বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ আমাদের দেশে প্রচলিত শিক্ষা ব্যবস্থার মধ্যে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ও কার্যকরী শিক্ষার স্তর হচ্ছে প্রাথমিক শিক্ষা। গুরুত্বপূর্ণ এ কারণে যে, প্রাথমিক শিক্ষা সকল শিক্ষার ভিত। আর কার্যকরী কারণ, প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা কারিক্যুলাম এমনভাবে সাজানো যাতে কোনো শিশু যদি এই স্তর শেষে আর পড়ার সুযোগ না পায় তবু যেন সে তার জীবনকে সুন্দরভাবে পরিচালনা করার জন্যে প্রয়োজনীয় নৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মীয় জ্ঞান এ স্তর থেকেই পেতে সক্ষম হয়।
আজকে যারা সামাজিকভাবে দক্ষ নীতিনির্ধারকের ভূমিকায়, দেশ পরিচালনার অংশ কিংবা দেশ পরিচালনায় সরাসরি সম্পৃক্ত তাদের একটি বৃহৎ অংশই কিন্তু প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী ছিলেন। অথচ তখনও কিন্ডারগার্টেন ছিল, হয়তো তার সংখ্যা আজকের মত এতটা ছিলো না। এর মানে কি এটা, ওই সফলদের একটা অংশ কিন্ডারগার্টেনের ? অবশ্যই না। কারণ, মানুষের তখন এতটা কিন্ডারগার্টেন প্রীতি ছিলো না এবং মানুষ প্রাথমিক বিদ্যালয় বিমুখ ছিল না। অথচ তখনকার সময়ে বিদ্যালয়ে না ছিল এত ভাল অবকাঠামোগত সুবিধা, না ছিল উচ্চশিক্ষিত শিক্ষক। তবু সন্তানের প্রাথমিক স্তরের পড়াশুনার জন্য বাবা-মায়ের পছন্দের তালিকায় প্রথমেই ছিল প্রাথমিক বিদ্যালয়। যা আজকের দিনে বাবা-মায়ের মধ্যে আর নেই।
আজ নিম্নবিত্ত থেকে উচ্চবিত্ত সবারই প্রথম পছন্দ কিন্ডারগার্টেন। অথচ এখানে অর্থাৎ কোনো কোনো কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকদের অনেকেরই শিক্ষাগত যোগ্যতা আমাদের প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের থেকে অনেক কম। কখনো কখনো এটাও প্রমাণিত যে, প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষক নিয়োগ পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হতে না পেরে প্রাইভেট স্কুল বা কিন্ডারগার্টেনে শিক্ষকতা করছেন। আর এদের কাছেই সব শ্রেণির অভিভাবক ছুটছেন অন্ধের মতো। তবে এর পেছনের কারণগুলোও যে একেবারেই অযৌক্তিক, তেমন না। আমাদের বোধহয় সময় এসেছে এর কারণ খুঁজে বের করে সে অনুযায়ী ব্যবস্থা গ্রহণের।
প্রাথমিক স্তরের শিক্ষা ব্যবস্থায় বর্তমানে শিক্ষার থেকে আনুষ্ঠানিক কাজে বেশি মনোযোগ দেওয়া হয়। যেমন অতিমাত্রায় প্রশিক্ষণ, দাপ্তরিক বিভিন্ন তথ্য যা বছরে এক/দুবার নিলেই যথেষ্ট, বিভিন্ন বিভাগের কাজ (ভোটার তালিকা, মৎস্যজীবীদের তালিকা, স্বাস্থ্য বিভাগের বিভিন্ন ক্যাম্পিং ইত্যাদি)। অতিমাত্রায় প্রশিক্ষণ এ কারণে বলছি যে, যদি আমরা প্রাইভেট স্কুল কলেজগুলোর দিকে তাকাই সেখানের চিত্র একেবারেই ভিন্ন।
বেশিরভাগ বেসরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠান প্রধানই প্রতিষ্ঠানের স্বাভাবিক পাঠদান ব্যাহত হবে ভেবে তার শিক্ষককে কোনো ধরনের প্রশিক্ষণে অংশগ্রহনের অনুমতি দেন না; সেখানে প্রাথমিক বিদ্যালয়ে ক্লাস পরিচালনার মতো শিক্ষক বিদ্যালয়ে না থাকলেও প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক। যা অনেক সময়েই শিক্ষার্থীদের পাঠদানকে ব্যাহত করে। তাই মানসম্মত পাঠদানের জন্য শিক্ষকদের পাঠদানকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনায় রেখে অন্যান্য কার্যক্রমে সম্পৃক্ত করা উচিত।
একটা সময় ছিল যখন অধিকাংশ পরিবারেই গৃহশিক্ষক রাখার প্রবণতা কম ছিল। সন্ধ্যার পর মা এবং অফিস ফেরত বাবা পালন করতেন গৃহশিক্ষকের ভুমিকা। অথচ তাদের কোনো ধরনের পড়ানোর অভিজ্ঞতাই থাকত না। সেখানেও কিন্তু তারা সফল শিক্ষকের ভুমিকাই পালন করতেন। প্রশিক্ষণের প্রয়োজন আছে, আনন্দদায়ক ও ফলপ্রসু পাঠদানের জন্য কিন্তু সেটা অবশ্যই কোনোভাবেই পাঠদান কার্যক্রমকে ব্যাহত করে নয়।
আর একটি বিষয় হচ্ছে কর্মঘণ্টা। সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে শিশুর পাঠ গ্রহণের সময়সূচি সকাল সাড়ে ৯টা থেকে বিকেল সাড়ে ৪টা পর্যন্ত। এত দীর্ঘ সময় শিক্ষক এবং শিক্ষার্থী কারোরই মনোযোগ ধরে রাখা সম্ভব হয় না। বিদ্যালয়ের কর্মঘণ্টা বাস্তবতার নিরীখে করা এখন সময়ের দাবি। এতকিছুর পরও শতভাগ ভর্তি, অল্পসংখ্যক লোকবল নিয়ে নির্বিঘ্নে প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষা সুন্দর ও সুষ্ঠুভাবে সম্পন্ন করা, ঝরে পড়ার হার কমানো ইত্যাদি প্রশংসার দাবি রাখে। কোনো কাজই শতভাগ সাফল্যের সঙ্গে যে করা সম্ভব না তার বিস্তর উদাহরণ চারপাশ দেখলেই বোঝা যায়।
তাই সকলের আন্তরিকতা বাড়াতে গঠনমূলক সমালোচনার যেমন বিকল্প নেই, তেমনি মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের যৌক্তিক সুপারিশগুলোকে আমলে নিয়ে সেভাবে নীতিমালা তৈরি করে প্রাথমিক শিক্ষায় গতি বৃদ্ধি করা সম্ভব বলেই আমার বাস্তব অভিজ্ঞতা বলে।