাষী নিঃস্ব হয়। আর স্বচ্ছল কৃষক পূনঃপৌনিক অপরিশোধিত ঋণজালে আবদ্ধ হয়ে ছেলেমেয়ের লেখাপড়ায় ইতি টানেন কিংবা ফঁড়িয়া ব্যবসায়ী, উপরিযুক্ত সরকারি চাকরিজীবী কিংবা বিদেশপ্রবাসী ছেলের পিতার কাছে জমি বিক্রি করেন বা বন্ধক রাখেন। যুগ যুগ ধরে এমনতরো অনিশ্চিত জীবনধারায় যাপিত জীবনের হাওর জনপদের মানুষগুলোর জীবনের স্বপ্ন, চিরদিন অধরাই থেকে যায়।
১২। তারপরও হাওরাঞ্চলবাসী নতুন করে স্বপ্ন দেখে। আগামী বছরে ভাল ফসল হবে। ছেলেটা কিংবা মেয়েটা মাধ্যমিক/উচ্চমাধ্যমিক/দাখিল/আলিম পাশ করে একটা কাজ বা চাকরি যোগার করে নেবে। সারা জীবনের লাগাতার দূঃখ-কষ্টের কিছুটা লাঘব হবে। মেয়েটার একটু ভাল ঘরে ও শিক্ষিত বরে বিয়ে হবে। প্রতি পাঁচ বছরান্তে সারা দেশের মত নিয়ম করে হাওরেও নির্বাচন আসে। জাতীয় সংসদ, উপজেলা পরিষদ ও ইউনিয়ন কাউন্সিল। এ তিন স্তরেই জনগণের সরাসরি ভোটে তাদের প্রতিনিধি নির্বাচিত হন। দেশের উন্নয়ন, এলাকার উন্নয়ন, কৃষকের সমস্যা, কৃষিউপকরণ সহজলভ্য ও সস্তাকরণ, অকালবন্যা রোধ, যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়ন, স্বাস্থ্যসেবা ঘরে ঘরে পৌঁছে দেয়া, শিক্ষার আলোতে অন্ধকার জনপদ আলোকিত করা, ঘরে ঘরে চাকরি দেয়া, সুশাসন তথা দূর্নীতিমুক্ত প্রশাসনিক এবং নিপীড়ন ও বৈষম্যহীন সামাজিক ন্যায় বিচার প্রতিষ্ঠার গালভরা প্রতিশ্রুতির বন্যায় নির্বাচনের প্রাক্কালে প্লাবিত করে ফেলেন হাওর জনপদ। নির্বাচনের পরে দেখা যায় সুচতুর এসব জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচনী প্রচারে ব্যয়িত পুঁজির হাজারগুণ সুদে-আসলে তুলে নেয়ার প্রতিযোগিতায় থাকে মত্ত। অসমাপ্ত, অর্ধসমাপ্ত ও অপরিকল্পিত উন্নয়ন প্রকল্পের নামে জনগণের খাজনা-ট্যাক্সের শত ও হাজার কোটি টাকার প্রকল্প মুখ থুবরে পড়ে থাকে বছরের পর বছর। জনপদের মানুষের দৈনন্দিন কষ্ট লাঘবের পরিবর্তে আরো বৃদ্ধি পায় ক্রমবর্ধমান হারে। দৈনন্দিন প্রথাগত চলাচল ও জীবন যাপন হয় আরো দূর্ভোগের ও ব্যয়বহুল।
১৩। বর্ণিত যাপিত জীবনের তেমনি একটি জনপদ ইটনা-মিঠামইন-অষ্টগ্রাম হাওরাঞ্চল। এ অঞ্চলে যোগাযোগের প্রথাগত অবকাঠকমো ছিল নদীভিত্তিক। নদীগুলো সংস্কারের অভাবে কিংবা ভাবনাচিন্তা ও যথাযথ বিজ্ঞানভিত্তিক সমীক্ষা ও গবেষণা না করেই ‘লুপকাটিং` নামের অপরিকল্পিত নদীকাটা ও যত্রতত্র অসম্পূর্ণ ড্রেজিংয়ের ফলে নদীর নাব্যতা ও গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে যুগবাহিত নদীমাতৃক সভ্যতা ও জনবসতিসমুহ আজ হুমকির মুখে। কোথাও ভাঙ্গন, আবার কোথাও জলশূণ্যতা কিংবা কোথাও বালি পড়ে ফসলি জমির বিনাশ। অপরিকল্পিত, যথাযথ গবেষনা ও সমীক্ষাবিহীন এবং পরিবেশ ও প্রতিবেশবিরোধী যত্রতত্র উন্নয়নের কুফল হাওরের প্রাণ-প্রকৃতি ও স্বাভাবিক জীবনযাপনের পরিপন্থী হয়ে একদিন মিঠাপানির আধার ও জীববৈচিত্রের এই ভৌগলিক ও প্রাকৃতিক পরিবেশটিকে বিনষ্ট করে দেবে। তখন হয়তো আফসোস করেও আর ফিরে পাবো না প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের এ লীলাভূমি।
১৪। তাই আসুন যুগ যুগ ধরে অবহেলিত, উন্নয়ন বঞ্চিত, পশ্চাৎপদ ও দূর্গম জনপদ হাওরাঞ্চলকে দেশের উন্নয়নের মূলধারায় সংযুক্ত করার দাবীতে উচ্চকন্ঠে সবাই মিলে আওয়াজ তুলি-
(ক) হাওরের রক্তনালী নদী-খাল, হৃদপিন্ড বিল ও জলাভূমি, নদীভিত্তিক গ্রাম-গঞ্জ সভ্যতা রক্ষা ও বিকাশের অনুকূল যথোপযুক্ত উন্নয়ন মডেল উদ্ভাবন ও বাস্তবায়ন করুন;
(খ) প্রাকৃতিক ঝুঁকিমুক্ত বা ঝুঁকিসহনীয় দ্রুতবর্ধনশীল ফসলের চাষাবাদ প্রচলন করুন;
(গ) প্রধানত জলবাহিত দ্রুতগামী, নিরাপদ ও আরামদায়ক গণপরিবহন চালু করুন;
(ঘ) বর্ষায় নিমজ্জমান ও বাধাহীন পানিপ্রবাহে সহায়ক সড়ক ব্যবস্থার উন্নয়ন ও দ্রুত সম্প্রসারণের মাধ্যমে প্রতিটি গ্রাম ও পাড়াকে ইউনিয়ন ও উপজেলা সদরের সাথে সংযুক্ত করুন;
(ঙ) আগাম বন্যারোধী পরিবেশবান্ধব বাধ ও জলকপাট নির্মাণ করুন;
(চ) যথাযথ গবেষণা, পরীক্ষা-নিরীক্ষা ও সমীক্ষার মাধ্যমে নদীসমুহ খনন, তীররক্ষাকরণ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করুন;
(ছ) ভরা বর্ষায় অতিপ্লাবনের ও ঝড়োহাওয়া/ আফালের ঝুঁকি থেকে জনপদসমুহকে রক্ষার জন্য যথোপযুক্ত প্রতিরক্ষা-দেয়াল নির্মাণ করুন;
(জ) হাওরাঞ্চলের প্রতিটি উপজেলা স্বাস্থ্য ও পরিবার কল্যাণ কেন্দ্রে অবস্থিত হাসপাতালকে অবিলম্বে ৫০ শয্যার আধুনিক হাসপাতালে উন্নীতকরণসহ নিয়োগকৃত স্বাস্থ্য কর্মকর্তা, বিশেষজ্ঞ চিকিৎসক ও স্বাস্থ্যকর্মীদের হাসপাতালে নিয়মিত উপস্থিতি ও যথাযথ সেবাপ্রদান নিশ্চিত করুন;
(ঝ) সার্বিক উপযোগিতা, অর্থনৈতিক সুবিধা ও ব্যয় অনুপাত বিবেচনা, কারিগরি সম্ভাব্যতা, পরিবেশ-প্রতিবেশের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষয়ক্ষতি বিবেচনা না করে কোন প্রকার ‘আবুরা সড়কবাঁধ’, কালভার্ট ও ব্রিজ (Non-submersible Road, Culvert and Bridge)’ নির্মাণ বন্ধ করুন; এবং
(ঞ) শিক্ষিত যুবসমাজের স্থানীয়ভাবে স্থায়ী কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার নিমিত্ত প্রতিটি উপজেলা সদরে বা উপযুক্ত স্থানে ‘ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্প এলাকা’ স্থাপন এবং শিক্ষিত বেকার যুবকদের সহজ শর্তে বিনা জামানতে মেয়াদি-ঋণ প্রদান ও উদ্যোক্তা উন্নয়ন প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করুন।
লেখক; প্রকৌশলী মো. এনায়েতুর রহমান প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা, ইএমই কনসাল্ট্যান্টস এন্ড ইঞ্জিনিয়ার্স