বাঙালী কন্ঠ ডেস্কঃ ধানের জাত উদ্ভাবনে সেঞ্চুরি করেছে বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইন্সটিটিউট (ব্রি)। ১৯ সেপ্টেম্বর নতুন তিনটি ধানের জাত অনুমোদন
করেছে জাতীয় বীজ বোর্ড (এনএসবি)। এ নিয়ে গত ৪৬ বছরে ১০০টি ধানের জাত কৃষককে উপহার দিয়েছে জাতীয় এ সংস্থা। নতুন উদ্ভাবিত ধানের বীজ চাষাবাদের জন্য আগামী আমন মৌসুমে কৃষকের হাতে তুলে দেয়া হবে। আমন মৌসুম জুলাইয়ের দিকে শুরু হয়।
এদিকে আসন্ন বোরো মৌসুমে ৬টি নতুন জাতের ধান উৎপাদনে যাচ্ছে। গত দু’বছরের বিভিন্ন সময়ে উদ্ভাবিত নতুন এ বোরো জাতের ধানগুলো হচ্ছে- ব্রি-৮১, ব্রি-৮৪, ব্রি-৮৬, ব্রি-৮৮, ব্রি-৮৯ এবং ব্রি-৯২। নভেম্বরে বোরো মৌসুম শুরু হবে। বাংলাদেশের মোট ধানের চাহিদার শতভাগই আসে বোরো থেকে।
এদিকে ভিটামিন ‘এ’ পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি ধান উদ্ভাবনের কথা বলছে ব্রি। এটি এরপর পরিবেশগত ছাড়পত্রের জন্য পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে প্রস্তাবনা জমা দেয়া হয়েছে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, বায়ো-সেফটি কমিটির ছাড়পত্র মিললে পুষ্টি চাহিদা পূরণের দৃষ্টিকোণ থেকে এটি বৈশ্বিক ইতিহাস হবে। কেননা, বিশ্বে এখন পর্যন্ত এ ধরনের কোনো ধান উদ্ভাবন হয়নি। এর আগে বাংলাদেশ জিঙ্কসমৃদ্ধ ধান উদ্ভাবন করেছে।
ব্রির মহাপরিচালক ড. মো. শাহজাহান কবির যুগান্তরকে বলেন, ১৯৭২ সালে ব্রি প্রথম অধিক ফলনশীল ধান উদ্ভাবন করে। এরপর বিজ্ঞানীরা একে একে নানা জাতের বোরো ও আমন ধান আবিষ্কার করেছে। ব্রির সফলতার পালকে সর্বশেষ যুক্ত হয়েছে ব্রি-৯৩, ব্রি-৯৪ ও ব্রি-৯৫। এ তিন ধান নিয়ে উদ্ভাবনকৃত অধিক ফলনশীল ধানের সংখ্যা দাঁড়াল ১০০। আমরা সেঞ্চুরি করলাম।
এ কৃষি বিজ্ঞানী বলেন, তবে আমাদের আরও কয়েকটি গবেষণার ফসল পাইপলাইনে আছে। এর একটি হচ্ছে গোল্ডেন রাইস। এটির ব্যাপারে পরিবেশগত ছাড়পত্র দরকার। এজন্য প্রস্তাবনা পরিবেশ, বন ও জলবায়ু মন্ত্রণালয়ে পাঠানো হয়েছে। এ ধান নিয়ে বিতর্ক চলছে। আমরা মনে করি, ধানটি উৎপাদন ও খাওয়ার ক্ষেত্রে সমস্যা নেই। জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকির কারণে বাংলাদেশে ধান উৎপাদনে ৮টি চ্যালেঞ্জ আছে। এগুলো হচ্ছে- লবণাক্ততা, জলমগ্নতা, খরা, আকস্মিক বন্যা, বৃষ্টিনির্ভর নিুভূমি, উচ্চভূমির ক্ষেত, গভীর পানির ভূমি এবং চরাঞ্চল। এসব চ্যালেঞ্জ বিবেচনায় নিয়ে ব্রি ধান উদ্ভাবন করেছে। এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত ধানের মধ্যে ইনব্রিড ৯৪টি ও হাইব্রিড ৬টি। এসব ধান চাষের প্রকৃতি বিবেচনায় ভাগ করলে দেখা যায় রোপা আমনই ৪৫টি। এছাড়া বোরো ৪২টি, রোপা আউশ ৬টি, বোনা আউশ ৮টি, বোনা আমন ১টি, রোপা ও বোনা আউশ ১টি। বোরো জাত রোপা আউশ হিসেবে চাষযোগ্য আছে ১২টি।
বিজ্ঞানীরা জানান, ব্রি এখন পর্যন্ত উদ্ভাবিত ধানের মধ্যে লবণাক্তসহিষ্ণু জাত এনেছে ৯টি। এগুলো হচ্ছে- ব্রি-২৩, ৪০, ৪১, ৪৭, ৫৩, ৫৪, ৬১, ৬৭, ও ৭৩। জলমগ্নতাসহিষ্ণু জাত- ব্রি-৫১, ৫২ ও ৭৯টি। খরা সহিষ্ণু জাত- ব্রি-৫৬, ৫৭, ৬৬, ৭১। সবই রোপা আমন। এছাড়া ব্রি ঠাণ্ডাসহিষ্ণু ৪টি, লবণাক্ততা ও জলমগ্নতাসহিষ্ণু একটি, জোয়ার-ভাটার ধান ২টি এবং জলাবদ্ধতার ২টি জাত উদ্ভাবন করেছে। এর মধ্যে ব্রি-৭১ এক মিটার গভীর পানিতেও ফলন দেয়।
ড. শাহজাহান কবির বলেন, নতুন উদ্ভাবিত আমন জাতের উচ্চ ফলনশীল ধান ব্রি-৯৩ লালচে বর্ণের। এটি ১৩৪ দিনে উৎপাদিত হবে। ভারতীয় স্বর্ণা জাতের বিকল্প হবে এটি। ১৩৪ দিনে উৎপাদিত হবে ব্রি-৯৪। এটিও স্বর্ণার বিকল্প। এটিও লালচে বর্ণের। আর ব্রি-৯৫ হবে গভীর লালচে বর্ণের। এটি ১২৫ দিনে ফলানো সম্ভব। মূলত চিকন চালের চাহিদা মেটাতে এ ধানটি আনা হয়েছে। এ তিনটি জাত বিশেষ করে বরেন্দ্র অঞ্চলে খরাসহিষ্ণু হিসেবে কৃষকরা পাবেন।
ধানের জাত পরিচিতি ও ফলন, ধান উৎপাদনের আধুনিক প্রযুক্তি ও কাক্সিক্ষত ফলন অর্জনের উপায়, ধানের সার ও সেচ ব্যবস্থাপনা, ধানের প্রধান রোগ ও পোকামাকড়সংক্রান্ত এক বক্তৃতায় ব্রি মহাপরিচালক এবং পরিচালক (গবেষণা) ড. তমাল লতা আদিত্য পৃথকভাবে উল্লিখিত তথ্য প্রকাশ করেন।
ড. তমাল লতা বলেন, একটা সময়ে রচনায় আমরা পড়েছি যে বাংলাদেশের ৮০ শতাংশ মানুষের পেশা কৃষি। এখন সেটি নেমে এসেছে ৪০ দশমিক ৬ শতাংশে। জিডিপিতে কৃষির অবদান মাত্র ১৪ দশমিক ২৩ শতাংশ। কৃষির অন্যতম আর্থ-সামাজিক সমস্যা হচ্ছে বর্গাচাষী। কৃষিকাজে সম্পৃক্ত মোট জনগোষ্ঠীর ৫৫ শতাংশই বর্গাচাষী।
এ বিজ্ঞানী বলেন, বাংলার মানুষের খাবারের থালায় দৈনিক যে পরিমাণ খাবার তোলা হয় তার ৭৭ শতাংশই ভাত। অপরদিকে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৩ সালে বাংলাদেশ কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে এক অনুষ্ঠানে বলেছিলেন, ‘আমি সব ধরনের চেষ্টা করা সত্ত্বেও পৃথিবীর কোনো জায়গা থেকে চাল কিনতে পারিনি। আমরা যদি ভাত খেয়ে বাঁচতে চাই তাহলে আমাদের চাল পয়দা করে খেতে হবে।’ মূলত বঙ্গবন্ধুর এ নির্দেশনাই ব্রির বিভিন্ন জাতের ধান উদ্ভাবনের অনুপ্রেরণা। আমাদের লক্ষ্য ২৫ কোটি মানুষের ভাতের ব্যবস্থা করা। সে লক্ষ্যে গবেষণা এগিয়ে চলছে।