ব্যাংকে সঞ্চিত অর্থ যে কেউ বিনিয়োগ করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে যাঁর অর্থসম্পদ বেশি, ব্যাংকে তাঁর বিনিয়োগও বেশি। জনগণের থেকে নেওয়া এই বিনিয়োগ ব্যাংকগুলোর কাছে আমানত। দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও বিভিন্ন কর্মকাণ্ড সচল রাখতে ব্যাংকগুলো ওই আমানতের অর্থই বিভিন্ন খাতে ঋণ হিসেবে পুনর্বিনিয়োগ করে। এর জন্য নির্দিষ্ট হারে সুদ ধার্য করার পাশাপাশি তা পরিশোধে বেঁধে দেওয়া হয় সময়সীমাও।
বাংলাদেশ ব্যাংকের নীতিমালা অনুযায়ী এই শর্ত মেনে সক্ষম যে কেউ এই ঋণ পাওয়ার অধিকার রাখেন। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় উল্টো চিত্র। যে কারও কাছ থেকে আমানতের জোগান পেতে ব্যাংকগুলোকে আগ্রাসী কর্মকাণ্ড চালাতে দেখা গেলেও ঋণ বিতরণের বেলায় থাকে চরম পক্ষপাতিত্ব; বিশেষ করে ঋণ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে বাড়তি সুবিধা নেওয়ার অনৈতিক প্রবণতা ব্যাংকগুলোর সামগ্রিক ঋণের ৭৫ ভাগই ঠেলে দেওয়া হয়েছে বড়দের বা প্রভাবশালীদের দখলে। এর ফলে ছোটরা পাচ্ছেন ওই ঋণের ছিটেফোঁটা। সেটিও আবার সবার কপালে জুটছে না। দেশের ঋণ বিতরণ পরিস্থিতি নিয়ে বাংলাদেশ ব্যাংকের হালনাগাদ প্রতিবেদনে এমন বৈষম্যের চিত্রই ফুটে উঠেছে।
তথ্য অনুযায়ী, চলতি বছরের জুন পর্যন্ত ব্যাংকগুলোতে ১৫ কোটির বেশি আমানতকারীর সঞ্চয় জমা পড়েছে ১৮ লাখ ৩৮ হাজার ৮৩৭ কোটি টাকা। সেই আমানত থেকে ১ কোটি ২৬ লাখ ৫৭ হাজার ঋণ গ্রহণকারীর অনুকূলে ১৫ লাখ ৯৭ হাজার কোটি টাকার ঋণ বিতরণ করেছে ব্যাংকগুলো; যার ১২ লাখ ২ হাজার ৯৩৪ কোটি টাকাই নিয়েছেন প্রভাবশালীরা। অর্থাৎ ১ লাখ ৫২ হাজার ৫৯০ জন কোটিপতিই ভাগিয়েছেন এই বিপুল পরিমাণ ঋণ। যদিও ব্যাংকগুলো কোটিপতি আমানতকারীদের আমানতের পরিমাণ মাত্র ৭ লাখ ৭৩ হাজার কোটি টাকা বা ৪২ শতাংশ।
সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এত বিপুল পরিমাণ ঋণ বড়দের পেতে বিন্দুমাত্র সমস্যা না হলেও ছোটদের ছোট ছোট ঋণেও থাকে হাজারো ওজর-আপত্তি। এর বিপরীতে বড় ঋণের সিংহভাগ খেলাপি হওয়ার পরও তাঁদের বিরুদ্ধে তেমন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয় না। অথচ একজন কৃষক কিংবা ছোট উদ্যোক্তার ৫ হাজার টাকার ঋণের জন্য মামলা দিয়ে জেলে পাঠানোর নজিরও রয়েছে। এই বাস্তবতায় প্রান্তিক পর্যায়ের ক্ষুদ্র ও মাঝারি শিল্পের হাজারো উদ্যোক্তা প্রয়োজনীয় ঋণ থেকে বঞ্চিত হচ্ছেন।
ব্যাংক এশিয়ার সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক আরফান আলী বলেন, ‘স্বাধীনতার এত বছরেও ব্যাংকগুলো গ্রামাঞ্চলে ঋণ বিতরণের সক্ষমতা তৈরি করতে পারেনি। ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে খরচ বেশি হওয়ার অজুহাতে তারা এ খাত থেকে দূরে থাকছে। এতে গ্রামের মানুষ বেশি সুদে এমআরএ প্রতিষ্ঠানগুলোর কাছ থেকে ঋণ নিতে বাধ্য হচ্ছে। অথচ ব্যাংকগুলো এগিয়ে এলে কৃষক স্বল্প খরচে ঋণ নিতে পারতেন। এতে তাঁদের উৎপাদন খরচও কমত। এ কথা ঠিক, গ্রামে ঋণ বিতরণে খরচ কিছুটা বেশি হয়। কিন্তু ব্যাংকগুলোর তো সামাজিক দায়বদ্ধতা থাকা উচিত।’গ্রামাঞ্চলে খরচ বেশি হওয়ার অজুহাতে ক্ষুদ্রঋণ বিতরণে ব্যাংকগুলোর অনীহা আছে। আরফান আলী সাবেক ব্যবস্থাপনা পরিচালক ব্যাংক এশিয়া
কেন্দ্রীয় ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, গত জুন পর্যন্ত হিসাবে ব্যাংক খাতের মোট ঋণের ২৭ দশমিক ৬৯ শতাংশই দখলে নিয়েছেন মাত্র ৩ হাজার ৮০৬ জন গ্রাহক। অথচ নিম্ন আয়ের মানুষ বা লাখ টাকার নিচের ঋণগ্রহীতারা মাত্র ১ দশমিক ৭৫ শতাংশ ঋণ নিয়েছেন। এসব গ্রাহকের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ ৩২ হাজার ৭৩৬ কোটি টাকা। অতিক্ষুদ্র উদ্যোক্তা বা ১-৫ লাখ টাকা পর্যন্ত নেওয়া গ্রাহকদের ঋণের পরিমাণ ৪ দশমিক ৫৮ শতাংশ। এসব গ্রাহকের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ ৭৩ হাজার ২৬৮ কোটি টাকা। আর নতুন ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণের প্রয়োজন হয় ৫০ লাখ টাকা পর্যন্ত। এসব গ্রাহক জুন পর্যন্ত ব্যাংক থেকে মোট ঋণের ১২ দশমিক ৭২ শতাংশ ঋণ গ্রহণ করেছেন। তাঁদের মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ২ লাখ ৩ হাজার ৯৩ কোটি টাকা। এর বাইরে মধ্যম আয়ের চাকরিজীবী ও ব্যবসায়ী বা কোটি টাকা পর্যন্ত নেওয়া গ্রাহকেরা ৫ দশমিক ৬৩ শতাংশ ঋণ নিয়েছেন। তাঁদের নেওয়া মোট ঋণের পরিমাণ ৮৯ হাজার ৮৪৪ কোটি টাকা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক হুসনে আরা শিখা আজকের পত্রিকাকে বলেন, ঋণ বিতরণের সুনির্দিষ্ট নীতিমালা রয়েছে। তা মেনেই ব্যাংক ঋণ দিয়ে থাকে। কেবল নিয়মের ব্যত্যয় হলে তখন কেন্দ্রীয় ব্যাংক সেখানে হস্তক্ষেপ করে। তবে কোটিপতিদের ঋণ বেশি কেন, তা বলা মুশকিল উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, সাধারণত যাঁদের ব্যবসা বড়, তাঁরা বেশি ঋণ পেতে পারেন। এ নিয়ে সাধারণীকরণ করা কঠিন।’কোটিপতিদের ঋণ বেশি কেন, তা বলা মুশকিল। সাধারণত যাঁদের ব্যবসা বড়, তাঁরা বেশি ঋণ পেতে পারেন। হুসনে আরা শিখা মুখপাত্র ও নির্বাহী পরিচালক বাংলাদেশ ব্যাংক
বাংলাদেশ ব্যাংকের তথ্য অনুযায়ী, ৫০ কোটি টাকার বেশি এসব ঋণগ্রহীতার মোট ঋণের পরিমাণ দাঁড়িয়েছে ৪ লাখ ৪২ হাজার ১৮৪ কোটি টাকা। ২০ কোটি টাকার ওপরে ঋণ নিয়েছেন এমন গ্রাহকের সংখ্যা ১১ হাজার ৪৮৩ জন, যাঁদের কাছে আছে ৬ লাখ ৮৩ হাজার ৮৪৭ কোটি টাকা, যা ব্যাংক খাতের মাধ্যমে বিতরণ করা মোট ঋণের ৪২ দশমিক ৮২ শতাংশ।
এসএমই ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও ন্যাশনাল অ্যাসোসিয়েশন অব স্মল কটেজ ইন্ডাস্ট্রি অব বাংলাদেশের (নাসিব) সাবেক সভাপতি মির্জা নুরুল গনি শোভন বলেন, ‘আমাদের ক্ষুদ্র উদ্যোক্তাদের ঋণ দিতে ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলো খুব বেশি অনীহা দেখায়। এ ক্ষেত্রে বাংলাদেশ ব্যাংকের তদারকি বাড়ানো উচিত।