ঢাকা , শুক্রবার, ১১ অক্টোবর ২০২৪, ২৬ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

তালিকা ধরে যেসব জেলায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু

জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানে নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আজ থেকে শুরু হয়ে হবে এই অভিযান। তালিকাভুক্ত ও মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গিদের ধরতে এই অভিযান চলবে সাত দিন। পুলিশের সঙ্গে এই অভিযানে র‌্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ, বিশেষ শাখার সদস্যরাও থাকবেন। সীমান্ত এলাকায় এই অপারেশনের সঙ্গে যোগ দেবেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবির সদস্যরা।

একের পর এক টার্গেট কিলিং ঠেকাতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি এই অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। গতকাল সকালে পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয় বৈঠক। এই বৈঠকেই ধারাবাহিক টার্গেট কিলিং ঠেকাতে আলোচনা হয় কর্ম-কৌশল নিয়ে। প্রাথমিকভাবে ৭ দিনের সাঁড়াশি অভিযান চলবে।

সারা দেশে এই অভিযান চললেও জোর দেয়া হবে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। পুলিশের বিশেষ শাখা ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হালনাগাদ জঙ্গি তালিকার সমন্বয়ে চলবে এই অভিযান।

বৈঠকে আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণা জোরদার করতে হবে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য কমিউনিটি পুলিশিংকে কাজে লাগাতে হবে।’ দৃঢ় মনোবল নিয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন একদিন আগে দেশের বাইরে থেকে ফেরা পুলিশ মহাপরিদর্শক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টিম স্পিরিট নিয়ে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তিনি।

আইজিপি বলেন, দেশে সমপ্রতি যেসব সহিংসতা ঘটছে তার সঙ্গে ‘হোমগ্রোন’ বা দেশীয় জঙ্গিরা জড়িত রয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। তাই এদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী একটি অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত দেড় বছরে অন্তত ৪৭টি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে ২৯টির দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ও ৮টির দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা।

নিহতের তালিকায় ব্লগার থেকে শুরু করে লেখক, প্রকাশক, অধ্যাপক, পুলিশ সদস্য, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও মতাবলম্বী ব্যক্তি ও তাদের উপসানলয়, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইসলাম ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের ওপর হামলা চলছে। সর্বশেষ জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মবর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

গত মঙ্গলবার প্রথম দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। আইজিপি বুধবার দেশে ফেরার একদিন পরই আবারো পুলিশ সদর


দপ্তরে বৈঠক হয়। এই বৈঠকে পুলিশের বিভিন্ন শাখা এসবি, সিআইডি, র‌্যাব, ডিবি, কাউন্টার টেররিজম, সকল রেঞ্জ ডিআইজি, উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি প্রবণ এলাকার পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার পর থেকেই কঠোর মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরই মধ্যে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে অন্তত ৫ জঙ্গি সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। জঙ্গি নিয়ে কাজ করেন এমন পুলিশ কর্মকর্তারাও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বুধবার সংসদে বলেছেন, গুপ্ত হত্যা করে কেউ পার পাবে না। এভাবে পরিবারের ওপর হাত দিলে কারও হাতই থেমে থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হত্যাকারী এবং তাদের প্রভু যে-ই হোক তাদের আমরা রেহাই দেব না। যারা পরিবারের ক্ষতি করছে তাদের আমরা পাই পাই করে হিসাব নেব।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, পুলিশ সুপারের স্ত্রীকে হত্যার পর কঠোর মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যে কোনো মূল্যে জঙ্গি দমনে বদ্ধপরিকর তারা। পুলিশ ও র‌্যাবের নিজেদের গোয়েন্দা তথ্যের সঙ্গে সরকারের বিশেষ দুই গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের সমন্বয় করা হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের জঙ্গি দমন সেল, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা মিলে এই সমন্বয় করছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের বৈঠক সূত্র জানায়, একের পর এক টার্গেট কিলিং ঠেকানোর নানা কৌশল প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। সর্বশেষ এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমদুা হত্যার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন আইজিপি। এই হত্যাকাণ্ডকে অত্যন্ত নির্মম ও বর্বরোচিত ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেন। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জঙ্গি ঠেকানোর নানা কৌশল প্রয়োগ সম্পর্কে মতামত দেন।

বৈঠকে অংশ নেয়া ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, দেশব্যাপী জঙ্গিদের তালিকা হালনাগাদ করা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়ানো, ওয়ার্ড কমিউনিটি পুলিশিংকে কার্যকর করা, আগন্তুক ও ভাড়াটিয়াদের ওপর নজরদারী বাড়ানো, বিদেশিদের নিরাপত্তা দেয়াসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিরা কিভাবে সংগঠিত হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা চলে।

বৈঠক সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত অন্তত দুই শতাধিক জঙ্গি সদস্য গ্রেপ্তারের পর আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে গেছে। তারা কে কোথায় অবস্থান করছে তা জানার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বর্তমানে অধিক সক্রিয় জাম’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)’র কার্যক্রমের বিশদ বর্ণনা দেন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অভিজ্ঞ একজন কর্মকর্তা।

ওই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে জেএমবি কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্যরা কাজ করছে ‘স্লিপার সেল’ অথবা ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে। ফলে মাঠে সক্রিয় জঙ্গি সদস্যদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা গেলেও মূল হোতাদের আটক করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামও একই কৌশল অবলম্বন করছে। এই সংগঠনের সদস্যরা বেশির ভাগই শিক্ষিত ও নানা বিষয়ে দক্ষ।

বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার কারণে তারা কোনো অপারেশনের আগে নিজেরা যাতে ধরা না পড়ে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীয় যাতে শনাক্ত করতে না পারে সেজন্য নিরাপত্তা বিষয়ে বেশি সজাগ থাকে। এ ছাড়া এরা মূল পরিচয়ের আড়ালে একেকজন নিত্যনতুন নামে পরিচিত হয়। কোড নামও ব্যবহার করে। এসব জঙ্গি সদস্যদের ধরতে দীর্ঘ গোয়েন্দা নজরদারির কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে স্ট্রিং অপারেশন বা আন্ডার কাভার অভিযানেরও সিদ্ধান্ত হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (গোপনীয়) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, জঙ্গি তৎপরতা ঠেকাতে সমন্বিত অভিযান চালানো হবে। যে কোনো  মূল্যে জঙ্গি কার্যক্রম বন্ধ করা হবে।

বৈঠক সূত্র জানায়, জঙ্গিরা ঢাকাকেন্দ্রিক সংগঠিত হতে না পারলেও ঢাকার উপকণ্ঠ বিশেষ করে গাজীপুর ও সাভার, ঢাকার বাইরে টাংগাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ; উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, বগুড়া ও নাটোর, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝিনাইদহ, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় জোরালো অভিযান চালানো হবে।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব এলাকায় জঙ্গিরা তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা আগের চাইতে বৃদ্ধি করেছিল। ঢাকায় অবস্থান করতে না পেরে জেএমবি ও আনসারুল্লাহর সদস্যরা ঢাকার বাইরে গিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

নবগঠিত কাউন্টার টেররিজমের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেএমবির ভাগ হওয়া সব দল ও উপদলের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। এদের প্রত্যেককে আটকের জন্য চিরুনি অভিযান চালানো হবে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে যেসব জঙ্গি অভিযানের কারণে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে তাদের নাম ও ছবি বিভিন্ন ইমিগ্রেশনে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়া এলাকাগুলোতেও গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। যাতে তারা কোনোভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ  ফাঁকি দিয়ে পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে না পারে। -এমজমিন

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

তালিকা ধরে যেসব জেলায় সাঁড়াশি অভিযান শুরু

আপডেট টাইম : ০৮:৪১ পূর্বাহ্ন, শুক্রবার, ১০ জুন ২০১৬

জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে দেশজুড়ে সাঁড়াশি অভিযানে নামছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। আজ থেকে শুরু হয়ে হবে এই অভিযান। তালিকাভুক্ত ও মোস্ট ওয়ান্টেড জঙ্গিদের ধরতে এই অভিযান চলবে সাত দিন। পুলিশের সঙ্গে এই অভিযানে র‌্যাব, গোয়েন্দা পুলিশ, বিশেষ শাখার সদস্যরাও থাকবেন। সীমান্ত এলাকায় এই অপারেশনের সঙ্গে যোগ দেবেন বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ- বিজিবির সদস্যরা।

একের পর এক টার্গেট কিলিং ঠেকাতে পুলিশের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের এক বৈঠকে জঙ্গিবিরোধী সাঁড়াশি এই অভিযানের সিদ্ধান্ত হয়। গতকাল সকালে পুলিশ সদর দপ্তরে অনুষ্ঠিত হয় বৈঠক। এই বৈঠকেই ধারাবাহিক টার্গেট কিলিং ঠেকাতে আলোচনা হয় কর্ম-কৌশল নিয়ে। প্রাথমিকভাবে ৭ দিনের সাঁড়াশি অভিযান চলবে।

সারা দেশে এই অভিযান চললেও জোর দেয়া হবে জঙ্গিদের অভয়ারণ্য হিসেবে খ্যাত উত্তরাঞ্চলের বিভিন্ন জেলায়। পুলিশের বিশেষ শাখা ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার হালনাগাদ জঙ্গি তালিকার সমন্বয়ে চলবে এই অভিযান।

বৈঠকে আইজিপি একেএম শহীদুল হক বলেন, ‘জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাসবিরোধী প্রচারণা জোরদার করতে হবে। জঙ্গি ও সন্ত্রাসীদের সম্পর্কে তথ্য সংগ্রহের জন্য কমিউনিটি পুলিশিংকে কাজে লাগাতে হবে।’ দৃঢ় মনোবল নিয়ে পেশাদারিত্বের সঙ্গে দায়িত্ব পালনের জন্য পুলিশ কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন একদিন আগে দেশের বাইরে থেকে ফেরা পুলিশ মহাপরিদর্শক। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যদের টিম স্পিরিট নিয়ে দায়িত্ব পালনের আহ্বান জানান তিনি।

আইজিপি বলেন, দেশে সমপ্রতি যেসব সহিংসতা ঘটছে তার সঙ্গে ‘হোমগ্রোন’ বা দেশীয় জঙ্গিরা জড়িত রয়েছে বলে পুলিশ নিশ্চিত হয়েছে। তাই এদের বিরুদ্ধে আমরা ব্যাপকভাবে দেশব্যাপী একটি অভিযান শুরু করার সিদ্ধান্ত নিয়েছি।’

সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, গত দেড় বছরে অন্তত ৪৭টি জঙ্গি হামলার ঘটনা ঘটেছে। এসব ঘটনায় ৪৯ জন নিহত হয়েছেন। যার মধ্যে ২৯টির দায় স্বীকার করেছে আন্তর্জাতিক জঙ্গি গোষ্ঠী ইসলামিক স্টেট ও ৮টির দায় স্বীকার করেছে আল-কায়েদার ভারতীয় উপমহাদেশ শাখা।

নিহতের তালিকায় ব্লগার থেকে শুরু করে লেখক, প্রকাশক, অধ্যাপক, পুলিশ সদস্য, ভিন্ন ধর্মাবলম্বী ও মতাবলম্বী ব্যক্তি ও তাদের উপসানলয়, হিন্দু, খ্রিষ্টান, বৌদ্ধ, ইসলাম ধর্ম থেকে অন্য ধর্মে বিশ্বাসী ব্যক্তিদের ওপর হামলা চলছে। সর্বশেষ জঙ্গিবিরোধী অভিযানের সঙ্গে সম্পৃক্ত পুলিশ কর্মবর্তা বাবুল আক্তারের স্ত্রী সন্ত্রাসী হামলায় নিহত হওয়ার পর নড়েচড়ে বসেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

গত মঙ্গলবার প্রথম দফায় আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা বৈঠক করেন। আইজিপি বুধবার দেশে ফেরার একদিন পরই আবারো পুলিশ সদর


দপ্তরে বৈঠক হয়। এই বৈঠকে পুলিশের বিভিন্ন শাখা এসবি, সিআইডি, র‌্যাব, ডিবি, কাউন্টার টেররিজম, সকল রেঞ্জ ডিআইজি, উত্তরাঞ্চলের জঙ্গি প্রবণ এলাকার পুলিশ সুপারসহ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা উপস্থিত ছিলেন।

পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যার পর থেকেই কঠোর মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। এরই মধ্যে ৪৮ ঘণ্টার ব্যবধানে অন্তত ৫ জঙ্গি সদস্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কথিত ‘বন্দুকযুদ্ধে’ নিহত হয়েছেন। জঙ্গি নিয়ে কাজ করেন এমন পুলিশ কর্মকর্তারাও জঙ্গিদের বিরুদ্ধে এক ধরনের যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও বুধবার সংসদে বলেছেন, গুপ্ত হত্যা করে কেউ পার পাবে না। এভাবে পরিবারের ওপর হাত দিলে কারও হাতই থেমে থাকবে না। প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, হত্যাকারী এবং তাদের প্রভু যে-ই হোক তাদের আমরা রেহাই দেব না। যারা পরিবারের ক্ষতি করছে তাদের আমরা পাই পাই করে হিসাব নেব।’

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সূত্রগুলো বলছে, পুলিশ সুপারের স্ত্রীকে হত্যার পর কঠোর মনোভাব নিয়ে মাঠে নেমেছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। যে কোনো মূল্যে জঙ্গি দমনে বদ্ধপরিকর তারা। পুলিশ ও র‌্যাবের নিজেদের গোয়েন্দা তথ্যের সঙ্গে সরকারের বিশেষ দুই গোয়েন্দা সংস্থার তথ্যের সমন্বয় করা হচ্ছে।

পুলিশ সদর দপ্তরের জঙ্গি দমন সেল, কাউন্টার টেররিজম ইউনিট, র‌্যাবের গোয়েন্দা শাখা মিলে এই সমন্বয় করছেন। পুলিশ সদর দপ্তরের বৈঠক সূত্র জানায়, একের পর এক টার্গেট কিলিং ঠেকানোর নানা কৌশল প্রয়োগ নিয়ে আলোচনা হয় বৈঠকে। সর্বশেষ এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমদুা হত্যার বিষয়ে দুঃখ প্রকাশ করেন আইজিপি। এই হত্যাকাণ্ডকে অত্যন্ত নির্মম ও বর্বরোচিত ঘটনা বলে আখ্যায়িত করেন। বৈঠকে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা জঙ্গি ঠেকানোর নানা কৌশল প্রয়োগ সম্পর্কে মতামত দেন।

বৈঠকে অংশ নেয়া ডিআইজি পদমর্যাদার একজন কর্মকর্তা জানান, দেশব্যাপী জঙ্গিদের তালিকা হালনাগাদ করা, বিভিন্ন ধর্মীয় প্রতিষ্ঠানের ওপর নজরদারি বাড়ানো, ওয়ার্ড কমিউনিটি পুলিশিংকে কার্যকর করা, আগন্তুক ও ভাড়াটিয়াদের ওপর নজরদারী বাড়ানো, বিদেশিদের নিরাপত্তা দেয়াসহ নানা বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। বিশেষ করে উত্তরাঞ্চলে জঙ্গিরা কিভাবে সংগঠিত হচ্ছে তা নিয়ে আলোচনা চলে।

বৈঠক সূত্র জানায়, এ পর্যন্ত অন্তত দুই শতাধিক জঙ্গি সদস্য গ্রেপ্তারের পর আদালত থেকে জামিনে বেরিয়ে পালিয়ে গেছে। তারা কে কোথায় অবস্থান করছে তা জানার জন্য গোয়েন্দা তৎপরতা বাড়ানোর নির্দেশনা দেয়া হয়। জঙ্গি সংগঠনগুলোর মধ্যে বর্তমানে অধিক সক্রিয় জাম’আতুল মুজাহিদীন বাংলাদেশ (জেএমবি) ও আনসারুল্লাহ বাংলা টিম (এবিটি)’র কার্যক্রমের বিশদ বর্ণনা দেন জঙ্গিবিরোধী অভিযানে অভিজ্ঞ একজন কর্মকর্তা।

ওই কর্মকর্তা বলেন, বর্তমানে জেএমবি কয়েকটি ভাগে ভাগ হয়ে তাদের সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করছে। প্রতিটি গ্রুপের সদস্যরা কাজ করছে ‘স্লিপার সেল’ অথবা ‘কাট আউট’ পদ্ধতিতে। ফলে মাঠে সক্রিয় জঙ্গি সদস্যদের অনেককেই গ্রেপ্তার করা গেলেও মূল হোতাদের আটক করা যাচ্ছে না। একই সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিম বা আনসার আল ইসলামও একই কৌশল অবলম্বন করছে। এই সংগঠনের সদস্যরা বেশির ভাগই শিক্ষিত ও নানা বিষয়ে দক্ষ।

বিশেষ করে তথ্য-প্রযুক্তিতে দক্ষ হওয়ার কারণে তারা কোনো অপারেশনের আগে নিজেরা যাতে ধরা না পড়ে বা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীয় যাতে শনাক্ত করতে না পারে সেজন্য নিরাপত্তা বিষয়ে বেশি সজাগ থাকে। এ ছাড়া এরা মূল পরিচয়ের আড়ালে একেকজন নিত্যনতুন নামে পরিচিত হয়। কোড নামও ব্যবহার করে। এসব জঙ্গি সদস্যদের ধরতে দীর্ঘ গোয়েন্দা নজরদারির কোনো বিকল্প নেই। প্রয়োজনে স্ট্রিং অপারেশন বা আন্ডার কাভার অভিযানেরও সিদ্ধান্ত হয়। পুলিশ সদর দপ্তরের এআইজি (গোপনীয়) মোহাম্মদ মনিরুজ্জামান জানান, জঙ্গি তৎপরতা ঠেকাতে সমন্বিত অভিযান চালানো হবে। যে কোনো  মূল্যে জঙ্গি কার্যক্রম বন্ধ করা হবে।

বৈঠক সূত্র জানায়, জঙ্গিরা ঢাকাকেন্দ্রিক সংগঠিত হতে না পারলেও ঢাকার উপকণ্ঠ বিশেষ করে গাজীপুর ও সাভার, ঢাকার বাইরে টাংগাইল, ময়মনসিংহ, শেরপুর, সিরাজগঞ্জ; উত্তরাঞ্চলের জয়পুরহাট, গাইবান্ধা, নীলফামারী, বগুড়া ও নাটোর, দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের ঝিনাইদহ, মেহেরপুরসহ বিভিন্ন এলাকায় জোরালো অভিযান চালানো হবে।

গোয়েন্দা সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, এসব এলাকায় জঙ্গিরা তাদের সাংগঠনিক তৎপরতা আগের চাইতে বৃদ্ধি করেছিল। ঢাকায় অবস্থান করতে না পেরে জেএমবি ও আনসারুল্লাহর সদস্যরা ঢাকার বাইরে গিয়ে সংগঠিত হওয়ার চেষ্টা করছে।

নবগঠিত কাউন্টার টেররিজমের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, জেএমবির ভাগ হওয়া সব দল ও উপদলের তালিকা প্রস্তুত করা হয়েছে। একই সঙ্গে আনসারুল্লাহ বাংলা টিমের সদস্যদের তালিকা হালনাগাদ করা হয়েছে। এদের প্রত্যেককে আটকের জন্য চিরুনি অভিযান চালানো হবে।

কাউন্টার টেররিজম ইউনিট সূত্র জানায়, ইতিমধ্যে যেসব জঙ্গি অভিযানের কারণে বিদেশে পালিয়ে যেতে পারে তাদের নাম ও ছবি বিভিন্ন ইমিগ্রেশনে দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া অবৈধভাবে সীমান্ত পাড়ি দেয়া এলাকাগুলোতেও গোয়েন্দা নজরদারি করা হচ্ছে। যাতে তারা কোনোভাবেই আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর চোখ  ফাঁকি দিয়ে পার্শ্ববর্তী কোনো দেশে গিয়ে আশ্রয় নিতে না পারে। -এমজমিন