ঢাকা , বৃহস্পতিবার, ২৬ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১০ আশ্বিন ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

রংপুরের বেনারসি পল্লীতে…

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বাংলাদেশে কয়েকটা ‘বেনারসি পল্লী’ রয়েছে। সেগুলো নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, মিরপুর ও রংপুরে অবস্থিত। মিরপুরের পল্লীটি সবচেয়ে বড়, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও জমজমাটও। উত্তরের জেলা রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় মাঝারি মানের একটি বেনারসি পল্লী গড়ে উঠেছে। বেনারসি পল্লীটির ওপর দিয়ে গেছে পিচ রাস্তা। দাফতরিক ও ব্যক্তিগত কাজে প্রায়ই সেখানে যাওয়া পড়ে।

বেনারসির ইতিহাস : বেনারসি শাড়ির মূল উৎপত্তিস্থল ভারতের বেনারস শহরে। মুসলিম তাঁতিরা বংশ-পরম্পরায় এ শাড়ি তৈরি করে আসছেন। কিন্তু ঠিক কবে থেকে এর সূচনা হয়েছে তা আজও অজানা। তবে প্রচলিত আছে যে বেনারসি শাড়ির তাঁতিদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন আনসারি। বেনারসের পুরনো বাসিন্দাদের মতে, বেনারসের তাঁত শিল্পীদের নব্বই শতাংশই এ আনসারিদের বংশধর! ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারতের বেনারস থেকে কয়েকটি পরিবার বাংলাদেশে চলে এলে এ দেশেও বেনারসি শিল্পের বিকাশ ঘটে। তারা মিরপুর ও পুরান ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং সেখানেই বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে থাকেন।

রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গঙ্গাচড়া উপজেলাতেও গড়ে উঠেছে এই বেনারসি পল্লীটি। ২০০৫ সালে প্রায় ১০০ তাঁতি ওই এলাকায় বেনারসি পল্লী গড়ে তোলেন। জানা গেছে, মঙ্গাকবলিত এ উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের তালুক হাবু গ্রামসহ আশপাশের আরা ৪-৫টি গ্রামে এ শিল্পের বিকাশ ঘটছে। এখানকার তাঁত শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রহমান। তার দেখাদেখি প্রতিবেশীরাও ঝুঁকে পড়েন এ শিল্পে। দেখতে দেখতে এ শিল্পের প্রসার ঘটে। বলা চলে হাবু গ্রামের সবাই এখন তাঁতি। এক সময় প্রায় ৬০০ তাঁত ছিল বেনারসি পল্লীতে। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদিত কাপড়ের বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, শ্রমিক সংকট, স্থানীয়ভাবে সুতা না পাওয়া এবং প্রসেসিং ও কাটিং মেশিন না থাকাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তা কমতে কমতে ১০০-এর নিচে নেমে গেছে।

বেনারসি পল্লী : হাবু বেনারসি পল্লীসহ গঙ্গাচড়ার বিভিন্ন এলাকায় ১৩২ জন মালিকের প্রায় ৬০০ তাঁত রয়েছে। এখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুরুষ ও ৪০০ নারী কাজ করছেন। প্রতিবছর এ পল্লী থেকে প্রায় এক হাজার পিসের মত শাড়ি উৎপাদন করা হয়। এসব শাড়ি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়। এলাকায় ৬৪টি পরিবারের মধ্যে সমন্বয় করে তাঁত স্থাপনের জন্য ৬৮০ বর্গফুট আয়তনের ৪০টি শেড নির্মাণ করা হয়েছে। এসব শেডে চলছে বেনারসি শাড়ি উৎপাদনের কাজ। সেখানেই প্রদর্শনী কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছে। তাঁত বোনা যন্ত্রের খটখট শব্দে মুখরিত পুরো এলাকা। ঈদ ঘিরে বেড়েছে ব্যস্ততা। কারিগরদের দম ফেলার ফুরসত নেই। তবে মজুরি কম। ঈদ ঘিরে রংপুরের গঙ্গাচড়ার বেনারসি পল্লী প্রাণ ফিরে পায়। কারিগরদের নিখুঁত বুননে তৈরি হচ্ছে একেকটি বাহারি শাড়ি। তবে কারিগরদের মজুরি কম হওয়ায় তাদের মুখে হাসি নেই। বিকাশমান এই বেনারসি পল্লীকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হলেও কারিগররা ন্যায্য মজুরি পান না। অনেকেই পল্লী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

কোরবাণি ঈদকে সামনে রেখে রংপুরের বেনারসি পল্লী সরগরম হয়ে উঠেছে। তাঁতের মাকুর খটখট শব্দে মুখরিত এখন গঙ্গাচড়ার তালুক হাবুর বেনারসি পল্লী। ঈদের আগে দম ফেলার সময় পান না কারিগররা। এমনকি মালিকরাও। শেষ মুহূর্তে শাড়ি, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবি তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসে ততই নির্ঘুম সময় কাটে তাদের।

গঙ্গাচড়ার তালুক হাবু এলাকার ‘রহমান উইভিং কারখানা’র কারিগর রোস্তম মিয়া জানান, ঈদকে সামনে রেখে বেনারসি শাড়ির চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে আমাদের দিন-রাত কাজ করতে হচ্ছে। কারখানার মালিক ফরিদা আখতার জানান, তার এখানে আটটি তাঁত রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২৪ ঘণ্টাই চলছে কাজ। আগে যেখানে সপ্তাহে ১৬টি শাড়ি তৈরি হতো, সেখানে এখন ৩০টি তৈরি হচ্ছে।

উৎপাদিত পণ্যের নাম ও মূল্য

এখানকার উৎপাদিত শাড়িগুলোর রয়েছে বৈচিত্র্যময় সব নাম। বেনারসি, বারবুটা, কুচিকাট, ফুলকলি ইত্যাদি। বেনারসি শাড়ির রং, কারুকাজ ও নকশায় বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। ধরন বা নকশার ভিত্তিতে বেনারসি শাড়ির রয়েছে বিভিন্ন নাম। যেমন- ব্রোকেট কাতান, পিরামিড কাতান, মিরপুরী রেশমি কাতান, বেনারসি কসমস, চুনরি কাতান, প্রিন্স কাতান ইত্যাদি। বর্তমানে বেনারসি কাতান শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে প্রকারভেদে ৭০০০ টাকা পর্যন্ত, জুট কাতান বিক্রি হচ্ছে ৪০০০ থেকে ৭০০০ টাকায়, বিয়ের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৩০০০ থেকে ২৩০০০ টাকা পর্যন্ত। ঈদে জুট কাতানের ব্যাপক চাহিদা হয়। জুট কাতানের থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকায়। কাতানের থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকায়। পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ২৫০০ টাকায়।

‘নিশাত বেনারসি’র স্বত্বাধিকারী আবদুল কুদ্দুস জানান, কয়েক বছর থেকে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন উৎসবে বেনারসি পল্লীর কাপড় বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কিন্তু স্থানীয় বাজারে সুতা পাওয়া যায় না। সুতা আনতে হয় ঢাকার মিরপুর থেকে। এসব কারণে দাম বেশি পড়ে যায়।

বেনারসি পল্লীর সমস্যা

প্রসেসিং এবং কাটিং স্থানীয়ভাবে করার ব্যবস্থা না থাকায় প্রথমে ওইসব কাপড় ঢাকার মিরপুরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আবার নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রসেসিং ও কাটিং হয়ে আসতে সময় লাগে ১৫ দিন। ফলে অর্ডারের কাপড় সময়মতো সরবরাহ করতে না পারার আশঙ্কা থাকে। উৎপাদিত শাড়ি বাজারজাত করা, ক্রেতার চাহিদা আকর্ষণের জন্য নতুন ডিজাইন সংগ্রহ, কাঁচামালসহ অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহের সমস্যার কারণে তাদের এ পেশায় টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। এ পল্লীতে নেই কোনো আধুনিক ডাইং মেশিন। ডাইংয়ের কাজ ঢাকায় করানো হয় বলে তাঁত মালিকরা জানান। একটি ডাইং মেশিনের দাম প্রায় কোটি টাকা, যা কেনার সাধ্য তাঁতিদের নেই। তাই প্রসেসিংয়ের জন্য মিরপুর ও নারায়ণঞ্জে পাঠাতে হয়। এতে সময় ও অর্থের অপচয় হয়। বেনারসি শাড়ি তৈরিতে কাঁচা রেশম সুতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয় জরি সুতা। দেশীয় কাঁচা রেশম সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁতিরা এখন চায়না সিল্ক সুতা ব্যবহার করছেন।

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কাপড়

বর্তমানে রংপুরের বেনারসি পল্লীর শাড়ি, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবির ব্যাপক চাহিদা। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে এ চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়।

বেনারসি পল্লীতে কাপড় কিনতে আসা রংপুর নগরীর বাদশা-পরিবার জানান, শপিংমলগুলোয় যেসব বেনারশি শাড়ি পাওয়া যায় তার মধ্যে হাবু বেনারসি পল্লীর উৎপাদিত কাপড় অনেক মানসম্মত এবং টেকসই। বেশ কয়েক বছর ধরে এখানকার কাপড় নিজেরা ব্যবহার করছেন, পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনকে বিভিন্ন উৎসবে উপহার দেন বলে তারা জানান।

উৎপাদনকারীদের

চাওয়া-পাওয়া

শাড়িতে সুতা তোলাসহ অন্যান্য কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিক সাবিনা, জুলেখা ও আমেনা জানান, একটি শাড়ির সুতা তুলতে তারা ৩০ থেকে ৪০ টাকা মজুরি পান। পুরো সপ্তাহে ২০টি শাড়ির বেশি সুতা তোলা সম্ভব হয় না। এ টাকায় কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়। মালিকপক্ষ জানায়, একটি বেনারসি শাড়ি তৈরিতে খরচ পড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। চার থেকে পাঁচ দিন খাটুনির পর কারিগররা পান দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। সেই শাড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্রি হয় সাত থেকে আট হাজার টাকায়। সহজ বুননের একটি বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে একজন তাঁতির সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ। আবার কঠিন বুননের একটি শাড়ি তৈরিতে তিনজন তাঁতির সময় লাগে প্রায় তিন মাস।

‘ফাইয়াজ বেনারসি’র স্বত্বাধিকারী ফরিদা রহমান জানান, বর্তমানে তার তাঁতের সংখ্যা ২৪টি। প্রতিদিন ৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। অধিকাংশই নারী।

সংকট থেকে উত্তরণে কিছু সুপারিশ

বিপণন সমস্যাই এ শিল্প বিকাশের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রংপুরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ও মার্কেট গড়ে তুলতে সহযোগিতা করা দরকার। কাঁচামাল সহজলভ্য করতে হবে। ভালো প্রশিক্ষক দিয়ে কারিগরদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ব্যবসা সম্প্র্রসারণ ও টিকিয়ে রাখতে ঋণ দেয়া দরকার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে নজর বাড়াতে হবে। সুযোগসুবিধা প্রদানে স্বজনপ্রীতি রুখতে হবে। কারিগরদের জন্য আলাদা আবাসনব্যবস্থা করলে আরও ভালো হবে। একত্রে থেকে কারিগররা অভিজ্ঞতার বিষয়ে পারস্পারিক মতবিনিময় করে কারখানা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করার সুযোগ পেলে কাজগুলো আরও ভালো হতে পারে। বেনারসি পল্লীর পরিসর আরও বাড়ানো দরকার। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে যাবে। এলাকায় অর্থনীতিতে গতি আসবে।

যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া

ঢাকা বা দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে বাস-ট্রেনে রংপুর যাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। এরপর বাংলাদেশ মোড় থেকে অটোতে বেনারসি পল্লী। থাকা খাওয়ার জন্য রংপুরে ভালোমানের আবাসিক ও খাওয়ার হোটেল আছে।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

রংপুরের বেনারসি পল্লীতে…

আপডেট টাইম : ১০:১৭ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১০ জুলাই ২০১৯

বাঙালী কণ্ঠ নিউজঃ বাংলাদেশে কয়েকটা ‘বেনারসি পল্লী’ রয়েছে। সেগুলো নারায়ণগঞ্জ, পাবনা, মিরপুর ও রংপুরে অবস্থিত। মিরপুরের পল্লীটি সবচেয়ে বড়, স্বয়ংসম্পূর্ণ ও জমজমাটও। উত্তরের জেলা রংপুরের গঙ্গাচড়া উপজেলায় মাঝারি মানের একটি বেনারসি পল্লী গড়ে উঠেছে। বেনারসি পল্লীটির ওপর দিয়ে গেছে পিচ রাস্তা। দাফতরিক ও ব্যক্তিগত কাজে প্রায়ই সেখানে যাওয়া পড়ে।

বেনারসির ইতিহাস : বেনারসি শাড়ির মূল উৎপত্তিস্থল ভারতের বেনারস শহরে। মুসলিম তাঁতিরা বংশ-পরম্পরায় এ শাড়ি তৈরি করে আসছেন। কিন্তু ঠিক কবে থেকে এর সূচনা হয়েছে তা আজও অজানা। তবে প্রচলিত আছে যে বেনারসি শাড়ির তাঁতিদের পূর্বপুরুষরা ছিলেন আনসারি। বেনারসের পুরনো বাসিন্দাদের মতে, বেনারসের তাঁত শিল্পীদের নব্বই শতাংশই এ আনসারিদের বংশধর! ১৯৪৭ সালে দেশ ভাগের পর ভারতের বেনারস থেকে কয়েকটি পরিবার বাংলাদেশে চলে এলে এ দেশেও বেনারসি শিল্পের বিকাশ ঘটে। তারা মিরপুর ও পুরান ঢাকায় বসবাস করতে শুরু করেন এবং সেখানেই বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে থাকেন।

রংপুর শহর থেকে প্রায় ১৬ কিলোমিটার দূরে অবস্থিত গঙ্গাচড়া উপজেলাতেও গড়ে উঠেছে এই বেনারসি পল্লীটি। ২০০৫ সালে প্রায় ১০০ তাঁতি ওই এলাকায় বেনারসি পল্লী গড়ে তোলেন। জানা গেছে, মঙ্গাকবলিত এ উপজেলার গজঘণ্টা ইউনিয়নের তালুক হাবু গ্রামসহ আশপাশের আরা ৪-৫টি গ্রামে এ শিল্পের বিকাশ ঘটছে। এখানকার তাঁত শিল্পের প্রতিষ্ঠাতা আবদুর রহমান। তার দেখাদেখি প্রতিবেশীরাও ঝুঁকে পড়েন এ শিল্পে। দেখতে দেখতে এ শিল্পের প্রসার ঘটে। বলা চলে হাবু গ্রামের সবাই এখন তাঁতি। এক সময় প্রায় ৬০০ তাঁত ছিল বেনারসি পল্লীতে। কিন্তু বর্তমানে উৎপাদিত কাপড়ের বাজার ব্যবস্থা গড়ে না ওঠা, শ্রমিক সংকট, স্থানীয়ভাবে সুতা না পাওয়া এবং প্রসেসিং ও কাটিং মেশিন না থাকাসহ নানা সমস্যায় জর্জরিত হয়ে তা কমতে কমতে ১০০-এর নিচে নেমে গেছে।

বেনারসি পল্লী : হাবু বেনারসি পল্লীসহ গঙ্গাচড়ার বিভিন্ন এলাকায় ১৩২ জন মালিকের প্রায় ৬০০ তাঁত রয়েছে। এখানে প্রায় সাড়ে তিন হাজার পুরুষ ও ৪০০ নারী কাজ করছেন। প্রতিবছর এ পল্লী থেকে প্রায় এক হাজার পিসের মত শাড়ি উৎপাদন করা হয়। এসব শাড়ি দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রফতানি হয়। এলাকায় ৬৪টি পরিবারের মধ্যে সমন্বয় করে তাঁত স্থাপনের জন্য ৬৮০ বর্গফুট আয়তনের ৪০টি শেড নির্মাণ করা হয়েছে। এসব শেডে চলছে বেনারসি শাড়ি উৎপাদনের কাজ। সেখানেই প্রদর্শনী কেন্দ্রও স্থাপন করা হয়েছে। তাঁত বোনা যন্ত্রের খটখট শব্দে মুখরিত পুরো এলাকা। ঈদ ঘিরে বেড়েছে ব্যস্ততা। কারিগরদের দম ফেলার ফুরসত নেই। তবে মজুরি কম। ঈদ ঘিরে রংপুরের গঙ্গাচড়ার বেনারসি পল্লী প্রাণ ফিরে পায়। কারিগরদের নিখুঁত বুননে তৈরি হচ্ছে একেকটি বাহারি শাড়ি। তবে কারিগরদের মজুরি কম হওয়ায় তাদের মুখে হাসি নেই। বিকাশমান এই বেনারসি পল্লীকে টিকিয়ে রাখতে সরকারিভাবে উদ্যোগ নেয়া হলেও কারিগররা ন্যায্য মজুরি পান না। অনেকেই পল্লী ছেড়ে চলে যাচ্ছেন।

কোরবাণি ঈদকে সামনে রেখে রংপুরের বেনারসি পল্লী সরগরম হয়ে উঠেছে। তাঁতের মাকুর খটখট শব্দে মুখরিত এখন গঙ্গাচড়ার তালুক হাবুর বেনারসি পল্লী। ঈদের আগে দম ফেলার সময় পান না কারিগররা। এমনকি মালিকরাও। শেষ মুহূর্তে শাড়ি, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবি তৈরিতে ব্যস্ত কারিগররা। ঈদ যতই ঘনিয়ে আসে ততই নির্ঘুম সময় কাটে তাদের।

গঙ্গাচড়ার তালুক হাবু এলাকার ‘রহমান উইভিং কারখানা’র কারিগর রোস্তম মিয়া জানান, ঈদকে সামনে রেখে বেনারসি শাড়ির চাহিদা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে যায়। এ কারণে আমাদের দিন-রাত কাজ করতে হচ্ছে। কারখানার মালিক ফরিদা আখতার জানান, তার এখানে আটটি তাঁত রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে চাহিদা বেড়ে যাওয়ায় ২৪ ঘণ্টাই চলছে কাজ। আগে যেখানে সপ্তাহে ১৬টি শাড়ি তৈরি হতো, সেখানে এখন ৩০টি তৈরি হচ্ছে।

উৎপাদিত পণ্যের নাম ও মূল্য

এখানকার উৎপাদিত শাড়িগুলোর রয়েছে বৈচিত্র্যময় সব নাম। বেনারসি, বারবুটা, কুচিকাট, ফুলকলি ইত্যাদি। বেনারসি শাড়ির রং, কারুকাজ ও নকশায় বেশ বৈচিত্র্য দেখা যায়। ধরন বা নকশার ভিত্তিতে বেনারসি শাড়ির রয়েছে বিভিন্ন নাম। যেমন- ব্রোকেট কাতান, পিরামিড কাতান, মিরপুরী রেশমি কাতান, বেনারসি কসমস, চুনরি কাতান, প্রিন্স কাতান ইত্যাদি। বর্তমানে বেনারসি কাতান শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৮০০ থেকে প্রকারভেদে ৭০০০ টাকা পর্যন্ত, জুট কাতান বিক্রি হচ্ছে ৪০০০ থেকে ৭০০০ টাকায়, বিয়ের শাড়ি বিক্রি হচ্ছে ১৩০০০ থেকে ২৩০০০ টাকা পর্যন্ত। ঈদে জুট কাতানের ব্যাপক চাহিদা হয়। জুট কাতানের থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে ৩০০০ থেকে ৪০০০ টাকায়। কাতানের থ্রি-পিস বিক্রি হচ্ছে ১৫০০ থেকে ২২০০ টাকায়। পাঞ্জাবি বিক্রি হচ্ছে ১২০০ থেকে ২৫০০ টাকায়।

‘নিশাত বেনারসি’র স্বত্বাধিকারী আবদুল কুদ্দুস জানান, কয়েক বছর থেকে স্থানীয় চাহিদা বৃদ্ধি পাওয়ায় বিভিন্ন উৎসবে বেনারসি পল্লীর কাপড় বিক্রি বেড়ে গেছে কয়েকগুণ। কিন্তু স্থানীয় বাজারে সুতা পাওয়া যায় না। সুতা আনতে হয় ঢাকার মিরপুর থেকে। এসব কারণে দাম বেশি পড়ে যায়।

বেনারসি পল্লীর সমস্যা

প্রসেসিং এবং কাটিং স্থানীয়ভাবে করার ব্যবস্থা না থাকায় প্রথমে ওইসব কাপড় ঢাকার মিরপুরে পাঠানো হয়। সেখান থেকে আবার নারায়ণগঞ্জে নিয়ে যাওয়া হয়। সব মিলিয়ে প্রসেসিং ও কাটিং হয়ে আসতে সময় লাগে ১৫ দিন। ফলে অর্ডারের কাপড় সময়মতো সরবরাহ করতে না পারার আশঙ্কা থাকে। উৎপাদিত শাড়ি বাজারজাত করা, ক্রেতার চাহিদা আকর্ষণের জন্য নতুন ডিজাইন সংগ্রহ, কাঁচামালসহ অন্যান্য উপকরণ সংগ্রহের সমস্যার কারণে তাদের এ পেশায় টিকে থাকা কষ্টসাধ্য হয়ে পড়ছে। এ পল্লীতে নেই কোনো আধুনিক ডাইং মেশিন। ডাইংয়ের কাজ ঢাকায় করানো হয় বলে তাঁত মালিকরা জানান। একটি ডাইং মেশিনের দাম প্রায় কোটি টাকা, যা কেনার সাধ্য তাঁতিদের নেই। তাই প্রসেসিংয়ের জন্য মিরপুর ও নারায়ণঞ্জে পাঠাতে হয়। এতে সময় ও অর্থের অপচয় হয়। বেনারসি শাড়ি তৈরিতে কাঁচা রেশম সুতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয় জরি সুতা। দেশীয় কাঁচা রেশম সুতার দাম বেড়ে যাওয়ায় তাঁতিরা এখন চায়না সিল্ক সুতা ব্যবহার করছেন।

বিশেষ চাহিদা সম্পন্ন কাপড়

বর্তমানে রংপুরের বেনারসি পল্লীর শাড়ি, থ্রি-পিস ও পাঞ্জাবির ব্যাপক চাহিদা। ঈদসহ বিভিন্ন উৎসবে এ চাহিদা আরও বৃদ্ধি পায়।

বেনারসি পল্লীতে কাপড় কিনতে আসা রংপুর নগরীর বাদশা-পরিবার জানান, শপিংমলগুলোয় যেসব বেনারশি শাড়ি পাওয়া যায় তার মধ্যে হাবু বেনারসি পল্লীর উৎপাদিত কাপড় অনেক মানসম্মত এবং টেকসই। বেশ কয়েক বছর ধরে এখানকার কাপড় নিজেরা ব্যবহার করছেন, পাশাপাশি আত্মীয়স্বজনকে বিভিন্ন উৎসবে উপহার দেন বলে তারা জানান।

উৎপাদনকারীদের

চাওয়া-পাওয়া

শাড়িতে সুতা তোলাসহ অন্যান্য কাজে নিয়োজিত নারী শ্রমিক সাবিনা, জুলেখা ও আমেনা জানান, একটি শাড়ির সুতা তুলতে তারা ৩০ থেকে ৪০ টাকা মজুরি পান। পুরো সপ্তাহে ২০টি শাড়ির বেশি সুতা তোলা সম্ভব হয় না। এ টাকায় কষ্ট করে সংসার চালাতে হয়। মালিকপক্ষ জানায়, একটি বেনারসি শাড়ি তৈরিতে খরচ পড়ে সাড়ে পাঁচ হাজার টাকা। চার থেকে পাঁচ দিন খাটুনির পর কারিগররা পান দেড় থেকে দুই হাজার টাকা। সেই শাড়ি ঢাকাসহ দেশের বিভিন্ন শহরে বিক্রি হয় সাত থেকে আট হাজার টাকায়। সহজ বুননের একটি বেনারসি শাড়ি তৈরি করতে একজন তাঁতির সময় লাগে প্রায় এক সপ্তাহ। আবার কঠিন বুননের একটি শাড়ি তৈরিতে তিনজন তাঁতির সময় লাগে প্রায় তিন মাস।

‘ফাইয়াজ বেনারসি’র স্বত্বাধিকারী ফরিদা রহমান জানান, বর্তমানে তার তাঁতের সংখ্যা ২৪টি। প্রতিদিন ৫০ জন শ্রমিক কাজ করেন। অধিকাংশই নারী।

সংকট থেকে উত্তরণে কিছু সুপারিশ

বিপণন সমস্যাই এ শিল্প বিকাশের প্রধান অন্তরায় হয়ে দাঁড়িয়েছে। রংপুরে প্রদর্শনীর ব্যবস্থা ও মার্কেট গড়ে তুলতে সহযোগিতা করা দরকার। কাঁচামাল সহজলভ্য করতে হবে। ভালো প্রশিক্ষক দিয়ে কারিগরদের প্রশিক্ষণ দিতে হবে। ব্যবসা সম্প্র্রসারণ ও টিকিয়ে রাখতে ঋণ দেয়া দরকার। কিছু কিছু ক্ষেত্রে প্রণোদনা দিতে হবে। সরকারের সংশ্লিষ্ট দফতরকে নজর বাড়াতে হবে। সুযোগসুবিধা প্রদানে স্বজনপ্রীতি রুখতে হবে। কারিগরদের জন্য আলাদা আবাসনব্যবস্থা করলে আরও ভালো হবে। একত্রে থেকে কারিগররা অভিজ্ঞতার বিষয়ে পারস্পারিক মতবিনিময় করে কারখানা ও ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে তা প্রয়োগ করার সুযোগ পেলে কাজগুলো আরও ভালো হতে পারে। বেনারসি পল্লীর পরিসর আরও বাড়ানো দরকার। এতে কর্মসংস্থানের সুযোগ বেড়ে যাবে। এলাকায় অর্থনীতিতে গতি আসবে।

যাতায়াত ও থাকা-খাওয়া

ঢাকা বা দেশের যে কোনো প্রান্ত থেকে বাস-ট্রেনে রংপুর যাওয়ার সুব্যবস্থা রয়েছে। এরপর বাংলাদেশ মোড় থেকে অটোতে বেনারসি পল্লী। থাকা খাওয়ার জন্য রংপুরে ভালোমানের আবাসিক ও খাওয়ার হোটেল আছে।