রোববার প্রেস ব্রিফিংয়ে সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার বলেন, এসপি বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু খুনের নির্দেশদাতা কে, এ হত্যাকাণ্ডে কারা কারা জড়িত সবকিছু সম্পর্কে তারা অবহিত হয়েছেন। জানেন। কিন্তু তদন্তের স্বার্থে তারা সবকিছু বলতে পারবেন না। তদন্ত সম্পন্ন হলেই বিস্তারিত জানাবেন মিডিয়াকে। তুলে ধরবেন জাতির সামনে। কিন্তু পুলিশ কমিশনারের এমন বক্তব্য জনমনে নানা প্রশ্নের জন্ম দিয়েছে।
প্রথমত, পুলিশ হত্যাকাণ্ডের মোটিভসহ পুরো বিষয়টি জানলেও প্রকাশ করছে না কেন? যে দু’জন আসামি আদালতে ১৬৪ ধারায় জবানবন্দি দিয়েছে তারা অবশ্যই ১৬১ ধারায় পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদে সব তথ্য দিয়েছে। খুনের দায় স্বীকার করলে কার নির্দেশে এবং কেন তারা এ হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছে তা অবশ্যই বলেছে। তাহলে প্রশ্ন হল- পুলিশ প্রকাশ করছে না কেন?
এখানেই সব রহস্য ঘুরপাক খাচ্ছে। সাধারণ মানুষের প্রশ্ন- মিতু হত্যার নির্দেশদাতার পরিচয় জানলেও পুলিশ গোপন করছে কেন? কী এমন রহস্য লুকিয়ে আছে এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে, যা সাধারণ মানুষকে এখন জানানো যাচ্ছে না। কেনই বা নির্দেশদাতার নাম প্রকাশ করতে অপারগতা পুলিশের। এর কারণই বা কী ইত্যাদি। এসব কারণে সোমবার বিষয়টি ছিল ‘টক অব দ্য কান্ট্রি’।
পর্যবেক্ষক মহল মনে করেন, বাবুল আক্তারের মতো একজন সফল পুলিশ সুপারের স্ত্রীর হত্যাকাণ্ড নিয়ে যদি পুলিশ এত লুকোচুরি করে তবে সাধারণ মানুষ যাবে কোথায়। তাহলে কী শেষ পর্যন্ত কুমিল্লার তনু কিংবা ঢাকার সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনী হত্যার মতো এ হত্যাকাণ্ডের রহস্যও উদ্ঘাটন হবে না। অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যাবে হত্যার মোটিভ। কোনোদিন জানা যাবে না নির্দেশদাতা বা পরিকল্পনাকারীর নাম-পরিচয়।
এ হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে নাম প্রকাশ না করে সম্প্রতি পুলিশের বিভিন্ন সূত্র থেকে নানা ধরনের তথ্য দেয়া হচ্ছে সাংবাদিকদের- যা গণমাধ্যমকর্মীদের যেমন বিভ্রান্ত করছে, তেমনি সাধারণ মানুষও কোনো কূল-কিনারা খুঁজে পাচ্ছেন না। এ হত্যাকাণ্ড নিয়ে এখন পর্যন্ত যেসব তথ্য ঘুরপাক খাচ্ছে তা নিয়ে শুধু রহস্য দানা বেঁধে উঠছে।
সূত্রগুলোর কেউ কেউ বলছেন, শক্তভাবে চোরাচালান দমন করতে গিয়ে বাবুল আক্তার বেশ কিছু প্রভাবশালী লোকের তোপের মুখে পড়েন, যা শেষ পর্যন্ত পরিবারের জীবননাশের জন্য হুমকি হয়ে দেখা দেয়। কেউ বলেন, বাবুল আক্তারের দ্বারা ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত একজন ব্যবসায়ী রয়েছেন এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যে। কেউ কেউ আবার এসপি বাবুল আক্তারের দাম্পত্য জীবনে স্ত্রী মিতুর সঙ্গে তার সম্পর্কের বড় ধরনের টানাপোড়েন ছিল বলে দাবি করছেন। একই সঙ্গে তারা এও বলছেন, হত্যাকাণ্ডের পেছনে এখানেই (দাম্পত্য কলহ) অনেক রহস্য লুকিয়ে আছে।
পুলিশের ভাবমূর্তি সংকট হতে পারে এমন প্রশ্নে বিষয়টি খোলাসা করা হচ্ছে না। কিন্তু এখন পর্যন্ত মিতুর পরিবারের পক্ষ থেকে দাম্পত্য কলহসংক্রান্ত কোনো অভিযোগ তোলা হয়নি। এমনকি বলা হয়েছে, এসব রটিয়ে মামলাটি ভিন্ন খাতে নেয়ার জন্য মহলবিশেষ অপচেষ্টা চালাচ্ছে।
এদিকে মিতু হত্যার নির্দেশদাতার নাম জানলেও পুলিশের পক্ষ থেকে কেন প্রকাশ করা হচ্ছে না- এমন প্রশ্ন করা হলে সোমবার চট্টগ্রাম পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার তার আগের দেয়া বক্তব্য থেকে সরে আসেন। এ প্রসঙ্গে সোমবার তিনি যুগান্তরকে বলেন, ‘আমি তো খুনের নির্দেশদাতার নাম জানি, এটি বলিনি। এখানে কারও নাম গোপন বা প্রকাশ না করার কোনো অবকাশ নেই। আগে তো আমাকে জানতে হবে, তারপরই না আপনাদের জানাব।’
তিনি বলেন, যেহেতু মিতু হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়া দুই খুনি ধরা পড়েছে। তারা হত্যাকাণ্ডে অংশ নেয়ার কথা স্বীকার করেছে। আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিও দিয়েছে। তাই তাদের সূত্র ধরে মূল আসামিরা ধরা পড়বেই। তাদের কাছ থেকে আরও তথ্য জানা যাবে। খুনের মোটিভ উদ্ধার করা সম্ভব হবে।’ তিনি বলেন, ‘তদন্ত সম্পন্ন হলে পরিপূর্ণ তথ্যই জানানো হবে। ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ব্যবসায়িকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত পক্ষের নির্দেশেই বাবুল আক্তারের স্ত্রীকে হত্যা করা হয়েছে এমন বক্তব্য এসেছে কিনা- এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘এটি তিনি জানেন না। এমন কোনো বক্তব্য আসামিরা দিয়েছে কিনা তাও তার জানা নেই।’
জানা গেছে, চট্টগ্রামে আলোচিত পুলিশ সুপার বাবুল আক্তারের স্ত্রী মাহমুদা খানম মিতু হত্যা মামলার তদন্ত নিয়ে শুরু থেকেই পুলিশের একটি গ্রুপ জট পাকানোর চেষ্টা করছে বলে অভিযোগ উঠেছে। তদন্ত ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার চেষ্টায় লিপ্ত রয়েছে গ্রুপটি। প্রকৃত আসামিদের গ্রেফতার বা ঘটনার আসল রহস্য উদ্ঘাটনের পরিবর্তে ওই গ্রুপটি মামলার তদন্ত নিয়ে ভিন্নপথে হাঁটার চেষ্টাও করেছে। ঘটনার সঙ্গে ন্যূনতম সম্পর্ক নেই এমন লোকদের যেমন মিতু হত্যার মূল পরিকল্পনাকারী বা হোতা সাজানোর চেষ্টা করা হয়েছে, তেমনি হত্যাকাণ্ডের নেপথ্য কারণও ব্যাখ্যা করা হয়েছে নানাভাবে।
সর্বশেষ কিলিং মিশনে ভাড়াটে খুনি হিসেবে অংশ নেয়া ওয়াসিম ও আনোয়ার নামে দু’জনের নাম প্রকাশ করা হয়েছে। ওয়াসিমের গুলিতেই মিতু খুন হয়েছে এবং এ হত্যাকাণ্ডে আনোয়ারসহ ৭-৮ জন অংশ নেয় বলে পুলিশ কমিশনার রোববার প্রেস ব্রিফিংয়ে জানিয়েছেন। মিতু হত্যাকাণ্ডটি টার্গেটি কিলিং বলেও জানিয়েছেন পুলিশ কমিশনার ইকবাল বাহার। কিন্তু কেন তাকে টার্গেট করা হল, কার নির্দেশে এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত হল সেসব বিষয়ে খোলাখুলি কিছুই বলেননি তিনি। বাবুল আক্তারকেই বা কেন শুক্রবার গভীর রাতে বাসা থেকে জিজ্ঞাসাবাদের নামে তুলে নিয়ে আসা হল- এ প্রশ্নের উত্তরও এড়িয়ে যান পুলিশ কমিশনার।
সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেছেন, মামলার তদন্ত সিএমপি করছে ঠিকই, কিন্তু পুরো মামলাটি মনিটরিং হচ্ছে পুলিশ সদর দফতর থেকে। তাই সব প্রশ্নের উত্তর তার পক্ষে দেয়া সম্ভব নয়। তাছাড়া এহতেশামুল হক ভোলা ও আবু মুছা নামে বাবুল আক্তারের দুই সোর্সকে আটকের বিষয়ে পুলিশ কমিশনার বলেছেন, এই নামের কেউ তাদের হাতে আটক নেই! কিন্তু বাস্তবতা হচ্ছে, এহতেশামুল হক ভোলাকে আটক করা হয়েছে। তার স্বীকারোক্তি অনুযায়ী উদ্ধার করা হয়েছে হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত অস্ত্র। এরপরও পুলিশ রহস্যজনক কারণে ভোলাকে মিডিয়ার সামনে আনছে না। সব মিলিয়ে বাবুল আক্তারের স্ত্রী মিতু হত্যা মামলার তদন্ত নিয়ে সৃষ্টি হয়েছে ধোঁয়াশা। তাই প্রকৃত সত্য বের হয়ে আসবে কিনা এ নিয়েই জনমনে সন্দেহ ও সংশয় বাড়ছে।
পুলিশের একাধিক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাও নানা সন্দেহ প্রকাশ করে যুগান্তরকে বলেন, মিতু হত্যার রহস্য উদ্ঘাটন হবে কিনা তা নিয়ে তারা যথেষ্ট সন্দিহান। তনু হত্যা কিংবা সাংবাদিক সাগর-রুনী হত্যার মতো এ হত্যাকাণ্ডের মোটিভও যদি অন্ধকারের অতল গহ্বরে হারিয়ে যায় তবে বিস্মিত হওয়ার কিছুই থাকবে না।
চট্টগ্রামে পুলিশ অফিসারদের ওপর নজরদারি : পুলিশের একাধিক সূত্র জানায়, মিতু হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে এ মামলা তদন্তের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অনেকেই অনেক তথ্য জানেন। কারা, কেন এ হত্যাকাণ্ড সংঘটিত করেছে তার সবিস্তার রয়েছে পুলিশের হাতে। কিন্তু এসব তথ্য যাতে কোনোভাবেই বাইরে না যায়, সাংবাদিকরা জানতে না পারেন সে ব্যাপারে সিএমপির সব পুলিশ অফিসারকে কঠোরভাবে সতর্ক করে দেয়া হয়েছে। বলা হয়েছে, সিএমপি কমিশনার ইকবাল বাহার ও অতিরিক্ত কমিশনার দেবদাস ভট্টাচার্যই এ বিষয়ে যা জানানোর মিডিয়াকে জানাবেন। এর বাইরে অন্য কেউ কথা বলতে পারবেন না। এ দু’জন ছাড়া এ মামলা সম্পর্কে মামলার আইও, জিজ্ঞাসাবাদকারী কর্মকর্তা থেকে শুরু করে কেউই যেন কোনো তথ্য সাংবাদিকদের না দেন এবং বাইরে ফাঁস না করেন এজন্য সতর্ক করা হয়েছে।
বেশ কিছু অফিসারের মোবাইল ফোনের রেকর্ডও সংগ্রহ করেছে সিএমপি কর্তৃপক্ষ। সাংবাদিকদের সঙ্গে কোন অফিসার কতক্ষণ কথা বলছেন, কী কথা বলছেন এমন রেকর্ডও সিএমপির ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের হাতে। ওসি পর্যায়ের একজন পুলিশ কর্মকর্তাকে রীতিমতো শোকজ করে তার বিরুদ্ধে শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলেও নির্ভরযোগ্য সূত্র জানিয়েছে। সূত্র জানায়, পুলিশের একটি পক্ষও মিতু হত্যাকাণ্ড নিয়ে নানারকম অবিশ্বাস্য গল্প, প্রোপাগান্ডা ও বিভ্রান্তি ছড়াচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রামে বাবুল আক্তারের পুলিশি সাফল্যে যেসব কর্মকর্তা ক্ষুব্ধ ছিলেন তারা পর্দার আড়ালে এমন অপতৎপরতা চালাচ্ছেন।