ঢাকা , শনিবার, ১৬ নভেম্বর ২০২৪, ২ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ

দুর্বল নীতির সুযোগ নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি

ম মুনাফার বড় অংশই তারা নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে ম ভারতে আইন করে পুঁজিবাজারে আসতে বাধ্য করা হয়েছে ম দেশে লাইসেন্স দেওয়ার আগে জোরালো কোনো শর্ত না থাকায় তারা আগ্রহ দেখায় না

বাংলাদেশে শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানি বছরের পর বছর চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাদের মুনাফার বড় অংশই তারা নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার অবসানে কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো কাজে আসছে না। এর কারণ, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নমনীয় নীতি দেখানো। ব্যবসার সুযোগ দিয়ে লাইসেন্স দেওয়ার আগে পুঁজিবাজারে আসার জোরালো কোনো শর্ত না থাকায় তারা আগ্রহ দেখায় না।

সংশিষ্টরা বলছেন, কোনো বহুজাতিক কোম্পানিই স্বেচ্ছায় পুঁজিবাজারে আসবে না। তাদের পুঁজিবাজারে আনতে হলে এখনই সুনির্দিষ্ট আইন দরকার।

এদিকে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ব্যাপারে কোম্পানিগুলোকে চাপ প্রয়োগ করলে তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহারের হুমকিও দিচ্ছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে, বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়ার পরও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না দেশে কার্যরত বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানি। দীর্ঘদিন ধরে একাধিক মহল থেকে বহুজাতিক ও সরকারি কোম্পানিগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত করার দাবি উঠে আসছে। বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৩০০ নিবন্ধিত বহুজাতিক কোম্পানি থাকলেও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে মাত্র ১২টি।

অথচ ভারতে একটি আইন করা হয়েছে, সরকারি সহায়তায় দেশে কোনো বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবসা করলে নির্দিষ্টসংখ্যক শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়তে হবে। এটি সেখানে করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের পুঁজিবাজারে হচ্ছে না। এখানেও এমন আইন করতে হবে। তাহলে বাজারে বহুজাতিক কোম্পানি আসবে। ফলে বাজার সম্প্রসারিত হবে।

তবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএসইসি চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন জানিয়েছেন, মোবাইল অপারেটর রবি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রবি ও গ্রামীণফোনের সমস্যার বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। রবি বলেছে, সমস্যা সমাধান হলে তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। কোম্পানিটি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে আসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে তাদের অর্থিক প্রতিবেদন শক্ত না হওয়ার কারণে তাদেরকে সেটার ওপর আরও কাজ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তারা সেটা নিয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, তাদের সমস্যা সমাধানের যে কাজ করছি সেটি শেষ হওয়ার পর তাদেরকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে কাজ করব। তাদের বলেছি সমস্যার সমাধান হওয়ার পর আপনারা আইপিও আবেদন নিয়ে আসেন; আমরা অনুমোদন দেব।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে অনেক বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। কিন্তু সেগুলো মানতে চায় না বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। কারণ, তারা এ দেশে ব্যবসা করে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের মুনাফা করছে। এসব মুনাফার বড় একটি অংশ তারা নগদ আকারে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে না আসায় তাদের মুনাফার অংশ লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে না দেশের মানুষ। এতে বাজারে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, দেশে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে, এর প্রায় সবগুলোই ভালো মানের। তারা প্রতি বছর মোটা অংকের মুনাফা করছে। এগুলো প্রতি বছরই শেয়ারহোল্ডারদের কাঙ্ক্ষিত লভ্যাংশ দিচ্ছে।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ জানান, কোনো বহুজাতিক কোম্পানিই স্বেচ্ছায় পুঁজিবাজারে আসবে না। তাদের আনতে হলে নীতি নির্ধারকদের কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নিবন্ধনের সময়ই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির শর্ত থাকা দরকার। আর যারা বর্তমানে নিবন্ধিত রয়েছে তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে। এ উদ্যোগ নিতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কেই।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতদিন পর্যন্ত পুঁজিবাজারে ব্যাপকহারে বহুজাতিক কোম্পানি এবং সরকারি মুনাফামুখী কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত না হবে ততদিন পর্যন্ত বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা উচ্চ পর্যায়ে যাবে না। তাই এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে। তাই এ কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিএসইসিকেই উদ্যোগী হতে হবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে কার্যরত ইউনিলিভার ভারত, পাকিস্তান এবং থাইল্যান্ডের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। অনেক বহুজাতিক কোম্পানিই অন্য যেসব দেশে ব্যবসা করছে সে দেশগুলোতে ঠিকই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই।

উলেস্নখ্য, যেসব বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছে- এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- ইউনিলিভার, নেসলে, বার্জার, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, লাফার্জহোলসিম, বাটা, সিঙ্গার, লিন্ডে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ম্যারিকো, শেভরন, সিমেন্স, রবি, বাংলালিংক, এরিকসন, রেকিট বেনকিজার, গস্ন্যাক্সো, এসকেএফ, নোভার্টিজ, এবিবি, পারফেট্টি ভেন মেলে, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, জনসন অ্যান্ড জনসন ইত্যাদি।

আলোচিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে কেবল বার্জার, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, লাফার্জহোলসিম, বাটা, সিঙ্গার, লিন্ডে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ম্যারিকো, রেকিট বেনকিজার ও গস্ন্যাক্সোস্মিথক্লাইন আমাদের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাকি কোম্পানিগুলো এখনো পুঁজিবাজারের বাইরেই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইউনিলিভার (হিন্দুস্তান লিভার), নেসলে (নেসলে ইন্ডিয়া), নোভার্টিস (নোভার্টিস ইন্ডিয়া), সিনজেন্টা (সিনজেন্টা ইন্ডিয়া), এসকেএফ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মেটলাইফ ইন্সু্যরেন্স (পিএনবি মেটলাইফ), জনসন অ্যান্ড জনসন, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, সিমেন্স ইত্যাদি ভারতের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।

জানা যায়, ২০০৫ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ‘বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার কীভাবে বাড়ানো যায়’- এ বিষয়ে আলোচনা হয় এবং যেসব বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারি মালিকানা রয়েছে, সেগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য এক বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয়। পরের বছর মোট ৬২টি সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে এক বছরের মধ্যে পুঁঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি এলেও উদ্যোগটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

পরবর্তী সময়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ২০০৬ সালে শেয়ারবাজারে দেশি-বিদেশি কোম্পানি তালিকাভুক্ত-সংক্রান্ত আদেশ জারি করেন। ওই আদেশ অনুযায়ী ৪০ কোটি টাকা বা তদূর্ধ্ব মূলধনি প্রাইভেট কোম্পানিকে ছয় মাসের মধ্যে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর এবং ৫০ কোটি বা এর বেশি মূলধনি কোম্পানিকে এক বছরের মধ্যে আইপিও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। না হলে ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ২০১০ সালের ৫ মে বিএসইসি এ বিষয়ে সংশোধন করে একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করলেও তা কার্যকর করতে পারেনি বিএসইসি। বরং পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে শর্ত থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।

২০১৫ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। সে সময় শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনটির অনুরোধে পুঁজিবাজারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয় বিএসইসি। এতে উচ্চ মুনাফা করা ইউনিলিভার, নেসলের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার পুঁজিবাজারে আসার বাধ্যবাধকতা উঠে যায়।

Tag :
আপলোডকারীর তথ্য

Bangal Kantha

দুর্বল নীতির সুযোগ নিচ্ছে বহুজাতিক কোম্পানি

আপডেট টাইম : ০৫:৪৬ পূর্বাহ্ন, রবিবার, ৬ অক্টোবর ২০১৯

ম মুনাফার বড় অংশই তারা নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে ম ভারতে আইন করে পুঁজিবাজারে আসতে বাধ্য করা হয়েছে ম দেশে লাইসেন্স দেওয়ার আগে জোরালো কোনো শর্ত না থাকায় তারা আগ্রহ দেখায় না

বাংলাদেশে শতাধিক বহুজাতিক কোম্পানি বছরের পর বছর চুটিয়ে ব্যবসা করে যাচ্ছে। তাদের মুনাফার বড় অংশই তারা নিজ নিজ দেশে নিয়ে যাচ্ছে। এ অবস্থার অবসানে কোম্পানিগুলোকে পুঁজিবাজারে নিয়ে আসার বারবার উদ্যোগ নেওয়া হলেও কোনো কাজে আসছে না। এর কারণ, বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে নমনীয় নীতি দেখানো। ব্যবসার সুযোগ দিয়ে লাইসেন্স দেওয়ার আগে পুঁজিবাজারে আসার জোরালো কোনো শর্ত না থাকায় তারা আগ্রহ দেখায় না।

সংশিষ্টরা বলছেন, কোনো বহুজাতিক কোম্পানিই স্বেচ্ছায় পুঁজিবাজারে আসবে না। তাদের পুঁজিবাজারে আনতে হলে এখনই সুনির্দিষ্ট আইন দরকার।

এদিকে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির ব্যাপারে কোম্পানিগুলোকে চাপ প্রয়োগ করলে তারা বিনিয়োগ প্রত্যাহারের হুমকিও দিচ্ছে বলে জানা গেছে।

অন্যদিকে, বিভিন্ন প্রণোদনা দেয়ার পরও পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হচ্ছে না দেশে কার্যরত বেশিরভাগ বহুজাতিক কোম্পানি। দীর্ঘদিন ধরে একাধিক মহল থেকে বহুজাতিক ও সরকারি কোম্পানিগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত করার দাবি উঠে আসছে। বর্তমানে দেশে প্রায় সাড়ে ৩০০ নিবন্ধিত বহুজাতিক কোম্পানি থাকলেও শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে মাত্র ১২টি।

অথচ ভারতে একটি আইন করা হয়েছে, সরকারি সহায়তায় দেশে কোনো বহুজাতিক কোম্পানি ব্যবসা করলে নির্দিষ্টসংখ্যক শেয়ার পুঁজিবাজারে ছাড়তে হবে। এটি সেখানে করতে বাধ্য করা হয়েছে। কিন্তু এ বিষয়টি আমাদের পুঁজিবাজারে হচ্ছে না। এখানেও এমন আইন করতে হবে। তাহলে বাজারে বহুজাতিক কোম্পানি আসবে। ফলে বাজার সম্প্রসারিত হবে।

তবে সম্প্রতি এক অনুষ্ঠানে বিএসইসি চেয়ারম্যান খায়রুল হোসেন জানিয়েছেন, মোবাইল অপারেটর রবি পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার আগ্রহ প্রকাশ করেছে। রবি ও গ্রামীণফোনের সমস্যার বিষয় নিয়ে তাদের সঙ্গে আলোচনা হয়েছে। রবি বলেছে, সমস্যা সমাধান হলে তারা পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হবে। কোম্পানিটি বুক বিল্ডিং পদ্ধতিতে বাজারে আসার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে। তবে তাদের অর্থিক প্রতিবেদন শক্ত না হওয়ার কারণে তাদেরকে সেটার ওপর আরও কাজ করার পরামর্শ দেয়া হয়েছে। তারা সেটা নিয়ে কাজ করছে। তিনি বলেন, তাদের সমস্যা সমাধানের যে কাজ করছি সেটি শেষ হওয়ার পর তাদেরকে তালিকাভুক্ত করার বিষয়ে কাজ করব। তাদের বলেছি সমস্যার সমাধান হওয়ার পর আপনারা আইপিও আবেদন নিয়ে আসেন; আমরা অনুমোদন দেব।

জানা গেছে, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত হলে অনেক বিধিবিধান মেনে চলতে হবে। কিন্তু সেগুলো মানতে চায় না বহুজাতিক কোম্পানিগুলো। কারণ, তারা এ দেশে ব্যবসা করে প্রতি বছর মোটা অঙ্কের মুনাফা করছে। এসব মুনাফার বড় একটি অংশ তারা নগদ আকারে বিদেশে নিয়ে যাচ্ছে। এতে দেশের মুদ্রা বিদেশে চলে যাচ্ছে। পুঁজিবাজারে না আসায় তাদের মুনাফার অংশ লাভ করার সুযোগ পাচ্ছে না দেশের মানুষ। এতে বাজারে মৌলভিত্তিসম্পন্ন কোম্পানির ঘাটতি রয়েই যাচ্ছে।

সূত্র জানায়, দেশে যেসব বহুজাতিক কোম্পানি রয়েছে, এর প্রায় সবগুলোই ভালো মানের। তারা প্রতি বছর মোটা অংকের মুনাফা করছে। এগুলো প্রতি বছরই শেয়ারহোল্ডারদের কাঙ্ক্ষিত লভ্যাংশ দিচ্ছে।

এসব ব্যাপারে জানতে চাইলে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতি বিভাগের অধ্যাপক ড. আবু আহমেদ জানান, কোনো বহুজাতিক কোম্পানিই স্বেচ্ছায় পুঁজিবাজারে আসবে না। তাদের আনতে হলে নীতি নির্ধারকদের কার্যকরী পদক্ষেপ নিতে হবে। এজন্য বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর নিবন্ধনের সময়ই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির শর্ত থাকা দরকার। আর যারা বর্তমানে নিবন্ধিত রয়েছে তাদের সঙ্গে এ ব্যাপারে আলোচনা করতে হবে। এ উদ্যোগ নিতে হবে অর্থ মন্ত্রণালয়কেই।

বাজার সংশ্লিষ্টরা বলছেন, যতদিন পর্যন্ত পুঁজিবাজারে ব্যাপকহারে বহুজাতিক কোম্পানি এবং সরকারি মুনাফামুখী কোম্পানিগুলো তালিকাভুক্ত না হবে ততদিন পর্যন্ত বাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা উচ্চ পর্যায়ে যাবে না। তাই এ ধরনের কোম্পানিগুলোকে বাজারে তালিকাভুক্ত করার ব্যাপারে উদ্যোগ নিতে হবে। তবেই পুঁজিবাজারে বিনিয়োগকারীদের আস্থা ফিরবে। তাই এ কোম্পানিগুলোর তালিকাভুক্তির ব্যাপারে অর্থ মন্ত্রণালয় এবং বিএসইসিকেই উদ্যোগী হতে হবে।

জানা গেছে, বাংলাদেশে কার্যরত ইউনিলিভার ভারত, পাকিস্তান এবং থাইল্যান্ডের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত রয়েছে। অনেক বহুজাতিক কোম্পানিই অন্য যেসব দেশে ব্যবসা করছে সে দেশগুলোতে ঠিকই পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাংলাদেশের বাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার ক্ষেত্রে তাদের কোনো উদ্যোগ নেই।

উলেস্নখ্য, যেসব বহুজাতিক কোম্পানি বাংলাদেশে দীর্ঘদিন ধরে ব্যবসা করছে- এসব কোম্পানির মধ্যে রয়েছে- ইউনিলিভার, নেসলে, বার্জার, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, লাফার্জহোলসিম, বাটা, সিঙ্গার, লিন্ডে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ম্যারিকো, শেভরন, সিমেন্স, রবি, বাংলালিংক, এরিকসন, রেকিট বেনকিজার, গস্ন্যাক্সো, এসকেএফ, নোভার্টিজ, এবিবি, পারফেট্টি ভেন মেলে, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, জনসন অ্যান্ড জনসন ইত্যাদি।

আলোচিত কোম্পানিগুলোর মধ্যে কেবল বার্জার, হাইডেলবার্গ সিমেন্ট, লাফার্জহোলসিম, বাটা, সিঙ্গার, লিন্ডে, ব্রিটিশ আমেরিকান টোব্যাকো, ম্যারিকো, রেকিট বেনকিজার ও গস্ন্যাক্সোস্মিথক্লাইন আমাদের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত। কিন্তু বাকি কোম্পানিগুলো এখনো পুঁজিবাজারের বাইরেই রয়ে গেছে।

বাংলাদেশে পুঁজিবাজারের বাইরে থাকা কোম্পানিগুলোর মধ্যে ইউনিলিভার (হিন্দুস্তান লিভার), নেসলে (নেসলে ইন্ডিয়া), নোভার্টিস (নোভার্টিস ইন্ডিয়া), সিনজেন্টা (সিনজেন্টা ইন্ডিয়া), এসকেএফ, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংক, মেটলাইফ ইন্সু্যরেন্স (পিএনবি মেটলাইফ), জনসন অ্যান্ড জনসন, প্রক্টর অ্যান্ড গ্যাম্বল, সিমেন্স ইত্যাদি ভারতের পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্ত।

জানা যায়, ২০০৫ সালে অর্থ মন্ত্রণালয়ে একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় সভায় ‘বাজারে ভালো কোম্পানির শেয়ার কীভাবে বাড়ানো যায়’- এ বিষয়ে আলোচনা হয় এবং যেসব বহুজাতিক কোম্পানিতে সরকারি মালিকানা রয়েছে, সেগুলো পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। এজন্য এক বছর সময় বেঁধে দেওয়া হয়। পরের বছর মোট ৬২টি সরকারি ও বহুজাতিক কোম্পানিকে এক বছরের মধ্যে পুঁঁজিবাজারে শেয়ার ছাড়ার প্রস্তুতি নেওয়ার জন্য বলা হয়েছিল। পরবর্তী সময়ে হাতেগোনা কয়েকটি কোম্পানি এলেও উদ্যোগটি পুরোপুরি বাস্তবায়িত হয়নি।

পরবর্তী সময়ে বিএসইসির সাবেক চেয়ারম্যান এবং সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম ২০০৬ সালে শেয়ারবাজারে দেশি-বিদেশি কোম্পানি তালিকাভুক্ত-সংক্রান্ত আদেশ জারি করেন। ওই আদেশ অনুযায়ী ৪০ কোটি টাকা বা তদূর্ধ্ব মূলধনি প্রাইভেট কোম্পানিকে ছয় মাসের মধ্যে পাবলিক লিমিটেড কোম্পানিতে রূপান্তর এবং ৫০ কোটি বা এর বেশি মূলধনি কোম্পানিকে এক বছরের মধ্যে আইপিও প্রক্রিয়ার মাধ্যমে শেয়ারবাজারে তালিকাভুক্ত হওয়ার বাধ্যবাধকতা আরোপ করা হয়। না হলে ওই কোম্পানির বিরুদ্ধে আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া যাবে। ২০১০ সালের ৫ মে বিএসইসি এ বিষয়ে সংশোধন করে একটি গেজেট বিজ্ঞপ্তি জারি করলেও তা কার্যকর করতে পারেনি বিএসইসি। বরং পরিশোধিত মূলধন বৃদ্ধির ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কোম্পানিগুলোকে শর্ত থেকে অব্যাহতি দেওয়া হচ্ছে।

২০১৫ সালে ব্যবসায়ীদের শীর্ষ সংগঠন এফবিসিসিআই অর্থ মন্ত্রণালয়কে জানায়, পুঁজিবাজারে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা দেশি-বিদেশি বিনিয়োগ আসার ক্ষেত্রে অন্যতম বাধা। সে সময় শীর্ষ বাণিজ্য সংগঠনটির অনুরোধে পুঁজিবাজারে বহুজাতিক কোম্পানিগুলোকে তালিকাভুক্তির বাধ্যবাধকতা থেকে অব্যাহতি দেয় বিএসইসি। এতে উচ্চ মুনাফা করা ইউনিলিভার, নেসলের মতো বহুজাতিক কোম্পানিগুলোর শেয়ার পুঁজিবাজারে আসার বাধ্যবাধকতা উঠে যায়।