ঢাকা , শুক্রবার, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ১২ পৌষ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

একই ধানগাছে দুবার ফলন

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম ও মো. তানজিমুল ইসলাম একই ধানগাছ থেকে দুইবার ধান উৎপাদনে সফল হয়েছেন। প্রায় দুই বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সম্প্রতি তাঁরা সফল হয়েছেন। এই কাজে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন খুবির অ্যাগ্রো-টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম। অর্থায়ন করেছে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশি বায়োটেকনোলজিস্ট অর্গানাইজেশন (জিএনওবিবি)।

মুড়ি ধান (রেটুনিং) চাষের কার্যকারিতা অনুসন্ধানের জন্য ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে খুলনার বটিয়াঘাটায় মাঠ পরীক্ষা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই দুই শিক্ষার্থী। ধান কাটার পর গাছের গোড়া থেকে আবারও ধান উৎপাদনের এই প্রযুক্তিকে বলা হয় রেটুন ক্রপ।

আমন রোপণের আগে ও বোরো কাটার পর ৪৫ থেকে ৭০ দিন জমি পতিত থাকে। মুড়ি ধান চাষের মাধ্যমে (রেটুনিং) অর্থাৎ কেটে নেওয়া ধানগাছের গোড়া পরিচর্যার মাধ্যমে এসব জমির সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব। তবে উচ্চ লবণাক্ত মাটিতে মুড়ি ফসলের ফলন হয় না।

এ পদ্ধতিতে ধানগাছ নির্দিষ্ট উচ্চতায় কেটে (গোড়া থেকে ৩০ সেন্টিমিটার) কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করলে সামান্য পরিমাণে সেচ এবং সার প্রয়োগ করে দুবার ফলন পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া অল্প মাত্রায় কীটনাশক ছিটিয়ে মাত্র ৩৫ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে (ধানের জাতের ওপর নির্ভর করে) একই জমি থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল ফসলের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব। ফলে বোরো ধান কাটার পর বর্ষা বা বন্যা আসার আগেই দ্বিতীয় পর্যায়ের ফলন ঘরে তুলতে পারবেন কৃষক।

এ ব্যাপারে সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণে ধানের উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। উৎপাদন বাড়ানোর একটি উপায় হিসেবে মুড়ি ধান চাষের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। বিভিন্ন দেশে গবেষণার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মুড়ি ধান চাষ করে মূল ফসলের প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব।

চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁরা বলেন, বোরো মৌসুমের আগাম জাত মুড়ি ধান উৎপাদনের জন্য উপযোগী। এ পদ্ধতিতে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য এ জাতগুলোর পাকা ধান কিছুটা সবুজ থাকা অবস্থায় কাটতে হবে। সাধারণত বোরো মৌসুমে মধ্যম উঁচু জমিতে মুড়ি ধান চাষ করা যায়। এ জন্য মূল ফসল কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ২০-৪০ সেন্টিমিটার নাড়া বা ২-৩টি নোড বা পর্ব রেখে ফসল কাটতে হবে। মূল ফসল কাটার পাঁচ-সাত দিন পর বিঘাপ্রতি পাঁচ কেজি ইউরিয়া ও পাঁচ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করলে বিঘাপ্রতি পাঁচ-ছয় মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে তানজিমুল ইসলাম বলেন, মুড়ি ধান চাষে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি রাখতে হবে, যেন নাড়া থেকে কুশি জন্মাতে পারে। তা ছাড়া নতুন কুশি মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া মুড়ি ধান চাষের জন্য এমন জাতের ধান নির্বাচন করতে হবে, যার কুশি উৎপাদনক্ষমতা বেশি এবং বাতাসে সহজে ঢলে না পড়ে। এই ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রয়োজনে বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

এ ধান চাষ সম্পর্কে আশার কথা জানিয়ে সাজিদুল ইসলাম বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে মূল ফসলের অতিরিক্ত প্রায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফলন হতে পারে। পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে বীজ ধান বীজতলা ও জমি তৈরি এবং রোপণ খরচ লাগে না বিধায় এটি ব্যয়সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। তা ছাড়া মূল ফসলের চেয়ে মুড়ি ধান পাকতে ৬৫ শতাংশ কম সময় লাগে। মুড়ি ধানের জন্য জমি তৈরি ও চারা রোপণ করতে হয় না। সেচ, সার ও শ্রমিক খরচ ৫০-৬০ শতাংশ কম লাগে। একবার চাষ করে একই জমি থেকে দুবার ফলন পাওয়ায় শস্যের নিবিড়তাও বাড়ে। ’

কৃষকদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই দুই শিক্ষার্থী বলেন, ‘মুড়ি ধান পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হওয়ার আশঙ্কা থাকে বিধায় পরবর্তী মৌসুমে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া মুড়ি ধান চাষের সফলতা মূল ফসলের আন্তপরিচর্যার ওপর নির্ভর করে। কিছু ক্ষেত্রে এই ধান চাষে পরবর্তী মৌসুমের জমি তৈরি ও ফসল চাষে দেরি হতে পারে। আগাম জাত নির্বাচন মুড়ি ধান ফসলের জন্য ভালো। এই পদ্ধতিতে ধান চাষের সময় জমিতে এক-দেড় ইঞ্চি পানি রাখলে ফলন ভালো হয়। ’

এ বিষয়ে খুবির অ্যাগ্রো-টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ‘এই পদ্ধতি নতুন নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটা নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই। অতীতে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গসহ যেসব অঞ্চলে বেশি ধান উৎপাদিত হয়, সেখানে কৃষকেরা আমন মৌসুমে এই পদ্ধতি ব্যবহার করত। কিন্তু আমাদের যেটা গবেষণা সেটা হলো, বোরো মৌসুমে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা। সেদিক থেকে এটি নতুন ও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা হিসেবেও নতুন। ’

মতিউল ইসলাম আরও বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য খুবই উপযোগী পদ্ধতি; বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য। কারণ, এ অঞ্চলে আমন মৌসুম আসার আগেই বোরোর রেটুনিং থেকে ফলন তুলে ফেলা সম্ভব। তবে লবণের মাত্রা বেশি হলে এই পদ্ধতিতে ফলন পাওয়া সম্ভব নয়।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

জনপ্রিয় সংবাদ

একই ধানগাছে দুবার ফলন

আপডেট টাইম : ০৫:৪০ অপরাহ্ন, মঙ্গলবার, ৬ জুন ২০২৩

খুলনা বিশ্ববিদ্যালয়ের (খুবি) সাবেক শিক্ষার্থী সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম ও মো. তানজিমুল ইসলাম একই ধানগাছ থেকে দুইবার ধান উৎপাদনে সফল হয়েছেন। প্রায় দুই বছর ধরে পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে সম্প্রতি তাঁরা সফল হয়েছেন। এই কাজে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন খুবির অ্যাগ্রো-টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম। অর্থায়ন করেছে গ্লোবাল নেটওয়ার্ক অব বাংলাদেশি বায়োটেকনোলজিস্ট অর্গানাইজেশন (জিএনওবিবি)।

মুড়ি ধান (রেটুনিং) চাষের কার্যকারিতা অনুসন্ধানের জন্য ২০২১ সালের নভেম্বর থেকে খুলনার বটিয়াঘাটায় মাঠ পরীক্ষা করেন বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই দুই শিক্ষার্থী। ধান কাটার পর গাছের গোড়া থেকে আবারও ধান উৎপাদনের এই প্রযুক্তিকে বলা হয় রেটুন ক্রপ।

আমন রোপণের আগে ও বোরো কাটার পর ৪৫ থেকে ৭০ দিন জমি পতিত থাকে। মুড়ি ধান চাষের মাধ্যমে (রেটুনিং) অর্থাৎ কেটে নেওয়া ধানগাছের গোড়া পরিচর্যার মাধ্যমে এসব জমির সঠিক ব্যবহার করা সম্ভব। তবে উচ্চ লবণাক্ত মাটিতে মুড়ি ফসলের ফলন হয় না।

এ পদ্ধতিতে ধানগাছ নির্দিষ্ট উচ্চতায় কেটে (গোড়া থেকে ৩০ সেন্টিমিটার) কিছু পদ্ধতি অবলম্বন করলে সামান্য পরিমাণে সেচ এবং সার প্রয়োগ করে দুবার ফলন পাওয়া সম্ভব। এ ছাড়া অল্প মাত্রায় কীটনাশক ছিটিয়ে মাত্র ৩৫ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে (ধানের জাতের ওপর নির্ভর করে) একই জমি থেকে দ্বিতীয় পর্যায়ে মূল ফসলের ৩৫ শতাংশ পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব। ফলে বোরো ধান কাটার পর বর্ষা বা বন্যা আসার আগেই দ্বিতীয় পর্যায়ের ফলন ঘরে তুলতে পারবেন কৃষক।

এ ব্যাপারে সৈয়দ সাজিদুল ইসলাম বলেন, বাংলাদেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগ যেমন বন্যা, খরা, লবণাক্ততা ও শৈত্যপ্রবাহের কারণে ধানের উৎপাদন ব্যাহত হয়। কিন্তু ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার খাদ্যের চাহিদা পূরণে ধানের উৎপাদন বাড়ানোর বিকল্প নেই। উৎপাদন বাড়ানোর একটি উপায় হিসেবে মুড়ি ধান চাষের ওপর গুরুত্ব দেওয়া জরুরি। বিভিন্ন দেশে গবেষণার ক্ষেত্রে দেখা যায়, মুড়ি ধান চাষ করে মূল ফসলের প্রায় ৫০ শতাংশ পর্যন্ত ফলন পাওয়া সম্ভব।

চাষ পদ্ধতি সম্পর্কে তাঁরা বলেন, বোরো মৌসুমের আগাম জাত মুড়ি ধান উৎপাদনের জন্য উপযোগী। এ পদ্ধতিতে ভালো ফলন পাওয়ার জন্য এ জাতগুলোর পাকা ধান কিছুটা সবুজ থাকা অবস্থায় কাটতে হবে। সাধারণত বোরো মৌসুমে মধ্যম উঁচু জমিতে মুড়ি ধান চাষ করা যায়। এ জন্য মূল ফসল কাটার সময় গাছের গোড়া থেকে ২০-৪০ সেন্টিমিটার নাড়া বা ২-৩টি নোড বা পর্ব রেখে ফসল কাটতে হবে। মূল ফসল কাটার পাঁচ-সাত দিন পর বিঘাপ্রতি পাঁচ কেজি ইউরিয়া ও পাঁচ কেজি পটাশ সার প্রয়োগ করলে বিঘাপ্রতি পাঁচ-ছয় মণ পর্যন্ত ফলন পাওয়া যায়।

এ বিষয়ে তানজিমুল ইসলাম বলেন, মুড়ি ধান চাষে মাটিতে পর্যাপ্ত পরিমাণ পানি রাখতে হবে, যেন নাড়া থেকে কুশি জন্মাতে পারে। তা ছাড়া নতুন কুশি মাটি থেকে প্রয়োজনীয় পুষ্টি উপাদান গ্রহণ করতে পারে। এ ছাড়া মুড়ি ধান চাষের জন্য এমন জাতের ধান নির্বাচন করতে হবে, যার কুশি উৎপাদনক্ষমতা বেশি এবং বাতাসে সহজে ঢলে না পড়ে। এই ধানে রোগবালাই ও পোকামাকড়ের আক্রমণ হলে যথাযথ ব্যবস্থা নিতে হবে এবং প্রয়োজনে বালাইনাশক প্রয়োগ করতে হবে।

এ ধান চাষ সম্পর্কে আশার কথা জানিয়ে সাজিদুল ইসলাম বলেন, ‘এ পদ্ধতিতে মূল ফসলের অতিরিক্ত প্রায় ৫০ ভাগ পর্যন্ত ফলন হতে পারে। পাশাপাশি এ পদ্ধতিতে বীজ ধান বীজতলা ও জমি তৈরি এবং রোপণ খরচ লাগে না বিধায় এটি ব্যয়সাশ্রয়ী প্রযুক্তি। তা ছাড়া মূল ফসলের চেয়ে মুড়ি ধান পাকতে ৬৫ শতাংশ কম সময় লাগে। মুড়ি ধানের জন্য জমি তৈরি ও চারা রোপণ করতে হয় না। সেচ, সার ও শ্রমিক খরচ ৫০-৬০ শতাংশ কম লাগে। একবার চাষ করে একই জমি থেকে দুবার ফলন পাওয়ায় শস্যের নিবিড়তাও বাড়ে। ’

কৃষকদের প্রতি পরামর্শ দিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ের সাবেক এই দুই শিক্ষার্থী বলেন, ‘মুড়ি ধান পোকামাকড়ের আশ্রয়স্থল হওয়ার আশঙ্কা থাকে বিধায় পরবর্তী মৌসুমে পোকামাকড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দিতে পারে। তা ছাড়া মুড়ি ধান চাষের সফলতা মূল ফসলের আন্তপরিচর্যার ওপর নির্ভর করে। কিছু ক্ষেত্রে এই ধান চাষে পরবর্তী মৌসুমের জমি তৈরি ও ফসল চাষে দেরি হতে পারে। আগাম জাত নির্বাচন মুড়ি ধান ফসলের জন্য ভালো। এই পদ্ধতিতে ধান চাষের সময় জমিতে এক-দেড় ইঞ্চি পানি রাখলে ফলন ভালো হয়। ’

এ বিষয়ে খুবির অ্যাগ্রো-টেকনোলজি ডিসিপ্লিনের অধ্যাপক ড. মো. মতিউল ইসলাম বলেন, ‘এই পদ্ধতি নতুন নয়। কিন্তু বাংলাদেশে এটা নিয়ে তেমন উল্লেখযোগ্য গবেষণা নেই। অতীতে বাংলাদেশের উত্তরবঙ্গসহ যেসব অঞ্চলে বেশি ধান উৎপাদিত হয়, সেখানে কৃষকেরা আমন মৌসুমে এই পদ্ধতি ব্যবহার করত। কিন্তু আমাদের যেটা গবেষণা সেটা হলো, বোরো মৌসুমে এই পদ্ধতি ব্যবহার করা। সেদিক থেকে এটি নতুন ও বিজ্ঞানভিত্তিক গবেষণা হিসেবেও নতুন। ’

মতিউল ইসলাম আরও বলেন, এটি বাংলাদেশের জন্য খুবই উপযোগী পদ্ধতি; বিশেষ করে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের জন্য। কারণ, এ অঞ্চলে আমন মৌসুম আসার আগেই বোরোর রেটুনিং থেকে ফলন তুলে ফেলা সম্ভব। তবে লবণের মাত্রা বেশি হলে এই পদ্ধতিতে ফলন পাওয়া সম্ভব নয়।