ইদ্রিস আলী ও নাজির হোসেন কাজ করতেন সিরাজগঞ্জের রায়গঞ্জে একটি ধানের চাতালে। মাস দেড়েক আগে ওই ধানের চাতালে বয়লার বিস্ফোরণে ঘটনাস্থলেই মারা যান তাঁরা। পরে জানা যায়, ধানের চাতালে ব্যবহার করা বয়লারটি ছিল ত্রুটিপূর্ণ। নিবন্ধিত ও অনিবন্ধিত মিলে দেশে এখন প্রায় ৫০ হাজার ধানের চাতাল আছে, যেগুলোতে ত্রুটিপূর্ণ বয়লার ব্যবহারের ফলে প্রতিবছরই বিস্ফোরণে হতাহতের ঘটনা ঘটছে। প্রতিবছর নিহতের সংখ্যাও বাড়ছে। শুধু নিহত নয়, প্রচলিত পদ্ধতির বয়লার থেকে নির্গত ধোঁয়া ও ছাই আশপাশের পরিবেশকে মারাত্মকভাবে দূষিত করছে। প্রথাগত বয়লারের কারণে দেশের বিভিন্ন জেলায় চোখ ও ফুসফুসের নানা রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঘটনাও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে। তা ছাড়া দেশের চাতালগুলোতে ধান সিদ্ধ করতে যে বয়লার ব্যবহার করা হয়, সেগুলোর বেশির ভাগেরই জ্বালানিদক্ষতা কম। ফলে ধানের তুষের বেশির ভাগই সিদ্ধ করার কাজে লেগে যায়। ধানের চাতালে এমন অব্যবস্থপনার বিষয়টি সরকারেরও নজরে এসেছে। ধান সিদ্ধ ও শুকাতে তুষ যাতে কম লাগে, বয়লার থেকে কালো ধোঁয়া ও ছাই যেন বের না হয় এবং বয়লার যাতে বিস্ফোরিত না হয়, সে জন্য নতুন একটি প্রযুক্তি উদ্ভাবন করা হয়েছে। বিদ্যুৎ বিভাগের আওতাধীন সংস্থা টেকসই ও নবায়নযোগ্য জ্বালানি উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (স্রেডা) ও জার্মানির উন্নয়ন সহযোগী সংস্থা জিআইজেড যৌথভাবে এই প্রযুক্তি উদ্ভাবন করেছে। গত ২৮ মে শেরপুর জেলা সদরে অন্যতম বৃহৎ চাল ব্যবসায়ী আসাদুজ্জামান রওশনের যমুনা অটো রাইস মিলে আনুষ্ঠানিকভাবে নতুন প্রযুক্তিটি উদ্বোধন করা হয়।
শেরপুর সদরে ২০টি অটো রাইস মিল আছে, যার মধ্যে আসাদুজ্জামান রওশনের যমুনা রাইস মিল অন্যতম বৃহৎ। রাইস মিল প্রতিষ্ঠার পর থেকেই আসাদুজ্জামানকে তাঁর ধান শুকাতে অপেক্ষায় থাকতে হতো ভালো আবহাওয়ার দিকে। মেঘলা আকাশ, বৃষ্টি ও রোদের অভাবে এত দিন ধান শুকাতে অনেক দেরি হতো, বিশেষ করে বোরো ধান। বছরে মাত্র ৬০ দিন ধান সিদ্ধ করার পর স্বাভাবিকভাবে সূর্যের আলোয় ধান শুকাতে পারতেন তিনি। বৈরী আবহাওয়ার কারণে বোরো ধান সিদ্ধ ও শুকাতে সময় বেশি লাগায় চালের মানও খারাপ হয়ে যেত। তবে তাঁর অটো রাইস মিলে নতুন যে প্রযুক্তি প্রতিস্থাপন করা হয়েছে, তাতে সারা বছরই ধান সিদ্ধ ও শুকাতে পারবেন আসাদুজ্জামান। নতুন এই প্রযুক্তির নাম ইন্টিগ্রেটেড পারবয়েলিং-ড্রাইং পদ্ধতি। নতুন প্রযুক্তি প্রতিস্থাপনের ফলে একদিকে জ্বালানি খরচ কমবে, অন্যদিকে পরিবেশ সুরক্ষা নিশ্চিত করা যাবে। একই সঙ্গে খরচ কমবে ও সময় বাঁচবে। তা ছাড়া এই প্রযুক্তির যন্ত্রপাতি স্থাপনে যে খরচ, তা প্রচলিত ব্যবস্থার যন্ত্রপাতি স্থাপনের খরচের অর্ধেক বলে জানিয়েছেন স্রেডা ও জিআইজেডের কর্মকর্তারা।
সরেজমিনে ঘুরে নতুন প্রযুক্তি সম্পর্কে জানা গেল, নতুন পদ্ধতিতে চালকলের বয়লারের সঙ্গে হিট এক্সচেঞ্জার বসিয়ে গরম বাতাস তৈরি করে সেই বাতাস দিয়ে ধান শুকানো হয়। নতুন বয়লারে নকশা পরিবর্তন করা হয়েছে। প্রতিস্থাপন করা হয়েছে সেফটি ভাল্ভ। সংযোগ লাগানো হয়েছে ওয়াটার লেভেল কন্ট্রোলার। একই সঙ্গে অটোমেশন সিস্টেম ও প্রেশার মিটার। ইন্টিগ্রেটেড পারবয়েলিং-ড্রাইং পদ্ধতিটি পরিবেশবান্ধব, নিরাপদ ও জ্বালানিসাশ্রয়ী। স্থানীয়রা বলছেন, নতুন পদ্ধতিতে ধান সিদ্ধ ও শুকানো দুটিই করা সম্ভব। নতুন পদ্ধতির বয়লার তুষসাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব। তাঁরা বলছেন, পুরনো বয়লারে তুষ অনেক বেশি লাগত। তুষ পুরোপুরি পুড়ত না। ফলে কালো ধোঁয়া বের হতো। নতুন পদ্ধতিতে তুষ পুরোপুরি পোড়ানোর ব্যবস্থা রয়েছে। ফলে কালো ধোঁয়া বের হওয়ার কোনো আশঙ্কা নেই।
জানতে চাইলে জিআইজেডের সিনিয়র উপদেষ্টা আল মুতাব্বির বিন আনাম কালের কণ্ঠকে বলেন, ধান শুকাতে ও সিদ্ধ করতে কোনো উপযুক্ত প্রযুক্তির ব্যবহার না থাকায় বেশির ভাগ সময় চালকল মালিকদের মিলের কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়। এ অবস্থা থেকে বের হতে সাসটেইনেবল এনার্জি ফর ডেভেলপমেন্ট (সেড) কর্মসূচির আওতায় ধান সিদ্ধকরণ ও ড্রাইং সমন্বিত প্রযুক্তির উদ্ভাবন করা হয়। নবপ্রযুক্তি উদ্ভাবনের ফলে চালকল মালিকরা যেমন জ্বালানি খরচ কমাতে পারবেন, তেমনি অপেক্ষাকৃত কম বিনিয়োগে মিলের উৎপাদনক্ষমতা বাড়াতে পারবেন।
যমুনা অটো রাইস মিলের স্বত্বাধিকারী আসাদুজ্জামান রওশন কালের কণ্ঠকে বলেন, ‘আমার অটো রাইস মিলে প্রচলিত যে বয়লার ব্যবহার করে এত দিন ধান সিদ্ধ করতাম, সেটি নিরাপদ ছিল না। ব্যয়বহুলও ছিল। চালের মান ঠিক রাখতে এটি ভালোভাবে নিয়ন্ত্রণও করা যায় না। পুরনো ব্যবস্থায় চাতালের মধ্যে রোদে ধান শুকাতে হয়। এ জন্য আবহাওয়ার দিকে তাকিয়ে থাকতে হতো এত দিন। সব মিলিয়ে বছরে ৬০-৬৫ দিনের বেশি ধান শুকানো যেত না। অনেক সময় ধান সিদ্ধ করে রোদের জন্য অপেক্ষা করতে হতো। এতে ধান নষ্ট হয়ে যেত এবং চালের মান ভালো হতো না।’ নতুন পদ্ধতিতে বছরে ১২ মাস যেকোনো সময় ধান শুকানো যায় বলে জানান তিনি। আসাদুজ্জামান রওশন বলেন, নতুন পদ্ধতি সময় ও খরচ বাঁচানোর পাশাপাশি নিরাপদও। তা ছাড়া পুরনো বয়লার থেকে যে কালো ধোঁয়া বের হয়ে পরিবেশদূষণ হয়, এখন তা-ও হয় না।
বাংলাদেশ অটো মেজর ও হাস্কিং মিল ওনার্স অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক কে এম লায়েক আলী কালের কণ্ঠকে বলেন, ক্ষুদ্র ও মাঝারি চালকল মালিকদের জন্য এই প্রযুক্তি খুবই দরকারি। সারা দেশে প্রায় ৫০ হাজার ধানের চাতাল-মিল আছে। এসব মিলে যদি এই প্রযুক্তি ব্যবহার করা যায় তাহলে জ্বালানি ও তুষ দুটিই সাশ্রয় হবে। বর্তমানে এসব মিলে প্রায় ৩০ লাখ শ্রমিক কাজ করছে। এর মধ্যে ১৫ লাখ পুরুষ ও ১৫ লাখ নারী শ্রমিক আছে। হাস্কিং মিলগুলো আধুনিক করা গেলে শ্রমিকদের কাজের আরো সুবিধা হবে বলে তিনি মনে করেন। লায়েক আলী বলেন, সরকারের উচিত এসব চালকল মালিককে শিল্প খাতের আওতায় এনে স্বল্প সুদে ঋণ দেওয়ার ব্যবস্থা করা। তাহলে এই প্রযুক্তির ব্যবহার বাড়বে।