বাঙালী কণ্ঠ ডেস্কঃ বৃদ্ধি পাচ্ছে সমুদ্র পৃষ্ঠের উচ্চতা। কৃষি জমিতে প্রবেশ করছে লবণাক্ত পানি। ঘটছে ঘন ঘন বন্যা। দেখা দিচ্ছে তীব্র খরা। আঘাত করছে তীব্র গতিসম্পন্ন ঘূর্ণিঝড়। এসবই নদীমাতৃক এবং দক্ষিণে সমুদ্রবেষ্টিত বাংলাদেশের কৃষিখাতকে কঠিন থেকে কঠিন করে তুলছে। এর সঙ্গে যুক্ত হয়েছে করোনা ভাইরাস। এই দুইয়ের প্রভাব বাংলাদেশের কৃষকদেরকে আবার দারিদ্র্যের দিকে ঠেলে দিচ্ছে।
তারা যে অগ্রগতি করেছিলেন, তা এখন উল্টোযাত্রা শুরু করেছে। লন্ডন থেকে প্রকাশিত অনলাইন টেলিগ্রাফে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে এসব কথা বলা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে, বাংলাদেশি কৃষকরা তাদের উৎপাদিত পণ্য বিদেশি বাজারে সরবরাহ দিতে পারতেন এর আগে। এর ফলে তারা সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারতেন। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তনের সঙ্গে তাদের সেই জীবনধারার ওপর সরাসরি আঘাত হেনেছে করোনা ভাইরাস। ফলে তারা দারিদ্র্যে নিপতিত হচ্ছেন। এমনই একটি কৃষি পরিবারের কথা তুলে ধরা হয়েছে প্রতিবেদনে। নিলুফা বেগম ও তার স্বামী ১০ বছর আগে কাঁকড়া চাষ শুরু করেছিলেন। উপকূলীয় খুলনার বেশির ভাগ মানুষের মতো তারাও ধান চাষ করতেন। কিন্তু সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা বৃদ্ধির জন্য চাষের জমি ক্রমশ লবণাক্ত ও অনুর্বর হয়ে গেছে। ফলে কৃষকরা বিকল্প আয়ের দিকে দৃষ্টি দিয়েছেন। তারা চিংড়ি ও কাঁকড়া চাষ শুরু করেন। এগুলো চাষ সেখানে বেশ জনপ্রিয়তা পায়। ২০১৫ সালে এই খাত থেকে ৭৬ লাখ ডলারের চিংড়ি বা কাঁকড়া রপ্তানি হয়েছে। এর চাহিদা আকাশচুম্বী হয়ে ওঠে। ২০১৮-১৯ সালে তা বৃদ্ধি পেয়ে ৪ কোটি ৩০ লাখ ডলারে এসে দাঁড়ায়। বাংলাদেশের প্রায় ৫ লাখ মানুষ এখন এই কাঁকড়া চাষ করেন। তাদের সঙ্গে আরো ১০ লাখ মানুষ এই খাতে কর্মসংস্থান খুঁজে পেয়েছেন। বৃটিশভিত্তিক দাতব্য সংস্থা ভলান্টারি সার্ভিস ওভারসিস (ভিএসও) থেকে সমর্থন পেয়েছিন মিস নিলুফা বেগম। বিনিয়োগে সব ধরনের প্রয়োজনীয় বুদ্ধি দিয়েছে তারা। ফলে খুব শিগগিরই নিলুফা বেগম বুঝতে পারেন কাঁকড়া চাষ কতটা লাভজনক হতে পারে। এক বছরের মধ্যে তিনি ব্যবসা সম্প্রসারণ করেন। ঘরের পিছনে একটি পুকুরে শুরু করেন এর চাষ। স্থানীয় ক্রেতাদের কাছে তিনি বিক্রি করে দেন কাঁকড়া। তা চলে যায় দূরপ্রাচ্যের এশিয়ার দেশগুলোতে- বিশেষ করে চীনে।
গত ৯ বছর ধরে নিলুফা বেগমের লাভ বৃদ্ধিই পাচ্ছিল। কিন্তু ২০১৯ সালে একটি ঘূর্ণিঝড় তার পুকুর ভাসিয়ে নেয়। মারা যায় কাঁকড়াগুলো। ধ্বংস হয়ে যায় এর সঙ্গে সম্পর্কিত সব সরঞ্জাম। তিনি আবার এই চাষ শুরু করার চিন্তা করেন। ঠিক তখনই করোনা ভাইরাস আঘাত হানে। দেশজুড়ে দেয়া হয় লকডাউন। নিলুফা বলেন, শহর থেকে আমাদের গ্রাম অনেক দূরে। তাই শুরুতে বুঝতে পারিনি কি ঘটতে যাচ্ছে। এক পর্যায়ে ক্রেতারা আসা বন্ধ করে দিলেন। ফলে আমরা বকেয়া ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলাম। লকডাউন দেয়ার ফলে নিলুফা বেগম ও তার স্বামী স্থানীয় বাজারে নিতে পারলেন না তাদের কাঁকড়া। নিলুফা বলেন, আস্তে আস্তে বুঝতে পারলাম আমরা এতদিন যে কঠোর পরিশ্রম করেছি বিপর্যয়ের পর তার সবটাই নষ্ট হয়েছে।
নিলুফা বেগম একাই নন। তার গ্রামের আরো কয়েক শত কৃষক এভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন বলে জানিয়েছেন তিনি। তারা কেউ আর ঘুরে দাঁড়ানোর কোন লক্ষণ দেখছেন না। এখন লকডাউন শিথিল করা হয়েছে। কিন্তু নিলুফা বেগম তার ঋণের টাকা শোধ করার জন্য লড়াই করছেন। করোনা মহামারির কারণে তাদের রপ্তানি বন্ধ হয়ে আছে। তার ক্রেতারা আবার ব্যবসা শুরু করার চেষ্টা করছেন। খুলনাভিত্তিক বেসরকারি প্রতিষ্ঠান উইনরকের বিশেষজ্ঞ সাইফুল্লাহ বলেন, বাংলাদেশের এসব চিংড়ি বা কাঁকড়া চাষীরা মূলত রপ্তানির ওপর নির্ভরশীল। সাংস্কৃতিক কারণে মুসলিম প্রধান বাংলাদেশে কাঁকড়া জনপ্রিয় নয়। এ ছাড়া বিপুল সংখ্যক হিন্দুও এটা খান না। ফলে স্থানীয় পর্যায়ে কাঁকড়ার চাহিদা খুবই কম। বাংলাদেশে যে পরিমাণ কাঁকড়া চাষ হয় তার শতকরা প্রায় ৮৫ ভাগ যায় চীনে। বাকিটা যায় এশিয়ারা অন্যান্য দেশ এবং ইউরোপে। করোনা ভাইরাস সংক্রমণ শুরু হতেই কাঁকড়া আমদানি বন্ধ করে দেয় চীন। এরপর বাংলাদেশের বিমানবন্দর বন্ধ করে দেয়া হয়। চীনের আমদানিবাজারও বন্ধ হয়ে যায়। বিশেষ করে মধ্য শরতের চীনে যে উৎসব হয়, তাও বন্ধ করে দেয়া হয়। এ সময়টাতে সেখানে কাঁকড়ার চাহিদা থাকে তুঙ্গে।
কাঁকড়ার এভাবে চাহিদায় পতন হওয়ার পর স্থানীয়বাজারে এর দাম পড়ে যায় দুই-তৃতীয়াংশ। সাইফুল্লাহ বলেন, ২০১৯ সালে ঢাকার ফার্মগেটের বাজারে প্রতি কিলোগ্রাম কাঁকড়ার মাংস বিক্রি হয়েছে ২৫০০ টাকায়। ২০২০ সালের অক্টোবরে সেই দাম নেমে এসেছে ৮০০ থেকে ৯০০ টাকায়। ফলে কাঁকড়া চাষী এবং বাংলাদেশী উপকূল এলাকার ব্যবসায়ীরা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার দ্বারপ্রান্তে। অন্যদিকে লকডাউনের কারণে দেশের আরেকটি খাতের কৃষকরাও বড় আঘাত পেয়েছেন। কারণ রপ্তানিবাণিজ্য হয়েছে ধীর গতির। বাংলাদেশের হাওর অঞ্চল সমুদ্র থেকে অনেক দূরে। কিন্তু জলবায়ুর পরিবর্তন এখানকার কৃষিখাতে বিপর্যয় সৃষ্টি করেছে। কিছুদিন আগেও এখানে বৃষ্টি হতো একটি নিয়ম মেনে। কিন্তু এখন বৃষ্টি হয় অনাকাঙ্খিতভাবে। ফলে অসময়ে কড়া খড়া দেখা দেয়। আবার বন্যা দেখা দেয়। এতে নষ্ট হয়ে যায় ধান। এই ধানই সেখানকার প্রধান আয়ের উৎস। দ্বিতীয় সাধারণ উৎস হলো হাঁস-মুরগী। চরমভাবাপন্ন আবহাওয়ার কারণে এসবও পড়ে বিপর্যয়ে। তারা যে শুধু ডুবে মরে এমন নয়। মাঝে মাঝেই তাপমাত্রার উত্থান-পতনের কারণে তারা অসুস্থ হয়। তা সত্ত্বেও হাওর অঞ্চলের মানুষ দেখতে পেয়েছে মুরগী পালনের চেয়ে হাঁস পালন লাভজনক।
বাংলাদেশভিত্তিক এনজিও ব্র্যাক মনে করে, হাঁস পালন হাওয়ার অঞ্চলের জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে কিছুটা মানিয়ে উঠতে পারবে। ব্র্যাকের ইন্টিগ্রেটেড ডেভেলপমেন্ট প্রোগ্রামের অধীনে ঋণ দেয়া হয়। প্রশিক্ষণ দেয়া হয়। বিশেষ করে নারীদের। হাঁস পালন এবং এ সংক্রান্ত ব্যবসা নিয়ে তাদেরকে সাহায্য করা হয়। করোনা মহামারির আগে ক্রেতারা হাওরে যেতেন হাঁস কিনতে। বিদেশ থেকেও ক্রেতা যেতেন বলে জানিয়েছেন ব্র্যাকের হাঁস বিষয়ক কর্মসূচির কৃষিবিদ মো. হেলাল উদ্দিন। তিনি বলেন, হাঁসের মাংসের চাহিদা বৃদ্ধির জন্য এর দাম অনেক বেশি। এর ফলে হাঁস পালনকারীরা ভাল লাভ পেতেন। কিন্তু করোনা ভাইরাস সেই মাংসের চাহিদা শেষ করে দিয়েছে। ক্রেতারা এখন আর হাওরমুখী হচ্ছেন না। হেলাল উদ্দিন আরো বলেন, আরো খারাপ খবর হলো, এসব প্রাণির খাবার, ওষুধ ও টিকা সরবরাহেও বিঘ্ন সৃষ্টি হয়েছে।
করোনা মহামারির আগে বানিয়াচংয়ের শিপ্রা এবং পিংকু দাস মাসে গড়ে ১৫ হাজার থেকে ২০ হাজার টাকা আয় করতেন এ খাত থেকে। কিন্তু তাদের আয় একেবারে কমে গেছে এখন অর্ধেকে।