ঢাকা , শনিবার, ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় গণহত্যা

একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতটি ছিল বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে বিভীষিকাময় এক রাত। এই রাতে দানবীয় নৃশংসতায় বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের ওপর। অথচ বাঙালিরা আশা করেছিল এই দিন কিছু একটা সমঝোতা হবে। একাত্তরে ২৫ মার্চ, দিনের শেষের এই রাত ইতিহাসে এক বর্বর গণহত্যার সাক্ষী হয়ে আছে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এই অভিযানে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের ওপর। উদ্দেশ্য বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দেয়া।
কৃষ্ণপক্ষের ঘন অন্ধকারের সেই রাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে গোপনে বেরিয়ে আসে ট্যাংক, কামান আর সাঁজোয়া গাড়ির সারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল আর ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সেনারা মেতে ওঠে নির্বিচার গণহত্যায়। গোলা ফেলা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসে। পথের পাশের বস্তিবাসীরাও রেহাই পায়নি। হামলা চালানো হয় পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাতেও। একই সময়ে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দফতরে। রাজারবাগ ও পিলখানার বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ট্যাংক ও ভারি অস্ত্রের মুখে তাদের পিছু হটতে হয়। পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের গোলার আঘাত থেকে প্রেসক্লাবও রেহাই পায়নি। এক রাতে এত বিপুল গণহত্যার নজির ইতিহাসে বিরল।
একাত্তরের ২৫ মার্চ সারাদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাড়ির সামনে ছিল জনতার ঢল। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, বিশ্বের কোনো শক্তিই পূর্ব বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ন্যায়সঙ্গত ও আইনসঙ্গত অধিকার নস্যাত করতে পারবে না। অন্যদিকে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রাত আটটায় নীরবে করাচির পথে ঢাকা ত্যাগ করেন। কয়েক ঘণ্টা পরই ঢাকায় শুরু হয় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড। প্রকৃতপক্ষে সেই রাত থেকেই একদিকে যেমন নৃশংস গণহত্যা শুরু, তেমনি একই সঙ্গে বাঙালির বিক্ষোভ প্রতিরোধের সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়।
সেই ২৫ মার্চের কালরাতের ভয়াবহতা চিহ্নিত হয়ে আছে কয়েক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়। একাত্তরে জগন্নাথ হলের নির্মম গণহত্যার দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল উল্লা। তিনি গোপনে তুলেছিলেন তার বিরল ভিডিও চিত্র। সেই বিভীষিকাময় রাতের বর্ণনা ছাপা হয়েছে রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক গ্রন্থে। এক জায়গায় নুরুল উল্লা লেখেন, ‘চারদিক নিস্তব্ধ আর ফাঁকা, কেবল জগন্নাথ হলের মাঠের ওপর পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। দেখলাম রাস্তার ওপর দিয়ে একটা ভ্যান চলে গেল, তার ওপর একটা গোল এ্যান্টেনা ঘুরছে।’
লন্ডনের বিখ্যাত ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া বাহিনীর সামরিক আক্রমণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিয়েছেন। তার ওই রিপোর্টটিতে তিনি বলেছেন, ‘পদাতিক ও সাঁজোয়া বাহিনী রাত ১০টার পূর্বে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে এবং প্রায় ১১টা থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। আমেরিকা কর্তৃক সরবরাহকৃত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের এম-২৪ ট্যাংকসহ একটি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাত ১২টার পরই প্রবেশ করে। এই বাহিনী ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে সেখান থেকে ছাত্রনিবাসগুলোতে প্রবেশ করতে থাকে। এই আকস্মিক হামলায় কেবল ইকবাল হলের দু’শ’ ছাত্র নিহত হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে গুলিবর্ষণ করা হয়। রেললাইনের নিকটবর্তী বস্তিগুলোতে ওই রাতেই উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই গুলি থেকে মসজিদও রেহায় পায়নি। রাজারবাগ পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে ট্যাংকের গোলাবর্ষণে এগারোশ’ পুলিশ আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে প্রতিরোধের পরে অতি অল্প সংখ্যকই আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়।’
একজন পুলিশ অফিসার এই সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন যে, একটি থানা এলাকায় তার অধীন ২৪০ জন পুলিশ সদস্য ছিল। তাদের মধ্যে তিনি কেবল ৩০ জনকে জীবিত পেয়েছেন। ঢাকার নয়াবাজার অঞ্চলে সৈন্যরা গ্যাসোলিন দিয়ে বাড়িতে ও দোকানে আগুন দিয়েছে। যারা আত্মরক্ষার জন্য বেরিয়ে এসেছিল, তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় এবং বাকি সব আগুনে পুড়ে মারা যায়। ২৬ তারিখ দুপুরে অগ্নিকাণ্ডে ২ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৭০০ নারী, শিশু ও পুরুষ এভাবে সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারায়।
যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের সদস্য ডউলিয়াম বি. সেক্সবির কাছে লিখিত ঢাকাস্থ ইউএসএইডের আমেরিকান ডাক্তারের পত্র এবং আমেরিকান কনসাল মি. আর্চার ব্লাডের দীর্ঘ রিপোর্ট পশ্চিমদেশীয় জনগণকে স্তম্ভিত করেছে। সিনেটর সেক্সবি বাংলাদেশে গণহত্যার বীভৎস রূপের বর্ণনা দিয়ে ২৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে বক্তৃতা করেন।
আর্চার ব্লাড নামের ঢাকাস্থ আমেরিকান উপদূতাবাসের প্রধান ২৫ মার্চের পাকিস্তানি সামরিক অভিযান এবং গণহত্যা দেখেছেন চোখের সামনে। মানুষ তখন দিশেহারা। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। তার অনুমান, ২৫ মার্চের পরপর সামরিক অভিযানে চার থেকে ছয় হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল ঢাকায়। তিনি এটা সহ্য করতে পারেননি। ২৭ মার্চ তিনি ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’ শিরোনামে একটা তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার গণহত্যার কথা উল্লেখ করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের পক্ষ নিয়েছিলেন। আর্চার ব্লাডের তারবার্তা ছিল তার দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। জবাবে তিনি পেয়েছিলেন শুধুই নীরবতা। এবার তিনি অন্য পথ ধরলেন। কনস্যুলেটর অন্যান্য কূটনীতিকসহ মার্কিন সাহায্য সংস্থা এবং তথ্য বিভাগের ২০ কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ তিনি ওয়াশিংটন ছাড়াও ইসলামাবাদ, করাচি ও লাহোরে মার্কিন দূতাবাসগুলোতে আরেকটি তারবার্তা পাঠান। এই বার্তার শিরোনাম ছিল ‘ভিসেন্ট ফ্রম ইউএস পলিসি টুওয়ার্ড ইস্ট পাকিস্তান।’ বার্তার ছত্রে ছত্রে ছিল মার্কিন সরকারের ‘পূর্ব পাকিস্তান নীতির’ কড়া সমালোচনা। এটাই পরে ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিতি পায়। ব্লাড টেলিগ্রাম ছিল মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন বিবেকের আহাজারি। আর্চার ব্লাডকে এর মূল্য দিতে হয়েছিল। তিনি ঢাকা কনস্যুলেট থেকে অপসারিত হন এবং নিক্সন প্রশাসনের সময় ওয়াশিংটনেও তার জায়গা হয়নি। ১৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে মি. গর্ডন এ্যালট এক দীর্ঘ রিপোর্টে গণহত্যা সম্পর্কিত বাংলাদেশে অবস্থানরত আমেরিকানদের তথ্যপূর্ণ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে যে বক্তৃতা করেন, তার প্রতিবাদ পাকিস্তান সরকার কোনোদিনই করতে পারেনি। এই রিপোর্টের কোনো কোনো অংশ সংক্ষেপে উদ্ধৃত করা যেতে পারে:
(ক) ২৮ মার্চ সকালে ঠাটারী বাজারের গলির মুখে মেশিনগান বসিয়ে সৈন্যরা গোলা ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। দু’দিন পরে এই ব্যস্ত এলাকায় কোনো প্রাণের লক্ষণ দেখা যায়নি।
(খ) সদরঘাটের টার্মিনালের ওপর মেশিনগান বসিয়ে ২৬ তারিখে গণহত্যা শুরু হয়। লঞ্চ ও নৌকার জন্য যারা অপেক্ষা করছিলেন তারা সবাই সেদিন নিহত হয়েছিলেন। অনেক মৃতদেহ বাসে করে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। বহুসংখ্যক লাশ নদীতে ভাসছিল।
(গ) ঢাকার রেসকোর্সের মধ্যস্থলে অবস্থিত হিন্দুদের রমনা কালীবাড়ি ২৮ মার্চ রাতে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা আক্রমণ করে প্রায় দু’শ’ আশ্রিত ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। ২৯ মার্চেও ৭০ থেকে ১০০ বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ পড়েছিল। কালীবাড়িটি গোলার মুখে উড়িয়ে দেয়া হয়।
(ঘ) নয়াবাজার, রায়ের বাজার কারফিউর সময় রাতে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
(ঙ) রাজারবাগে পুলিশ ব্যারাকে আনুমানিক পাঁচ হাজার পুলিশ ছিল। রাতে সৈন্যদের আকস্মিক প্রতিরোধ করতে গিয়ে অধিকাংশ পুলিশ প্রাণ ত্যাগ করে এবং তাদের ব্যারাক পুড়িয়ে দেয়া হয়।
(চ) ২৬ মার্চ সকালে যুদ্ধবেশি সৈনিকরা পিলখানার কাছে ইপিআর ব্যারাক আক্রমণ করে। আনুমানিক এক হাজার ইপিআরের সদস্য মারা গেছে। সেখানেও প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়।
বাংলাদেশের গণহত্যার কাহিনী পর্যালোচনাকালে আমরা নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সরকার উদ্বোধনের পর পরই ১৭ এপ্রিল প্রদত্ত বিবৃতি থেকে উল্লেখ করতে পারি। তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে রয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে যে বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে সুপরিকল্পিতভাবে শান্তিপূর্ণ জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করা হয়েছিল, আজও বিশ্ব-ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে কোনো সতর্কতা দেয়নি: ‘কোনো কারফিউ জারি করার পূর্বেই মেশিনগান, সাঁজোয়া বাহিনী, ট্যাংক ও কামান রাস্তায় বের করা হয়েছিল। লে. জেনারেল টিক্কাখান পরদিন সকালবেলা রেডিও মারফত মার্শাল ল’ ধারা ঘোষণার পূর্বেই পঞ্চাশ হাজার মানুষকে শহরে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকাকে পরিণত করা হয়েছিল অগ্নিকুণ্ডে।’

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায় গণহত্যা

আপডেট টাইম : ০৫:১২ অপরাহ্ন, শনিবার, ২৫ মার্চ ২০১৭

একাত্তরের ২৫ মার্চের রাতটি ছিল বাঙালি জাতির জীবনে সবচেয়ে বিভীষিকাময় এক রাত। এই রাতে দানবীয় নৃশংসতায় বর্বর পাকিস্তানি সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল বাঙালিদের ওপর। অথচ বাঙালিরা আশা করেছিল এই দিন কিছু একটা সমঝোতা হবে। একাত্তরে ২৫ মার্চ, দিনের শেষের এই রাত ইতিহাসে এক বর্বর গণহত্যার সাক্ষী হয়ে আছে। ‘অপারেশন সার্চলাইট’ নামের এই অভিযানে ভারি অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে পাকিস্তানি সৈন্যরা ঝাঁপিয়ে পড়েছিল ঘুমন্ত নিরীহ বাঙালিদের ওপর। উদ্দেশ্য বাঙালির মুক্তির সংগ্রামকে স্তব্ধ করে দেয়া।
কৃষ্ণপক্ষের ঘন অন্ধকারের সেই রাতে ঢাকা সেনানিবাস থেকে গোপনে বেরিয়ে আসে ট্যাংক, কামান আর সাঁজোয়া গাড়ির সারি। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জগন্নাথ হল আর ইকবাল হলে (বর্তমানে সার্জেন্ট জহুরুল হক হল) সেনারা মেতে ওঠে নির্বিচার গণহত্যায়। গোলা ফেলা হয় ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ ছাত্রাবাসে। পথের পাশের বস্তিবাসীরাও রেহাই পায়নি। হামলা চালানো হয় পুরান ঢাকার হিন্দু অধ্যুষিত এলাকাতেও। একই সময়ে পাকিস্তানি সেনারা হামলা চালায় রাজারবাগ পুলিশ লাইন ও পিলখানায় ইস্ট পাকিস্তান রাইফেলসের সদর দফতরে। রাজারবাগ ও পিলখানার বাঙালি পুলিশ ও ইপিআর বীরত্বের সঙ্গে প্রতিরোধ গড়ে তোলার চেষ্টা করেছিলেন। কিন্তু ট্যাংক ও ভারি অস্ত্রের মুখে তাদের পিছু হটতে হয়। পাকিস্তানি সেনাদের মর্টারের গোলার আঘাত থেকে প্রেসক্লাবও রেহাই পায়নি। এক রাতে এত বিপুল গণহত্যার নজির ইতিহাসে বিরল।
একাত্তরের ২৫ মার্চ সারাদিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ধানমণ্ডির বাড়ির সামনে ছিল জনতার ঢল। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দেন, বিশ্বের কোনো শক্তিই পূর্ব বাংলার সাড়ে ৭ কোটি মানুষের ন্যায়সঙ্গত ও আইনসঙ্গত অধিকার নস্যাত করতে পারবে না। অন্যদিকে জাতির উদ্দেশে দেয়া ভাষণে তৎকালীন পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া দেশব্যাপী রাজনৈতিক কর্মকাণ্ড নিষিদ্ধ ঘোষণা করেন। এরপর গণহত্যার নির্দেশ দিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া রাত আটটায় নীরবে করাচির পথে ঢাকা ত্যাগ করেন। কয়েক ঘণ্টা পরই ঢাকায় শুরু হয় ইতিহাসের নিষ্ঠুরতম হত্যাকাণ্ড। প্রকৃতপক্ষে সেই রাত থেকেই একদিকে যেমন নৃশংস গণহত্যা শুরু, তেমনি একই সঙ্গে বাঙালির বিক্ষোভ প্রতিরোধের সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধে রূপান্তরিত হয়।
সেই ২৫ মার্চের কালরাতের ভয়াবহতা চিহ্নিত হয়ে আছে কয়েক প্রত্যক্ষদর্শীর বর্ণনায়। একাত্তরে জগন্নাথ হলের নির্মম গণহত্যার দৃশ্য স্বচক্ষে দেখেছিলেন প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক নুরুল উল্লা। তিনি গোপনে তুলেছিলেন তার বিরল ভিডিও চিত্র। সেই বিভীষিকাময় রাতের বর্ণনা ছাপা হয়েছে রশীদ হায়দার সম্পাদিত ‘১৯৭১: ভয়াবহ অভিজ্ঞতা’ শীর্ষক গ্রন্থে। এক জায়গায় নুরুল উল্লা লেখেন, ‘চারদিক নিস্তব্ধ আর ফাঁকা, কেবল জগন্নাথ হলের মাঠের ওপর পড়ে আছে অসংখ্য লাশ। দেখলাম রাস্তার ওপর দিয়ে একটা ভ্যান চলে গেল, তার ওপর একটা গোল এ্যান্টেনা ঘুরছে।’
লন্ডনের বিখ্যাত ডেইলি টেলিগ্রাফের সংবাদদাতা সাইমন ড্রিং ২৫ মার্চ ইয়াহিয়া বাহিনীর সামরিক আক্রমণ সম্পর্কে প্রত্যক্ষদর্শীর বিবরণ দিয়েছেন। তার ওই রিপোর্টটিতে তিনি বলেছেন, ‘পদাতিক ও সাঁজোয়া বাহিনী রাত ১০টার পূর্বে ব্যারাক থেকে বেরিয়ে আসে এবং প্রায় ১১টা থেকে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। আমেরিকা কর্তৃক সরবরাহকৃত দ্বিতীয় মহাযুদ্ধকালের এম-২৪ ট্যাংকসহ একটি বাহিনী ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় রাত ১২টার পরই প্রবেশ করে। এই বাহিনী ব্রিটিশ কাউন্সিল লাইব্রেরি দখল করে সেখান থেকে ছাত্রনিবাসগুলোতে প্রবেশ করতে থাকে। এই আকস্মিক হামলায় কেবল ইকবাল হলের দু’শ’ ছাত্র নিহত হয়। ঢাকা মেডিক্যাল কলেজে গুলিবর্ষণ করা হয়। রেললাইনের নিকটবর্তী বস্তিগুলোতে ওই রাতেই উড়িয়ে দেয়া হয়েছিল। এই গুলি থেকে মসজিদও রেহায় পায়নি। রাজারবাগ পুলিশের প্রধান কার্যালয়ে ট্যাংকের গোলাবর্ষণে এগারোশ’ পুলিশ আক্রান্ত হয়। তাদের মধ্যে প্রতিরোধের পরে অতি অল্প সংখ্যকই আত্মরক্ষা করতে পেরেছিলেন বলে মনে হয়।’
একজন পুলিশ অফিসার এই সাংবাদিককে জানিয়েছিলেন যে, একটি থানা এলাকায় তার অধীন ২৪০ জন পুলিশ সদস্য ছিল। তাদের মধ্যে তিনি কেবল ৩০ জনকে জীবিত পেয়েছেন। ঢাকার নয়াবাজার অঞ্চলে সৈন্যরা গ্যাসোলিন দিয়ে বাড়িতে ও দোকানে আগুন দিয়েছে। যারা আত্মরক্ষার জন্য বেরিয়ে এসেছিল, তাদের গুলি করে হত্যা করা হয় এবং বাকি সব আগুনে পুড়ে মারা যায়। ২৬ তারিখ দুপুরে অগ্নিকাণ্ডে ২ ঘণ্টার মধ্যে প্রায় ৭০০ নারী, শিশু ও পুরুষ এভাবে সৈন্যদের হাতে প্রাণ হারায়।
যুক্তরাষ্ট্র সিনেটের সদস্য ডউলিয়াম বি. সেক্সবির কাছে লিখিত ঢাকাস্থ ইউএসএইডের আমেরিকান ডাক্তারের পত্র এবং আমেরিকান কনসাল মি. আর্চার ব্লাডের দীর্ঘ রিপোর্ট পশ্চিমদেশীয় জনগণকে স্তম্ভিত করেছে। সিনেটর সেক্সবি বাংলাদেশে গণহত্যার বীভৎস রূপের বর্ণনা দিয়ে ২৯ এপ্রিল যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে বক্তৃতা করেন।
আর্চার ব্লাড নামের ঢাকাস্থ আমেরিকান উপদূতাবাসের প্রধান ২৫ মার্চের পাকিস্তানি সামরিক অভিযান এবং গণহত্যা দেখেছেন চোখের সামনে। মানুষ তখন দিশেহারা। যে যেদিকে পারছে পালাচ্ছে। তার অনুমান, ২৫ মার্চের পরপর সামরিক অভিযানে চার থেকে ছয় হাজার মানুষ নিহত হয়েছিল ঢাকায়। তিনি এটা সহ্য করতে পারেননি। ২৭ মার্চ তিনি ওয়াশিংটনে মার্কিন পররাষ্ট্র দফতরে ‘সিলেকটিভ জেনোসাইড’ শিরোনামে একটা তারবার্তা পাঠান। তারবার্তায় তিনি পাকিস্তানি সৈন্যদের নির্বিচার গণহত্যার কথা উল্লেখ করেন। মার্কিন প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সন পাকিস্তানি সামরিক শাসক ইয়াহিয়া খানের পক্ষ নিয়েছিলেন। আর্চার ব্লাডের তারবার্তা ছিল তার দেশের সর্বোচ্চ কর্তৃপক্ষের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ। জবাবে তিনি পেয়েছিলেন শুধুই নীরবতা। এবার তিনি অন্য পথ ধরলেন। কনস্যুলেটর অন্যান্য কূটনীতিকসহ মার্কিন সাহায্য সংস্থা এবং তথ্য বিভাগের ২০ কর্মকর্তার স্বাক্ষরসহ তিনি ওয়াশিংটন ছাড়াও ইসলামাবাদ, করাচি ও লাহোরে মার্কিন দূতাবাসগুলোতে আরেকটি তারবার্তা পাঠান। এই বার্তার শিরোনাম ছিল ‘ভিসেন্ট ফ্রম ইউএস পলিসি টুওয়ার্ড ইস্ট পাকিস্তান।’ বার্তার ছত্রে ছত্রে ছিল মার্কিন সরকারের ‘পূর্ব পাকিস্তান নীতির’ কড়া সমালোচনা। এটাই পরে ‘ব্লাড টেলিগ্রাম’ নামে পরিচিতি পায়। ব্লাড টেলিগ্রাম ছিল মার্কিন নীতির বিরুদ্ধে মার্কিন বিবেকের আহাজারি। আর্চার ব্লাডকে এর মূল্য দিতে হয়েছিল। তিনি ঢাকা কনস্যুলেট থেকে অপসারিত হন এবং নিক্সন প্রশাসনের সময় ওয়াশিংটনেও তার জায়গা হয়নি। ১৪ জুলাই যুক্তরাষ্ট্র সিনেটে মি. গর্ডন এ্যালট এক দীর্ঘ রিপোর্টে গণহত্যা সম্পর্কিত বাংলাদেশে অবস্থানরত আমেরিকানদের তথ্যপূর্ণ রিপোর্টের ওপর ভিত্তি করে যে বক্তৃতা করেন, তার প্রতিবাদ পাকিস্তান সরকার কোনোদিনই করতে পারেনি। এই রিপোর্টের কোনো কোনো অংশ সংক্ষেপে উদ্ধৃত করা যেতে পারে:
(ক) ২৮ মার্চ সকালে ঠাটারী বাজারের গলির মুখে মেশিনগান বসিয়ে সৈন্যরা গোলা ও গুলিবর্ষণ শুরু করে। দু’দিন পরে এই ব্যস্ত এলাকায় কোনো প্রাণের লক্ষণ দেখা যায়নি।
(খ) সদরঘাটের টার্মিনালের ওপর মেশিনগান বসিয়ে ২৬ তারিখে গণহত্যা শুরু হয়। লঞ্চ ও নৌকার জন্য যারা অপেক্ষা করছিলেন তারা সবাই সেদিন নিহত হয়েছিলেন। অনেক মৃতদেহ বাসে করে নিয়ে গিয়ে পুড়িয়ে ফেলা হয়। বহুসংখ্যক লাশ নদীতে ভাসছিল।
(গ) ঢাকার রেসকোর্সের মধ্যস্থলে অবস্থিত হিন্দুদের রমনা কালীবাড়ি ২৮ মার্চ রাতে ইয়াহিয়ার সৈন্যরা আক্রমণ করে প্রায় দু’শ’ আশ্রিত ব্যক্তিকে হত্যা করেছে। ২৯ মার্চেও ৭০ থেকে ১০০ বুলেটবিদ্ধ মৃতদেহ পড়েছিল। কালীবাড়িটি গোলার মুখে উড়িয়ে দেয়া হয়।
(ঘ) নয়াবাজার, রায়ের বাজার কারফিউর সময় রাতে পুড়িয়ে দেয়া হয়।
(ঙ) রাজারবাগে পুলিশ ব্যারাকে আনুমানিক পাঁচ হাজার পুলিশ ছিল। রাতে সৈন্যদের আকস্মিক প্রতিরোধ করতে গিয়ে অধিকাংশ পুলিশ প্রাণ ত্যাগ করে এবং তাদের ব্যারাক পুড়িয়ে দেয়া হয়।
(চ) ২৬ মার্চ সকালে যুদ্ধবেশি সৈনিকরা পিলখানার কাছে ইপিআর ব্যারাক আক্রমণ করে। আনুমানিক এক হাজার ইপিআরের সদস্য মারা গেছে। সেখানেও প্রতিরোধ যুদ্ধ হয়।
বাংলাদেশের গণহত্যার কাহিনী পর্যালোচনাকালে আমরা নবগঠিত গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের প্রথম প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সরকার উদ্বোধনের পর পরই ১৭ এপ্রিল প্রদত্ত বিবৃতি থেকে উল্লেখ করতে পারি। তিনি বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে এক দীর্ঘ বিবৃতিতে বলেন, ‘বাংলাদেশ এখন যুদ্ধে রয়েছে। ২৫ মার্চ রাতে যে বিশ্বাসঘাতকতার সঙ্গে সুপরিকল্পিতভাবে শান্তিপূর্ণ জনগণের বিরুদ্ধে গণহত্যা শুরু করা হয়েছিল, আজও বিশ্ব-ইতিহাসে তার তুলনা বিরল। ইয়াহিয়া আওয়ামী লীগকে কোনো সতর্কতা দেয়নি: ‘কোনো কারফিউ জারি করার পূর্বেই মেশিনগান, সাঁজোয়া বাহিনী, ট্যাংক ও কামান রাস্তায় বের করা হয়েছিল। লে. জেনারেল টিক্কাখান পরদিন সকালবেলা রেডিও মারফত মার্শাল ল’ ধারা ঘোষণার পূর্বেই পঞ্চাশ হাজার মানুষকে শহরে হত্যা করা হয়েছে। ঢাকাকে পরিণত করা হয়েছিল অগ্নিকুণ্ডে।’