ঢাকা , সোমবার, ১৪ অক্টোবর ২০২৪, ২৯ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

পিরোজপুর ভয়ংকর স্কুলযাত্রা

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ঘুম ভাঙলেই বিদ্যালয়ে যাওয়ার তাড়া। বই-খাতাসহ স্কুলব্যাগের পাশাপাশি নিতে হয় নৌকা আর বৈঠার খোঁজ।

এরপর সাত-আটজন করে একেক নৌকায় উঠতে হয় দল বেঁধে। সবার গন্তব্য শিক্ষালয়। চারপাশে কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী ইউনিয়নের খাল-বিল বেষ্টিত বিলাঞ্চলের ১৬টি প্রতিষ্ঠানের যাতায়াতের মূল বাহন নৌকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা শঙ্কার মধ্য দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের ১২ মাসই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করে। কখনো কখনো ঢেউয়ের কারণে নৌকা উল্টে যাওয়ার শঙ্কার সঙ্গে জীবন হারানোর ভয় তো আছেই। তবু ঝুঁকি নিয়েই তারা পৌঁছে শিক্ষাঙ্গনে। কথা হয় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রুবিনার সঙ্গে। তার ভাষ্য, ‘পড়ালেহা শিখতে হলে স্কুলে তো আইতেই অবে।

তাই নৌকা চালানো শিখছি। ’ বর্ষা মৌসুমে থইথই পানিতে তারা সহজেই নৌকাযোগে স্কুলে যাতায়াত করতে পারে। বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে পড়তে হয় কচুরিপানার বিড়ম্বনায়। আবার শীত মৌসুমে খালের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নৌকা চলে না। তখন জোয়ারের অপেক্ষায় থাকতে হয় তাদের। এ সময় জোয়ার-ভাটা অনুসরণ করে চলে বিদ্যালয়ের পাঠদান কর্মসূচি। গত মঙ্গলবার সকালে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ওই বিলাঞ্চলে পৌঁছে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে দেউলবাড়ী ইউনিয়নটি সবচেয়ে অবহেলিত। ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ছয়টি ওয়ার্ডে যাতায়াতের জন্য কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও এ বিলাঞ্চলে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। ছয়টি ওয়ার্ডে রয়েছে ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; যার মধ্যে আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং তিনটি মাদরাসা। ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য একমাত্র ভরসা নৌকা।

শীতকালে খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। তখন পড়তে হয় ভিন্ন সমস্যায়। এ সময় কোনো বাহনই চলে না। তখন জোয়ার-ভাটা নির্ণয় করে দেওয়া হয় স্কুলের সময়সূচি। অর্থাৎ খালে জোয়ার এলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায় এবং জোয়ার শেষ হওয়ার আগে অথবা পরবর্তী জোয়ারে তাদের বাড়ি ফিরতে হয়। পরবর্তী জোয়ার পেতে অনেক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসে। অবহেলিত এ জনপদেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় স্কুলে টিফিন নিয়ে আসে না কেউ। তা ছাড়া বিলাঞ্চল হওয়ায় স্কুল ফিডিং কার্যক্রমও নেই এখানে। ফলে ক্ষুধার তাড়না নিয়েই শিশু শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। তাঁর বাড়ি এ বিলাঞ্চলেই। অবহেলিত বিলাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য তাঁকে পর পর তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছে এলাকাবাসী। কিন্তু প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরই তিনি ইউনিয়নের শহরাঞ্চল বলে খ্যাত গাওখালী বাজারে বাড়ি করে সেখানে সপরিবারে বাস করতে থাকেন। এলাকার খেটে খাওয়া মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ’

স্থানীয় বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন বাহাদুর জানান, এ অঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ স্থান বর্ষা মৌসুমে ডুবে থাকে। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের উপায় থাকে না। নৌকা কিনে স্কুলে যাওয়ার মতো অবস্থাও অনেকের নেই। অনেক সময় যে জায়গায় স্কুল, সেখানে নিয়মিত যাতায়াতের জন্য কোনো নৌকাও পাওয়া যায় না। এ পরিস্থিতিতে অনেক শিশু বর্ষাকালে স্কুলে যেতে চায় না বা তাদের অভিভাবকরাও তাদের পাঠাতে চান না। শীতকালে খালে পানি থাকে না। তখন অবস্থা আরো খারাপ হয়।

উত্তর গাওখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিলীপ রায় বলেন, ‘এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত খালে পানি থাকে। তখন নৌকায় আসা-যাওয়া করা যায়। অক্টোবর ও নভেম্বরে কচুরিপানার কারণে খাল বন্ধ হয়ে যায়। তখন অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে আসতে পারে না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে খালে পানি থাকে না। তখন জোয়ার-ভাটা অনুসরণ করে স্কুল চালাতে হয়। ’

মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমীরণ রায় জানান, বছরের ১২ মাসই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কমপক্ষে ছয় কিলোমিটার সড়কের ব্যবস্থা করা গেলে এ দুর্ভোগ অনেকটা কমে আসত।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বিলাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কষ্ট করেই স্কুলে আসা-যাওয়া করে। এ কারণে স্কুলে উপস্থিতিও কম। ’ পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খায়রুল আলম শেখ বলেন, ‘সরেজমিনে গিয়ে আমি শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া-আসার চিত্র দেখেছি। সে অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের জন্য শিগগিরই সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগের কাছে চিঠি পাঠানো হবে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

পিরোজপুর ভয়ংকর স্কুলযাত্রা

আপডেট টাইম : ০৫:৪০ পূর্বাহ্ন, সোমবার, ১৬ অক্টোবর ২০১৭

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ ঘুম ভাঙলেই বিদ্যালয়ে যাওয়ার তাড়া। বই-খাতাসহ স্কুলব্যাগের পাশাপাশি নিতে হয় নৌকা আর বৈঠার খোঁজ।

এরপর সাত-আটজন করে একেক নৌকায় উঠতে হয় দল বেঁধে। সবার গন্তব্য শিক্ষালয়। চারপাশে কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। পিরোজপুরের নাজিরপুর উপজেলার দেউলবাড়ী ইউনিয়নের খাল-বিল বেষ্টিত বিলাঞ্চলের ১৬টি প্রতিষ্ঠানের যাতায়াতের মূল বাহন নৌকা।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, নানা শঙ্কার মধ্য দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানগুলোর শিক্ষার্থীরা ছোট ছোট নৌকায় জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বছরের ১২ মাসই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা করে। কখনো কখনো ঢেউয়ের কারণে নৌকা উল্টে যাওয়ার শঙ্কার সঙ্গে জীবন হারানোর ভয় তো আছেই। তবু ঝুঁকি নিয়েই তারা পৌঁছে শিক্ষাঙ্গনে। কথা হয় পঞ্চম শ্রেণির ছাত্রী রুবিনার সঙ্গে। তার ভাষ্য, ‘পড়ালেহা শিখতে হলে স্কুলে তো আইতেই অবে।

তাই নৌকা চালানো শিখছি। ’ বর্ষা মৌসুমে থইথই পানিতে তারা সহজেই নৌকাযোগে স্কুলে যাতায়াত করতে পারে। বর্ষা মৌসুমের শেষ দিকে পড়তে হয় কচুরিপানার বিড়ম্বনায়। আবার শীত মৌসুমে খালের পানি শুকিয়ে যাওয়ায় নৌকা চলে না। তখন জোয়ারের অপেক্ষায় থাকতে হয় তাদের। এ সময় জোয়ার-ভাটা অনুসরণ করে চলে বিদ্যালয়ের পাঠদান কর্মসূচি। গত মঙ্গলবার সকালে উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৩০ কিলোমিটার দূরে ওই বিলাঞ্চলে পৌঁছে স্থানীয় লোকজনের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, উপজেলার ৯টি ইউনিয়নের মধ্যে দেউলবাড়ী ইউনিয়নটি সবচেয়ে অবহেলিত। ইউনিয়নের ৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ছয়টি ওয়ার্ডে যাতায়াতের জন্য কোনো সড়ক যোগাযোগ নেই। স্বাধীনতার ৪৬ বছরেও এ বিলাঞ্চলে উন্নয়নের কোনো ছোঁয়া লাগেনি। ছয়টি ওয়ার্ডে রয়েছে ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান; যার মধ্যে আটটি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, পাঁচটি মাধ্যমিক বিদ্যালয় এবং তিনটি মাদরাসা। ১৬টি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের যাতায়াতের জন্য একমাত্র ভরসা নৌকা।

শীতকালে খাল-বিল শুকিয়ে চৌচির হয়ে যায়। তখন পড়তে হয় ভিন্ন সমস্যায়। এ সময় কোনো বাহনই চলে না। তখন জোয়ার-ভাটা নির্ণয় করে দেওয়া হয় স্কুলের সময়সূচি। অর্থাৎ খালে জোয়ার এলে শিক্ষার্থীরা স্কুলে যায় এবং জোয়ার শেষ হওয়ার আগে অথবা পরবর্তী জোয়ারে তাদের বাড়ি ফিরতে হয়। পরবর্তী জোয়ার পেতে অনেক সময় সন্ধ্যা ঘনিয়ে রাত নেমে আসে। অবহেলিত এ জনপদেও বেশির ভাগ শিক্ষার্থী দরিদ্র পরিবারের হওয়ায় স্কুলে টিফিন নিয়ে আসে না কেউ। তা ছাড়া বিলাঞ্চল হওয়ায় স্কুল ফিডিং কার্যক্রমও নেই এখানে। ফলে ক্ষুধার তাড়না নিয়েই শিশু শিক্ষার্থীদের ক্লাস করতে হয়।

নাম প্রকাশ না করার শর্তে একটি বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক বলেন, ‘আমাদের ইউনিয়নের বর্তমান চেয়ারম্যান মাস্টার মোহাম্মদ ওয়ালিউল্লাহ। তাঁর বাড়ি এ বিলাঞ্চলেই। অবহেলিত বিলাঞ্চলের উন্নয়নের জন্য তাঁকে পর পর তিনবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত করেছে এলাকাবাসী। কিন্তু প্রথমবার চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ার পরই তিনি ইউনিয়নের শহরাঞ্চল বলে খ্যাত গাওখালী বাজারে বাড়ি করে সেখানে সপরিবারে বাস করতে থাকেন। এলাকার খেটে খাওয়া মানুষদের ভাগ্যের কোনো পরিবর্তন হয়নি। ’

স্থানীয় বাসিন্দা শাহাবুদ্দিন বাহাদুর জানান, এ অঞ্চলে রাস্তাঘাট নেই বললেই চলে। বেশির ভাগ স্থান বর্ষা মৌসুমে ডুবে থাকে। নৌকা ছাড়া যাতায়াতের উপায় থাকে না। নৌকা কিনে স্কুলে যাওয়ার মতো অবস্থাও অনেকের নেই। অনেক সময় যে জায়গায় স্কুল, সেখানে নিয়মিত যাতায়াতের জন্য কোনো নৌকাও পাওয়া যায় না। এ পরিস্থিতিতে অনেক শিশু বর্ষাকালে স্কুলে যেতে চায় না বা তাদের অভিভাবকরাও তাদের পাঠাতে চান না। শীতকালে খালে পানি থাকে না। তখন অবস্থা আরো খারাপ হয়।

উত্তর গাওখালী সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ভারপ্রাপ্ত প্রধান শিক্ষক দিলীপ রায় বলেন, ‘এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর মাস পর্যন্ত খালে পানি থাকে। তখন নৌকায় আসা-যাওয়া করা যায়। অক্টোবর ও নভেম্বরে কচুরিপানার কারণে খাল বন্ধ হয়ে যায়। তখন অধিকাংশ শিক্ষার্থী স্কুলে আসতে পারে না। ডিসেম্বর ও জানুয়ারিতে খালে পানি থাকে না। তখন জোয়ার-ভাটা অনুসরণ করে স্কুল চালাতে হয়। ’

মনোহরপুর সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সমীরণ রায় জানান, বছরের ১২ মাসই শিক্ষক-শিক্ষার্থীদের দুর্ভোগ পোহাতে হয়। কমপক্ষে ছয় কিলোমিটার সড়কের ব্যবস্থা করা গেলে এ দুর্ভোগ অনেকটা কমে আসত।

উপজেলা প্রাথমিক শিক্ষা কর্মকর্তা মোহাম্মদ রফিকুল ইসলাম বলেন, ‘সড়ক যোগাযোগ না থাকায় বিলাঞ্চলের শিক্ষার্থীরা কষ্ট করেই স্কুলে আসা-যাওয়া করে। এ কারণে স্কুলে উপস্থিতিও কম। ’ পিরোজপুরের জেলা প্রশাসক মোহাম্মদ খায়রুল আলম শেখ বলেন, ‘সরেজমিনে গিয়ে আমি শিক্ষার্থীদের স্কুলে যাওয়া-আসার চিত্র দেখেছি। সে অঞ্চলের সমস্যা সমাধানের জন্য শিগগিরই সংশ্লিষ্ট সংস্থা ও বিভাগের কাছে চিঠি পাঠানো হবে।