বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ স্কুলে ছাত্রদের প্রায় বাধ্যতামূলক হয়ে উঠা প্রাইভেট বা কোচিং বন্ধ করতে পাঁচ বছর আগে জোরালো অবস্থান নিয়েছিলেন শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ। তৈরি করা হয় নীতিমালা। না মানলে কঠোর শাস্তির কথাও আছে সেখানে। কিন্তু নেই নীতিমালার কোনো বাস্তবায়নই নেই। স্কুলে এখন পড়া হয় না, ছাত্রদেরকে শিক্ষক রেখে বা স্কুল শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট বা কোচিং করানো ছাড়া উপায় থাকে না। শিক্ষামন্ত্রী নুরুল ইসলাম নাহিদ বাঙালী কণ্ঠকে বলেছেন, তিনি কোচিং বন্ধ করবেনই। তিনি বলেন, ‘শিক্ষা নিয়ে আর কোনো ব্যবসা চলবে না। কোচিং বাণিজ্য বন্ধ করতে আইন করা হচ্ছে।’
পটুয়াখালী বাউফল উপজেলার কালাইয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয় থেকে এবার এসএসসি পরীক্ষা দেবে এস এম রাহাত। ২০১৮ সালের ১ ফেব্রুয়ারি তার এসএসসি পরীক্ষা শুরু। বছরের শুরু থেকেই ছয়টি বিষয়ে কোচিং করছে সে। এই ছয় বিষয় হচ্ছে ইংরেজি, সাধারণ গণিত, উচ্চতর গণিত, পদার্থ, রসায়ন ও জীববিজ্ঞান।
ক্লাস করার পরও কেন এই ছয় বিষয়ে তাকে কোচিং করতে হবে- এমন প্রশ্নের জবাব, তার অন্যান্য সহপাঠীরা এসব বিষয় কোচিং করছে। আবার যারা কোচিং করে তাদের প্রতি বিশেষ যত্ন নেন শিক্ষকরা। এসব কারণে ছয় বিষয়ে কোচিং করছে রাহাত।
রাহাতের মা সাবিনা বেগম বললেন, ছেলের ভাল ফলাফল করতে হবে। এজন্য তিনি ছেলেকে কোচিং এ দিচ্ছেন। শুধু ক্লাসের পড়ার উপর তিনি নির্ভর করতে পারছেন না।
এতো গ্রাম এলাকার হালচাল যেখানে প্রশাসনের নিয়ন্ত্রণ কিছুটা কম। কিন্তু যেখানে নিয়ন্ত্রণ বেশি, সেই রাজধানীর চিত্র কেমন?
রাজধানীতে প্রতিটি স্কুলে চলে কোচিং করার প্রতিযোগিতা। একেকটি ক্লাসে প্রতিটি বিষয়েই কোচিং বা শ্রেণি শিক্ষকের কাছে প্রাইভেট পড়তে হয় এই শহরের ছেলে-মেয়েদের।
শিক্ষার্থী ও অভিভাবকরা জানান, প্রায় শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানেই প্রাইভেট ও কোচিংয়ে জড়িত শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদের তাঁদের কাছে পড়তে বিভিন্ন কৌশলে বাধ্য করেন বা চাপ দেন। এতে শিক্ষার্থী-শিক্ষকের স্বাভাবিক সম্পর্কের অবনতির পাশাপাশি পাঠদান-পাঠগ্রহণেও ধারাবাহিকতার বিঘ্ন ঘটছে।
একাধিক অভিভাবকের বলেছেন, শ্রেণিকক্ষে ভালো পড়ালেখা হয় না। তাই কোচিং সেন্টার কিংবা শ্রেণি শিক্ষকদের বাড়িতে ছেলেমেয়েদের প্রাইভেট পড়াতে বাধ্য হচ্ছেন তাঁরা।
শিক্ষা মন্ত্রণালয় ২০১২ সালে কোচিং-বাণিজ্য বন্ধের নীতিমালার প্রজ্ঞাপন জারি করে। নীতিমালার অনুচ্ছেদ ৭-এ উল্লেখ আছে, শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের পরিচালনা কমিটি কোচিং-বাণিজ্য রোধে কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন। ৮ নম্বর অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, কোচিং-বাণিজ্য বন্ধে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানপ্রধান প্রয়োজনীয় প্রচারণা ও অভিভাবকদের সঙ্গে মতবিনিময় করবেন।
অনুচ্ছেদ ১৪-এর ‘ক’ উপ-অনুচ্ছেদে বলা আছে, এমপিওভুক্ত কোনো শিক্ষক কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তাঁর এমপিও স্থগিত, বাতিল, বার্ষিক বেতন বৃদ্ধি স্থগিত, বেতন এক ধাপ অবনমিতকরণ, সাময়িক বরখাস্ত, চূড়ান্ত বরখাস্ত ইত্যাদি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। একই অনুচ্ছেদের ‘খ’ উপ-অনুচ্ছেদে এমপিওভুক্ত প্রতিষ্ঠানের এমপিওবিহীন শিক্ষক কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তাঁর প্রতিষ্ঠান প্রদত্ত বেতন-ভাতা স্থগিতসহ এমপিওভুক্ত শিক্ষকদের ক্ষেত্রে প্রযোজ্য একই ধরনের শাস্তি প্রদানের কথা বলা হয়েছে।
সেই সঙ্গে অনুচ্ছেদের ‘ঙ’ উপ-অনুচ্ছেদে বলা হয়েছে, সরকারি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষকেরা কোচিং-বাণিজ্যে জড়িত থাকলে তাঁদের বিরুদ্ধে সরকারি কর্মচারী (শৃঙ্খলা ও আপিল) বিধিমালা ১৯৮৫ প্রয়োগ করা হবে।
এই বিধিসমূহ শিক্ষামন্ত্রী থেকে শুরু করে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের প্রধানসহ ২৪টি স্তরে পাঠানো হয়েছে। শুরুতে এ নিয়ে বেশ আলোচনা হয়েছিল। কিন্তু এখন সব চলছে আগের মতোই। অথচ শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের দৃশ্যমান তৎপরতা নেই, শিক্ষামন্ত্রীও এখন আর বিষয়টি নিয়ে কথা বলছেন না।
কোচিং বাণিজ্যের তথ্য পেয়েছে দুদকও
সম্প্রতি রাজধানীর ২৪টি সরকারি স্কুলের পাঁচ শতাধিক শিক্ষকের বিরুদ্ধে ‘কোচিং বাণিজ্যে’র মাধ্যমে অর্থ উপার্জনের অভিযোগ পেয়েছে দুদক। এসব শিক্ষককে তাদেরকে বদলির সুপারিশ করেছে সংস্থাটি।
শিক্ষকদের বদলি না করার পেছনে রাজনৈতিক চাপ, তদবির ও অনৈতিক আর্থিক লেনদেনের নানা ধরনের প্রমাণও পেয়েছে দুদক।
গত ফেব্রুয়ারি থেকে দুদকের পরিচালক মীর মো. জয়নুল আবেদীন শিবলীর নেতৃত্বে পাঁচ সদস্যের একটি দল ঢাকার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ভর্তি বাণিজ্য, কোচিং বাণিজ্য ও নিয়োগ বাণিজ্যের নামে কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ তদন্ত শুরু করে। নভেম্বরে শুরুতে তদন্ত টিম কমিশনে তাদের প্রতিবেদন দাখিল করেন।
প্রতিবেদনে বলা হয়, রাজধানীতে ৫২২ জনের মতো শিক্ষক ১০ বছর থেকে সর্বোচ্চ ৩৩ বছর পর্যন্ত এক বিদ্যালয়েই রয়েছেন। অথচ সরকারি নীতিমালা মোতাবেক একই কর্মস্থলে তিন বছরের বেশি থাকার কথা নয়।
প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, কোনো কোনো বিদ্যালয়ে প্রয়োজনের চেয়ে বেশি ইংরেজি শিক্ষক বা গণিত শিক্ষক কর্মরত রয়েছেন। আবার কোনো কোনো বিদ্যালয়ে শিক্ষকের ঘাটতি রয়েছে। এর মূল কারণ হচ্ছে কোচিং বাণিজ্য ও সিন্ডিকেট।
কোনো শিক্ষক ঢাকায় ১০ বছরের বেশি এক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কর্মরত থাকলে তাকে বিভাগের বাইরের বিদ্যালয়গুলোতে এবং পাঁচ বছরের বেশি সময় কর্মরত শিক্ষকদের ঢাকা নগরীর বাইরে এবং তিন বছরের বেশি সময় এক বিদ্যালয়ে কর্মরত থাকলে অন্য বিদ্যালয়ে বদলির সুপারিশ করেছে দুদক।
আইন করে কোচিং এর লাগাম টানার উদ্যোগ
কোচিং ব্যবসা, শিক্ষকদের প্রাইভেট পড়ানো এবং নোট ও গাইড বই নিষিদ্ধ করার উদ্যোগ নিয়েছে শিক্ষা মন্ত্রণালয়। এছাড়া সব ধরনের শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান স্থাপনে নিয়ন্ত্রণ আরোপ এবং অপ্রয়োজনীয় প্রতিষ্ঠান বন্ধ বা অন্য প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে একীভূত করা হবে।
সরকারের অনুমোদন ছাড়া কোনো শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান টিউশনসহ অন্যান্য ফি আরোপ করতে পারবে না। নকলে সহায়তা বা প্রশ্ন ফাঁসে সহায়তা করলে পেতে হবে শাস্তি। শিক্ষার্থীকে শারীরিক নির্যাতন করলে বেতন বন্ধ বা চাকরি যাবে শিক্ষকের।
এমন বিভিন্ন বিধান রেখে শিক্ষা আইনের খসড়া তৈরি করা হয়েছে। মন্ত্রিসভায় উপস্থাপনের জন্য শিগগিরই তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে।
জানতে চাইলে মন্ত্রণালয়ের মাধ্যমিক ও উচ্চশিক্ষা বিভাগের সচিব সোহরাব হোসাইন বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, ‘শিক্ষা আইনের খসড়া আমরা প্রায় চূড়ান্ত করেছি। এর ওপর মতামতের জন্য দেড় মাস আগে প্রাথমিক ও গণশিক্ষা মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। সেখান থেকে ফিরলে আমরা তা মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠাব।’
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক সৈয়দ মনজুরুল ইসলাম বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্য রোধে শিক্ষক-শিক্ষার্থী-অভিভাবকসহ সব মহলকেই সচেতন হবে হবে। আইন করে এটা রোধ করা যাবে না। কোচিং এর নেতিবাচক দিকগুলো জনসম্মুখে তুলে ধরতে হবে। তাহলে অনেকেই সচেতন হবে বলে মনে করি।’
এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য আখতারুজ্জামান বাঙালী কণ্ঠকে বলেন, ‘কোচিং বাণিজ্য আইন করে বন্ধ করা যাবে না। এটাকে নিয়ন্ত্রণের মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। শিক্ষকদের নৈতিক দিক থেকে আর বেশি শক্তিশালী হওয়া দরকার। শিক্ষার্থী ও অভিভাবকদের মানসিকতায় পরিবর্তন আনতে হবে। অন্যথায় এই সমস্যা থেকে উত্তোরণের উপায় নেই।